Cancel Preloader

নবি-রাসুল ও অলী-আল্লাহ্গণের মর্যাদা


ড. মুহাম্মদ নাছিরউদ্দীন (সোহেল)
নবি-রাসুল ও অলী-আল্লাহ্গণ মহান আল্লাহর প্রিয় বন্ধু। মহান রাব্বুল আলামিন স্বয়ং তাঁদের মর্যাদাকে সমুন্নত করেছেন। তাঁরা যে সাধারণ মানুষ থেকে মর্যাদায় অনন্য, তা মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে ঘোষণা করেছেন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ এরশাদ করেন, ‘‘আর আমি যাদের সৃষ্টি করেছি, তাদের মধ্যে এমন এক দল আছে, যারা সত্য পথ দেখায় এবং সেই অনুযায়ী ন্যায়বিচার করে।’’ (সূরা আল আ’রাফ ৭: আয়াত ১৮০)

মহান আল্লাহর এই বাণী মোবারক থেকে সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, মানুষের মাঝে দুটি শ্রেণি বিদ্যমান। একটি শ্রেণি হলেন সৎ পথ প্রদর্শনকারী ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকারী অর্থাৎ তাঁরা হলেন হেদায়েতকারী মহামানব তথা নবি-রাসুল ও অলী-আল্লাহ্। অপর শ্রেণিটি হলেন সাধারণ মানুষ, যারা হেদায়েতকারী মহামানবের সাহচর্যে গিয়ে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে মু’মিন বান্দায় পরিণত হয়ে থাকেন। মহান আল্লাহ্ তাঁর বন্ধুদেরকে দুটি যুগে বিভক্ত করে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। হেদায়েতকারী মহামানব প্রেরণের প্রথম পর্বটি হলো নবুয়তের যুগ এবং দ্বিতীয় বা শেষ পর্বটি হলো বেলায়েতের যুুগ। নবুয়তের যুগে যাঁরা প্রেরিত হয়েছেন তাদেরকে বলা হয় নবি ও রাসুল। আরবি নবি শব্দের অর্থ ‘সুসংবাদদাতা’,নবি শব্দটির বহুবচন আম্বিয়া, যার বাংলা অর্থ সুসংবাদদাতাগণ। সর্বকালের, সর্বযুগের, সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.)-কে ধুলির ধরায় প্রেরণের মধ্য দিয়ে মহান আল্লাহ্ নবুয়তের যুগের পরিসমাপ্তি ঘটান। তাঁর পরে কিয়ামত পর্যন্ত আর কোনো নবি বা রাসুল আসবেন না। কিন্তু হেদায়েতের চিরন্তন ধারা অব্যহত রাখার জন্য মহান আল্লাহ্ বেলায়েতের যুগের সূচনা করেছেন। এই যুগে যাঁরা হেদায়েতের সুমহান দায়িত্ব পালন করে থাকেন, তাঁরা হলেন অলী-আল্লাহ্, এই আরবি শব্দটির বাংলা অর্থ হলো আল্লাহর বন্ধু, আল্লাহ্ওয়ালা। অলী-আল্লাহ্ শব্দটির বহুবচন হলো আওলিয়াল্লাহ্ অর্থাৎ আল্লাহর বন্ধুগণ।

আম্বিয়ায়ে কেরাম তথা নবি-রাসুলগণের সুমহান মর্যাদা উপস্থাপন করে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ বিভিন্ন আয়াত নাজিল করেছেন। নিম্নে এই সংক্রান্ত পবিত্র কুরআনের কতিপয় আয়াত উপস্থাপন করা হলো-
** ‘‘তোমাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর জীবনে উত্তম আদর্শ।’’ (সূরা আল আহযাব ৩৩: আয়াত ২১)
** ‘‘যে ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর আনুগত্য করে, সে তো আল্লাহরই আনুগত্য করল।’’ (সূরা আন নিসা ৪: আয়াত ৮০)
** ‘‘হে রাসুল (সা.)! নিশ্চয় যারা আপনার হাতে বায়াত গ্রহণ করে, তারা তো আল্লাহরই হাতে বায়াত গ্রহণ করে। আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর।’’ (সূরা আল ফাতহ ৪৮: আয়াত ১০)
**‘‘হে নবি (সা.)! নিশ্চয়ই আমি তো আপনাকে সাক্ষীরূপে, সুসংবাদদাতারূপে ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি।’’ (সূরা আল আহযাব ৩৩: আয়াত ৪৫)
** রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.) আল্লাহর নির্দেশে বিশ্ববাসীর সামনে নিজের পরিচয় প্রকাশ করে বলেন- ‘‘বলুন, হে মানবজাতি! আমি তোমাদের সকলের জন্য আল্লাহর রাসুলরূপে প্রেরিত হয়েছি।’’ (সূরা আল আ‘রাফ ৭: আয়াত ১৫৮)
** হযরত নুহ (আ.) স্বজাতির সামনে নিজের পরিচয় প্রকাশ করে বলেন- ‘‘হে আমার সম্প্রদায়! আমার মধ্যে কোনো পথভ্রষ্টতা নেই, বরং আমি তো জগৎসমূহের প্রতিপালকের তরফ থেকে একজন রাসুল।’’ (সূরা আল আ’রাফ ৭: আয়াত ৬১)
** হযরত মুসা (আ.) প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ বলেন- ‘‘আর আমি তো মুসা (আ.)-কে আমার মু’জিজাসহ ফেরাউন ও তার সভাসদবৃন্দের কাছে প্রেরণ করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন- আমি তো জগৎসমূহের প্রতিপালকের রাসুল।’’ (সূরা আঝ ঝুখরুফ ৪৩: আয়াত ৪৬)
** হযরত হুদ (আ.) স্বজাতির সামনে নিজের পরিচয় প্রকাশ করে তাঁর আনুগত্য করার আহ্বান করে বলেন- ‘‘আমি তো তোমাদের জন্য এক বিশ্বস্ত রাসুল। অতএব তোমরা আল্লাহ্কে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো।’’ (সূরা আশ শু‘আরা ২৬: আয়াত ১২৫ ও ১২৬)

** হযরত রাসুল (সা.) আম্বিয়ায়ে কেরামের সুউচ্চ মর্যাদা প্রসঙ্গে বিভিন্ন হাদিস বর্ণনা করেন। এ প্রসঙ্গে হযরত আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘‘নিশ্চয় মহান আল্লাহ্ নবিগণের দেহ ভক্ষণকরা জমিনের জন্য হারাম করেছেন। ফলে আল্লাহর নবি জীবিত এবং তাঁকে রিজিক দেওয়া হয়।’’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, পৃষ্ঠা ১১৮; ই. ফা. বা. কর্তৃক অনূদিত সুনানে ইবনে মাজাহ-২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭৮, হাদিস নং ১৬৩৭)
** আল্লাহর রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘‘আল্লাহর নবিগণ কখনো মৃত্যুবরণ করেন না, বরং তাঁরা এক ঘর থেকে অন্য ঘরে স্থানান্তরিত হন মাত্র।’’ (তাফসীরে কাবীর-৯ম খণ্ড,পৃষ্ঠা ৫৯৬৭)

পবিত্র কুরআনের উল্লিখিত আয়াতসমূহ এবং হযরত রাসুল (সা.)-এর হাদিস দুটি প্রমাণ করে যে, নবি-রাসুলগণ মহান আল্লাহর নিকট বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। তাঁদের অনুসরণের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ মহান আল্লাহর পরিচয় লাভ করতে সক্ষম হন। যাঁরা আল্লাহ্ তায়ালার প্রেরিত নবি-রাসুলগণকে অবিশ্বাস করে তাদের আনুগত্য করেনি, তারাই ধ্বংস হয়েছে। আর আম্বিয়ায়ে কেরামের প্রদর্শিত পথে যারা নিজেদেরকে পরিচালিত করতে সক্ষম হয়েছেন, তারাই মু’মিন বান্দায় পরিণত হয়েছেন।

এই প্রসঙ্গে মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী, সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজান বলেন,‘‘প্রকৃতপক্ষে নবি ও রাসুলগণ মানুষকে আল্লাহর সাথে যোগাযোগের পদ্ধতি শিক্ষা দিয়ে থাকেন। যে সকল মানুষ তাঁদের দেওয়া পদ্ধতি অনুসরণ করে নিজের ক্বালব বা অন্তরের অন্ধকার দূর করে আল্লাহর নুরে উক্ত ক্বালবকে আলোকিত করতে পারে, তারাই হয় প্রকৃত মু’মিন। আর যারা সত্য প্রত্যাখ্যান করে নিজের ক্বালব বা অন্তরে আল্লাহর নুরকে অন্ধকারে ঢেকে রাখে, তারাই প্রকৃত অর্থে কাফির।’’ (মুক্তি কোন পথে? পঞ্চম সংস্কারণ, পৃষ্ঠা ৫)

নবুয়তের যুগের মতো বেলায়েতের যুগের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম বিদ্যমান। বেলায়েতের যুগে মহান আল্লাহ্ প্রেরিত হেদায়েতকারী মহামানব তথা অলী-আল্লাহ্গণকে অনুসরণ করা সাধারণ মানুষের জন্য অপরিহার্য। অলী-আল্লাহ্গণ হলেন নায়েবে রাসুল অর্থাৎ হযরত রাসুল (সা.)-এর উত্তারাধিকারী, আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর প্রতিনিধি, স্থলাভিষিক্ত ব্যক্তি।
এই প্রসঙ্গে হাদিস শরীফে হযরত রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- ‘‘(আল্লাহ্তত্ত্বের জ্ঞানে জ্ঞানী) আলেমগণ নবিদের ওয়ারিস তথা উত্তরাধিকারী।’’ (আহমদ, তিরমিযী, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ ও দারেমী শরীফের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৩৪)
মহান আল্লাহ্ নিজেই তাঁর অলী-বন্ধুদের সুউচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করে বলেছেন, ‘‘জেনে রেখো, আল্লাহর বন্ধুদের কোনো ভয় নেই এবং তাঁরা দুঃখিতও হবে না।’’ (সূরা ইউনুস-১০: আয়াত ৬২)

এ প্রসঙ্গে হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ্ দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেন, ‘‘যে ব্যক্তি আমার বন্ধুর সাথে শত্রুতা পোষণ করে, আমি তাকে আমার সাথে যুদ্ধের জন্য আহ্বান করি।’’ (বোখারী শরীফ-২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৬৩)
অলী-আল্লাহ্গণের মর্যাদা সম্পর্কে হযরত রাসুল (সা.)-এর কতিপয় বাণী মোবারক নিম্নে উপস্থাপন করা হলো-

হযরত রাসুল (সা.) এরশাদ করেন-
** ‘‘আমার উম্মতের মধ্যে যারা আলেম তথা আল্লাহর পরিচয় লাভকারী অলী-আল্লাহ্, তাঁরা বনি ইসরাঈলের নবিগণের মতো।’’ (তাফসীরে রূহুল বয়ান-১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৪৮)
** ‘‘মহান আল্লাহ্ বলেছেন- ‘‘নিশ্চয় আমার বান্দাদের মধ্যে অলী-আল্লাহ্ হলেন তাঁরা, আমাকে স্মরণ করলে যাঁদের কথা স্মরণ হয় এবং যাঁদেরকে স্মরণ করলে, আমার কথা স্মরণ হয়।’’ (তাফসীরে মাজহারী-৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৪৮)
** ‘‘আল্লাহর অলীগণ মৃত্যুবরণ করেন না, বরং তাঁরা এক ঘর থেকে অন্য ঘরে স্থানান্তরিত হন মাত্র।’’ (তাফসীরে কাবীর-৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৮৮১)

পবিত্র কুরআন ও হাদিসের আলোকে বিষয়টি সুস্পষ্ট যে, অলী-আল্লাহ্দেরকে সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন করা মানবজাতির জন্য অত্যাবশ্যক। কারণ অলী-আল্লাহ্গণের সহবতে গিয়ে সাধারণ মানুষ মু’মিন বান্দায় পরিণত হয়ে থাকেন। মু’মিনদের প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে বেশকিছু আয়াত নাজিল করেছেন, নিম্নে কতিপয় আয়াত উপস্থাপন করা হলো-

** ‘‘হে মু’মিনগণ! তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর, আনুগত্য করো রাসুলের এবং আনুগত্য করো তাঁদের, তোমাদের মধ্যে যাঁরা (আল্লাহর সাথে যোগাযোগ করে) নির্দেশ প্রদানে সক্ষম।’’ (সূরা আন নিসা ৪: আয়াত ৫৯)
** ‘‘হে মু’মিনগণ! আল্লাহ্কে ভয় করো, তাঁর নৈকট্য লাভের জন্য অসিলা অন্বেষণ করো।’’ (সূরা আল মায়িদাহ ৫: আয়াত ৩৫)
** ‘‘যে নেক কাজ করে এবং সে মু’মিন, হোক সে পুরুষ কিংবা নারী, আমি তাকে অবশ্যই দান করব এক পবিত্র শান্তিময় জীবন এবং তারা যা করত, তার জন্য তাদেরকে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করব।’’ (সূরা আন নাহল ১৬: আয়াত ৯৭)
** ‘‘হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহ্কে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গ লাভ করো।’’ (সূরা আত তাওবাহ ৯: আয়াত ১১৯)
** ‘‘তিনিই আল্লাহ্, যিনি মু’মিনদের ক্বালবে প্রশান্তি (ফায়েজ) নাজিল করেন, যেন তারা তাদের ইমানের সাথে আরো ইমান বৃদ্ধি করে নেয়।’’ (সূরা আল ফাতহ ৪৮: আয়াত ৪)
** ‘‘আল্লাহ্ (তাঁর নিকট থেকে) তাঁর রাসুল ও মু’মিনদের উপর পরম শান্তি (ফায়েজ) নাজিল করে তাদের সাহায্য করেন।’’ (সূরা আত তাওবাহ ৯: আয়াত ২৬)
** ‘‘অবশ্যই আল্লাহ্ মু’মিনদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন যে, তিনি তাদের কাছে তাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসুল পাঠিয়েছেন। তিনি আল্লাহর আয়াত তাদের পাঠ করে শুনান, তাদের পবিত্র করেন এবং তাদের শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমত; যদিও তারা পূর্বে প্রকাশ্য গোমরাহিতে ছিল।’’ (সূরা আলে ইমরান ৩: আয়াত ১৬৪)
** ‘‘হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহ্কে যথার্থরূপে ভয় করো এবং তোমরা আত্মসমর্পণকারী না হয়ে কোনো অবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করো না।’’ (সূরা আলে ইমরান ৩: আয়াত ১০২)
** ‘‘হে রাসুল (সা.)! অবশ্যই আল্লাহ্ মু’মিনদের প্রতি সস্তুষ্ট হলেন, যখন তারা বৃক্ষের নিচে আপনার আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করল, আর তাদের ক্বালব বা অন্তরে যা ছিল, তা তিনি জানতেন। অতঃপর তিনি তাদের ক্বালবে নাজিল করলেন পরম শান্তি (ফায়েজ) এবং তাদেরকে দান করলেন একটি নিকবর্তী বিজয়।’’ (সূরা আল ফাতহ ৪৮: আয়াত ১৮)
** ‘‘যারা মু’মিন, আল্লাহ্ তাদের অভিভাবক।’’ (সূরা বাকারা ২: আয়াত ২৫৭)

মু’মিনদের মর্যাদা প্রসঙ্গে হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহ্ বলেন, ‘‘আমার জমিন আমাকে ধারণ করতে পারে না, আমার আসমানও আমাকে ধারণ করতে পারে না। কেবল আমার মু’মিন বান্দার ক্বালব আমাকে ধারণ করে থাকে।’’ (তাফসীরে মাজহারী-৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৬০)

এছাড়া হযরত রাসুল (সা.) মু’মিনদের সম্পর্কে এরশাদ করেন-
** ‘‘তোমরা মু’মিন ব্যক্তির অন্তর্দৃষ্টিকে ভয় করো, কেননা সে মহান ও মহিমান্বিত আল্লাহর নুর বা জ্যোতির সাহায্যে দেখে থাকে।’’ (তাফসীরে আলীয়্যুন ফিল কুরআনে ওয়াস সুন্নাহ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪১৬; তাফসীরে জিলানী ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪১৩)
** ‘‘মু’মিন ব্যক্তির ক্বালব বা দিল হলো আল্লাহর আরশ।’’ (তাফসীরে ইবনুল আরাবী ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮৯)
** এই প্রসঙ্গে হযরত ইবনে উমর (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন- ‘‘আমি নবি (সা.)-কে কাবা শরীফ তাওয়াফ করতে দেখলাম। তখন তিনি বলছিলেন- ‘(হে কাবা!) তুমি কতো পবিত্র এবং কতোই না পবিত্র তোমার ঘ্রাণ! কতোই না বড়ো মর্যাদাসম্পন্ন তুমি এবং তোমার সম্মান কতোইনা উচ্চ! যাঁর হাতে মোহাম্মদ (সা.)-এর প্রাণ, তাঁর শপথ করে বলছি- আল্লাহর নিকট মু’মিনের মর্যাদা তোমার মর্যাদার চেয়েও অনেক বেশি। তাঁর জানমাল এবং তাঁর ধারণা সবই কল্যাণকর’।’’ (তাফসীরে দুররে মানছুর ২৬নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৬৫; এবং সুনানে ইবনে মাজাহ, পৃষ্ঠা ২৮২; ই. ফা. বা. কর্তৃক অনূদিত সুনানে ইবনে মাজাহ ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৫৭)

হযরত রাসুল (সা.)-এর উল্লিখিত হাদিসটি থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মু’মিন ব্যক্তির সম্মান কাবা ঘরের চেয়েও বেশি। এই প্রসঙ্গে যুুগের ইমাম সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান বলেন, ‘‘অলী-আল্লাহ্গণ অবশ্যই মু’মিন; উপরন্তু তাঁরা যেমন আল্লাহর বন্ধু, তেমনি তারা মানুষকে মু’মিন হওয়ার পদ্ধতি শিক্ষা দেন। এজন্য তাঁদের মর্যাদা আল্লাহর কাছে কাবা ঘরের চেয়ে অনেক বেশি। মু’মিন ব্যক্তির ক্বালবে আল্লাহ্ বিরাজ করেন।’’ (মুক্তি কোন পথে? পঞ্চম সংস্করণ, পৃষ্ঠা ১০৭)

বিখ্যাত সুফি হযরত রাবেয়া বসরি (রহ.)-এর গৌরবময় জীবন সংঘটিত একটি ঘটনা থেকে বুঝা যায় যে, মহান আল্লাহর নিকট অলী-আল্লাহর মর্যাদা অত্যধিক। তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য পবিত্র কাবাঘর তাঁর নিকট উপস্থিত হয়। ঘটনাটি তাযকেরাতুল আওলিয়া কিতাবের সূত্রে ‘মুক্তি কোন পথে?’ পঞ্চম সংস্করণ, কিতাবে বর্ণিত হয়েছে। ঘটনাটি হলো- ‘‘হযরত ইবরাহিম আদহাম মক্কা শরীফে গমনকালে পথিমধ্যে প্রতি কদমে দুই রাকাত নামাজ আদায় করে চৌদ্দ বছরে কাবা শরীফে পৌঁছেছিলেন। তিনি প্রতিটি মুহূর্তে মনে মনে বলতেন- ‘লোকেরা এই পথে পায়ে হেঁটে চলে, আমি চক্ষু দ্বারা এই পথ দেখে দেখে হাঁটব।’ তিনি মক্কা শরীফে প্রবেশ করে খানায়ে কাবাকে যথাস্থানে দেখতে পেলেন না। তিনি মনে মনে বললেন, ‘হায়! একি ব্যাপার! সম্ভবত আমার চোখে কোনো সমস্যা হয়েছে।’ তৎক্ষণাৎ গায়েব থেকে আওয়াজ আসলো- তোমার চোখে কোনো সমস্যা হয়নি; বরং কাবা শরীফের ঘর এক দুর্বল বৃদ্ধার সম্মানার্থে ইস্তেকবালের জন্য গমন করেছে, সেই বৃদ্ধা এদিকে আসছে। হযরত ইবরাহিম আদহাম মনের দুঃখে ও ক্ষোভে চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে বললেন- ‘সেই বৃদ্ধা রমণী কে?’ এ কথা বলতে না বলতে হযরত রাবেয়া বসরি (রহ.) লাঠি ভর করে সেখানে এসে পৌঁছালেন এবং সঙ্গে সঙ্গে কাবা গৃহও এসে যথাস্থানে উপস্থিত হলো। হযরত ইবরাহীম আদহাম বললেন- ‘রাবেয়া! দুনিয়ার বুকে তুমি এ কেমন হুলুস্থূল কাণ্ড ঘটালে? রাবেয়া বসরি (রহ.) আদহামকে জিজ্ঞেস করলেন- ‘তুমি কেন কাবা ঘরে এসেছ?’ ইব্রাহিম আদহাম জবাব দিলেন-‘আমি কাবা ঘর জিয়ারত করার উদ্দেশ্যে এখানে এসেছি।’ রাবেয়া বসরি (রহ.) বললেন- ‘আমি তো কাবার মালিক আল্লাহর জিয়ারতের জন্যে এসেছি’।’’ (তাযকেরাতুল আওলিয়া ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫০)
এই প্রসঙ্গে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, গবেষক ও লেখক ইমাম ড. আরসাম কুদরত এ খোদা (মা. আ.) হুজুর তাঁর অনবদ্য তাসাউফের কিতাব ‘মোর্শেদের দরবারে মুরীদের করণীয়’-তে উল্লেখ করেছেন, ‘‘মহান রাব্বুল আলামিন হযরত রাবেয়া বসরি (রহ.)-কে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য কাবা ঘরকে প্রেরণ করেন। যাত্রা পথে হঠাৎ হযরত রাবেয়া বসরি (রহ.) দেখতে পেলেন তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য কাবাঘর তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে। এ দৃশ্য দেখে তিনি বললেন, ‘হে দয়াময় খোদা! এই ঘর দিয়ে আমি কী করব? আমি যে এই ঘরের মালিকের প্রত্যাশী। মালিক আপনি বলেছেন, ‘যে বান্দা আমাকে পাওয়ার জন্য এক বিঘত অগ্রসর হয়, আমি তার দিকে এক হাত এগিয়ে যাই।’ সুতরাং হে দয়াময় খোদা! আমি শুধু কাবা ঘর ও তার শোভায় কীভাবে খুশি হতে পারি?’’ (দ্বিতীয় সংস্কারণ, পৃষ্ঠা ৮২)
উচ্চপর্যায়ের অলী-আল্লাহ্গণের জীবনী মোবারক গবেষণা করলে দেখা যায় যে, তাঁদের জীবনে সংঘটিত এমন অনেক ঘটনা রয়েছে, যেগুলো অলী-আল্লাহ্গণের সুমহান মর্যাদার বিষয়টি প্রমাণ করে। তাই অলী-আল্লাহ্গণের সান্নিধ্যে যাওয়া আবশ্যক। এই প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ বলেন, ‘‘আল্লাহ্ যাকে গোমরাহ করেন, আপনি কখনো তার জন্য কোনো (মুর্শেদ বা) পথপ্রদর্শনকারী অভিভাবক পাবেন না।’’ (সূরা আল কাহ্ফ ১৮: আয়াত ১৭)

এই প্রসঙ্গে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান বলেন, ‘‘প্রকৃতপক্ষে এই গোমরাহ্ শ্রেণির লোক মুর্শেদ বা হিদায়েতকারী মহামানবের সন্ধান করে না, কিংবা মুর্শেদের সংস্পর্শে যাওয়াকে অবজ্ঞা করে থাকে। অতএব নবুয়ত ও বেলায়েত তথা সর্বযুগেই যারা আল্লাহর প্রেরিত মহামানব তথা নুরে হিদায়েতের ধারক ও বাহক তথা নবি, রাসুল, যুগের ইমাম, মোজাদ্দেদ ও আওলিয়ায়ে কেরামের বিরুদ্ধাচরণ করে, তাঁদের সহবতে গিয়ে নুরে হিদায়েতের আলো দ্বারা নিজেকে আলোকিত করার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করে, এ সকল মানুষ সর্বকালেই গোমরাহ ছিল, আছে ও থাকবে।’’ (মুক্তি কোন পথে? পঞ্চম সংস্করণ পৃষ্ঠা ৫৭)

আমাদের পরম সৌভাগ্য যে, আমরা বেলায়েতের যুগের শ্রেষ্ঠ ইমাম সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজানকে মহান মুর্শেদরূপে পেয়েছি। তিনি বেলায়েতের যুগের শ্রেষ্ঠ অলী-আল্লাহ্, শ্রেষ্ঠ ইমাম। যুগের ইমামের সান্নিধ্যে যাওয়া প্রসঙ্গে হযরত রাসুল (সা.) ফরমান, ‘‘যে ব্যক্তি তার জামানার ইমামকে চিনতে পারে না এবং এ অবস্থায় যদি মৃত্যু ঘটে, তবে তার মৃত্যু অন্ধকারে নিমজ্জিত ও নিপতিত হবে।’’ (মুসনাদে ইমাম সাদেক ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫১৯ ও ৫৩৩)
এই প্রসঙ্গে আল্লাহর রাসুল (সা.) আরো এরশাদ করেন, ‘‘যে ব্যক্তি (যুগের) ইমামের আনুগত্য না করে মৃত্যুবরণ করেছে, সে জাহেলি অবস্থা তথা ধর্মহীন বেইমান হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে।’’ (মুসনাদে আহমদ ১৩নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৮৮)

জগৎশ্রেষ্ঠ মহামানব সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান পবিত্র কুরআনের আলোকে মানুষকে আত্মশুদ্ধি, দিলজিন্দা ও নামাজে হুজুুুুুরির শিক্ষা দিয়ে থাকেন। এই তিনটি শিক্ষা ২৭ জন নবি ও রাসুল তাঁদের স্বজাতিকে দিয়েছিলেন, যা মহা গ্রন্থ আল কুরআনে বর্ণিত আছে।
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ বলেন, ‘‘নিশ্চয় সাফল্য লাভ করবে সে, যে আত্মশুদ্ধি লাভ করে এবং সে স্বীয় প্রতিপালকের নাম স্মরণ করে ও নামাজ আদায় করে।’’ (সূরা আল আ’লা-৮৭: আয়াত ১৪ ও ১৫) এই তিনটি শিক্ষা ছাড়াও সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান মানুষকে ‘আশেকে রাসুল’ হওয়ার শিক্ষা দেন, যেন মানুষ হযরত রাসুল (সা.)-কে ভালোবেসে মু’মিন হতে পারে।

পরিশেষে জগৎশ্রেষ্ঠ মহামানব, যুগের শ্রেষ্ঠ ইমাম সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের কদমে এই আর্জি পেশ করছি, তাঁর নির্দেশিত ওয়াজিফা আমল করে এবং তাঁরই গোলামির মাধ্যমে নিজের আমিত্ব-অহংকার বিসর্জন দিয়ে আলোকিত মানুষরূপে যেন নিজেকে গড়ে তুলতে পারি। আমিন।
[লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, দি পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ]

সম্পর্কিত পোস্ট