Cancel Preloader

ইসলাম মানবতার ধর্ম

ইমাম ড. সৈয়দ এ.এফ.এম. মঞ্জুর-এ-খোদা
ইসলাম মানবতার ধর্ম। সকল সৃষ্টির প্রতি প্রেম ভালোবাসাই ইসলামের শিক্ষা। কিন্তু আজ আমরা সেই ইসলামের আদর্শ ও শিক্ষা থেকে দূরে সরে পড়েছি। তাই আমাদের মাঝে আজ চরম দ্বন্দ্ব, কলহ ও হানাহানি বিরাজমান। এটা কখনো ইসলামের শিক্ষা হতে পারে না।
বর্তমান পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে অনেকে ফিরে যাচ্ছে মধ্যযুগীয় যুগে অর্থাৎ- আইয়্যামে জাহেলিয়ার যুগে। অথচ ইসলামের সুমহান শিক্ষা ও আদর্শ হৃদয়ে ধারণ করে তৎকালীন যুগের আরবের বর্বর মানুষেরা আদর্শ চরিত্রের অধিকারী হয়ে শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত হয়েছিলেন। উল্লেখ্য যে, এক যুদ্ধে এক মুসলমান তৃষ্ণায় কষ্ট পেয়ে ‘পানি’ ‘পানি’ বলে চিৎকার করছেন। তার সামনে পানি নিয়ে যাওয়া হল, তখন সে দেখল আরেক মুসলিম ভাই আহত হয়ে পানির কষ্টে কাতরাচ্ছে। তাই তিনি ঐ পানি অপর মুসলিম ভাইকে দিতে বলে নিজে পানি পান থেকে বিরত থাকলেন। এভাবে একে একে ১৭ জন শহীদ হয়ে গেলেন। তবুও নিজে পানি পান করলেন না। পারস্পরিক ভালোবাসার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তাঁরা স্থাপন করেছিলেন।
সুতরাং ধর্মের নামে, বোমাবাজি, ফতোয়া, হত্যা ও নারী নির্যাতন কখনো ইসলামের অংশ হতে পারে না। হাদিস শরিফে আছে- “আল্ মুসলিমু মান সালিমাল মুসলিমুনা মিন লিসানিহি ওয়া ইয়াদিহি।” অর্থাৎ- যার হাত ও জবানের অনিষ্ট থেকে অন্য মানুষ নিরাপদ থাকে সেই প্রকৃত মুসলমান। অতএব ধর্মের নামে সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ, মসজিদ-মন্দিরে হামলা ও সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন কখনই প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা ও রূপরেখা হতে পারে না। ইসলাম শুধু পরকালে নয়, দুনিয়াতেও শান্তি দিতে সক্ষম। সত্যিকারের মুসলমান ব্যক্তি নিজেও শান্তিতে থাকবে এবং অন্যকেও শান্তিতে থাকতে দিবে। সে নিজে সবাইকে ভালোবাসবে এবং সবাই তাকে ভালোবাসবে। এ প্রসঙ্গে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে- “ইরহাম মান ফিল আরদে ইয়ারহামুকা মান ফিস সামায়ি।” অর্থাৎ- তুমি জগতবাসীর প্রতি দয়াশীল হও, তাহলে নভোমণ্ডলের অধিকারী মহান আল্লাহ্ তোমার প্রতি দয়া করবেন।
কবির ভাষায়-
তসবি এবং সেজদা দেখে খোদ এলাহি ভুলবে না
মানব সেবার কুনজি ছাড়া স্বর্গ দুয়ার খুলবে না।
পৃথিবীর সকল ধর্মেই মানবতার দর্শন নিহিত। যুগে যুগে ধর্ম প্রবর্তকগণ সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসার কথা বলেছেন। আমার পরম শ্রদ্ধেয় পিতা সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেব্লাজান বলেন, “স্রষ্টাকে ভালোবাসতে হলে তাঁর সৃষ্টিকে ভালোবাসতে হবে। আর ধর্মের মূলেই রয়েছে প্রেম। কারণ সৃষ্টিজগতের মহান প্রভু প্রেমের কারণেই জগত সৃজন করেছেন।”
তাঁর এই অমীয় বাণীর মাধ্যমে সুষ্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, মানব সেবাকে আমার শ্রদ্ধেয় পিতা সকল কিছুর উর্ধ্বে রেখেছেন। তাই আমি গর্বের সাথে বলতে পারি- আমি আমার পিতা-মাতার কাছ থেকে শিখেছি মানব সেবাই আল্লাহ্র সেবা। মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার অনুপম নিদর্শন আমি আমার মহান পিতা সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী হুজুর কেব্লাজানের নিকট শিক্ষা লাভ করেছি।
উল্লেখ্য, ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দ ছিল বাংলাদেশের জন্য চরম দুর্যোগময় সময়। তখন শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহতম বন্যায় প্লাবিত হয়েছিল বাংলার জনপদ। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের কোটি কোটি মানুষ গৃহহীন হয়ে
বিভিন্ন উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিল। তখনকার চরম দুঃসময়ে মানুষের কষ্ট দেখে আমার পিতা সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজানের হৃদয় বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে। আমার পিতা তাঁর অনুসারীদের নিয়ে বন্যাপীড়িত মানুষের সাহায্যার্থে দিনরাত পরিশ্রম করেছেন। দুর্গত এলাকার মানুষের কাছে রুটি, গুড়, খাবার স্যালাইন, ঔষধ ও কাপড় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করাই ছিল তখন তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তিনি দিনরাত অবিরাম মানব সেবা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। তাঁর পক্ষ থেকে রাজধানী ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়। তিনি বন্যার্ত মানুষের সাহায্যার্থে ত্রাণসামগ্রী বিতরণের ব্যাপারে সবাইকে উৎসাহিত করার জন্য বলেছিলেন, “মানবতাই হলো সবচেয়ে বড় ধর্ম। হযরত রাসুল (সা.) ফরমান, ‘যে সৃষ্টির প্রতি দয়াশীল, আল্লাহ্ও তাঁর প্রতি দয়াশীল।’ সুতরাং এখন প্রতিটি সামর্থবান মানুষের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো- বন্যাদুর্গত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসা।” আমার পিতার তখনকার মানব প্রেমের প্রেরণা আমাকে মন্ত্রের মত উজ্জীবিত করেছিল। এছাড়া তিনি সবসময় অসহায় ও দরিদ্র মানুষদেরকে সহায়তা করে থাকেন।
যুগে যুগে ধর্ম প্রবর্তকগণ সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসার কথা বলেছেন। এ প্রসঙ্গে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক বিশ্ব মানবতার মূর্ত প্রতীক বিশ্বনবি হযরত রাসুল (সা.) খ্রিস্টান ধর্মের প্রবর্তক হযরত ঈসা (আ.), বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধ, সনাতন ধর্মের মহাভারতে উল্লেখিত মানবতাবাদী দর্শনের বাণী প্রণিধানযোগ্য। তাঁদের বাণীতে মানবতার জয়গান ফুটে উঠেছে।
বিশ্বনবি হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, “সকল সৃষ্টি জীবকে আল্লাহ্র একই পরিবারভুক্ত মনে করবে।” তিনি আরো বলেন, “মানব সেবা আল্লাহ্রই সেবা।” অন্যত্র তিনি বলেন, “তুমি যদি সৃষ্ট জীবকে ভালোবাস তাহলে উর্ধ্বলোকের মহান স্রষ্টা তোমাকে ভালোবাসবেন।” রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.)-এর হাদিস অবলম্বনে কবি আবদুল কাদির ‘মানুষের সেবা’ কবিতায় বলেন-
হাশরের দিন বলিবেন খোদা, ‘হে আদম-সন্তান,
তুমি মোরে সেবা করো নাই যবে ছিনু রোগে অজ্ঞান।’
মানুষ বলিবে, ‘তুমি প্রভু করতার,
আমরা কেমনে লইব তোমার পরিচর্যার ভার?’
বলিবেন খোদা, ‘দেখনি মানুষ কেঁদেছে রোগের ঘোরে
তারি শুশ্রুষা করিলে তুমি যে সেথায় পাইতে মোরে।’
খোদা বলিবেন, ‘হে আদম-সন্তান,
আমি চেয়েছিনু, ক্ষুধার অন্ন, তুমি কর নাই দান।’
মানুষ বলিবে, ‘তুমি জগতের প্রভু
আমরা কেমনে খাওয়াব তোমারে, সে কাজ কি হয় কভু?’
বলিবেন খোদা, ক্ষুধিত বান্দা গিয়েছিল তব দ্বারে,
মোর কাছে তুমি ফিরে পেতে যদি খাওয়াইতে তারে।’
পুনরায় খোদা বলিবেন, ‘শোন হে আদম-সন্তান,
পিপাসিত হয়ে গিয়েছিনু আমি করাওনি জলপান।’
মানুষ বলিবে, ‘তুমি জগতের স্বামী,
তোমারে কেমনে পিয়াইব বারি, অধম বান্দা আমি?’
বলিবেন খোদা, ‘তৃষ্ণার্ত তোমা ডেকেছিল জল আশে,
তারে যদি জল দিতে তুমি, তবে পাইতে আমায় পাশে।”
হযরত ঈসা (আ.) বলেছেন- সবকিছুর মধ্যে অপরের কাছ থেকে তোমরা যে ব্যবহার প্রত্যাশা করো, তাদের প্রতিও তেমনি ব্যবহার করো; কারণ এটাই বিধান এবং নবিগণের শিক্ষা। -যিশু, ম্যাথু ৭:১২
তিনি আরো বলেছেন, “সূর্য যেমন সব জায়গাতেই কিরণ দেয়, বৃষ্টিধারা যেমন সবকিছুতেই সিঞ্চিত করে, তুমিও তেমনই ভেদাভেদ না করে সবাইকে সমান ভালোবাসবে।”
অন্যত্র তিনি বলেন, “কারও উপর প্রতিশোধ নিতে যেও না। কেউ যদি তোমার এক গালে চড় মারে, তাকে আর একটি গাল ফিরিয়ে দিও।”
গৌতম বুদ্ধ বলেছেন, “কারো সাথে এমনভাবে আচরণ করো না, যা তোমার নিজের কাছে বেদনাদায়ক মনে হতে পারে।”- উদানা-ভার্গা ৫:১৮
তিনি আরো বলেছেন, “যে স্বার্থপরতা ত্যাগ করতে পেরেছে, শান্তি এবং সত্যকে লাভ করেছে, সেই সুখী।”
অন্যত্র তিনি বলেন, “তোমার দুঃখের কারণ যাই হোক না কেন, অপরকে আঘাত করো না। অপরের প্রতি শুভেচ্ছা প্রকাশই ধর্ম। সর্বপ্রাণীর প্রতি অন্তরে অসীম মৈত্রী পোষণ করো।”
সনাতন ধর্মের মহাভারতে মানবতাবাদ সম্পর্কে বলা হয়েছে, “কারো সাথে এমন কিছুই করো না, যা তোমার সাথে করা হলে তুমি দুঃখ পেতে। এই হচ্ছে দায়িত্ব সমষ্টি।” -মহাভারত ৫:১৫১৭
এই মানব সেবার আদর্শটি স্বামী বিবেকানন্দের কবিতায়ও আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে- জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।
বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেব্লাজান মানবতাবাদী দর্শন সম্পর্কে বিভিন্ন সময় বাণী মোবারক প্রদান করেছেন। তাঁর কিছু বাণী নিম্নে উপস্থাপন করা হলো-
-মানব সেবার মাধ্যমেই আল্লাহ্র নৈকট্য লাভ করা সম্ভব।
-মানুষকে ভালোবাসার মাধ্যমেই আল্লাহ্কে পাওয়া যায়।
-আল্লাহ্কে পেতে হলে মানুষকে ভালোবাসতে শিখুন, মানুষকে কষ্ট দিয়ে আল্লাহ্কে পাওয়া যায় না।
কিন্তু আমরা আজ পৃথিবীতে প্রেম-ভালোবাসা থেকে দূরে সরে গিয়ে হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি, যুদ্ধ-বিগ্রহ, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, প্রভাব-প্রতিপত্তির মোহে ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবন, সমাজ জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন এমনকি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলকে কলুষিত করে ফেলেছি। আমরা যদি মানব প্রেমে উদ্বুত হতে পারি তাহলে এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড হতে পারে শান্তির স্বর্গ। পারস্পরিক স্নেহ, মমতা, প্রেম, প্রীতি, ভালোবাসার মাধ্যমে রচনা করা যাবে এক সুন্দর পৃথিবী।
পরিশেষে বলা যায় যে, মানবতাবোধ ও মনুষ্যত্ব চেতনা হোক আমাদের চরিত্রের ভূষণ। স্রষ্টার সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসায় আমাদের হৃদয় হোক পরিপূর্ণ। আমরা যেন হই উদার প্রকৃতির মানুষ। আমাদের অন্তরে জাগ্রত হোক স্রষ্টার প্রতি গভীর প্রেম ও সৃষ্টির প্রতি অগাধ ভালোবাসা। আমরা যদি মানবতাবাদী দর্শনকে আমাদের হৃদয়ে ধারণ করতে পারি, তাহলে আমাদের মাধ্যমে একটি আলোকিত পৃথিবী গড়ে তোলা সম্ভব।

সম্পর্কিত পোস্ট

1 Comment

  • অনেক মূল্যবান পোষ্ট

Leave a Reply to Shamim Rana Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *