Cancel Preloader

পবিত্র আশুরা: ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় দিন


ড. শরীফ উদ্দিন আহমেদ
আশুরার দিবসে আল্লাহ্ বসলেন আরশে, আশুরার অসিলায় পাপীতাপী মুক্তি পায়; রহমতবর্ষে দুনিয়ায় আশুরার অসিলায়। মহাকালের পালাবদলে ঘুরে আবারও এসেছে পবিত্র মহররম অপরিসীম রহমত ও বরকতের বার্তা নিয়ে। সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন মহররম মাসের ১০ তারিখে তথা পবিত্র আশুরার দিনে এমন সব ঐতিহাসিক ও অবিস্মরণীয় ঘটনার অবতারণা করেছেন, যা এদিনকে বছরের অন্যান্য দিন অপেক্ষা অধিকতর শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করেছে। হাদিসে কুদসিতে মহান রাব্বুল আলামিন ফরমান, “আমি ছিলাম গুপ্ত ধনাগার। অতঃপর আমি পছন্দ করলাম যে, নিজেকে প্রকাশ করব। তারপর (নিজ পরিচয় প্রকাশের মানসে) সৃষ্টিজগত সৃজন করলাম।” (তাফসীরে মাজহারী ১০ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮০ এবং তাফসীরে রূহুল বয়ান ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা ১৮৯)


মহান প্রভু আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন নিজেকে প্রকাশের নিমিত্তে পবিত্র আশুরার দিনে আরশ, কুরছি, লওহ, কলম, আসমান ও জমিন সৃষ্টি করে প্রভু হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন, মহান রাব্বুল ইজ্জতের এ অভিষেকের অনুষ্ঠানে সেই দিনে তিনি আরশে সমাসীন অবস্থায় আলমে আরওয়াহতে এই আত্মাগুলোকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আলাসতু বিরাব্বিকুম’ অর্থাৎ ‘আমি কি তোমাদের প্রভু নই?’ তখন আত্মাগুলো সমস্বরে জবাব দিয়েছিল, ‘বালা’ অর্থাৎ ‘হাঁ’। যেহেতু মহান রাব্বুল আলামিন পবিত্র আশুরার দিনে আরশে সমাসীন হয়েছিলেন, সেহেতু এ দিনের সম্মানের খাতিরে অসংখ্য নবি-রাসুলের বিপদ আপদ দূর করেছিলেন। ফলে এ পূর্ণময় দিনটি জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র মানবজাতির জন্য পরম পবিত্র রহমত ও বরকতময়।


পবিত্র আশুরার দিনে মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাঁকে এ দিনেই বেহেস্তে প্রবেশ করানো হয়েছে এবং পরবর্তীতে এ দিনেই দুনিয়াতে প্রেরণ করে মহান আল্লাহ্ তাকে প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ দিনে ২০০০ নবি প্রেরণ করেছেন, সর্বপ্রথম বৃষ্টি ও মহান আল্লাহর রহমত এ দিনেই অবতীর্ণ হয়েছিল এবং হযরত ইদ্রিস (আ.)-কে সম্মানিত উঁচু স্থানে তুলে নেওয়া হয়েছিল।

হযরত নূহ (আ.)-এর যুগে তিনি ৯৫০ বছর যাবৎ একত্ববাদের বাণী প্রচারের পর যখন সেই যুগের মানুষ মহান আল্লাহ্র বিধিনিষেধ পালনে অস্বীকৃতি জানায় তখন নেমে আসে গজব। ফলে হযরত নূহ (আ.)-এর সম্প্রদায় হয়েছে কোপগ্রস্থ। আর রক্ষা পায় শুধু একত্ববাদে বিশ্বাসী হযরত নূহ (আ.)-এর অনুসারীবৃন্দ। পবিত্র আশুরার দিনেই মহাপ্লাবনকালে হযরত নূহ (আ.)-এর কিস্তি তাঁর অনুসারীদের নিয়ে জুদি পাহাড়ের পাদদেশে এসে থেমেছিল; পবিত্র আশুরার এ দিনেই হযরত ইব্রাহীম (আ.) ভুমিষ্ঠ হন। পরবর্তীতে তিনি দূরাচার নমরুদের অগ্নিকুণ্ড হতে পরিত্রাণ লাভ করেন এবং এই দিন মহান আল্লাহর ইচ্ছায় নিজের প্রাণাধিক প্রিয় পুত্রকে মহান আল্লাহর নামে উৎসর্গ করে। খলিলুল্লাহ বা আল্লাহর বন্ধু হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছিলেন পবিত্র আশুরার এই দিনে।


পবিত্র আশুরার এই দিনে হযরত আইয়ুব (আ.) রোগমুক্ত হয়েছিলেন; হযরত ঈসা (আ.) শুভ জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং চতুর্থ আসমানে উত্থিত হয়েছিলেন। হযরত দাউদ (আ.) মহান রাব্বুল আলামিনের কাছ থেকে ক্ষমা লাভ করেছিলেন। হযরত সোলায়মান (আ.) তাঁর হারানো রাজত্ব পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়েছিলেন; হযরত ইউনুছ (আ.) মাছের পেট হতে মুক্তি লাভ করেছিলেন; হযরত ইউসুফ (আ.)-কে তাঁর ভ্রাতা কেনানের ক‚পে নিক্ষেপ করার পর এ দিনেই তিনি তা থেকে পরিত্রাণ লাভ করেছিলেন; হযরত ইয়াকুব (আ.) তাঁর সন্তান হযরত ইউসুফ (আ.)-কে চল্লিশ বছর পর ফিরে পেয়েছিলেন। পবিত্র আশুরার এই দিনে ফেরাউনের স্ত্রী বিবি আছিয়া (আ.) শিশু হযরত মুসা (আ.)-কে গ্রহণ করেছিলেন, আবার নিজ সম্প্রদায়ের লোকজনসহ হযরত মুসা (আ.) লোহিত সাগর অতিক্রম করেছিলেন। পক্ষান্তরে ফেরাউন সদলবলে লোহিত সাগরে ডুবে মৃত্যুবরণ করেছিল। আশুরার এ দিনেই হযরত মুসা (আ.) মহান আল্লাহর সাথে কথোপকথন করে ‘কালিমুল্লাহ’ উপাধিতে ভ‚ষিত হয়েছিলেন; হযরত জাকারিয়া (আ.) একটি পুত্র সন্তান লাভের জন্য প্রার্থনা করলে মহান আল্লাহর দরবারে তা কবুল হয় এবং তিনি হযরত ইয়াহ্ইয়া (আ.)-কে লাভ করেন; আশুরার এই পবিত্র দিনে এমনি আরও অসংখ্য ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।


পবিত্র আশুরার দিনটি বিশ্ব মুসলিমের কাছে যে কারণে সবচেয়ে স্মরণীয় ও হৃদয় বিদারক, তাহলো এ দিনেই অর্থাৎ হিজরি ৬১ সালের ১০ই মহররম (আশুরা) দিবসে দুরাচারী এজিদ বাহিনী সাইয়্যেদুল মুরসালিন, সরদারে দোআলম হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা আহমদ মোজতবা (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র, আমিরুল মু’মিনিন শেরে খোদা হযরত আলী (কা.) ও খাতুনে জান্নাত হযরত মা ফাতেমা (রা.)-এর হৃদয়ের ধন মোহাম্মদী ইসলামের উজ্জ্বল নক্ষত্র ও অকুতোভয় সৈনিক হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)-কে সপরিবারে কারবালার মরুপ্রান্তরে নির্মমভাবে শহিদ করে। তখন তাঁর বয়স ছিল ৫৫ বছর ৫ মাস ৫ দিন। কারবালার এই যুদ্ধে ইমাম পরিবারের ১৭ জন এবং সঙ্গীদের ৫৫জনসহ মোট ৭২জন সহযোগী নিয়ে এজিদের ২২ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে জিহাদ করে শাহাদতবরণের মাধ্যমে সত্য ও ন্যায়ের জন্য আপসহীন সংগ্রাম করার এক মহান আদর্শ স্থাপন করে গেছেন। কারবালার যুদ্ধ সম্পর্কে ঐতিহাসিক গিবন বলেন- “সেই যুগেও আবহাওয়ায় হোসাইনের মৃত্যুর বিয়োগান্ত দৃশ্য কঠিনতম পাঠকের অন্তরেও সমবেদনার সঞ্চার করবে। মুসলমানদের দৃষ্টিতে এ যুদ্ধ ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ। এ যুদ্ধে ইমাম হোসাইন (রা.) পরাজিত হলেও ধর্মনিষ্ঠ মুসলমানদের দৃষ্টিতে ইহা মূলত একটি আদর্শবাদেরই জয় ছিল।”


কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার পর মোহাম্মদী ইসলামের অনুসারী মুসলমানগণ এক গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নিজেদের ঐতিহ্য ও মর্যাদা হারিয়ে ফেলে। ফলে মুসলিম জাতি বিশ্বের সেরা জাতি হওয়া সত্তে¡ও বিধর্মীদের হাতে নির্যাতিত ও লাঞ্চিত হয়। প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে চক্রান্তের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর রেখে যাওয়া মহান আদর্শ মোহাম্মদী ইসলাম কালের অতলে হারিয়ে গেছে, ইসলামের সেই মৌলিক শিক্ষাকে পুনরুজ্জীবিত করে জগদ্বাসীর কাছে তুলে ধরার লক্ষ্যে ১৯৮৫ সালের এ দিনে মহান সংস্কারক মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী, যুগের ইমাম, আম্বিয়ায়ে কেরামের ধর্মের দায়িত্ব ও বেলায়েত লাভকারী সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর উপজেলার দেওয়ানবাগে ‘দেওয়ানবাগ দরবার শরীফ’ প্রতিষ্ঠা করেন।


পবিত্র আশুরা সমগ্র জগত সৃষ্টির দিন হিসেবে যেমন স্বীকৃত, তেমনি এ দিন কেয়ামতের মহাপ্রলয় সংঘটিত হয়ে জগত ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। তাই এ দিনটি কেবল মুসলিম জাতির জন্য নয়, সমগ্র মানবজাতির নিকট অতীব পবিত্র ও সম্মানিত। পবিত্র আশুরায় কোনো মু’মিন ব্যক্তিকে তৃপ্তি সহকারে আহার করানো একটি উত্তম কাজ।
আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, “রমজান মাসের পর যদি তুমি আরো কোনো রোজা রাখতে চাও তবে মহররমের রোজা রাখো। কেননা এটি আল্লাহর মাস। এতে এমন একটি দিন আছে যেদিন আল্লাহ্ তায়ালা এক সম্প্রদায়ের তাওবা কবুল করেছিলেন এবং আগামীতেও তিনি আরেক সম্প্রদায়ের তাওবা এই দিনে কবুল করবেন।” (তিরমিজি শরীফ ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা ১৫৭)


পবিত্র আশুরার দিনটি অপরিসীম রহমত ও বরকতপূর্ণ বিধায় মহান সংস্কারক মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান এ দিনে ঢাকার প্রাণকেন্দ্র মতিঝিলের ‘বাবে রহমত’ দেওয়ানবাগ শরীফে আশেকে রাসুল (সা.) সম্মেলন করতেন। তাঁর ওফাতের পর মোহাম্মদী ইসলামের নেতৃত্বপ্রদানকারী মহামানব, দেওয়ানবাগ শরীফের পরিচালক, সমন্বয়ক ও সমস্যার ফয়সালাকারী, তিন কোটি আশেকে রাসুলের হৃদয়ের বাতিঘর ইমাম প্রফেসর ড. কুদরত এ খোদা (মা. আ.) হুজুরের বিশেষ উদ্যোগে Online Platform-এর মাধ্যমে এ সম্মেলনের আয়োজন করছেন। এ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সকলেই যেন অসীম ফায়েজ বরকত ও রহমত হাসিল করতে পারেন মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের সেই তৌফিক দান করুন। আমিন।


[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, রাজামেহার ইঞ্জিনিয়ার মঞ্জুরুল আহসান মুন্সী আদর্শ কলেজ, দেবিদ্বার, কুমিল্লা।]

সম্পর্কিত পোস্ট