Cancel Preloader

পরমাত্মা ও জীবাত্মা: তাসাউফভিত্তিক পর্যালোচনা


ইমাম প্রফেসর ড. আরসাম কুদরত এ খোদা

আমার মহান মোর্শেদ মহান সংস্কারক মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজানের প্রথম শিক্ষা হলো আত্মশুদ্ধি (Self-purification)। আত্মশুদ্ধি বলতে বুঝায় নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করা, কলুষমুক্ত করা। আত্মা বলতে সত্তাকে (Entity) বুঝায়।

মানুষের মূল চালিকা শক্তিই হলো আত্মা। আত্মা প্রধানত দুভাগে বিভক্ত, যথা-

১। নফ্স তথা জীবাত্মা, যা আবার তিনভাগে বিভক্ত, যথা ১) পশুর আত্মা ২) হিংস্র জন্তুর আত্মা ও ৩) শয়তানের আত্মা

২। রূহ বা পরমাত্মা, এটি আবার দুই ভাগে বিভক্ত, যথা ১) মানবাত্মা ও ২) ফেরেশতার আত্মা।

একটি শিশু যখন মানবকোলে জন্মগ্রহণ করে তখন তার আত্মা পরিশুদ্ধ থাকে। সেই শিশুর মাঝে তখন রূহ বা পরমাত্মার সম্পূর্ণ প্রভাব থাকে। ফলে শিশুটি থাকে নিষ্পাপ অর্থাৎ সে থাকে পাপমুক্ত। কিন্তু ঐ শিশুটি যখন ধীরে ধীরে বড়ো হতে থাকে, তখন তার মাঝে নফ্স তথা জীবাত্মার প্রভাব বিস্তার শুরু হয়। জীবাত্মাকে বেষ্টন করে রাখে ষড়রিপু (Six Instincts)।

ষড়রিপু হচ্ছে কাম (Lust), ক্রোধ (Anger), লোভ (Greed), মোহ (Illusion), মদ (Vanity) ও মাৎসর্য (Envy)।

কামের কারণে মানুষ ব্যভিচারে লিপ্ত হয়; ক্রোধের কারণে ঝগড়া, বিবাদ, রক্তাপাত ঘটায়; লোভের কারণে পরের বস্তু আত্মসাৎ করার প্রবৃত্তি (Propensity) সৃষ্টি হয়; মোহের কারণে দুনিয়ার মায়ায় ডুবে থাকে; মদের কারণে অশ্লিল আনন্দে বিভোর থাকে এবং মাৎসর্য রিপুর কারণে ঈর্ষা, হিংসা, পরশ্রীকাতরতার সৃষ্টি হয়। শিশুর বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে পরিবেশ ও পরিপার্শ্বিকতার কারণে পরমাত্মার প্রভাব কমতে থাকে, আর জীবাত্মার কার্যকারীতা বৃদ্ধি পায়। মূলত পরিবার ও বাহ্যিক পারিপার্শ্বিকতা থেকে শিশু জীবাত্মার খোরাক পেয়ে থাকে, অর্থাৎ সে মিথ্যা বলা শিখে, অন্যায় অত্যাচার শিখে। এভাবে চলতে থাকলে একটা সময় পরমাত্মা তার প্রয়োজনীয় উপাদান ফায়েজের (Flow of Love) অভাবে নিস্তেজ হয়ে যায়, অন্যদিকে জীবাত্মা ক্রমশই শক্তিশালী হয়ে উঠে। অথচ মানুষের মধ্যে রূহ বা পরমাত্মা বিদ্যমান থাকায় মানুষ সৃষ্টির সেরা। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ বলেন, “যখন আমি তাঁকে [আদম (আ.)-কে] সুঠাম করব এবং তাঁর মধ্যে আমার রূহ থেকে রূহ ফুঁকে দেবো, তখন তোমরা (ফেরেশতারা) তাঁকে সিজদা করবে।” (সূরা আল হিজর ১৫: আয়াত ২৯) আর এই রূহ বা পরমাত্মাই যদি নিস্তেজ থাকে তাহলে মানুষ ও অন্য প্রাণীর মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। পশুর মধ্যে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য- এই ষড়রিপুর বিদ্যমান থাকে, কিন্তু পশুর মধ্যে রূহ বা পরমাত্মা ফুঁকে দেওয়া হয়নি। এখানেই মানুষ এবং পশুর মধ্যে পার্থক্য। মানুষ তাঁর রূহ বা পরমাত্মাকে দুর্বল করে রাখে বিধায় জীবাত্মা হয়ে উঠে শক্তিশালী, ফলে সে পশুর মতো আচরণ করে, পরিবার ও সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করে। আত্মশুদ্ধি লাভ না করায় সে সমাজের জন্য হয়ে উঠে হুমকিস্বরূপ।


জীবাত্মা ও পরমাত্মা সম্পর্কে সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) বলেন, “মানুষের জন্ম প্রক্রিয়ায় পিতার শুক্রকীট থেকে যে সত্তার জন্ম হয় এবং যা দেহের ষড়রিপুতে পরিণত হয়, এটাই জীবাত্মা। আর মায়ের উদরে সন্তান মানবাকৃতি লাভ করার পর আল্লাহর যে সত্তা রূহ হিসেবে মানবের ভেতরে ফুঁকে দেওয়া হয়, এটিই পরমাত্মা। জীবের জন্ম প্রক্রিয়ার বিচারে মানুষ এবং অন্যান্য জীবের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই।” (মুক্তি কোন পথে? পঞ্চম সংস্করণ, পৃষ্ঠা ১৭৪) সুতরাং বিষয়টি সুস্পষ্ট যে, মানুষের মাঝে পরমাত্মা ও জীবাত্মা উভয়ই বিদ্যমান। তবে মানুষ সাধনা ও রিয়াজতের মাধ্যমে জীবাত্মাকে পরমাত্মার অধীনস্থ করতে সক্ষম হয়। এই কর্মটি সফলভাবে সম্পন্ন করতে পারলেই মানুষ আশরাফুল মাখলুকাতের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো মানুষ কীভাবে তার পরমাত্মা দ্বারা নিজেকে পরিচালিত করতে পারে? পরমাত্মাকে শক্তিশালী করার জন্য আল্লাহর প্রেরিত আধ্যাত্মিক শিক্ষক তথা মোর্শেদের (Spiritual Guide) সহবতে যাওয়া প্রয়োজন। মোর্শেদ তথা পথপ্রদর্শক হলেন নবুয়তের যুগে নবি-রাসুলগণ এবং বেলায়েতের যুগে অলী-আল্লাহ্গণ। মোর্শেদের গুরুত্ব সম্পর্কে মহিমান্বিত আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন, “আল্লাহ্ যাকে গোমরাহ করেন, আপনি কখনো তার জন্য (মোর্শেদ) পথপ্রদর্শনকারী অভিভাবক পাবেন না।” (সূরা আল কাহ্ফ ১৮: আয়াত ১৭)


মোর্শেদের সহবতে যাওয়ার পর মোর্শেদ তাঁর মুরিদকে (Disciple) আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে জীবাত্মাকে নিয়ন্ত্রণ করার পদ্ধতি শিক্ষা দেন। মোর্শেদ প্রতি ওয়াক্ত নামাজের পর মোরাকাবা (Spiritual Meditation) করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। মোর্শেদের পরামর্শ অনুযায়ী মুরিদ যখন দুনিয়ার সকল কিছু ভুলে গিয়ে মোরাকাবায় বসেন, তখন মোর্শেদের পক্ষ থেকে মুরিদের কলুষিত অন্তরে ফায়েজ বর্ষিত হয়। এভাবে ফায়েজ অবতীর্ণ হতে থাকলে মুরিদের কলুষিত অন্তরটা ধীরে ধীরে আলোকিত হয়ে উঠে। একপর্যায় মুরিদ তার ক্বালবে তথা অন্তরে আপন মোর্শেদের জ্যোতির্ময় (Luminous) চেহারা মোবারক দেখার সৌভাগ্য অর্জন করে থাকে। এভাবে প্রতিনিয়ত মোরাকাবা করতে থাকলে একপর্যায় মুরিদ তাঁর মহান মোর্শেদের অসিলায় (Seeking means of nearness to Allah) তাঁর ক্বালবে রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.)-কে দেখতে পান। তখন হযরত রাসুল (সা.)-এর অসিলা ধরে ক্বালবের মাঝে দয়াময় মহান আল্লাহ্কে খুঁজে বের করতে হয়। অতঃপর দয়াময় আল্লাহর নিকট থেকে ফায়েজ ভিক্ষা নিতে হয়। তখন ঐ ফায়েজ আল্লাহ্ তায়ালার জাত পাক হতে দোছরা দায়রা হয়ে হযরত রাসুল (সা.)-এর দিল মোবারক হয়ে আপন মোর্শেদের দিল মোবারক হয়ে মুরিদের ক্বালবের মাঝে পড়ে। আর ঐ ফায়েজ যখন মুরিদের অন্তরে পড়ে, তখন মুরিদের অন্তরের কলুষিত দাগগুলো আস্তে আস্তে উঠতে থাকে। সেসময় মুরিদ চোখ বন্ধ করলে অন্ধকার দেখে না, তখন মুরিদ নুর বা আলো দেখতে পায়, আবার কখনো কখনো সেই আলোটা চলে যায়। অনেক সময় ঐ আলো চলে যাওয়ার ফলে মুরিদ ধৈর্য হারিয়ে ফেলে। কিন্তু সেসময় ধৈর্যচ্যুত না হয়ে আরো দীর্ঘ সময় মোরাকাবায় বসে ফায়েজ খেয়াল করতে হয়। এভাবে মোরাকাবারত থাকলে একপর্যায় ঐ অন্ধকার আস্তে আস্তে দূরীভূত হয়ে যায়। নিজের ক্বালবের ভেতরে যখন অন্ধকার দূর হয়ে নুর বা আলোটা বিকাশ লাভ করে, তখন ঐ প্রজ্বলিত নুর মুরিদের ক্বালবকে আল্লাহময় করে তোলে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মুরিদের ক্বালব আলোকিত হয়ে উঠে। এভাবে মুরিদের জীবাত্মা, যা ষড়রিপু দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে, তা দমন হয়ে যায় এবং নিজ ক্বালবের মাঝে পরমাত্মার প্রভাব বৃদ্ধি পায়। পরমাত্মার প্রভাব বাড়তে থাকলে মুরিদ আল্লাহময় জগতে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। এই পর্যায় মুরিদের মাঝে আল্লাহ্ তায়ালার গুণগুলো প্রকাশ পেতে থাকে এবং ক্বালবের মধ্যে পরমাত্মার রাজত্ব সৃষ্টি হয়।


মূলত জীবাত্মাকে বশীভূত করার জন্য ষড়রিপুর সূক্ষ্ম শক্তিকে খারাপ পথ থেকে ফিরিয়ে দয়াময় আল্লাহর প্রেমে নিমগ্ন করার জন্য ফায়েজের সূক্ষ্মশক্তির প্রয়োজন হয়। কোনো ব্যক্তি একাকী সাধনা করে এই ফায়েজ হাসিল করতে পারে না। এক্ষেত্রে মোর্শেদের সান্নিধ্যে গমন ও তাঁর পরামর্শনুযায়ী আমল করা অত্যাবশ্যক। সাধনায় নিমগ্ন হয়ে আপন মোর্শেদের চেহারা মোবারক খেয়াল করে মোরাকাবা করলে মোর্শেদের পক্ষ থেকে ফায়েজ মুরিদের ক্বালবে বর্ষিত হয়। এর ফলে ষড়রিপু ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। মূলত ইরেজার দিয়ে যেমন যে কোনো লেখা মুছা যায়, ঠিক তেমনি মোর্শেদের ফায়েজ হচ্ছে ইরেজারের মতো, যা গুনাহার ময়লাকে ধীরে ধীরে হৃদয় থেকে মুছে দেয়। মুরিদ তখন পরিশুদ্ধ আত্মার অধিকারী হতে সক্ষম হয়।


পরামাত্মাকে বিজয়ী করার জন্য প্রত্যেক মুরিদকে মোহাম্মদী ইসলামের সবক (Spiritual Lesson) নেওয়ার পর তার প্রধান কাজ হলো মোর্শেদের প্রতি আনুগত্য (Allegiance) করা, হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রতি আনুগত্য করা এবং আল্লাহ্তে আনুগত্য করা। এই প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “যে ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর আনুগত্য করে, সে তো আল্লাহর আনুগত্য করল।” (সূরা নিসা ৪: আয়াত ৮০) আল্লাহ্ আরো বলেন, “হে মু’মিনগণ! তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর, আনুগত্য করো রাসুলের এবং আনুগত্য করো তাঁদের, তোমাদের মধ্যে যাঁরা (আল্লাহর সাথে যোগাযোগ করে) নির্দেশ প্রদানে সক্ষম।” (সূরা আন নিসা ৪: আয়াত ৫৯) এভাবে আনুগত্য ও আত্মসমর্পণ এবং মোর্শেদের দেওয়া নিয়মানুযায়ী মোরাকাবা করে নিজেকে চরিত্রবান বানানো সম্ভব।

মহান আল্লাহ্ মানুষের কলুষিত ক্বালবকে পরিষ্কার করার জন্য যুগে যুগে তাঁর বন্ধুদেরকে মোর্শেদরূপে প্রেরণ করে থাকেন। এই প্রেরণের উদ্দেশ্য হলো মানুষ যেন আল্লাহর বন্ধুদের সাথে প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আল্লাহর বন্ধুর এশকে দেওয়ানা হয়ে নিজের ভুলগুলো দূর করে সিরাতুল মোস্তকিমের পথে পরিচালিত হতে পারে। মোর্শেদবিহনে আল্লাহ্কে পাওয়া যায় না এবং জীবাত্মাকে পরিশুদ্ধও করা যায় না। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “হে মু’মিনগণ! আল্লাহ্কে ভয় করো, তাঁর নৈকট্য লাভের জন্য অসিলা অন্বেষণ করো।” (সূরা আল মায়িদাহ ৫: আয়াত ৩৫) আর অসিলা ছিলেন নবুয়েতের যুগে নবি-রাসুলগণ এবং বেলায়েতের যুগে অসিলা হলেন অলী-আল্লাহ্গণ।

সুতরাং ষড়রিপুর বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে আত্মশুদ্ধি লাভ করার জন্য মোর্শেদের সাহচর্যে যাওয়া অপরিহার্য। আইয়ামে জাহেলি যুগের বর্বর মানুষেরা হযরত রাসুল (সা.)-এর সহবতে এসে আদর্শ চরিত্রের অধিকারী হতে সক্ষম হয়েছেন। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ আদর্শ চরিত্রবান ব্যক্তিকে সফল বলে উল্লেখ করেছেন। এই প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে “অবশ্যই সফলকাম হয়েছে সে, যে ব্যক্তি নিজেকে পরিশুদ্ধ করেছে। আর অবশ্যই ব্যর্থ হয়েছে সে, যে ব্যক্তি নিজেকে পাপাচারে কলুষিত করেছে।” (সূরা আশ শামস ৯১: আয়াত ৯ ও ১০) এছাড়া আল্লাহ্ আরো বলেন, “নিশ্চয়ই সাফল্য লাভ করবে সে, যে আত্মশুদ্ধি লাভ করবে।” (সূরা আল আ‘লা ৮৭: আয়াত ১৪)


মূলত আত্মশুদ্ধির শিক্ষা ব্যতীত জীবাত্মাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। দেহের মাঝে পরমাত্মার রাজত্ব কায়েম করার জন্য উত্তম চরিত্র মাধুর্যের অধিকারী হতে হয়। আত্মশুদ্ধি সকল ইবাদতের মূল বুনিয়াদ। ক্বালব বা হৃদয়ের পবিত্রতা ও অপবিত্রতা নির্ভর করে আত্মশুদ্ধির উপর। এ প্রসঙ্গে হযরত নু‘মান ইবনে বশীর (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, “জেনে রাখো, নিশ্চয় মানবদেহের মাঝে একটি মাংসের টুকরা রয়েছে, সেটি যখন ঠিক হয়ে যায়, অর্থাৎ পবিত্র হয়ে যায়, তখন গোটা মানবদেহ পবিত্র হয়ে যায়। আর তা যখন খারাপ হয়ে যায়, তখন গোটা মানবদেহ খারাপ হয়ে যায়। জেনে রেখো, সেই মাংসের টুকরোটি হলো ক্বালব (হৃদয়)।” (বোখারী শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৩; ই.ফা.বা. কর্তৃক অনূদিত বোখারী শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৯ ও ৪০)


তাই আমার মহান মোর্শেদ সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান আত্মশুদ্ধির সাথে ক্বালবে আল্লাহর জিকির (Dhikr of Allah in the Qalb) জারির শিক্ষা দিয়ে গেছেন। ক্বালবে আল্লাহর জিকির জারি হলে মানুষ গোমরাহি থেকে মুক্তি লাভ করতে সক্ষম হয় এবং ক্বালবে নুরে ইমান লাভ করে ইসলামের প্রকৃত শান্তি বাস্তবে উপলদ্ধি করতে পারে। ক্বালবে আল্লাহর জিকির জারি করার অর্থই পরমাত্মাকে জীবাত্মার উপর বিজয়ী করা। মূলত ক্বালব বা হৃদয়ে জিকির জারির মধ্য দিয়ে দিল জিন্দা (Activate Dhikr in the Qalb) করা হয়।

এই প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “দুর্ভোগ তাদের জন্য, যাদের ক্বালব বা হৃদয় কঠোর, আল্লাহ্র জিকির থেকে গাফেল বা বিমুখ। তারা রয়েছে প্রকাশ্য গোমরাহিতে।” (সূরা আঝ ঝুমার ৩৯: আয়াত ২২) এমনিভাবে মহিমান্বিত আল্লাহ্ ওহির বাণী আল কুরআনের অন্য আয়াতে এরশাদ করেন, “যারা ইমান আনে এবং আল্লাহর জিকিরে যাদের ক্বালবে প্রশান্তি লাভ করে; জেনো রেখো আল্লাহর জিকিরেই কেবল ক্বালব প্রশান্তি লাভ করে।” (সূরা আর রা‘দ ১৩: আয়াত ২৮)


মূলত সাধনার কেন্দ্রবিন্দু হলো ক্বালব। কেননা মহাগ্রন্থ আল কুরআন ও হাদিসের বর্ণনা অনুসারে প্রতীয়মান হয় যে, কুমন্ত্রণাদাতা শয়তান যেমন ক্বালবের প্রথম স্তর সুদুরের মোকামে অবস্থান করেন, তদ্রুপ নুরময় সত্তা আল্লাহ্ ক্বালবের সপ্তম স্তর নাফসির মোকামে অবস্থান করে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ ফরমান, “আমি (আল্লাহ্) তোমাদের (ক্বালবের সপ্তম স্তর) নাফসির মোকামে বিরাজ করি, তোমরা কি দেখো না?” (সূরা আয যারিয়াত ৫১: আয়াত ২১) অপরদিকে ক্বালবের প্রথম স্তর সুদুরের মোকামে শয়তান অবস্থান করে মানুষের হৃদয়ে কুমন্ত্রণা দিয়ে থাকে। এই প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে ফরমান, “যে (শয়তান) মানুষের (ক্বালবের প্রথম স্তর) সুদুরের মোকামে থেকে ওয়াসওয়াসা (কুমন্ত্রণা) দিয়ে থাকে।” (সূরা আন নাস ১১৪: আয়াত ৫)


আদর্শ চরিত্রের অধিকারী হওয়ার জন্য শয়তানকে বিতাড়িত করার সাধনা যেমন ক্বালবকে ঘিরে, তেমনি আল্লাহর সুপ্ত নুর জাগ্রত করে, তাঁর রূপ দর্শন এবং পূর্ণ মু’মিনে পরিণত সাধনাও ঐ একই ক্বালবকে ঘিরে। ক্বালব প্রসঙ্গে হযরত রাসুল (সা.) বহু হাদিস বর্ণনা করেছেন। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর (রা.) এবং হযরত আবু হুরায়রাহ (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে, তাঁরা বলেন- হযরত রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, “যখন মানুষের ক্বালব ভালো অর্থাৎ পরিশুদ্ধ হয়ে যায়, তখন তার গোটা শরীর পরিশুদ্ধ হয়ে যায়, আর যখন মানুষের ক্বালব খারাপ তথা দুষ্কর্মময় হয়ে পড়ে, তখন পুরো শরীরটিই খারাপ হয়ে যায়।” (তাফসীরে মিজান, ১৫নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০৮) এছাড়া পবিত্র কুরআনে মহিমান্বিত আল্লাহ্ বিশুদ্ধ ক্বালবের গুরুত্ব প্রসঙ্গে বলেন, “যেদিন ধন সম্পদ ও সন্তানসন্ততি কোনো কাজে আসবে না, সেদিন উপকৃত হবে কেবল সে, যে আল্লাহর নিকট আসবে ক্বালবে সালিম তথা বিশুদ্ধ অন্তর নিয়ে।” (সূরা আশ শু‘আরা ২৬: আয়াত ৮৮ ও ৮৯)


সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান ক্বালব সর্ম্পকে বলেন, “আল্লাহ্ প্রাপ্তির পথে সাধকের যাবতীয় আধ্যাত্মিক উন্নতির সোপান তার ক্বালবকে ঘিরে রচিত। সুতরাং তার এ সাধনার জন্য আপন ক্বালবের সঠিক অবস্থান জানা খুব জরুরি। ক্বালবের অবস্থান সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান না থাকলে, ব্যক্তির যাবতীয় ধ্যান খেয়াল বিফল হবে। এজন্যই নায়েবে রাসুল কামেল অলী, আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর সুন্নত তরিকা অবলম্বনে মুরিদকে সবক দেওয়ার সময় আঙ্গুল দিয়ে তার ক্বালবের সঠিক স্থান চিহ্নিত করে দিয়ে থাকেন।” (মুক্তি কোন পথে? পঞ্চম সংস্করণ, পৃষ্ঠা ১৩৫)


পরিশেষে মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা- তিনি যেন সবাইকে আত্মশুদ্ধি ও দিলজিন্দার মাধ্যমে পরমাত্মাকে জীবাত্মার উপর বিজয়ী হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমিন।


[লেখক: মোহাম্মদী ইসলামের নেতৃত্ব প্রদানকারী ইমাম; পরিচালক, সমন্বয়ক ও সমস্যার ফয়সালাকারী, দেওয়ানবাগ শরীফ; প্রফেসর, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি]

সম্পর্কিত পোস্ট