Cancel Preloader

ইসলামের দৃষ্টিতে নজর ও মানত

মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী, সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান

[সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান রচিত ‘শান্তি কোন পথে?’ নামক কিতাব থেকে প্রবন্ধটি সংকলন করা হয়েছে।-সম্পাদক]

নজর আরবি শব্দ, এর অর্থ নিবেদন করা, উৎসর্গ করা, অর্থাৎ বিনা চাওয়াতে কোনো কিছু প্রার্থনা করা। ব্যবহারিক বাংলা অভিধান অনুযায়ী আরবি মানত শব্দের অর্থ ওয়াদা পূরণ করা, মনোবাঞ্ছনা পূরণের প্রত্যাশায় সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে কিছু উৎসর্গ করার সংকল্প করা, দরবার শরীফে মানত করা ইত্যাদি। অর্থাৎ মনোবাসনা পূরণ হওয়ার জন্য মহান আল্লাহর কাছে প্রতিশ্রুতি দেওয়া, অতঃপর আল্লাহর দয়া লাভ করার পর প্রতিশ্রুতি পূরণ করাকে মানত বলে। মানতকে আরবিতে নজরও বলা হয়। হযরত রাসুলে আকরাম (সা.)-এর দরবারে আসলে সাহাবায়ে কেরাম তাঁকে নজর দিতেন। পবিত্র কুরআনে বিষয়টির বর্ণনা সুস্পষ্টভাবে দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ্ বলেন- “হে মু’মিনগণ! যখন তোমরা রাসুল (সা.)-এর সাথে একান্তে কথা বলতে যাবে, তখন তোমাদের কথা বলার পূর্বে নজরানা বা তোহফা প্রদান করবে। এটি তোমাদের জন্য উত্তম। আর এটি পবিত্র হওয়ার সর্বোত্তম উপায়।” (সূরা আল মুজাদালাহ ৫৮: আয়াত ১২)


অনুরূপভাবে মহিমান্বিত আল্লাহ্ ওহির বাণী আল কুরআনের অন্য আয়াতে এরশাদ করেন- “হে রাসুল (সা.)! আপনি মু’মিনদের সম্পদ থেকে তোহফা বা নজরানা গ্রহণ করুন; এর ফলে আপনি তাদের পবিত্র করবেন এবং পরিশুদ্ধ করবেন। আর আপনি তাদের জন্য দোয়া করুন। নিশ্চয় আপনার দোয়া তাদের অন্তরে প্রশান্তি এনে দেবে। আল্লাহ্ তো সবকিছু জানেন ও শুনেন।” (সূরা আত তাওবাহ ৯: আয়াত ১০৩)

হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আবু আওফা (রা.) হতে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর নিকট কোনো ব্যক্তি তোহফা বা নজরানা নিয়ে এলে তিনি দোয়া করতেন- “হে আল্লাহ্! আপনি এই ব্যক্তির পরিবার-পরিজনের উপর রহমত নাজিল করুন। বর্ণনাকারী বলেন- আমার পিতা হযরত রাসুল (সা.)-এর পবিত্র দরবার শরীফে নজর নিয়ে এলে, তিনি দোয়া করেন- হে আল্লাহ্! আবু আওফার পরিবার-পরিজনের উপর রহমত নাজিল করুন।” (বোখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসায়ী ও ইবনে মাজাহ’র সূত্রে তাফসীরে দুররে মানছুর ১১নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮১)


নবুয়ত পরবর্তী বেলায়েতের যুগে আওলিয়ায়ে কেরাম হযরত রাসুল (সা.)-এর সুমহান আদর্শ মানুষকে শিক্ষা দেন, যে কারণে তাঁদের দরবার শরীফেও হযরত রাসুল (সা.)-এর দরবার শরীফের অনুরূপ পদ্ধতি দেখা যায়। প্রকৃতপক্ষে কোনো পির কিংবা মোর্শেদ তথা অলী-আল্লাহগণের নিকট গেলেও তাঁকে নজর দেওয়া একান্ত কর্তব্য। কেননা মোর্শেদ হলেন হযরত রাসুল (সা.)-এর উত্তরাধিকারী এবং আধ্যাত্মিক শিক্ষাগুরু। তাঁর শিক্ষা পদ্ধতি অনুশীলনের মাধ্যমেই একজন মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে সক্ষম হয়। তাই মুরিদের পক্ষ থেকে মোর্শেদকে সন্তুষ্টচিত্তে যা প্রদান করা হয়, কুরআনের ভাষায় এটিই নজর অর্থাৎ নজরানা বা তোহফা বলে গণ্য।


সেই সাথে মানত আদায় করার প্রতিও ইসলামে যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। অশেষ দয়াময় আল্লাহ্ বলেন- “তোমরা (হে মু’মিনগণ!) যা কিছু ব্যয় করো, কিংবা যা কিছু মানত করো, সে সবকিছুই আল্লাহ্ জানেন।” (সূরা আল বাকারাহ ২: আয়াত ২৭০) আর মানত করা, অতঃপর কার্যসিদ্ধির পর মানত আদায় করার এই রেওয়াজ কেবলমাত্র মোহাম্মদী ইসলামে সীমাবদ্ধ নয়। এটি মুসলিম জাতির আদি পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.) কর্তৃক প্রবর্তিত ইব্রাহিমি ইসলামেও ছিল। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে-“[হে ইব্রাহিম (আ.)!] আপনি মানুষের মধ্যে হজের জন্য ঘোষণা করে দিন; তারা আপনার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে, আর তারা আসবে দূর-দূরান্তের পথ অতিক্রম করে এবং সব ধরনের দুর্বল (অর্থাৎ দূরত্বের কারণে তাদের বাহন উটগুলো দুর্বল হয়ে পড়বে) উটের পিঠে সওয়ার হয়ে, তারপর তারা যেন দূর করে ফেলে নিজেদের শরীরের অপবিত্রতা এবং নিজেদের মানতসমূহ আদায় করে দেয় ও প্রাচীন কাবাগৃহের তাওয়াফ করে।” ( সূরা আল হাজ্জ ২২: আয়াত ২৭ ও ২৯)


হযরত জাকারিয়া (আ.)-এর ভায়রা-ভাই হযরত ইমরান (আ.)-এর স্ত্রী বিবি হান্না (আ.) স্বীয় গর্ভজাত সন্তানকে মানত করে বলেছিলেন- “হে আমার প্রতিপালক! নিশ্চয় আমি আমার গর্ভজাত সন্তানকে একমাত্র আপনার উদ্দেশে মানত করেছি। আপনি (দয়া করে) আমার কাছ থেকে এ মানত কবুল করুন। নিশ্চয় আপনি সবকিছু শুনেন ও জানেন।” (সূরা আলে ইমরান ৩: আয়াত ৩৫)

এ গর্ভজাত সন্তানই হলেন- বিবি মারইয়াম (আ.)। হযরত ঈসা (আ.)-এর সম্মানিত মাতা বিবি মরিয়ম (আ.)-ও মানত করেছিলেন। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হচ্ছে- সদ্য ভূমিষ্ঠ ঈসা (আ.) স্বীয় মাতাকে আশ্বস্ত করে বললেন- “যদি আপনি কোনো মানুষকে দেখেন, তবে বলে দিন- আমি দয়াময় আল্লাহর উদ্দেশে রোজা মানত করেছি। সুতরাং আজ আমি কিছুতেই কোনো মানুষের সাথে কথা বলব না।” (সূরা মারইয়াম ১৯: আয়াত ২৬)


উপর্যুক্ত আয়াতগুলো দ্বারা প্রমাণিত হলো, মানত সকল নবি ও রাসুলের যুগেই ছিল। এ মানত যেমন গর্ভজাত সন্তান হতে পারে, তেমনি নামাজ, রোজা, ইত্যাদি বিষয়াবলিও হতে পারে। আবার মুসিবতের অবস্থা অনুযায়ী অর্থ-সম্পদও হতে পারে। তবে মানতের ক্ষেত্রে একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, মানত হচ্ছে মূলত আল্লাহর সাথে একটি অঙ্গীকার। ফলে মানত করার পর মানুষ উপকার পেলে, সাথে সাথে তাকে মানত আদায় করতে হয়। যারা মানত আদায় করে, তারা সৎকর্মশীল। এ মানত আদায়কারী সৎকর্মশীলদের জন্য মহান রাব্বুল আলামিন সুখময় জীবনের সুসংবাদ দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “নিশ্চয় সৎকর্মশীলেরা পান করবে এমন পানীয়, যাতে কর্পূর মিশ্রিত থাকবে। আল্লাহর এ সকল বান্দারা এমন একটি ঝরনা থেকে পান করবে, যে ঝরনা তাদের ইচ্ছানুযায়ী প্রবাহিত হবে। তারা মানত পূর্ণ করে এবং সেই দিনকে (ক্বিয়ামত দিবসকে) ভয় করে, যে দিনের বিপত্তি হবে সুদূরপ্রসারী।” (সূলা আদ দাহর ৭৬: আয়াত ৫ থেকে ৭)


নিম্নে মানত পূর্ণ করার গুরুত্ব সংবলিত কতিপয় হাদিস উপস্থাপন করা হলো। যথা-
১। হযরত ইমরান ইবনে হোসাইন (রা.) হতে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “আমার যুগই তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক উৎকৃষ্ট। তারপর তারা, যারা তাদের নিকটতম। অতঃপর তারা, যারা তাদের নিকটতম। ইমরান (রা.) বলেন- আমি নিশ্চিত জানি না, তিনি স্বীয় যুগের পর দু’বার উল্লেখ করেছেন, নাকি তিনবার। এরপর এমন সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটবে, তারা মানত করবে, কিন্তু তা পূরণ করবে না এবং তারা খেয়ানত করবে ও তারা বিশ্বস্ত হবে না। তারা সাক্ষ্য দিতে আগ্রহী হবে, অথচ তাদের সাক্ষ্য চাওয়া হবে না। বস্তুত তাদের মধ্যে আরাম-আয়েশ ও বিলাসিতাই হবে মুখ্য।” (বোখারী শরীফ ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৯০)

২। হযরত আয়েশা (রা.) আল্লাহর রাসুল (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন। হযরত রাসুল (সা.) বলেছেন- “যে ব্যক্তি আল্লাহর আনুগত্য করার মানত করে, সে যেন অবশ্যই সেটি পূর্ণ করে। আর যে ব্যক্তি তাঁর অবাধ্যতা করার মানত করে, সে যেন অবশ্যই তা হতে বিরত থাকে।” (বোখারী শরীফ ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৯১)


৩। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। হযরত উমর (রা.) বলেছিলেন-“হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! ইসলামপূর্ব যুগে আমি এ মানত করেছিলাম যে, মসজিদে হারামে এক রাত এতেকাফ করব। তিনি বললেন- তোমার মানত আদায় করো।” (বোখারী শরীফ ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৯১)

৪। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে- “সা’দ ইবনে উবাদাহ আনসারী নবি করিম (সা.)-এর কাছে জানতে চাইলেন, তার মাতার উপর একটি মানত ছিল, কিন্তু তা আদায় করার আগেই সে মারা গেছে। হযরত রাসুল (সা.) তার পক্ষ থেকে এটি পূর্ণ করার জন্য তাকে নির্দেশ প্রদান করলেন। এরপর হতে সেটিই সুন্নাত সাব্যস্ত হলো।” (বোখারী শরীফ ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৯১)


৫। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে আরো বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন- “এক ব্যক্তি নবি করিম (সা.)-এর নিকট আগমন করে বললেন- আমার বোন হজ করার মানত করেছিল (কিন্তু তা পূর্ণ করার পূর্বেই) সে মৃত্যুবরণ করেছে। নবি করিম (সা.) বললেন- (আচ্ছা, বলো তো) সে কোনো ঋণ রেখে গেলে, তুমি কি তা পরিশোধ করতে? সে বলল- জী হাঁ। তিনি বললেন- এটি আল্লাহর ঋণ, সুতরাং এটি পরিশোধ করা বিশেষ কর্তব্য।” (বোখারী শরীফ ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৯১)


৬। অনুরূপভাবে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন- “একদা নবি করিম (সা.) বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। এমন সময় এক লোক দাঁড়িয়ে বলল- আবু ইসরাঈল মানত করেছে, সে (সর্বদা) দাঁড়িয়ে থাকবে এবং বসবে না, আর ছায়ায় যাবে না ও কথাবার্তা বলবে না এবং রোজা রাখবে। নবি করিম (সা.) বললেন- তাকে কথাবার্তা বলতে, ছায়ায় যেতে, বসতে এবং রোজা রাখতে বলো।” (বোখারী শরীফ ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৯১)

৭। হযরত যিয়াদ ইবনে জোবায়ের (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন- “আমি ইবনে উমর (রা.)-এর সাথে ছিলাম। (এ সময়) এক ব্যক্তি তাঁকে প্রশ্ন করল- আমি মানত করেছি, যতদিন জীবিত থাকব প্রত্যেক মঙ্গল অথবা বুধবার রোজা রাখব। (ঘটনাক্রমে) ঐ দিনের মধ্যে কোরবানি পড়ে গেলো (এখন কি করা যায়)। তিনি বললেন- মানত পূর্ণ করার জন্য আল্লাহ্ নির্দেশ দিয়েছেন, অথচ আমাদেরকে কোরবানির দিন রোজা রাখতে নিষেধ করা হয়েছে। সে আবার জিজ্ঞেস করলে তিনি পূর্বের ন্যায়ই উত্তর দিলেন। কোনো কথা বাড়ালেন না।” (বোখারী শরীফ ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৯২)


উপরন্তু কুল-কায়েনাতের রহমত বিশ্বনবি হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর দাদাজান হযরত আবদুল মুত্তালিব (আ.) জমজম কূপের সন্ধান এবং দশটি পুত্র সন্তানের জন্য মানত করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে হযরত ইসহাক (রহ.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন- “জমজম কূপ খনন করার সময় কোরাইশদের সঙ্গে হযরত আবদুল মুত্তালিব (আ.)-এর সাথে যে বিবাদ হয়েছিল, সেটির প্রেক্ষিতে তিনি মানত করেছিলেন, যদি তার দশটি সন্তান জন্ম নেয় এবং তারা যৌবনে উপনীত হয়ে তাঁকে শত্রুদের থেকে রক্ষা করার উপযুক্ত হয়, তাহলে তিনি তাদের একজনকে কাবার নিকটে আল্লাহর উদ্দেশে জবেহ করবেন। অতঃপর যখন তাঁর সন্তান সংখ্যা দশে উপনীত হয়, আর তিনি উপলব্ধি করলেন, তারা তাঁকে রক্ষা করতে সমর্থ, তখন তাদের সকলকে একত্রিত করে তিনি তাঁর মানতের কথা অবহিত করলেন এবং মহামহিম আল্লাহর উদ্দেশে মানত পূরণ করার জন্য সন্তানদের আহ্বান জানালেন। আর দশ সন্তান হলেন- হারিস, জুবায়ের, হাজাল, জেরার, মুকাওয়িম, আবু লাহাব, আব্বাস, হামজা, আবু তালিব ও আবদুল্লাহ (আ.)। সকল পুত্রই পিতার আহ্বানে সাড়া দিলেন। এমতাবস্থায় আবদুল মুত্তালিব (আ.) কোন পুত্রকে কোরবানি করে মানত পূর্ণ করবেন, সেটি নির্ধারণ করার জন্য তিনি লটারি করেন। লটারিতে হযরত রাসুল (সা.)-এর পিতা হযরত আবদুল্লাহ (আ.)-এর নাম উঠে। কোরবানির বিষয়ে হযরত আবদুল মুত্তালিব (আ.)-এর দৃঢ় সংকল্প ও অদম্য ইচ্ছা দেখে কোরাইশরা, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব এতে হস্তক্ষেপ করেন। অনন্তর তিনি হিজাযে বসবাসরত ঈসায়ী ধর্মের জনৈক ধর্মযাজিকার শরণাপন্ন হন। উক্ত ধর্মযাজিকা এ ঘটনা শুনে আবদুল মুত্তালিব (আ.)-কে পরামর্শ দেন যে, একদিকে পুত্রের নাম, অপরদিকে প্রচলিত রক্তপণ, অর্থাৎ দশটি উট এতদুভয়ের মধ্যে লটারি করুন। লটারিতে যদি ছেলেটির নাম আসে, তাহলে আরো দশটি উট নিয়ে আবারো লটারি করুন। আর যদি উটের নাম আসে, তাহলে পুত্রের স্থলে উটগুলো জবেহ করুন। এতেই আপনাদের প্রতিপালক সন্তুষ্ট হয়েছেন বলে ধরে নেওয়া যাবে। এতে আপনার পুত্রের জীবনও বেঁচে যাবে। অতঃপর আবদুল মুত্তালিব (আ.) সঙ্গীদের নিয়ে মক্কায় ফিরে আসলেন। সকলের সম্মতিক্রমে লটারি শুরু হলো। অতঃপর আবদুল মুত্তালিব (আ.) আল্লাহর নিকট দোয়া করতে লাগলেন। দশটি উট ও আবদুল্লাহকে উপস্থিত করা হলো। লটারি শুরু হলো। কিন্তু নাম আসলো আবদুল্লাহর। এবার আরো দশটি উট বাড়িয়ে লটারি দেওয়া হলো। এভাবে দশটি করে উট বাড়িয়ে লটারি চলতে থাকে। কিন্তু প্রতিবারই আবদুল্লাহর নাম উঠতে লাগল। অবশেষে একশ উট আর আবদুল্লাহর মধ্যে লটারি দেওয়া হলে, আবদুল্লাহর পরিবর্তে উটের নাম উঠলো। তখন কুরাইশরা বলে উঠল- হে আবদুল মুত্তালিব! সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। আপনার প্রতিপালক আপনার প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন। কিন্তু আবদুল মুত্তালিব (আ.) বললেন- না, এতে হবে না। আরো তিনবার লটারি না করে, আমি নিশ্চিত হয়ে পারছি না। অগত্যা লোকেরা আরো তিনবার লটারি দিলো। আর প্রতিবারই আবদুল্লাহর পরিবতে উটের নাম লটারিতে উঠতে থাকে। অবশেষে উটগুলো জবেহ করে মানত পূর্ণ করা হলো, আর আবদুল্লাহ (আ.) প্রাণে বেঁচে গেলেন। আর এতে কোনো লোকই যেমন বাধা দিলো না, তেমনি আবদুল মুত্তালিব (আ.)-এর মনেও কোনো সংকোচ রইলো না।” (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৩০ ও ২৩১)


এমনিভাবে হযরত আবদুল মুত্তালিব (আ.) কুল-কায়েনাতের রহমত হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর সম্মানিত পিতা হযরত আবদুল্লাহ (আ.)-এর জীবন একশ’ উট কোরবানি করার মধ্য দিয়ে মানত আদায় করে, তাঁর জীবনকে যেমন রক্ষা করেন, তেমনি শৈশবে শিশু মোহাম্মদ (সা.) দুধমা হালিমার কাছ থেকে হারিয়ে গেলে এ মানতের মাধ্যমেই তাঁকে ফিরে পান।

আরেকটি ঘটনায় উল্লেখ আছে- “হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর বয়স তখন ছয় বছর। বিবি হালিমা (রা.) তাঁর মায়ের নিকট ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য তাঁকে নিয়ে ফেরার সময় মক্কার কাছাকাছি এলাকায় এসে তিনি কোথায় যেন হারিয়ে যান। এতে বিবি হালিমা (রা.) পাগলপ্রায় হয়ে হযরত মোহাম্মদ (সা.)-কে তন্নতন্ন করে খুঁজেও তাঁর সন্ধান পেলেন না। অবশেষে বিষয়টি তাঁর দাদা হযরত আবদুল মুত্তালিব (আ.)-এর কর্ণগোচর হলো। তিনি প্রাণপ্রিয় পৌত্রের হারানোর সংবাদ শুনে পেরেশান হয়ে উঠেন। তাঁকে পাওয়ার জন্য সাথে সাথে মানত করে তিনি নিজে খুঁজতে লাগলেন। অবশেষে হযরত মোহাম্মদ (সা.)-কে একটি বৃক্ষের নিচে সুস্থ ও প্রশান্তভাবে প্রকৃতির বৈচিত্রময় খেলা অবলোকন করা অবস্থায় পেয়ে গেলেন।”


সুতরাং কোনো ব্যক্তি যদি রোজা, অথবা হজ পালন এবং পশু কোরবানি করার জন্য মানত করে, তাহলে তার জন্য উক্ত মানত পূর্ণ করা ওয়াজিব হয়। ইতঃপূর্বে উল্লিখিত পবিত্র কুরআন ও হাদিসে মানত আদায়ের কঠোর নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। অর্থাৎ মানত করে আল্লাহর হুজুরে এভাবে আজিজি করতে হয়, হে দয়াময় খোদা! দয়া করে আমার মানতকে কবুল করুন। অতঃপর আল্লাহ্ দয়া করে মানত কবুল করলে মানত পূরণ করা অবশ্যকর্তব্য। মহান আল্লাহ্ বলেন- ইমরানের স্ত্রী বিবি হান্না বলেছিল, হে আমার প্রতিপালক- “নিশ্চয় আমি আমার গর্ভজাত সন্তানকে একমাত্র আপনার উদ্দেশে মানত করেছি। আপনি (দয়া করে) আমার কাছ থেকে এ মানত (সন্তান)-কে কবুল করুন। নিশ্চয় আপনি সবকিছু শুনেন এবং সবকিছু জানেন।” (সূরা আলে ইমরান ৩: আয়াত ৩৫)


উল্লেখ্য, ইমরানের স্ত্রীর গর্ভে হযরত মারইয়াম (আ.) জন্মগ্রহণ করেন। যদিও তিনি মেয়ে ছিলেন, তথাপি তাঁর পিতামাতা মানত পূর্ণ করার উদ্দেশে তাঁকে বাইতুল মুক্বাদ্দাসের খেদমতে উৎসর্গ করেছিলেন। কেননা মানত যেহেতু আল্লাহর কাছে অঙ্গীকার, সেহেতু মকসুদ হাসিল শেষে তা পূর্ণ করা অপরিহার্য কর্তব্য। অতএব মানত আদায়ের গুরুত্ব সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও হাদিসের যথেষ্ট বর্ণনা যেমন রয়েছে, তেমনি ফতোয়ার কিতাবে এ সম্পর্কে একটি অধ্যায়ও রয়েছে।


পরিশেষে এ কথা বলা যায়, অলী-আল্লাহ্গণ আল্লাহর বন্ধু এবং হযরত রাসুল (সা.)-এর ওয়ারিশ। তাঁরা আল্লাহর প্রিয়ভাজন হওয়ায় তাঁদের দরবারে আল্লাহর নামে কিছু মানত করে মানুষ বহু বিপদ থেকে মুক্তি পেয়ে থাকে। সুতরাং আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে অলী-আল্লাহগণের দরবারে নজর বা মানত করা সম্পূর্ণ বৈধ এবং সেটি আদায় করা পবিত্র কুরআন ও হাদিসের দৃষ্টিতে ওয়াজিব।
[লেখক: দেওয়ানবাগ শরীফের প্রতিষ্ঠাতা]

সম্পর্কিত পোস্ট