Cancel Preloader

পবিত্র শবে মি‘রাজ: একটি পর্যালোচনা

ড. মুহাম্মদ নাছিরউদ্দীন (সোহেল)
দোজাহানের বাদশাহ্ রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.)-এর গৌরবদীপ্ত জীবনে মি‘রাজের ঘটনাটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর জীবনে এই গৌরবময় ঘটনাটি নবুয়তের ১২তম বর্ষে ২৬ রজব দিবাগত রাতে তাঁর ৫২ বছর বয়সে সংঘটিত হয়। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে হযরত রাসুল (সা.) সশরীরে মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করেন। মাশুক ও তাঁর শ্রেষ্ঠ আশেকের এই মহিমান্বিত সাক্ষাতের ঘটনাটি প্রতিবছর বিশ্বের সকল মুসলমান গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সাথে স্মরণ করে লাইলাতুল মি‘রাজ উদ্যাপন করে থাকে।


মি‘রাজ কী?
মি‘রাজ আরবি শব্দ, যার বাংলা অর্থ দিদার, ঊর্ধ্বলোকে ভ্রমণ, পথ, সিঁড়ি, ঊর্ধ্বে আরোহণ ইত্যাদি। ইসলামি পরিভাষায়, হযরত রাসুল (সা.) কর্তৃক সশরীরে সজ্ঞানে জাগ্রত অবস্থায় বিশেষ বাহন বোরাকের মাধ্যমে মাসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আকসা হয়ে প্রথম আসমান থেকে একে একে ৭ম আসমান এবং সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত অতঃপর সেখান থেকে একাকী রফরফ বাহনে আরশে আজিম পর্যন্ত ভ্রমণ, মহান আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ লাভ করত কথোপকথনের মাধ্যমে স্বীয় উম্মতের জন্য সালাত লাভ করা এবং জান্নাত ও জাহান্নাম পরিদর্শন করে ফিরে আসার ঘটনা হলো মি‘রাজ।


পবিত্র কুরআনে মি‘রাজ সর্ম্পকে আল্লাহ্ বলেন, “আল্লাহ্ পবিত্র মহিমাময়, যিনি তাঁর বান্দা [মোহাম্মদ (সা.)]-কে রজনিতে পরিভ্রমণ (সায়ের) করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত যার চতুস্পার্শকে আমি বরকতময় করেছি- যাতে আমি তাঁকে দেখাই আমার নিদর্শন, নিশ্চয়ই তিনিু সবকিছু শোনেন, সবকিছু দেখেন।” (সূরা বনী ইসরাইল ১৭: আয়াত ১)


মি‘রাজের পটভূমি:
মি‘রাজের ঘটনার মাধ্যমে রাহমাতুল্লিল আলামিনের প্রতি রাব্বুল আলামিনের শাশ্বত ভালোবাসার এক অনুপম নিদর্শন প্রকাশ পায়। মি‘রাজ সংঘটিত হওয়ার পূর্বে হযরত রাসুল (সা.)-এর শ্রদ্ধেয় চাচা হযরত আবু তালেব (রা.) এবং প্রাণপ্রিয় স্ত্রী হযরত খাদিজা (রা.) একই বছরে ওফাত লাভ করেন। এই বছরকে ইসলামের ইতিহাসে ‘আমুল হুজুন’ (Year of Sorrow) অর্থাৎ শোকের বছর বলে আখ্যায়িত করা হয়। তাঁদের দুইজনকে হারিয়ে আল্লাহর রাসুল (সা.) শোক ও বেদনায় মুহ্যমান হয়ে পড়েন। সেই সময় তাঁর প্রতি কাফেরদের অত্যাচারের মাত্রাও বৃদ্ধি পায়। ফলে মক্কায় ইসলাম প্রচার করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিেিত তিনি তায়েফে ইসলাম প্রচার করতে যান। কিন্তু সেখানেও কোনো সাড়া পাননি, বরং চরম নির্যাতনের শিকার হন। ফলে হযরত রাসুল (সা.) অত্যন্ত ব্যথিত হয়ে পড়েন। তাই মহান আল্লাহ্ তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু হযরত রাসুল (সা.)-কে মি‘রাজের মাধ্যমে নিজের কাছে নিয়ে তাঁর প্রিয় বন্ধুর ব্যথিত হৃদয়কে প্রশান্ত করে তুলেন।


মি‘রাজের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ:
মি‘রাজের রজনিতে হযরত রাসুল (সা.) এবং মহান আল্লাহ্ দু’জনই খুব নিকটবর্তী হন। বিশ্বনবি হযরত রাসুল (সা.) মি‘রাজ রজনিতে মহান আল্লাহর সাথে এমনভাবে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলেন, যেভাবে তির ধনুকের সাথে মিশে যায়। মহান আল্লাহ্ এই প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন, “তাঁদের (আল্লাহ্ ও রাসুল) মধ্যে দুই ধনুকের ব্যবধান রইলো অথবা তারও কম। তখন আল্লাহ্ তাঁর বান্দার প্রতি যা ওহি করার তা ওহি করলেন।” (সূরা আল নাজম ৫৩: আয়াত ৯-১০) এ বিষয়ে হযরত রাসুল (সা.)-এরশাদ করেন, “যখন আমাকে (মি‘রাজের রজনিতে) আকাশ পরিভ্রমণ করানো হচ্ছিল, তখন মহিমান্বিত প্রতিপালক আল্লাহ্ আমার নিকটবর্তী হলেন, আর এ সময় তিনি আমার এতই নিকটবর্তী হলেন, যতখানি তির ধনুকের নিকটবর্তী হয়, অতঃপর তিনি আরো নিকটে এলেন।” (তাফসীরে দুররে মানছুর ১৫নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ২২৭)


মহান আল্লাহ্ ও তাঁর প্রিয় হাবিবের কথোপকথন এবং ৫ ওয়াক্ত নামাজের বিধান:
প্রথমেই মহান আল্লাহ্ বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে হযরত রাসুল (সা.)-কে বললেন, “হে মাহবুব (সা.)! বন্ধু যখন বন্ধুর বাড়ি আসে, তখন সাথে উপহার উপঢৌকন নিয়ে আসে। হে বন্ধু! আপনি তো আমারই আমন্ত্রণে আমার কাছে এসেছেন, তাহলে আজ আপনি আমার জন্য কী নিয়ে এসেছেন?” জবাবে হযরত রাসুল (সা.) বললেন, “হে দয়াময়! সকল অভিবাদন, পবিত্রতা ও নামাজ আপনার জন্য।” মহান রাব্বুল আলামিন আপন মাহ্বুবের এ প্রশংসা বাণী উপহার পেয়ে খুশি হলেন। অতঃপর তিনি জবাব দিলেন, “হে বন্ধু! আপনার উপর পরম শান্তি, রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক।” পরম প্রেমাস্পদ মহান আল্লাহর এ সালাম পেয়ে হযরত রাসুল (সা.) পরিপূর্ণরূপে খুশি হতে পারলেন না এজন্য যে, মহান আল্লাহ্ এ সালাম কেবল তাঁকেই উদ্দেশ্যে করে দিয়েছেন। অতঃপর হযরত রাসুল (সা.) আল্লাহর এ সালামের মধ্যে স্বীয় উম্মতের সৎকর্মশীল মু’মিনদের অন্তর্ভূক্ত করে বললেন, “[হে দয়াময়!] আপনার এ সালাম আমাদের এবং আমার (উম্মতের মধ্যে) যারা নেককার, পরহেজগার, (মুত্তাকি ও মু’মিন) বান্দাদের উপর বর্ষিত হোক।” মহান রাব্বুল আলামিন হযরত রাসুল (সা.)-এর এই উক্তিতে খুশি হলেন এবং প্রিয় বন্ধু যাদেরকে আল্লাহ্ এই সালামের অন্তর্ভুক্ত করেছেন তাদেরকে কবুল করে নিলেন। এতে হযরত রাসুল (সা.) খুশি হলেন। অতঃপর তিনি আল্লাহ্কে প্রাণ ভরে দেখে সামনাসামনি মহান মালিকের একত্ববাদের সাক্ষ্য দেন- “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, হযরত মোহাম্মদ (সা.) তাঁরই বান্দা ও রাসুল।”


এভাবে মহান আল্লাহ্ ও তাঁর প্রিয় হাবিব হযরত রাসুল (সা.)-এর কথোপকথনের মধ্য দিয়ে ৫ ওয়াক্ত নামাজের বিধান উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য ফরজ করা হয়। মি‘রাজের মাধ্যমে হযরত রাসুল (সা.) যেমন মহান আল্লাহর দিদার লাভ করে ধন্য হয়েছেন, উম্মতে মোহাম্মদীও নামাজের মাধ্যমে আল্লাহ্ তায়ালার দিদার লাভ করতে সক্ষম হবে। এজন্য সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান তাঁর প্রধান চারটি শিক্ষার মাঝে নামাজকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী নামাজ কায়েম করতে পারলে নামাজে হুজুরি দিল তথা একাগ্রচিত্তে নামাজ আদায় করা সম্ভব হয় এবং নামাজ মু’মিন ব্যক্তির জন্য মি‘রাজ এই হাদিসের বাস্তবতা উপলব্ধি করা যায়। মোহাম্মদী ইসলামের নেতৃত্বপ্রদানকারী মহামানব ইমাম প্রফেসর ড. আরসাম কুদরত এ খোদা (মা. আ.) হুজুর কেব্লা আশেকে রাসুলদেরকে ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের পরামর্শ প্রদান করে বলেন, “নামাজ হচ্ছে এমন একটি ইবাদত, যা বান্দাকে দিনে ৫ বার মহান প্রভুর সামনে হাজির করে স্বীয় কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনার শিক্ষা দেয়।”

ইমামুল মুরসালিন মর্যাদায় অধিষ্ঠিত
মি‘রাজের মাধ্যমে হযরত রাসুল (সা.) আনুষ্ঠানিকভাবে ইমামুল মুরসালিন মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হন। নবুয়তের দ্বাদশ সালে মানবতার মুক্তির দিশারি রাহমাতুল্লিল আলামিন ২৬ রজব দিবাগত রাতে মি‘রাজের অর্থাৎ মাওলার সাথে দিদারের প্রাক্কালে মক্কা মোকাররমা থেকে বাইতুল মোকাদ্দাসে তশরিফ নেন। সেখানে পূর্ব থেকে সকল নবি-রাসুল তাঁকে সম্ভাষণ জানানোর জন্য সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন। হযরত রাসুল (সা.)-এর শুভাগমনের সাথে সাথে তাঁরা সবাই পরম শ্রদ্ধার সাথে ‘আস্সালামু আলাইকা ইয়া আউয়্যালিনা ওয়াল আখিরিন’ বলে তাঁকে সালাম পেশ করেন। সেসময় প্রত্যেক নবি-রাসুল আনন্দচিত্তে বলছিলেন, “মারহাবা ইয়া রাসুলাল্লাহ্! মারহাবা ইয়া হাবিবাল্লাহ্!!’ অতঃপর মহান আল্লাহর নির্দেশে হযরত রাসুল (সা.)-এর ইমামতিতে সকল নবি-রাসুল দুই রাকাত সালাতুল ইসরা অর্থাৎ ভ্রমণের নামাজ আদায় করেন। এই নামাজের মাধ্যমেই আল্লাহর রাসুল সকল নবি-রাসুলের ‘ইমাম’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। এই জন্য সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজান মোহাম্মদী ইসলামের মিলাদ শরীফে কিয়ামের অংশে হযরত রাসুল (সা.)-কে ‘ইয়া ইমাম’ সম্বোধন করেছেন। উল্লেখ্য যে, মি‘রাজের রজনিতে সপ্ত আকাশ সায়েরের সময় হযরত রাসুল (সা.)-এর সাথে প্রথম আকাশে হযরত আদম (আ.)-এর সাক্ষাত পান। হযরত ইদ্রিস (আ.), হযরত মুসা (আ.), হযরত ঈসা (আ.) ও হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এরও সাক্ষাৎ পেলেন। (ই.ফা.বা. কর্তৃক অনূদিত বোখারি শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২০০-২০১) সেসময় তাঁরা প্রত্যেকেই পরম আনন্দের সাথে হযরত রাসুল (সা.)-কে আন্তরিক মোবারকবাদ জানান।


পরিশেষে বলা যায় যে, মুসলিম উম্মাহর নিকট পবিত্র শবে মি‘রাজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনস্বীকার্য। এ বছর ২৮ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে বাংলাদেশে শবে মি‘রাজ পালিত হবে। প্রতি বছর দেওয়ানবাগ শরীফের পক্ষ থেকে শবে মি‘রাজ উদ্যাপিত হয়ে থাকে। সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজানের ভক্ত মুরিদান আশেকে রাসুলেরা যথাযথ মর্যাদার সাথে ইবাদত বন্দেগির মধ্য দিয়ে শবে মি‘রাজ পালন করে থাকেন। মহান আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে যথাযথ মর্যাদায় লাইলাতুল মি‘রাজ পালনের তৌফিক এনায়েত করুন। আমিন।


[লেখক: ইসলামি গবেষক; সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, দি পিপলস্ ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ]
তথ্যসূত্র:
১। আল কুরআন
২। আল হাদিস
৩। তাফসীরে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী, ১ম খণ্ড; সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান
৪। সূফী সম্রাটের যুগান্তকারী অবদান: আল্লাহ্ কোন পথে?; সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান
৫। আত্মার বাণী, মার্চ সংখ্যা ২০২০ইং এর সম্পাদকীয়
৬। আত্মার বাণী মার্চ সংখ্যা ২০২০ইং এবং মার্চ সংখ্যা ২০২১ইং ঢাকা থেকে প্রকাশিত

সম্পর্কিত পোস্ট