Cancel Preloader

কারবালার বেদনায় কাঁদে আশেকে রাসূলের প্রাণ

ড. পিয়ার মোহাম্মদ
কারবালা ইরাকের অন্তর্গত একটি ঐতিহাসিক স্থান। এ স্থানটি বাগদাদ শহর থেকে ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত। যা প্রকৃতপক্ষে কুফা নগরীর ফোরাত নদীর তীরের একটি বালুকাবেলা। কুফার প্রায় ৪০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে এবং ফোরাতের শাখা নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত প্রান্তরটিই কারবালা নামে পরিচিত। এ কারবালার নাম শুনলে আশেকে রাসুলদের প্রাণ শিউরে উঠে। আশেকে রাসুলেরা বেদনায় কাতর হয়ে পড়ে এবং অন্তরে অনুভব করে এক ঐশ্বরিক যাতনা। কেননা এখানেই নির্মমভাবে শহীদ হয়েছিলেন মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) এবং তাঁর পরিবারের সদস্যবৃন্দ-সহ মোট ৭২ জন। ইতিহাসের এ জঘন্যতম ঘটনা রাসুল প্রেমিক মুমিনদের জন্য চরম বেদনার হয়ে আছে এবং থাকবে যতদিন পৃথিবীতে আশেকে রাসুল থাকবেন।
মুয়াবিয়ার মুত্যুর পর তার মনোনয়ন অনুসারে তার পুত্র ইয়াজিদ ৬১ হিজরির সাবান মাসে সিংহাসনে আসীন হয়। এটি ছিল গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে খলিফা নির্বাচনের বিপরীত। তাছাড়া, ইয়াজিদ ছিল ইসলামি ভাবাদর্শ বিবর্জিত ব্যক্তি। সেজন্য মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) স্বৈরাচারী ইয়াজিদের খেলাফত মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান। কুফাবাসীরাও ইয়াজিদের বিপক্ষে অবস্থান নেন এবং ইমাম হোসাইন (রা.)-কে খলিফা হিসেবে দেখতে চান। তারা ইমাম হোসাইন (রা.)-কে কুফায় আসার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। সে আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েই ইমাম হোসাইন (রা.) পরিবার পরিজন ও সঙ্গী সাথী নিয়ে কুফার উদ্দেশে রওনা হন। ইতোমধ্যে কুফাবাসী ইয়াজিদের চক্রান্তে বিশেষ পরিস্থিতির শিকার হয়ে সমর্থন ত্যাগ করে। ইয়াজিদের বাহিনী এ সুযোগে কারবালার প্রান্তরে ইতিহাসের বর্বোরচিত এ ঘটনা ঘটায়। ইয়াজিদের অন্যায়, অসত্য ও জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত কারবালা প্রান্তরে জীবন বিসর্জন দিতে হয়েছে বিশ্বনবি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) ও তাঁর নিকট জনদের। ইতিহাসে তাদেরকে শোহাদায়ে কারবালা হিসেবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে।
ইয়াজিদ বাহিনীর মোকাবিলায় পরম করুণাময়ের প্রতি অবিচল আস্থা নিয়ে ও অকুতোভয় চিত্তে হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) যে প্রতিরোধের প্রাচীর গড়ে তুলেছিলেন, তা বিশ্ব ইতিহাসে এক নজীরবিহীন ঘটনা। তিনি অন্যায় ও অসত্যের কাছে মাথানত না করে সত্য ও ন্যায়ের পতাকাকে উড্ডিন করার জন্য কারবালার প্রান্তরে যে ত্যাগের নজরানা পেশ করেছিলেন তা প্রতিটি মুসলমানের জন্য প্রেরণার উৎস, মানব জাতির জন্য শিক্ষণীয়, অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় আদর্শ হয়ে আছে। হযরত ইমাম হাসানের শাহাদতের পর হযরত রাসুল (সা.)-এর নির্দেশানুযায়ী এবং আমিরুল মুমিনীন হযরত আলী (রা.) ও হযরত ইমাম হাসানের অসিয়ত অনুসারে মুসলমানদের নেতৃত্ব ও ইমামতের দায়িত্ব হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর স্কন্ধে অর্পিত হয়। হযরত ইমাম হোসাইন লক্ষ্য করেন যে, মুয়াবিয়া ইসলামের শক্তির উপর ভর করে খেলাফতের সিংহাসনে আরোহণ করে আল্লাহর নির্দেশাবলী পদদলিত করছে ও ইসলামি সমাজের মুলোৎপাটনে বদ্ধ পরিকর হয়েছে। সে কারণেই তিনি ইয়াজিদের খেলাফত মেনে নিতে পারেননি। ইয়াজিদ কোনো ক্রমেই রাসুল (সা.)-এর উত্তরসূরী হতে পারে না। ইসলাম মূলত বনি উমাইয়া থেকে এবং বনি উমাইয়া ইসলাম থেকে বহু দুরে। সেজন্য যদি সেদিন হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) ইয়াজিদের বিরোধীতা না করতেন, তাহলে মানুষ ইয়াজিদকে রাসুলের খলীফা হিসেবে মনে করত এবং ইয়াজিদ ও তার অধীনস্থদের অনাচার, অত্যাচার ও অন্যান্য অপকর্ম ইসলামের বিধান মনে করে ইসলামকে ঘৃণার চোখে দেখত। হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) জীবন উৎসর্গ করে ইসলামকে সে অপবাদ থেকে রক্ষা করেছেন, এটি ক্ষমতার জন্য নয় বরং রাসুল (সা.)-এর আদর্শকে রক্ষার জন্য।
কারবালার হৃদয় বিদারক ঘটনার পর এ দিনটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাসুল (সা.)-এর দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর পরিবার ও তার সঙ্গীদের নির্মম শাহাদাত দিবস হিসেবেই পরিচিত। আধিপত্যবাদ, অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে তাঁর সুমহান আদর্শের জন্য আত্মত্যাগ ও বিয়োগান্তক ঘটনার স্মরণে দিবসটি পালিত হয়। ইসলামের ইতিহাসে এ দিনটি বিভিন্ন ঘটনাপুঞ্জে মর্যাদাবান হলেও সর্বশেষে সংঘটিত কারবালা প্রান্তরে হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদতই এ দিবসের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
মহররম শব্দের অর্থ নিষিদ্ধ বা পবিত্র। এ মাসে ঝগড়া-বিবাদ ও যুদ্ধ বিগ্রহ করা নিষিদ্ধ। হযরত রাসুল (সা.) এ মাসে কোনো জিহাদেও অংশ নেননি। মহররম, রজব, জিলক্বদ ও জিলহজ এ চারটি মাসকে আল্লাহ তায়ালা পরম সম্মানিত ও পবিত্র বলে আল-কুরআনে উল্লেখ করেছেন। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- ‘‘তোমরা জেনে রাখ এই চারটি মাস বড়ো ফজিলত ও বরকতপূর্ণ। তোমরা এই মাসগুলোতে পাপাচার করে নিজেদের উপর জুলুম করে না।” অথচ সে মাসেই ইয়াজিদের বাহিনী রাসুল (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্রকে নির্মমভাবে শহিদ করেছিল। আবার সেই ইয়াজিদই নিজেকে ইসলামের কাণ্ডারি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল। এ অপরাধের জন্য ইতিহাস তাকে ক্ষমা করেনি। এখনো কারো মধ্যে কোনো খারাপি দেখলে তাকে ইয়াজিদের সাথে তুলনা করা হয়ে থাকে। এইতো তার আসল পাওনা। ইয়াজিদ এ জঘন্য কাজ করতে গিয়ে ইমাম হোসাইনের মান ও শান বিবেচনা করেনি। আর করবেই বা কেন, সেতো ইসলাম বিবর্জিত চরিত্রের লোক। রাসুল (সা.)-এর দৌহিত্রকে হত্যা করতে তার বিবেক বাধা দেয়নি। তার দরকার ক্ষমতা, তাতে যা করতে হয়। অথচ এটা যে কত জঘন্য, তা আশেকে রাসুলই উপলদ্ধি করতে পারেন এবং ব্যথিত হন।
স্বয়ং নবি করিম (সা.) তাঁর দৌহিত্রদের কানে প্রথম আযান দেন এবং তাঁদের আকিকা পালন করেন। রাসুল (সা.)-এর কাছে তাঁর দুই দৌহিত্র ছিলেন অত্যন্ত প্রিয়। তাদের দেখার নিমিত্তে প্রায়ই তাঁদের ঘরে যেতেন। তাদের খেলতে দেখে প্রীত হতেন এবং বুকের সাথে লাগিয়ে রেখে আদর করতেন। মাঝে মধ্যে নামাজ পড়ার সময়ে তাঁর দৌহিত্রগণ এসে পিঠে উঠে বসে থাকতেন। রাসুল (সা.) ধীরে সুস্থে নামাজ সম্পন্ন করে তাঁদের নিজের কোলে নিয়ে বসতেন। রাসুল (সা.) বলতেন যারা হাসান ও হোসাইনকে ভালোবাসে তাঁরা আমাকে ভালোবাসে। যারা তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে তারা আমার সম্পর্কেও বিদ্বেষ পোষণ করে। আমি হোসাইনের এবং হোসাইন আমার। যে হোসাইনকে ভালোবাসে, আল্লাহ তায়ালাও তাকে ভালোবাসেন। তিনি একদা মসজিদে নববিতে শুক্রবারের খুতবা প্রদানকালে শিশু ইমাম হোসাইন (রা.) প্রবেশ করলে তাঁকে দেখে মিম্বর হতে নেমে আসেন এবং তাঁকে কোলে তুলে বুকের সাথে লাগিয়ে রেখে মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করেন, ’হে আল্লাহ্! আমি তাদের উভয়কেই ভালোবাসি। আপনিও তাঁদের একইরকম ভালোবাসুন।’ (বোখারি শরীফ)। তাহলে কারবালার ঘটনায় আশেকে রাসুলগণ ব্যথিত না হয়ে পারেন কি করে?
পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “বলুন হে রাসুল (সা.)! আমি আমার দাওয়াতের বিনিময়ে তোমাদের কাছে আত্মীয়তার সম্প্রীতি (আহলে বাইতের প্রতি মহব্বত) ব্যতিরেকে অন্য কোনো প্রতিদান প্রত্যাশা করি না।” (সূরা শুরা ৪২ : আয়াত ২৩)। অর্থাৎ এ আয়াত দিয়ে আল্লাহ তায়ালা আহলে বাইতের প্রতি মহব্বত ফরজ করে দিয়েছেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, উক্ত আয়াত নাজিলের পর সাহাবায়ে কেরাম হুজুর পাক (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহ্র রাসুল (সা.) আপনার কোনো নিকট আত্মীয়, যাদের সম্পর্কে এ আয়াত নাজিল হলো? জবাবে নবি করিম (সা.) বলেন- আলী, মা ফাতেমা, ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন। তা ছাড়াও সূরা আলে ইমরানের ৬নং আয়াত নাজিলের পর রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.), হযরত আলী, মা ফাতেমা, ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইনকে গায়ের কালো চাদরের ভিতর ঢেকে বললেন, হে আল্লাহ সাক্ষী থাকুন তারাই আমার নিকট আত্মীয়। মহান আল্লাহ সূরা আলে ইমরানের ১০৩নং আয়াতে ফরমান ’তোমরা আল্লাহর রশিকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরো এবং দলে দলে বিভক্ত হয়ে যেওনা’। এ সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেন- আলী, ফাতেমা, হাসান ও হোসাইন এবং আমি আল্লাহ পাকের রজ্জু (রশি) (তিরমিজি শরীফ)। যারা তাদের সঙ্গে দৃঢ় মহব্বত রেখেছেন তারাই আল্লাহর রুজ্জুকে আঁকড়ে ধরেছেন। আশেকে রাসুলগণ হযরত রাসুল (সা.)-কে ভালোবাসেন বলেই ইমাম হোসাইনের জন্য ভালোবাসায় কারবালার ঘটনায় ব্যথিত হয়।
গাদীরে খুমের ভাষণে হযরত রাসুল (সা.) বলেছেন, আমি দুটি ভারি জিনিষ তোমাদের জন্য রেখে যাচ্ছি। তোমরা তা মজবুত করে আঁকড়ে ধরে রাখলে আমার পরে তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না অন্ধকারে পড়ে মরবে না। এ দুটি ভারি জিনিসের মধ্যে একটা হচ্ছে কিতাবাল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর বাণী পাক কুরআন ও ২য়টি হচ্ছে আমার আহলে বাইত। তাই এ দুটি ভারি জিনিস কখনো একটি অপরটি হতে পৃথক হবে না হাউজে কাউছার পর্যন্ত। হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু থেকে বর্ণিত হয়েছে- হযরত রাসুল (সা.)-এরশাদ করেন ‘হাশর দিবসে চার ব্যক্তির জন্য আমি নিজেই সুপারিশ করব। ১. যে আমার আহলে বাইত ও বংশধরকে সম্মান দেবে; ২. যে আমার আহলে বাইতের বংশধরদের অভাব পূরণ করবে; ৩, যে আমার আওলাদের মধ্যে কেউ অস্থির হয়ে পড়লে উদ্ধার করার জন্য প্রয়াসী হবে এবং ৪. যে আমার আওলাদের জন্য কথায় ও কাজে মনে প্রাণে মহব্বত রাখে’। হযরত সালমান ফারসি (রা.) বলেন, আমি দেখেছি হযরত রাসুল (সা.) ইমাম হোসাইন (রা.)-কে তাঁর হাঁটুর উপর বসিয়ে চুমু খাচ্ছেন আর বলছেন, ‘তুমি মহান, মহান ব্যক্তির পুত্র এবং মহান ব্যক্তিবর্গের পিতা। তুমি ইমাম, ইমামের পুত্র এবং ইমামের পিতা।’ হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) বর্ণনা করেছেন, যখন হযরত রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে আপনি আপনার আহলে বাইতের মধ্য থেকে কাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন? তিনি বলেন, ‘হাসান ও হোসাইনকে’। প্রিয় রাসুল (সা.) প্রায়ই ইমাম হাসান ও হোসাইনকে তাঁর বুকে চেপে ধরে তাদের পবিত্র দেহের সুঘ্রাণ নিতেন এবং তাদের চুম্বন করতেন।’ হযরত আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেছেন যে, আমি দেখেছি রাসুল (সা.), ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইনকে তাঁর কাঁধে বসিয়ে আমাদের দিকে আসছেন। যখন তিনি আমাদের কাছে পৌঁছলেন, তখন বললেন- যে আমার এই দুসন্তানকে ভালোবাসবে সে আমাকে ভালোবাসলো আর যে তাদের সাথে শত্রুতা করবে, সে আমার সাথে শত্রুতা করলো। আহলে বাইতের সদস্যগণ শুধু গুনাহ থেকেই মুক্ত নন বরং সকল প্রকার চারিত্রিক ও আচরণগত অপকৃষ্টতা থেকেও মুক্ত। (সূরা আল আহযাব ৩৩ : আয়াত ৩৩) নামাজের দরূদে আমরা বলে থাকি- ‘হে আল্লাহ! মুহাম্মদ ও আহলে বাইতের প্রতি দরূদ প্রেরণ করো, রহমত নাজিল করো, যেভাবে তুমি ইব্রাহীম ও আহলে ইব্রাহীমের প্রতি বরকত নাযিল করেছ। খুতবায় আমরা হযরত ইমাম হাসান আর হযরত ইমাম হোসাইনকে বেহেশতের যুবকদের নেতা বলে উল্লেখ করি। অথচ আশেকে রাসুল ছাড়া অনেকেই কারবালায় ঘটনা উপলদ্ধি করতে চান না। ইয়াজিদের চক্রান্তের কারণেই এ প্রথা চলে আসছে মুসলিম সমাজে।
বাস্তবতাকে বিশ্লেষণ করলে কারবালার ঘটনা মুসলিম জাহানের জন্য অত্যন্ত বেদনার। ইমাম হোসাইন (রা.) যে ঘটনায় নির্মমভাবে ইয়াজিদের বাহিনী দ্বারা শহিদ হলেন পরিবার পরিজনসহ, সে ঘটনাকে আমরা ভুলি কীভাবে? এ ঘটনায় যদি কেউ ব্যথিত না হয় তাহলে রাসুল (সা.)-এর বর্ণনানুযায়ী সে হযরত রাসুল (সা.)-কে ভালোবাসে না। আর রাসুল (সা.)-কে সব কিছুর চেয়ে বেশি ভালো না বাসতে পারলে, সে মু’মিন হতে পারে না?
অনেককে বলতে শুনি কারবালার ঘটনা শিয়াদের বিষয়। কত বড়ো ভুল আমাদের। এ কথা বললে আমরা কি রাসুল (সা.)-এর উম্মত দাবী করতে পারি। রাসুল (সা.) যাকে ভালোবেসেছেন আমরা যদি তাকে ভালোবাসতে না পারি তাহলে আমরা কীভাবে আশেকে রাসুল দাবী করতে পারি। তাছাড়া পবিত্র কুরআনের বিধানমতে রাসুল (সা.)-এর আহলে বাইতকে ভালোবাসা আমাদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় দায়িত্ব। অনেকে বলে থাকেন এদিন রাসুল (সা.) শুধু রোজা পালন করেছেন। কথা সত্য কিন্ত রাসুল (সা.)-এর সময়তো কারবালার ঘটনা ঘটেনি। তাহলে কি কারবালার ঘটনার পরও আমরা এ দিনটিকে অন্য আঙ্গিকে চিন্তা করব না? আর চিন্তা না করলে আমরা আল্লাহ ও রাসুলের বিধান মানছি তা বলি কীভাবে? মুমিন হতে হলে এ বিষয়টি উপলদ্ধি করা দরকার। মহান সংস্কারক সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজান বলেন, এ দিনটি শুধু মাত্র শিয়াদের হতে পারে না। এটি মুসলিম উম্মার সকলের। এর তাৎপর্য উপলদ্ধি করেই আশেকে রাসুল হতে হয়। অন্যথায় রাসুল (সা.)-এর সাথে বিদ্বেষের তুল্য হিসেবে গণ্য হয়।
কারবালার ঘটনায় যদি আমাদের অন্তরে ব্যথা অনুভব না করি তাহলে সহজেই অনুমেয় যে আমরা ইয়াজিদের কার্যকলাপকে মেনে নিচ্ছি। তা কি হতে পারে? কখনই না। আমরা অনুসরণ করি হযরত রাসুল (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের মধ্যে বিদ্যমান আদর্শকে। দয়াল রাসুল (সা.) আমাদেরকে সেভাবেই নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা ইয়াজিদের আদর্শকে কোনোভাবেই মানতে পারি না। কারবালার যুদ্ধের পর ৮৯ বছর ইয়াজিদ গোষ্ঠী রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলো। সে রাষ্ট্র ক্ষমতা ব্যবহার করে মানুষের মন থেকে কারবালার ঘটনা মুছে ফেলার জন্য ঘটনা প্রবাহকে ভিন্ন খাতে রূপ দিতে চেয়েছে। সেটাই স্বাভাবিক, কেন না সব অপরাধীই সুযোগ পেলে তার অপরাধকে ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করে। আমরা কি সে ষড়যন্ত্রে পা দিব নাকি সত্যকেই গ্রহণ করব? অবশ্যই আমরা আশেকে রাসুলেরা হযরত রাসুল (সা.)-এর নির্দেশিত পথে জীবন যাপন করব। এ দিনের বিয়োগান্তক ঘটনাকে স্মরণ করে সত্যকে প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রত্যয়ে শপথ গ্রহণ করব।
হযরত রাসুল (সা.)-এর দৌহিত্রদের ইমান ও কার্যক্রম নিয়ে কারো প্রশ্ন নেই। তাঁদের কেউ অশ্রদ্ধাও করেন না কিন্তু কারবালার ঘটনা ইয়াজিদের কারণে অনেকের মনে ভিন্নভাবে রেখাপাত করে। যা একটু চিন্তা করলে খুব সহজেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। ইয়াজিদ আমাদের কেউ না, পক্ষান্তরে হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) একজন মু’মিনের অতি আপনজন। ইমাম হোসাইন (রা.) পরিবার ও সঙ্গী সাথীদের মর্মভেদী বর্ণনা শুনেও যদি আমাদের হৃদয়ে অশ্রু না ঝরে, আর এ দিনটিকে শিয়াদের বলে চালিয়ে দিতে চেষ্টা করি, তাহলে রাসুল (সা.) আমাদের উপর সন্তষ্ট থাকবেন তা ভাবা বাতুলতা মাত্র। সেজন্য কারবালার ঘটনায় যদি কারো হৃদয়ে অশ্রু ঝরে, তবেই বুঝতে হবে সে আশেকে রাসুল। আর এ ঘটনাকে অবজ্ঞা করে যারা পবিত্র কুরআন ও হাদিসের বিরুদ্ধচরণ করে, রাসুলের আহলে বাইতের প্রতি সম্মান দেখায় না তাদের সম্পর্কে মহান আল্লাহই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।
ইয়াজিদের চক্রান্তে মুসলিম উম্মাহ ইসলামের সঠিক ইতিহাস এতদিন অনেক ক্ষেত্রেই উপলদ্ধি করতে পারেনি। তাই ইয়াজিদের উত্তরসূরীরা বহাল থেকে আমাদের বিভ্রান্ত করার সুযোগ পেয়েছে। যারা ইমাম হোসাইন (রা.)-কে শহিদ করেছে, তারা চেয়েছে কেউ যেন এ দিনটি স্মরণ না করে। এটিকে রাজনৈতিক রং লাগানোর চেষ্টা করেছে। ইমাম হোসাইন (রা.) ছিলেন মুসলিম জাহানের ইমাম। পার্থিব ক্ষমতার জন্য তাঁর কোনো লোভ থাকতে পারে না। তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো- মহান আল্লাহ ও হযরত রাসুল (সা.)-এর আদর্শকে সমুন্নত রাখা। এখানে হয়েছেও তাই।
যুগের ইমাম সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজান বলেন, চক্রান্তের বেড়াজাল পেরিয়ে আশেকে রাসুল হতে হয়। আমরা উপলদ্ধি করব এ দিনটি হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রা.) পরিবারের সত্যকে রক্ষা করতে গিয়ে নির্মমভাবে শহিদ হওয়ার দিন। একজন মুমিনের এটা ইমানি দায়িত্ব, আহলে বাইতকে ভালোবাসা। এ বিষয়টি সকল রাসুল প্রেমী মানুষের উপলদ্ধিতে আছে এবং থাকবে। এ ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে অন্যদেরও ইমানদীপ্ত পরকালমুখী জীবন গড়ে তোলা দরকার। আমরা সবাই যেন কারবালার ঘটনা বুঝে এবং হৃদয়ে ধারণ করে আহলে বাইতের প্রতি সন্মান দেখাতে পারি। যারা এখনো কারবালার ঘটনা সঠিকভাবে উপলদ্ধি করতে পারেননি, তারা একটু চিন্তা করলেই আহলে বাইতের নির্মম শাহাদতের বেদনা হৃদয়ে অনুভব করতে পারবেন। কেননা ইমাম হোসাইন (রা.) আমাদের আপনজন, ইয়াজিদ আমাদের কেউ নয়।
[ লেখক : অতিরিক্ত সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার]

সম্পর্কিত পোস্ট