Cancel Preloader

মসজিদে নববির ইতিবৃত্ত – ইমাম ড. সৈয়দ এ.এফ.এম মঞ্জুর-এ-খোদা


(পর্ব-০২)
পূর্ব প্রকাশিতের পর

হযরত রাসুল (সা.)-এর সময়কালের সম্মানিত স্তম্ভসমূহ
মসজিদে নববির স্তম্ভগুলোর মধ্যে ৮টি স্তম্ভ বিভিন্ন তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার কারণে বিশেষ সম্মান লাভ করেছিল। নিম্নে এই ৮টি সম্মানিত স্তম্ভরাজির বর্ণনা দেওয়া হলো:

১. হান্নানাহ/মাখলুক স্তম্ভ: বর্তমানে এই স্তম্ভটি যেখানে রয়েছে সেখানে খেজুর গাছের একটি খুঁটি ছিল। মিম্বর স্থাপনের পূর্বে আল্লাহর রাসুল (সা.) সেই খুঁটিতে হেলান দিয়ে খুৎবা প্রদান করতেন। মিম্বর স্থাপনের পর যেদিন হযরত রাসুল (সা.) মিম্বরে বসে খুৎবা প্রদান করেন, সেদিন উক্ত খেজুর গাছটি হযরত রাসুল (সা.)-এর বিচ্ছেদ বেদনায় উচ্চস্বরে কাঁদতে থাকে। খেজুর গাছটি এমনভাবে কাঁদছিল এবং কাঁপছিল যে, মনে হচ্ছিল এটি বুঝি ফেটে যাবে। নাসায়ি শরীফে হযরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, “খুঁটিটি বাচ্চা ছিনিয়ে নেওয়া উটনীর মতো কান্না আরম্ভ করে।” এই অবস্থা দেখে অনেকে ভয়ে দাঁড়িয়ে যান। তখন দয়াল রাসুল (সা.) খেজুর গাছটিকে আলিঙ্গন করে সেটির গায়ে হাত বুলিয়ে দেন। ফলে সাথে সাথে সেটির কান্না থেমে যায়।
অতঃপর হযরত রাসুল (সা.) গাছটিকে বললেন, “তুমি যদি বলো, আমি তোমাকে সেই স্থানে রোপন করব, যেখানে তুমি ছিলে। তখন তুমি পুনরায় আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। অথবা আমি তোমাকে বেহেশতে রোপন করতে পারি, তুমি সেখানকার নদী এবং ঝরনার পানি পান করতে পারবে। অতঃপর তুমি যখন ফলবতী হবে, তখন আল্লাহ্র বন্ধুগণ তোমার ফল গ্রহণ করবে।” (সুনান আল দারেমি শরীফ) খুঁটিটি বেহেশত পছন্দ করল। তখন দয়াল রাসুল (সা.)-এর নির্দেশে সেখানেই একটি গর্ত খুঁড়ে তাকে দাফন করা হলো।
এই প্রসঙ্গে হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ্ (রা.) বলেন- “যখন জুমার দিন হলো, হযরত রাসুল (সা.) সেই তৈরি মিম্বরের উপরে বসলেন। সেসময় যে খেজুর গাছের উপর ভর দিয়ে তিনি খুৎবা দিতেন, সেটি এমনভাবে চিৎকার করে উঠল, যেন তা ফেটে পড়বে। হযরত রাসুল (সা.) নেমে এসে তাকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে ধরলেন। তখন সেটি ফোঁপাতে লাগল, যেমন ছোটো শিশুকে চুপ করানোর সময় ফোঁপায়। অবশেষে তা স্থির হয়ে গেল। হযরত রাসুল (সা.) বলেন, ‘খেজুর গাছটি কাঁদছিল, কারণ এটি মহান আল্লাহ্র স্মরণের নিকটবর্তী ছিল’।” (বোখারী শরীফ, ই.ফা.বা কর্তৃক অনূদিত, হাদিস নং ১৯৬৫)
খেজুর গাছটি বাচ্চা ছিনিয়ে নেওয়া উষ্ট্রীর মতো কান্না করছিল বিধায় এই স্তম্ভটিকে ‘হান্নানাহ’ স্তম্ভ বলা হয়। আরবি হান্নানাহ শব্দ দ্বারা উটের কান্না বুঝানো হয়। অপরদিকে ‘খালুক’ নামক একটি বিখ্যাত সুগন্ধি এই স্তম্ভটিতে লাগিয়ে রাখা হতো। এজন্য এই স্তম্ভটিকে মাখলুক স্তম্ভও বলা হয়। আরবি ‘খালুক’ শব্দ থেকে মাখলুক শব্দের উৎপত্তি। এই স্তম্ভটি ‘মেহরাব-এ-নববি’-এর একটু পিছনে ডান দিকে অবস্থিত।

২. আয়েশা স্তম্ভ:
মসজিদে নববির ১ম সারির স্তম্ভরাজিতে তওবা স্তম্ভের ঠিক পরের স্তম্ভটি আয়েশা স্তম্ভ, যাকে ‘কোরাহ’ স্তম্ভ বা ‘মুহাজিরিন’ স্তম্ভও বলা হয় । মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের পর হযরত রাসুল (সা.) মক্কা থেকে আগত সকল মুহাজির সাহাবিকে নিয়ে এই স্থানে নামাজ আদায় করতেন এবং কেব্লা পরিবর্তনের কারণে মসজিদে নববির সংস্কারের সময়ও কিছুদিন হযরত রাসুল (সা.) সকলকে নিয়ে এই স্তম্ভের পিছনে নামাজ আদায় করেছেন। এছাড়াও মক্কা থেকে আগত মুহাজিরগণ এই স্থানেই নিয়মিত বসতেন। এজন্য একে ‘মুহাজিরিন স্তম্ভ’ বলা হয়।

আরবি ‘কোরাহ’ শব্দের অর্থ ‘ভাগ্য’। হযরত ইবনে জাবালাহ (রা.) বলেছেন, “আমরা জানতে পেরেছি যে, এই জায়গায় দোয়া কবুল হয়।”(ওয়াফাহ-আল-ওয়াফাহ, ২য় খণ্ড; নূরুদ্দিন সামহুদি)। তাবারানি তার আল-মুজাম আল-আওসাত গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন,“হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, হযরত রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমার মসজিদে এমন একটি স্থান আছে, লোকেরা এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য জানলে সেখানে নামাজ আদায়ের জন্য লটারির ব্যবস্থা করবে’।” তখন উপস্থিত সাহাবিগণ হযরত আয়েশা (রা.)-কে ঐ স্থানটির ব্যাপারে জানানোর অনুরোধ করলে তিনি নীরব থাকেন। অতঃপর শুধু হযরত আয়েশা (রা.)-এর ভাগ্নে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা.) ব্যতীত সকলে হুজরা শরীফ থেকে বের হয়ে আসেন। এর কিছুক্ষণ পর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা.) হযরত আয়েশা (রা.)-এর হুজরা শরীফ হতে বের হয়ে আসেন এবং মুহাজিরিন স্তম্ভের পাশে নামাজ আদায় করেন। ফলে সকলে ধরে নেন যে, এই স্থানটিই হযরত রাসুল (সা.) বর্ণিত সেই ফজিলতপূর্ণ স্থান। পরবর্তীতে হযরত আবু বকর (রা.), হযরত উসমান (রা.), হযরত আমির বিন আবদুল্লাহ (রা.)-সহ অনেক সাহাবিই সেখানে নামাজ আদায় করতেন। হযরত আয়েশা (রা.)-এর দ্বারা উক্ত স্তম্ভের গোপনীয়তা প্রকাশিত হওয়ায় পরবর্তীতে এই স্তম্ভটির নামকরণ করা হয় ‘আয়েশা স্তম্ভ’।

৩. তওবা স্তম্ভ: এটি ‘লুবাবা’ স্তম্ভ নামেও পরিচিত। এটি মিম্বর থেকে ৪র্থ এবং হযরত রাসুল (সা.)-এর কক্ষ থেকে ২য় স্তম্ভ যা রিয়াজুল জান্নাত-এর মধ্যে অবস্থিত। এক আনসার গোত্রপতি হযরত আবু লুবাবা (রা.) নিজের একটি ভুলের শাস্তি হিসেবে এই খুঁটিতে নিজেকে বেঁধে বলেছিলেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর রাসুল (সা.) নিজে না খুলে দেবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি এর সঙ্গে বাঁধা থাকব।” হযরত রাসুল (সা.) তখন বলেছিলেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত আমাকে আল্লাহ্ আদেশ না করবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত খুলব না।” তখন তিনি কান্নাকাটি করে তওবা করতে থাকেন। এভাবে ৭ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর তাঁর তওবা কবুল হয়। অতঃপর হযরত রাসুল (সা.) নিজ হাত মোবারকে তাঁর বাঁধন খুলে দেন এবং তাঁকে ক্ষমা করে দেন। তাই এই স্তম্ভকে তওবা কবুলের স্তম্ভ বলা হয়।

৪. আস-সারির স্তম্ভ: এই স্তম্ভটি তওবা স্তম্ভের সাথে অবস্থিত। হযরত রাসুল (সা.) এই স্তম্ভের নিকটে বসে মোরাকাবা করতেন। তিনি মাঝে মাঝে এখানে মাদুর পেতে বিশ্রাম নিতেন। মাদুর-এর আরবি প্রতিশব্দ সারির। তাই এই স্তম্ভটিকে আস সারির স্তম্ভ বলা হয়।

৫. আলী স্তম্ভ/হারাস স্তম্ভ: সারির স্তম্ভের ঠিক পিছনে উত্তর দিকে উম্মুল মু’মিনিন হযরত আয়েশা (রা.)-এর হুজরা শরীফের দরজার সামনেই এই স্তম্ভটি অবস্থিত। এই দরজা দিয়েই হযরত রাসুল (সা.) তাঁর হুজরা শরীফ থেকে মসজিদে নববিতে প্রবেশ করতেন। শেরে খোদা হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু প্রায় সর্বদাই এই স্তম্ভের নিকট দাঁড়িয়ে হযরত রাসুল (সা.)-কে পাহারা দিতেন, যেন বাইরের কোনো শত্রু তাঁকে আক্রমণ করতে না পারে। আরবি ‘হারাস’ শব্দের বাংলা অর্থ ‘পাহারা’। তাই এই স্তম্ভটিকে হারাস স্তম্ভ বলা হয়। তাছাড়া শেরে খোদা হযরত আলী (কা.)-এর সম্মানে এই স্তম্ভটিকে আলী স্তম্ভও বলা হয়ে থাকে।

৬.ওফুদ স্তম্ভ: আরবি ‘ওফুদ’ শব্দের বাংলা অর্থ প্রতিনিধি। এটি আলী স্তম্ভের উত্তরে অবস্থিত। হযরত রাসুল (সা.)-এর কাছে কেউ দেখা করতে আসলে বা কোনো প্রতিনিধি দল ইসলাম গ্রহণের উদ্দেশ্যে আসলে তিনি দয়া করে এখানে সাক্ষাত দিতেন। বহু গোত্র এখানে ইসলাম গ্রহণ করেছে।

৭. মারবা-আতুল বাইর স্তম্ভ: ‘মারবা-আতুল বাইর’ অর্থ সমাধির বর্গ। বর্তমানে এই স্তম্ভটি হযরত রাসুল (সা.)-এর রওজা মোবারকের চার দেওয়ালের ভিতরে পড়েছে বিধায় একে মারবা-আতুল বাইর স্তম্ভ বলা হয়।

৮. তাহাজ্জুদ স্তম্ভ: এই স্তম্ভটি নবিনন্দিনী হযরত ফাতেমা (রা.)-এর হুজরা শরীফের পিছনে স্থাপিত। এই কলামটির পিছনে হযরত রাসুল (সা.) প্রতি রাতে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করতেন। তাই এটিকে তাহাজ্জুদের স্তম্ভ বলা হয়।

৩য় সংস্কার
উদ্যোগ গ্রহণকারী: ২য় খলিফা হযরত উমর (রা.)
সময়: ৬৩৯ খ্রিষ্টাব্দ (১৭ হিজরি)
বিবরণ: মুসলিম জাহানের ২য় খলিফা হযরত উমর (রা.) [শাসনকাল: ৬৩৪-৬৪৪ খ্রি.]-এর খিলাফতকালে ৬৩৯ খ্রিষ্টাব্দে (১৭ হিজরি) ৩য় বারের মতো মসজিদে নববির সংস্কার করা হয়। মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় লোকেরা খলিফা হযরত উমর (রা.)-কে মসজিদটি সম্প্রসারণের জন্য অনুরোধ করেন। ৬৩৯ খ্রিষ্টাব্দে (১৭ হিজরি) হযরত উমর (রা.) হযরত জাফর ইবনে আবু তালেব (রা.)-এর একটি জমির অর্ধেক অংশ এক লক্ষ দিরহাম দিয়ে ক্রয় করে মসজিদটি দক্ষিণে প্রায় ১৬.৪ ফুট, উত্তরে প্রায় ৪৯.২১ ফুট এবং পশ্চিমে প্রায় ৩২.৮ ফুট প্রসারিত করেন। ফলে মসজিদের আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ৪৫,৫৪০ বর্গফুট (২৩০ ফুট১৯৮ ফুট)। তখন মসজিদের পশ্চিম সীমানা দেওয়াল মিম্বর থেকে ৭ কলাম দূরে ছিল। তবে এই সময় নির্মাণ কাজে খেজুর গাছের পরিবর্তে স্তম্ভ হিসাবে কাঠের খুঁটি ব্যবহার করা হয়। মসজিদের প্রবেশদ্বার ৩টি থেকে ৬টিতে উন্নীত করা হয়। পশ্চিম দেওয়ালে যে নতুন দরজা যুক্ত করা হয়েছিল, তা ‘বাবে সালাম’ এবং পূর্ব দেওয়ালে যে দরজা যুক্ত করা হয়েছিল, তা ‘বাবে নিসা’ নামে পরিচিত। হযরত উমর (রা.) মসজিদের উত্তর দিকের সীমানার বাইরের খালি জায়গায় ‘জমজম’ নামক একটি কূপ খনন করেন। যা পরবর্তীতে মসজিদ সম্প্রসারণের কারণে ভরাট করে ফেলা হয়। তিনি মসজিদের মেঝেতে ‘হাছি’ নামক ঘাসের পরিবর্তে ফরাশ (মেঝেতে বিছানোর জন্য মোটা সুতায় বোনা চাদর বিশেষ) ব্যবহার করেন।

৪র্থ সংস্কার
উদ্যোগ গ্রহণকারী: ৩য় খলিফা হযরত উসমান (রা.)
সময়: ৬৫৩ খ্রিষ্টাব্দ (২৯ হিজরি)
বিবরণ: মুসল্লিদের স্থান সংকুলান না হওয়ায় মুসলিম জাহানের ৩য় খলিফা হযরত উসমান (রা.) [শাসনকাল: ৬৪৪-৬৫৬ খ্রি.] তাঁর খেলাফতকালে ৬৫৩ খ্রিষ্টাব্দে (২৯ হিজরি) মসজিদে নববির ৪র্থ সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করেন। মসজিদটির উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম এই তিন দিকে প্রায় ১৬.৫ ফুট করে সম্প্রসারিত করা হয়। ফলে মসজিদের আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ৫৬,৪১৩ বর্গফুট (২৬৩ ফুট২১৪.৫ ফুট)। ফলে মসজিদটি মিম্বর থেকে পশ্চিম দিকে ৮ কলাম পর্যন্ত প্রসারিত হয়। মসজিদের দক্ষিণ দেওয়ালটি আজও একই স্থানে রয়েছে এবং খলিফা হযরত উসমান (রা.)-এর সময় থেকে দক্ষিণ দিকে আর সম্প্রসারণ করা হয়নি। এছাড়াও খলিফা হযরত উসমান (রা.) মসজিদটি অলংকৃত বা খোদাইকৃত পাথর দিয়ে তৈরি করেন। সেই সময় নির্মাণ সামগ্রী হিসাবে চুনাপাথর ব্যবহৃত হয়েছিল। পাথর দ্বারা বিভিন্ন ফুল ও লতার নক্শা করে মসজিদের কলাম ও দেওয়ালসমূহ সুসজ্জিত করা হয়। মসজিদের দেওয়ালসমূহ পবিত্র কুরআনের আয়াত দ্বারা অলংকৃত করা হয়। সেগুন কাঠ দিয়ে ছাদ নির্মাণ করা হয়। পূর্বের খেজুর গাছের স্তম্ভগুলি ফেলে দিয়ে অলংকৃত পাথর দ্বারা নতুন স্তম্ভ তৈরি করা হয়। এই কলামগুলির ভিতরের অংশ ফাঁকা ছিল। স্তম্ভগুলোকে আরও বেশি মজবুত করার জন্য এর মধ্যে লোহার টুকরো এবং গলিত সীসা দ্বারা পূর্ণ করা হয়। এসময় তিনি কেবলার দেওয়ালের দিকে চলাচলের একটি রাস্তাও নির্মাণ করেন। দক্ষিণের দেওয়ালে তিনি ‘বাব আলে উমর’ নামে একটি প্রবেশদ্বার নির্মাণ করেন। যা দক্ষিণ দেওয়ালের পূর্বাংশে হযরত রাসুল (সা.)-এর মেহরাব ও হুজরা শরীফের মাঝে বিদ্যমান ছিল। এই নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হতে প্রায় ১০ মাস সময় লেগে যায়।

৫ম সংস্কার
উদ্যোগ গ্রহণকারী: উমাইয়া খলিফা ১ম ওয়ালিদ
সময়: ৭০৭-৭১০ খ্রিষ্টাব্দ (৮৮-৯১ হিজরি)
বিবরণ: ৫ম উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিক (শাসনকাল: ৭০৫-৭১৫ খ্রি.) ৭০৭ খ্রিষ্টাব্দে (৮৮হিজরি) তৎকালীন মদিনার গভর্নর উমর ইবনে আবদুল আজিজ-কে মসজিদে নববি পুনর্নির্মাণের দায়িত্ব দেন। এই সময় তিনি উমর ইবনে আবদুল আজিজ-কে নির্দেশ দেন- “মসজিদে নববির আশপাশের সকল গৃহ ক্রয় করে নাও। যারা বিক্রয় করতে অস্বীকার করবে, তাদের গৃহ ভেঙে দিয়ে মূল্য পরিশোধ করে দাও। এতেও তারা অসম্মত হলে বলপূর্বক গৃহস্থান দখল করে নাও এবং মূল্য বাইতুল মালে জমা করে দাও। হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বাসস্থান (হুজরা শরীফ)-ও মসজিদের অন্তর্ভুক্ত করে নাও।” (মদীনা শরীফের ইতিহাস, মৌলভী শেখ আবদুল জব্বার; পৃষ্ঠা ৭৪; ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ) অতঃপর উমর ইবনে আবদুল আজিজ খলিফা ১ম ওয়ালিদ-এর নির্দেশে মসজিদ পুনর্নির্মাণের কাজ শুরু করেন। সমগ্র মদীনাবাসীর প্রতিবাদ সত্ত্বেও যে দিন হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর হুজরা শরীফগুলো ধ্বংস করে মসজিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, সেদিন যেন এক মহা প্রলয়কাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল। সমগ্র মদীনায় কান্নার রোল পড়ে গিয়েছিল।
উমর বিন আবদুল আজিজ মসজিদে নববির পশ্চিমে প্রায় ৩৩ ফুট এবং পূর্বে প্রায় ৪৯ ফুট প্রসারিত করেছিলেন যার ফলে মসজিদের আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ৭৭,৮৪৮ বর্গফুট (২৬৩ ফুট২৯৬ ফুট)। উল্লেখ্য যে, এসময় মসজিদে নববির পুনর্নির্মাণের জন্য সাহায্য চেয়ে খলিফা ওয়ালিদ তৎকালীন রোম সম্রাট ২য় জাস্টিনিয়ান-এর নিকট বার্তা পাঠান। রোম সম্রাট ২য় জাস্টিনিয়ান তখন ৪০ জন বিশেষজ্ঞ, ৪ হাজার রোমীয় কারিগর, ৪ হাজার কিবতি (মিশরের খ্রিষ্টান সম্প্রদায়) কারিগর, ৮০ হাজার দিনার, রূপার শিকল, প্রায় ১৭০ কিলোগ্রাম স্বর্ণ এবং কাঁচের ফানুসে রক্ষিত অসংখ্য প্রদীপ মদিনায় প্রেরণ করেন। [হৃদয় তীর্থ মদীনার পথে, শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দেস দেহলভী (রহ.), পৃষ্ঠা ৮৫] এই নির্মাণকালে মসজিদের কলামগুলো লোহার বার এবং গলিত সীসা দিয়ে মজবুত করা হয়েছিল। মসজিদের ছাদ নতুন করে নির্মাণ করা হয় এবং ছাদটি ৪১ ফুট উচ্চতায় বর্ধিত করা হয়। প্রতিকূল আবহাওয়া থেকে রক্ষা পেতে এই উপরের ছাদটির অল্প নিচে অপর একটি ছাদ নির্মাণ করা হয়েছিল। নিচের ছাদটি ছিল সেগুন কাঠের তৈরি। কলামের উপরের অংশ দরজার চৌকাঠ ও ছাদে স্বর্ণের কারুকার্য করা হয়। দেওয়ালের অভ্যন্তরের দিক মার্বেল পাথর দ্বারা সুসজ্জিত করা হয়েছিল। এই দেওয়ালগুলির বিভিন্ন অংশে বহু রঙিন পাথর দ্বারা অলংকৃত করা হয় এবং সোনালি পলিশ ব্যবহৃত হয়। এছাড়া দরজার ফ্রেমের উপরেও সোনালি পলিশ করা হয়। মসজিদের দেওয়াল ও ছাদ কারুকার্যময় করা হয়। মসজিদের চার কোণে ৪টি মিনার এবং ২০টি প্রবেশদ্বার নির্মাণ করা হয়। মসজিদে নববি-এর এই সংস্করণেই সর্বপ্রথম ধনুকাকৃতির মেহরাব নির্মাণ করা হয়। এই নির্মাণ কার্যক্রম সম্পন্ন করতে ৭০৭-৭১০ খ্রিষ্টাব্দ (৮৮-৯১ হিজরি) পর্যন্ত প্রায় ৩ বছর সময় লেগেছিল।
মসজিদে নববি এরূপ অভিনব প্রণালিতে পরিবর্ধিত ও পরিবর্তিত হলে ৫ম উমাইয়া খলিফা ১ম ওয়ালিদ মদীনা নগরীতে আগমন করেন। তখনও নবিনন্দিনী হযরত ফাতেমা (রা.)-এর হুজরা শরীফটি মসজিদে নববির পাশে অক্ষত অবস্থায় ছিল। উল্লেখ্য যে,ঐসময় সেই হুজরা শরীফটিতে ইমাম হাসান (রা.) ও ইমাম হোসাইন (রা.)-এর বংশধরগণ তথা নবি পরিবারের সদস্যগণ বসবাস করতেন। মদীনার গভর্নর উমর বিন আবদুল আজিজ আহলে বাইত প্রেমিক ছিলেন বিধায় সেই হুজরা শরিফটি তখনো অধিগ্রহণ করেননি। খলিফা ১ম ওয়ালিদ মদীনায় প্রবেশ করে যখন দেখতে পেলেন যে, তার নির্দেশ মোতাবেক হযরত ফাতেমা (রা.)-এর হুজরা শরীফটি তখনো ভাঙা হয়নি এবং নবি পরিবারের সদস্যরা সেখানে বসবাস করছেন; তখন তিনি রাগান্বিত হয়ে যান। খলিফা ১ম ওয়ালিদ তৎক্ষণাৎ মদিনার গভর্নর উমর ইবনে আবদুল আজিজকে ডেকে পাঠালেন এবং বেয়াদবের মতো বললেন, “তুমি এদেরকে বিতাড়িত করে এদের বাসস্থানকে (হুজরা শরীফ) আজও মসজিদের অন্তর্ভুক্ত করোনি কেন? পুনরায় এদেরকে এই স্থানে দেখি, আমার এরূপ ইচ্ছা ছিল না। এদেরকে আমি এখানে আর দেখতে চাই না। এদের গৃহ ক্রয় করে মসজিদের অন্তর্ভুক্ত করে নাও” [মদীনা শরীফের ইতিহাস, মৌলভী শেখ আবদুল জব্বার, পৃষ্ঠা ৭৪-৭৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ; হৃদয় তীর্থ মদিনার পথে, মূল: জজবুল-কুলুব ইলা দিয়ারিল মাহবুব, শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দেস দেহলভী (রহ.), অনুবাদ- মুহিউদ্দীন খান, পৃষ্ঠা ৮৪]


তারপর খলিফা ১ম ওয়ালিদ হযরত ফাতেমা (রা.)-এর হুজরা শরিফটি ক্রয় করতে চাইলেন, কিন্তু নবি পরিবারের সদস্যগণ তা বিক্রয় করতে সম্মত হলেন না। তখন ওয়ালিদ চরম বেয়াদবের মতো তার লোকদেরকে আদেশ দিলো, “যদি এরা বাইরে না আসে তবে গৃহ এদের উপরই ধসিয়ে দাও। গৃহের আসবাবপত্র এদের সম্মতি ছাড়াই বাইরে নিক্ষেপ করো। গৃহ উজাড় করে দাও।”[হৃদয় তীর্থ মদীনার পথে, শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দেস দেহলভী (রহঃ), অনুবাদ: মুহিউদ্দীন খান, পৃষ্ঠা ৮৪ ও ৮৫] খলিফার এই আদেশ পেয়ে তার লোকজন বলপূর্বক গৃহ থেকে তাঁদের জিনিসপত্র বাইরে ফেলে দিলো। অতঃপর নবি পরিবারের নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ সকলে প্রকাশ্য দিবালোকে মদীনার বাইরে চলে যেতে বাধ্য হন। খলিফা ১ম ওয়ালিদের এরূপ অবিবেচক সিদ্ধান্তের ফলে হযরত ফাতেমা (রা.)-এর এই হুজরা শরীফটিও ভেঙে ফেলে মসজিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। (চলবে)
[লেখক: পরিচালক, দেওয়ানবাগ শরীফ; সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, দি পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ]

সম্পর্কিত পোস্ট