Cancel Preloader

মরমি সাধক মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি (রহ.)

ড. সৈয়দ মেহেদী হাসান
মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি (রহ.) প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় জগতে অতি পরিচিত এক আধ্যাত্মিক সাধক ও মানবতাবাদী কবি। তিনি ১২০৭ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর, ৬০৪ হিজরি, ৬ই রবিউল আওয়াল বর্তমান আফগানিস্তানের বালখ নগরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মাওলানা সুলতান বাহাউদ্দিন ওয়ালাদ (রহ.)। তিনি ছিলেন সেই সময়ের একজন বিখ্যাত আলেম, সুফিসাধক ও প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাঁর পাণ্ডিত্যের কারণে তাঁকে ‘সুলতানুল উলামা’ (জ্ঞানীদের সম্রাট) বলা হতো। মাওলানা রুমি (রহ.)-এর মাতা ছিলেন আলাউদ্দিন মুহাম্মদ খাওয়ারয্ম শাহ্-এর কন্যা। তাঁর নাম মালাকায়ে জাহান। খাওয়ারয্ম শাহ্ ছিলেন খোরাসান হতে ইরাক পর্যন্ত বিশাল সাম্রাজ্যের প্রতিপত্তিশালী বাদশাহ।


মাওলানা রুমি (রহ.)-এর জন্মের পাঁচ বছর পর তাঁর পিতা তাঁকে তৎকালীন আধ্যাত্মিক গুরু হযরত শেখ ফরিদ উদ্দিন আত্তার (রহ.)-এর সাথে সাক্ষাতের জন্য নিয়ে যান। ফরিদ উদ্দিন আত্তার (রহ.) বলেন, “অদূর ভবিষ্যতে এ ছেলে সমাজের বিজ্ঞ ও বিদ্বানদের সচেতন আত্মাকে আলোকিত করবে।” হযরত আত্তার (রহ.) এই বালক সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেন, “এই বালকের যত্ন নিও, অচিরেই তাঁর উষ্ণ নিঃশ্বাসে উত্থিত প্রেমের আগুন দিয়ে এই পৃথিবীর প্রেমিকদের পোড়াবে।” এছাড়াও আত্তার (রহ.) স্বীয় বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আসরার নামেহ্’ বালক রুমিকে স্নেহাশীষ উপহার দেন।


মাওলানা রুমি (রহ.)-এর পিতা বাহাউদ্দিন (রহ.) অত্যন্ত বিদ্বান, তেজস্বী বক্তা এবং অসামান্য ধর্মনিষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন। সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁর অসংখ্য ছাত্র ও ভক্ত ছিল। তিনি রাজ-পরিবারে বিয়ে করেছিলেন। স্বয়ং সুলতান ছিলেন তাঁর একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত। এই অভিজাত ও জ্ঞানপূর্ণ পরিবেশেই রুমি (রহ.)-এর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়েছিল। তিনি তাঁর পিতার কাছ থেকে পবিত্র কুরআন, হাদিস ও ইসলামের অন্যান্য শাখায় প্রভূত জ্ঞান অর্জন করেন।


মাওলানা রুমি (রহ.) মাত্র ১৮ বছর বয়সে বিয়ে করেন এবং ১৯ বছর বয়সে তাঁর প্রথম সন্তানের জন্ম হয়। তাঁর সন্তানদের মধ্যে দু’জনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথম সন্তান সুলতান ওয়ালাদ (রহ.) এবং অপর সন্তান আলাউদ্দিন (রহ.)। সুলতান ওয়ালাদ (রহ.) পিতার অনুগত ছিলেন এবং পরবর্তীকালে তাঁর আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারী মনোনীত হন।
‘মানাকেবুল আরেফিন’ এর বর্ণনা অনুযায়ী মাওলানা রুমি (রহ.)-এর ওস্তাদ সৈয়দ বুরহান উদ্দীন (রহ.) তাঁকে বিভিন্ন জ্ঞানে পরীক্ষা নেন এবং সাথে সাথে তিনি তাঁকে দীক্ষা দানে ব্রতী হন। সৈয়দ বুরহান উদ্দীন (রহ.) তাঁকে সাহিত্য ও শরিয়ত বিষয়ক জ্ঞান অর্জনের জন্য হালাব শহর সফর করার জন্য অনুপ্রাণিত করেন। মাওলানা রুমি (রহ.) হালাব শহরে প্রসিদ্ধ ফকিহ কামাল উদ্দীন ইবনুল আদিমের কাছে হানাফি ফিকাহ্শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। এরপর উচ্চতর শিক্ষা অর্জনের জন্য দামেস্কে অবস্থান করেন। জানা যায় সেখানেই তিনি শেখ মুহিউদ্দীন আল আরাবী (রহ.)-এর সাক্ষাৎ লাভ করেন। ‘জাওয়াহেরুল আসরার’ গ্রন্থের প্রণেতা কামাল উদ্দীন হুসাইন খারাযমি লিখেছেন যে, মাওলানা রুমি (রহ.) যখন দামেস্কের মাহরুসায় ছিলেন, তখন কিছুদিন মালেকুল আরেফিন শেখ মুহিউদ্দীন আরাবী (রহ.)-এর সাহচর্য লাভ করেন এবং এমন সব হাকিকত ও রহস্যজ্ঞান পরস্পরের সাথে আলোচনা করেন যার বর্ণনা অনেক দীর্ঘ হবে। সাত বছর ধরে সাহিত্য ও শরিয়ত বিষয়ক জ্ঞান অর্জনের পর মাওলানা রুমি (রহ.) পুনরায় কুনিয়ায় ফিরে আসেন।


রুমি (রহ.)-এর পিতা বাহাউদ্দিন (রহ.)-এর প্রভাব প্রতিপত্তি এত ব্যাপক ছিল যে, খাওয়ারিজমের বাদশাহ পর্যন্ত তাঁর প্রতি ঈর্ষান্বিত হন। ফলে বাহাউদ্দিন (রহ.) সপরিবারে মাতৃভূমি বালখ ত্যাগ করে হেরাত ও তুসের পথ ধরে ১২১৯ সালে ইরানের নিশাপুরে এসে উপনীত হন। এছাড়াও শাসক শ্রেণির অত্যাচার ও ধ্বংসযজ্ঞের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এ সময় হাজার হাজার লোক দেশ ত্যাগ করতে থাকেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, মাওলানা রুমি (রহ.)-এর জন্মের আগে-পরে খ্রিষ্টানদের ক্রসেড, মঙ্গোলদের আক্রমণে মুসলিম বিশ্বে অস্থিরতা বিরাজ করছিল, তখন পরিবারের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে তাঁর পিতা বাহাউদ্দিন (রহ.) পরিবার-পরিজন ও কিছু সঙ্গী নিয়ে পশ্চিমাভিমুখে রওনা দেন। আফগানিস্তান পাড়ি দিয়ে ইরানের নিশাপুর, দামেস্ক হয়ে মক্কা, মদীনায় পাড়ি জমান। পবিত্র হজব্রত পালনসহ সেখানে কিছু দিন অবস্থান করেন। পরে এখানে ওখানে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু দিন অবস্থানের পর তুরস্কের কুনিয়ায় স্থায়ী হন। সময়ের পরিক্রমায় তিনি তাঁর বাবার মতো পাণ্ডিত্য অর্জন করেন এবং তাঁর বাবার মৃত্যুর পর ২৫ বছর বয়সে একটি মাদ্রাসায় পিতার স্থলাভিষিক্ত হন।


১২৩০ সালে পিতার মৃত্যুর পর স্বীয় ওস্তাদ সাইয়্যেদ বুরহান উদ্দিন (রহ.)-এর সংস্পর্শে এসে আধ্যাত্মিকতার পথে ধাবিত হতে থাকেন। আর যে মনীষীর সান্নিধ্য লাভের ফলে রুমি (রহ.)-এর জীবনে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয় তিনি হলেন শামসে তাবরিজি (রহ.)। অধিকাংশ গবেষকের মতে, তিনি ১২৪৪ সালে কুনিয়ায় আগমন করেন। শামসে তাবরিজি (রহ.)-এর সান্নিধ্যই রুমি (রহ.)-কে আধ্যাত্মিকতার জগতে নবদিগন্ত উন্মোচিত করে দেয়। রুমি (রহ.)-এর জীবনে তাঁর প্রভাব এতই বেশি ছিল যে, তাঁকে ছাড়া তিনি কিছুই কল্পনা করতে পারতেন না। এমনকি তাঁর বিরহে রুমি ‘দিওয়ানে শাম্স তাবরিজি’ রচনা করেন।
মাওলানা রুমি (রহ.) শামসে তাবরিজি (রহ.)-এর সকল চিন্তা-চেতনা ও শিক্ষা-দীক্ষার মূলনীতি গভীরভাবে হৃদয়ঙ্গম ও আয়ত্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মাকালাত গ্রন্থ থেকেও এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, মসনবি ও মাকালাতের মধ্যে শক্তিশালী সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। মাকালাতের অনেক উপমা, কাহিনি ও বিষয়বস্তুকে মাওলানা তাঁর মসনবিতে সন্নিবেশিত করেছেন। একথা বলা যায় যে, প্রস্তরের মাঝে যেমন অগ্নি লুক্কায়িত থাকে মাওলানা রুমি (রহ.)-এর মধ্যেও তেমনি কাব্য প্রতিভা লুক্কায়িত ছিল; কিন্তু শামস (রহ.)-এর বিরহ-চকমতির আঘাতে তাঁর অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বিমূর্ত হয়ে উঠে।


রুমি (রহ.)-এর কাব্য প্রতিভা বিকশিত হবার ক্ষেত্রে দুজন খ্যাতিমান কবি হাকিম সানায়ি ও ফরিদ উদ্দিন আত্তারের প্রভাব অপরিসীম। ফারসি সাহিত্যে সুফি দর্শনের বিকাশে সানায়ি ও আত্তারের ধারা অনুসরণ করেই রুমি (রহ.) কাব্য চর্চা ও সুফি দর্শন পূর্ণতা দানে ভূমিকা রাখেন। মাওলানা রুমি তাঁর শিষ্য হুসামুদ্দিন চেলেবির অনুরোধে এবং উৎসাহে মসনবি কাব্য রচনা করেন। হুসামুদ্দিন মাওলানা রুমি (রহ.)-কে হাকিম সানাঈ-এর ‘হাদিকায়ে সানাঈ’ অথবা ফরীদ উদ্দীন আত্তারের ‘মানতেকুত্তায়ের’এর পদ্ধতিতে একটি কিতাব রচনার প্রস্তাব দেওয়ার ফলে রুমি (রহ.) মসনবি কাব্য লেখা শুরু করেন। মসনবি রচনার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে The Encyclopaedia of Islam-এ নিম্নরূপ বক্তব্য এসেছে:
““The long poem was inspired by Husam al-din Celebi, who suggested to  Mawlana that he should something like the religious mathnawis of Sanai and Attar.
মাওলানা রুমি (রহ.) একটি শেরে নিজেকে সানাঈ ও আত্তারের মর্যাদা সম্পর্কে বলেন- “আত্তারের ছিল প্রাণ এবং সানাঈ তার দুটি চক্ষু; আমরা আত্তার ও সানাঈয়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এসেছি।” বরকতুল্লাহ উক্ত চরণের অনুবাদ করেছেন এভাবে “আত্তার মরমী শিক্ষার প্রাণ ও সানাঈ উহার দুইটি চক্ষু; আমি তাঁদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া চলিয়াছি মাত্র।”
বস্তুত মাওলানা রুমি (রহ.) নির্বাধে অনর্গল বয়েত আবৃত্তি করতেন আর হুসামুদ্দিন সাথে সাথে তা লিখে ফেলতেন। কোনো কোনো সময় তাঁদের এ কাজে সমগ্র রজনি অতিবাহিত হয়ে যেত। এ প্রসঙ্গে কবি বলেন- “প্রভাত হয়েছে। হে ভোরের অধিপতি পরওয়ার দিগার! আপনি আমার শ্রদ্ধেয় হুসামুদ্দিনের উযর কবুল করুন।”
এ প্রসঙ্গে দৌলতশাহ লিখেছেন, মাওলানা রুমি (রহ.)-এর গৃহে একটি স্তম্ভ ছিল। মাওলানা যখন খোদা প্রেমে আত্মহারা হয়ে পড়তেন, তখন সেই স্তম্ভ ধরে চারদিক ঘুরতেন এবং মসনবি (দ্বি-পদি কাব্য) বলে যেতেন, শিষ্যেরা তা সাথে সাথে লিখে ফেলতেন। এ বিষয়ে A. J. Arberry বলেন:Daulatshah tells us that there was a pillar in Maulwis house, and when he was drowned in the ocean of love he used to take hold of that pillar and set himself turning round it. Meanwhile he versified and dictated and people wrote down the verses.


নিংসন্দেহে বিশ্বব্যাপী মাওলানা রুমি (রহ.)-এর খ্যাতি ও পরিচিতির মূলে রয়েছে তাঁর শ্রেষ্ঠ মসনবি কাব্য। এতে সুফি মতবাদ ও এর সাধন প্রণালী ব্যাখ্যা ও দৃষ্টান্ত দ্বারা সহজবোধ্য করার জন্য রয়েছে অসংখ্য বাস্তব ও কল্পিত কাহিনি, উপকথা নীতিগল্প, রূপক কাহিনি এবং গভীর চিন্তাধারার সমাহার। মসনবি-ই-মা’নবি, মরমী কাব্য, জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্যগন্থ। সুফিবাদে অনুপ্রাণিত কাব্যরূপ মসনবি আজো বিশ্ব সাহিত্যের এক অমূল্য রত্ন। এটি ইসলামি বিশ্বের চিন্তা ও সাহিত্যের উপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে আছে। ইসলামি সাহিত্যের ভাণ্ডারে এই রকম কাব্যগ্রন্থ খুবই বিরল, যা ইসলামি বিশ্বের এত ব্যাপক ও বিরাট পরিধিকে এত দীর্ঘকালব্যাপী প্রভাবিত করে রেখেছে। ষষ্ঠ হিজরি শতক হতে গ্রন্থখানি মুসলিম বিশ্বের বুদ্ধিবৃত্তি ও সাহিত্য সংস্কৃতিকে নিত্য নতুন প্রেরণা দান করে আসছে।
ফারসি ভাষায় কুরআনি শিক্ষার নির্যাস রয়েছে এই মসনবিতে। কবির ভাষায়: “মৌলভির আধ্যাত্মিক বিষয় সংবলিত মসনবি পাহলভী (ফারসি) ভাষায় কুরআন (এরই ব্যাখ্যা)।” The New Encyclopaedia Britannica-†Z G cÖm‡½ ejv n‡q‡Q: Jalal ad-Din ar-Rumi called Mawlana, was the greatest Sufi-Islamic mystic poet in the Persian Language; he is famous for his lyrics and for his didactic epic masnavi (The spiritual couplets), which has been called ‘The Quran in Persian’.


মাওলানা রুমি (রহ.)-এর জীবনে প্রেমের উন্মাদনার প্রভাব পড়েছে প্রকটভাবে। তাঁর মতে-বাহ্যিক জ্ঞান অর্জনের পরও তিনি ইনসানে কামিল তথা পরিপূর্ণ মানুষে পরিণত হতে পারেননি। তাই তিনি আধ্যাত্মিক প্রেম জগতের দ্রষ্টা শামসে তাবরিজি (রহ.)-এর সান্নিধ্য লাভ করে ইনসানে কামিল তথা পরিপূর্ণ মানুষের মর্যাদা লাভ করেন, যা তাঁকে বিশ্ব পরিচিতি দান করে। এ সম্পর্কে বলা হয়েছে-
মৌলভি হারগেয নাহ্ শোদ মাওলায়ে রোম
তা’ গোলামী শামসে তাবরীযী নাহ্ শোদ
অর্থাৎ–রোমের এ মৌলভি কখনো হতো না মাওলায়ে রুমি
যদি না করত শামসে তাবরিজির গোলামি।
মাওলানা রুমি (রহ.) শামসে তাবরিজি (রহ.)-এর সংস্পর্শে আশার পর তাঁর জীবনের আমুল পরিবর্তন ঘটে এবং তিনি প্রেমের ও ভালোবাসার মহিমা কীর্তন করেন তাঁর মোর্শেদের অনুসরণে। রুমি (রহ.)-এর মতে, ঐশী প্রেম সব ব্যাধির মহৌষধ। প্রেম যেমন মনকে মলিনতা ও পাপাসক্তি থেকে মুক্ত রাখে, তেমনি তা আত্মাকে নির্মল ও উন্নত করে। তাই প্রেমকে তিনি অবিনশ্বর প্রাচুর্য হিসেবে দেখেছেন। দেখেছেন জীবনদায়ী শক্তি হিসেবে, আনন্দের উৎস হিসেবে। এই গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে মাওলানা রুমি (রহ.) তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছেন। রুমি (রহ.) তাঁর মোর্শেদ শামসে তাবরিজি (রহ.)-এর মাধ্যমে যে প্রেমের সন্ধান লাভ করেছিলেন, তার প্রভাব তিনি ব্যক্ত করেছেন এভাবে:
“মুরদেহ্ বুদাম, যেন্দেহ্ শুদাম; গেরইয়েহ্ বুদাম, খান্দেহ্ শুদাম।
দাওলাতে ইশ্ক অ’মাদো মান দাওলাতে পা’ইয়ান্দেহ্ শুদাম।”
অর্থাৎ- “মৃত ছিলাম, জীবিত হলাম; কাঁদতে ছিলাম, হাস্যোজ্জ্বল হলাম।
প্রেমের মহান সম্পদ এলো, তাইতো চিররত্ন হলাম।”
প্রেম হলো আল্লাহ্কে পাওয়ার এক আধ্যাত্মিক রাজপথ। এপথে ছল-চাতুরী বা চালাকীর কোনো স্থান নেই। এটি এক মহাসমূদ্র, এ সমুদ্রে সাঁতার দিয়ে নিমজ্জিত হওয়ার কোনো ভয় নেই। অথবা এ পথ এমন একটি নৌকা সদৃশ যাতে পাড়ি দিলে ডুবার আশংকা খুবই কম। তাই রুমি (রহ.) বলেন, এ পথে চলতে হলে ছল-চাতুরী বিক্রি করে প্রেমের হয়রানি ক্রয় করো, এতেই শান্তি নিয়োজিত। মসনবির ভাষায়-
যীরাকেই সাব্বাহী অ’মাদ দার বাহা’র
কাম যে হাদ গারক্ব আস্ত উ পা’ইয়া’ন কা’র
ইশ্ক্ব চোন কাশ্তী শাভাদ বেহার খা’স
কাম বুভাদ আ’ফাত বুভাদ আগলা’ব খালা’স
যীরাকেই বেফুরোশো হেইরা’নী বেজুয
যীরাকেই যান্নীস্ত হেইরা’নী নাযার
অর্থাৎ– “ছল-চাতুরী সমুদ্রে সাঁতারের ন্যায়
প্রেমের পরিণাম জলে ডুবা নয়।
প্রেম হলো আল্লাহ্র বিশেষ নৌকা তুল্য
যাতে নিমজ্জিত হওয়ার ভয় কম মুক্তির আশংকা বেশি।
ছল-চাতুরী ধারণামাত্র আর এ হয়রানি আল্লাহ্র দৃষ্টি।
রুমি (রহ.)-এর বেশিরভাগ কবিতা তাঁর ৩৭ থেকে ৬৭ বছর বয়সের মধ্যে লেখা। তিনি ৩ হাজারের বেশি গজল, গীতধর্মী কবিতা, ২ হাজারের বেশি রুবাইয়াত লিখেছেন। জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে ১২৫৮ সালে আধ্যাত্মিক শ্লোকের মহাকাব্য লেখা শুরু করেন, যা ‘মসনবি’ নামে পরিচিত। এতে প্রায় ২৫ হাজার ধ্রুপদী শ্লোক তথা ৫০ হাজার পংক্তি আছে। ৬ খণ্ডের এ মহাকাব্যের শেষ খণ্ডটি অসমাপ্ত রেখে ১২৭৩ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। উইকিপিডিয়া বলছে, এটি সুফিবাদের ওপর রচিত সবচেয়ে বিখ্যাত ও প্রভাবশালী রচনার একটি। এটি নীতিকথার আধার, স্রষ্টার প্রতি নিজেকে সমর্পণের এবং ভক্তি, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রদর্শনের এক অপূর্ব নিদর্শন। কল্পনা, বাস্তবতা, প্রেম, আধ্যাত্মিকতা, রূপ-রস, উপকথা ও উপদেশ সংবলিত এক অনবদ্য মহাকাব্য।
মূলত মসনবি শরীফের মাধ্যমেই রুমি (রহ.)-এর বিশ্বজোড়া পরিচিতি ঘটলেও এর বাইরেও তাঁর আরও কিছু রচনা রয়েছে। এগুলো হচ্ছে: দিওয়ানে শামসে তাবরিজি, গদ্যগ্রন্থ ফিহ্ মা ফিহ্, মাকতুবাত, মাজালিসে সাব’আ এবং রুবাইয়াতে রুমি।
ফারসি সাহিত্যের এই শ্রেষ্ঠ কবি ৬৮ বছর বয়সে ১২৭৩ সালে এ ধরণীর মায়া ত্যাগ করে মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে গমন করেন। তুরস্কের কুনিয়াতেই তাঁকে সমাহিত করা হয়।
তথ্যসূত্র:
১. প্রফেসর মুহাম্মদ শাহজালাল, জালালুদ্দীন রুমীর দর্শনে বিশ্বপ্রেম, দর্শন ও প্রগতি, বর্ষ ২৮; ১ম ও ২য় সংখ্যা, জানুয়ারি-জুন, জুলাই-ডিসেম্বর ২০১১, পৃষ্ঠা ১১৯-১২০
২. আবু মুসা মোঃ আরিফ বিল্লাহ ও মোঃ কামাল উদ্দিন, জালাল উদ্দীন রুমি: কবি ও সূফী; প্রবন্ধাবলী, খণ্ড ৫ ২০০৪, উচ্চতর সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পৃষ্ঠা ৮১
৩. প্রফেসর ড. আবদুস সবুর খান, মওলানা জালালুদ্দিন রুমি: আত্মার বাঁশিবাদক, নিউজলেটার, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দূতাবাস, ঢাকা থেকে প্রকাশিত, পৃষ্ঠা ৩৩
৪. সৈয়দ রেজাউল করিম, সূফিবাদ ও সূফিদের স্বরূপ সন্ধানে, বাংলা একাডেমী ১ম প্রকাশ জুন ২০২০, পৃষ্ঠা ১৮০
৫.

B. Lewis Ch., and J. Schacht Ledein E.J. Brill, The Encyclopaedia of Islam (The Netherlands, 1983), p. 395.

6. A.J. Arberry, Classical Persian Literature (London: George Allen and Unwin Ltd. 1958). P. 222

7. The New Encyclopaedia Britannica: Macropaedia Vol. 10 (Chicago: Helen Hemingway Benton Publisher, 1973-1974), p. 14.


৮. আবু মুসা মোঃ আরিফ বিল্লাহ ও মোঃ কামাল উদ্দিন, প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা ৮৩
৯. প্রফেসর ড. আবদুস সবুর খান, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৫
১০. প্রফেসর মুহাম্মদ শাহজালাল, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১০৯-১১০
১১. প্রফেসর ড. মো. কামাল উদ্দিন, জালাল উদ্দিন রূমির কাব্য ও দর্শন, নিউজলেটার, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দূতাবাস, ঢাকা থেকে প্রকাশিত, পৃষ্ঠা ৮-১০
১২. সালাহ উদ্দিন নাগরী, মাওলানা রুমী: দ্যা বেস্ট সেলিং পোয়েট ইন দ্যা ইউএস; সাপ্তাহিক দেওয়ানবাগ ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২১ অনলাইন সংস্করণ
১৩. প্রফেসর ড. মো. কামাল উদ্দিন, মাওলানা রূমির মসনবী দর্শন, সাপ্তাহিক দেওয়ানবাগ, অক্টোবর ২৬, ২০২০, অনলাইন সংস্করণ
[লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক]

সম্পর্কিত পোস্ট