Cancel Preloader

পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.): একটি বিশ্লেষণ

অধ্যক্ষ মো. নিয়ামুল কবির

হযরত রাসুল (সা.)-এর ওফাত লাভের পর আজ প্রায় ১৪৩৩ বছর (হিজরি সাল অনুযায়ী) চলছে। ওদিকে আরব সাগরের পানি বহু দূর গড়িয়েছে। এদিকে গঙ্গা নদীর পানি পদ্মা নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে কত কিউসেক তার ইয়ত্তা নেই! মহানবি (সা.)-এর ওফাত পরবর্তী যা কিছু বিবর্তিত (পরিবেশের পরিবর্তন) হয়েছে সবই বিদআত (নবসৃষ্ট)। ওফাত পরবর্তী যে মানুষগুলো জন্ম নিয়েছেন সকলই বিদআত। এর মধ্যে আমিও আপনিও। কেননা, দয়াল রাসুল (সা.)-এর সময় আপনিও ছিলেন না, আমিও ছিলাম না।

১০ই মহররম পবিত্র আশুরার শুক্রবার দিবসে পৃথিবীতে আগমন ঘটে আদি পিতা হযরত আদম (আ.) ও আদি মাতা হযরত হাওয়া (আ.)-এর, এ দিন স্বীয় সম্প্রদায়সহ লোহিত সাগর পাড়ি জমান হযরত মুসা (আ.), এ দিন হযরত ঈসা (আ.) ঊর্ধ্বাকাশে উত্থিত হন, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছে এ দিনে কিংবা ধ্বংস হবে এ দিনে। এরকম প্রায় ৫ হাজার বছর পূর্বের অনেক ঘটনা মনে আছে আপনার-আমার। অথচ কী আশ্চর্য! প্রায় ১৪৯৭ বছর পূর্বের দয়াল রাসুল (সা.)-এর জন্ম কিংবা ওফাতের দিন-তারিখ নিয়ে যত মতান্তর, তত বিভ্রান্তি! আরো মজার বিষয় হলো,  শ্রী কৃষ্ণের জন্মাষ্টমী বা বুদ্ধ পূর্ণিমা বা বৈশাখী পূর্ণিমা বা ঈশা মাসীহ্‌র বড়ো দিনের দিন-তারিখ নিয়ে তাদের স্ব-স্ব জাতির মধ্যে কোনো মতপার্থক্য নেই। যত মতান্তর মুসলমানদের মধ্যে। ঈদ অর্থ খুশি, মিলাদ অর্থ জন্ম, নবি মানে হযরত মোহাম্মদ (সা.) অর্থাৎ ঈদে মিলাদুন্নবি মানে হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর জন্মের খুশি। আবু লাহাবের মতো একজন কাট্টা কাফির দয়াল রাসুল (সা.)-এর জন্মে খুশি হয়ে দাসী মুক্ত করে দেন। হায় আফসোস! আমাদের মুসলিম সম্প্রদায়ের গোঁড়া ও রক্ষণশীল একটি অংশ ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.)-কে বিদআত সাব্যস্ত করে থাকেন!

এতদিন ধরে আমরা তোতা পাখির মতো মুখস্থ করে বলে আসছি যে, ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার দিবসটি হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর জন্মদিবস এবং ওফাত দিবস! বিষয়টি আসলে তা নয়। দিবস ও মাস একই, তারিখ ভিন্ন। আশ্চর্য হলেন? বেশিদূর যাওয়ার দরকার নেই। হাতের কাছে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ ২য় খন্ডের ৩২৯ পৃষ্ঠার ৩য় অনুচ্ছেদে দেখুন, “১ রবিউল আওয়াল সোমবার অপরাহ্নে (মতান্তরে পূর্বাহ্নে) ৬৩ বছর বয়সে হযরত রাসুল (সা.) ওফাত লাভ করেন।”১

একই কিতাবের ২৯২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে যে, হযরত মোহাম্মদ (সা.) ১২ই রবিউল আওয়াল তারিখে জন্মগ্রহণ করেন।২

পবিত্র হাদিসে বর্ণিত হয়েছে- “যে ব্যক্তি নিজের পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও অন্য সকল মানুষ অপেক্ষা আমাকে বেশি ভালো না বাসবে সে মু’মিন হতে পারবে না।” (বোখারি শরীফ ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা ৭; মুসলিম শরীফ ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা ৪৯)৩

ভালোবাসা বা মহব্বত করার মধ্যে যত আমল আছে তার মধ্যে অন্যতম আমল হলো দয়াল রাসুল (সা.)-এর জন্মদিনে খুশি বা মিলাদ অনুষ্ঠান পালন করা। মিলাদের ফজিলত এতো বেশি যে হযরত রাসুল (সা.)-এর জীবদ্দশাতেই সাহাবিগণের বাড়িতে ধুমধামের সাথে মিলাদ অনুষ্ঠিত হতো। এ মর্মে তাফসীরে জালালাইনের অন্যতম লেখক হযরত আল্লামা ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ূতি (রহ.) প্রণীত  “সাবিলুল হুদা ফি মাউলিদিল মুস্তফা” কিতাবে হাদিস উল্লেখ করা হয়েছে- “বিখ্যাত সাহাবি হযরত আবু দারদা (রা.) বর্ণনা করেন যে, তিনি একদিন রাসুল (সা.)-এর সাথে হযরত আমের আনসারী (রা.)-এর বাড়িতে গিয়ে দেখতে পেলেন, হযরত আমের (রা.) তাঁর ছেলে-মেয়ে ও আত্মীয়-স্বজনকে একত্রিত করে হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর শুভ জন্মদিনের বিবরণ শোনাচ্ছেন অতঃপর তিনি বলছিলেন- আজ সেই দিন (পবিত্র জন্মদিন)। তাঁর এ কাজে হযরত রাসুল (সা.) (অত্যন্ত আনন্দবোধ করলেন) এবং বললেন-হে আমের!  নিশ্চয় আল্লাহ্‌ তায়ালা তোমার জন্য তাঁর রহমতের দরজা খুলে দিয়েছেন এবং ফেরেশতারা তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। (যারা তোমার ন্যায় এমন কাজ করবে তারাও তোমার মতো ফজিলত পাবে)৪

হযরত ইমাম বোখারি (রহ.) বোখারি শরীফের ‘কিতাবুন নিকাহ’ অধ্যায়ে বর্ণনা করেন- “হযরত উরওয়া (রা.) বলেন- সুয়াইবা ছিলো আবু লাহাবের দাসি এবং আবু লাহাব তাকে [মোহাম্মদ (সা.)-এর শুভজন্মের সংবাদ দেওয়ার কারণে খুশি হয়ে] আজাদ করে দিয়েছিল। এরপর সে রাসুলুল্লাহ্‌ (সা.)-কে দুধ পান করায়। অতঃপর আবু লাহাব যখন মারা গেলো, তার একজন আত্মীয় তাকে স্বপ্নে দেখল যে, সে ভীষণ কষ্টের মধ্যে রয়েছে। তাকে জিজ্ঞেস করল, তোমার সাথে কীরূপ ব্যবহার করা হয়েছে? আবু লাহাব বলল- যখন তোমাদের থেকে দূরে রয়েছি, তখন থেকেই ভীষণ কষ্টে আছি। তবে দাসি সুওয়াইবাকে এই আঙ্গুলের ইশারায় (শাহাদাত অঙ্গুলি) আজাদ করার কারণে আমাকে পানীয় পান করানো হয়।” (বোখারী শরীফ ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭৬৪; ই.ফা.বা. কতৃর্ক অনূদিত, বোখারি শরীফ ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪০৪ ও ৪০৫, হাদিস নং ৪৭৩৪)৫

এ হাদিসের ব্যাখায় আল্লামা ইবনে হাজার আসকালীন (রহ.) তাঁর বিখ্যাত ফতহুল বারী কিতাবে বর্ণনা করেন- হযরত সুহাইলি (রা.) কর্তৃক হযরত আব্বাস (রা.) থেকে এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে- তিনি বলেন, আবু লাহাবের মৃত‍্যুর এক বছর পর তাকে স্বপ্নে দেখি যে, সে অত্যন্ত আজাবের মধ্যে আছে। তার অবস্থা সম্পর্কে আবু লাহাব জানায়, তোমাদের ছেড়ে আসার পর থেকে আমি শান্তির মুখ দেখিনি, তবে প্রতি সোমবার আমার আজাব লাগব করা হয়। হযরত আব্বাস (রা.) বলেন, তার এ আজাব লাগবের কারণ হলো: হযরত রাসুল (সা.)-এর জন্মদিন ছিল সোমবার, তাঁর শুভ জন্মের সুসংবাদ নিয়ে আসায় দাসী সুয়াইবাকে সে খুশি হয়ে মুক্তি দিয়েছিল। (ফতহুল বারী, ৯ম খন্ড, পৃষ্ঠা ১১৮)৬

হযরত রাসুল (সা.) হলেন সৃষ্টির মূল উপাদান। সৃষ্টিকুলের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই যেহেতু দয়াল রাসুল (সা.)-এর আবির্ভাব, সেহেতু তাঁর শুভ জন্মের দিন তথা পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.)-এর দিনটি আল্লাহ্‌ সুবাহানাহু তায়ালার নিকটও সবচেয়ে আনন্দময় দিন । তাই তিনি সবাইকে আনন্দ প্রকাশের নির্দেশ দিয়ে এরশাদ করেন-“[হে রাসুল (সা.)!] আপনি বলুন। আল্লাহ্‌র এ অনুগ্রহ ও রহমতে (রাসুল (সা.)-এর পে্র্ররণ) ও তাঁর দয়ার প্রতি আনন্দ প্রকাশ করা উচিত, তারা যে সম্পদ জমা করে তিনি [মোহাম্মদ (সা.)] এর থেকেও উত্তম। ” (সূরা ইউনুছ ১০: আয়াত ৫৮)৭

অন্যত্র বলেন- “নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ স্বয়ং ও তাঁর ফেরেশতারা নবির উপরে দর“দ পাঠ করেন, হে বিশ্বাসীগণ!  তোমরাও তাঁর উপরে দর“দ পড়ো এবং শ্রদ্ধার সাথে সালাম পেশ করো।” (সূরা আহযাব ৩৩: আয়াত ৫৬ )

উল্লিখিত আয়াতের ব্যাখ্যায় স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে, নবি (সা.)-এর উপর দর“দ পাঠ করা এবং তাজিমের সাথে সালাম পেশ করা (যা মিলাদ অনুষ্ঠানের নামান্তর) আল্লাহ্‌র হুকুম, যা ফরজ বলে সাব্যস্ত হয়েছে। সুতরাং প্রমাণিত হলো ফরজ কাজকে যে বা যারা বিদআত বলেন তারা ভুল প্রচার করছেন।

পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি-হযরত রাসুল (সা.)-এর শুভ জন্মদিন। কিন্তু এ দিনটি এদেশে সরকারিভাবে পালিত হতো সিরাতুন্নবি হিসেবে। মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনজীর্বনদানকারী সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্‌বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.),  হযরত রাসুল (সা.)-এর শুভ জন্মদিন পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.)-এর গুর“ত্ব তুলে ধরে এদিনকে ‘সৃষ্টিকুলের শ্রেষ্ঠ ঈদ’ হিসেবে ঘোষণা করেন। তাঁর বিখ্যাত উক্তি: ‘সৃষ্টিকুলের শ্রেষ্ঠ ঈদ দয়াল রাসুলের জন্ম ঈদ’ এবং ‘ঘরে ঘরে মিলাদ দিন, দয়াল রাসুলের শাফায়েত নিন’।

পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে তদানীন্তন সরকার এ দিনটি উদ্‌যাপনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে সিরাতুন্নবি বাতিল করে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) পালনের জন্য ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করে। ফলে সারা দেশে ১২ই রবিউল আউয়াল তথা পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) ধুমধামের সাথে পালিত হতে শুর“ করে।

ফারইস্ট ইউনিভার্সিটির ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ইমাম ড. কুদরত এ খোদা (মা. আ.) বলেন, এ পবিত্র খুশির দিনে আপনার আনন্দটুকু সমাজের অন্যান্যদের সাথে বেশি বেশি করে শেয়ার কর“ন।

সৌদি আরব, ইয়েমেন, মিশর, তুরস্ক, ইরান, মালয়েশিয়া, ইংল্যান্ড, লেবালন ও বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হচ্ছে।

সহায়ক গ্রন্থ:

  1. সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ ২য় খণ্ড পৃষ্ঠা ৩২৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, আগারগাঁও, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা-১২০৭, প্রথম প্রকাশ, এপি্রল ১৯৮২
  2. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৯২
  3. বিশ্বনবীর স্বরূপ উ˜ঘাটনে সূফী সম্রাট: রাসূল (সঃ) সত্যিই কি গরীব ছিলেন? পৃষ্ঠা ৩৫-৩৬, সূফী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, বাবে রহমত ভবন (৬ষ্ঠ তলা), ১৪৭ আরামবাগ, মতিঝিল, ঢাকা-১০০০, আধুনিক প্রকাশ: জানুয়ারী ২০১২
  4. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৪১-৪২
  5. মুক্তি কোন পথে?  পৃষ্ঠা ২৭
  6. বিশ্বনবীর স্বরূপ উ˜ঘাটনে সূফী সম্রাট: রাসূল (সঃ) সত্যিই কি গরীব ছিলেন? পৃষ্ঠা ৪৪
  7. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩০-৩১

[লেখক: অধ্যক্ষ, নবযুগ কলেজ, কুশুরা, ধামরাই, ঢাকা]

সম্পর্কিত পোস্ট