Cancel Preloader

মসজিদে নববির ইতিবৃত্ত


ইমাম ড. সৈয়দ এ.এফ.এম মঞ্জুর-এ-খোদা
পর্ব-১
‘মসজিদে নববি’ মুসলিম উম্মাহর পবিত্রতম আবেগের নাম। এই মসজিদের কথা স্মরণ হতেই রাসুল প্রেমিকদের মনে ভেসে ওঠে সবুজ গম্বুজের মনোরম চিত্র; অজান্তেই মন হু হু করে কেঁদে ওঠে, দুচোখ ভিজে যায়। কেননা এখানেই রয়েছে বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত, শাফায়েতের কাণ্ডারী, দোজাহানের বাদশাহ, রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর রওজা শরীফ। রাসুল প্রেমিক প্রত্যেকেই জীবনে অন্তত একবারের জন্য হলেও মসজিদে নববি তথা মদীনা মুনাওয়ারায় যাওয়ার ইচ্ছা অন্তরে পোষণ করেন। এই ইচ্ছাই কাজী নজরুল ইসলামের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে-
“আয় মরু-পারের হাওয়া, নিয়ে যা রে মদীনায়
জাত পাক মোস্তফার, রওজা মোবারক যেথায়।”
মদীনা নগরীর প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে মসজিদে নববি। মসজিদটি সৌদি আরবের পশ্চিম অংশের অন্তর্গত মদীনা শহরে অবস্থিত। এই মসজিদ শুধু নামাজ বা ইবাদতের স্থান রূপেই গণ্য হতো না, বরং ইসলামি জ্ঞান চর্চা এবং ইসলামি রাষ্ট্র পরিচালনার মূল কেন্দ্র ছিল মসজিদে নববি। হযরত রাসুল (সা.)-এর সহবতে থেকে আহলে সুফফার সদস্যগণ নিজেদেরকে আলোকিত মানুষরূপে গড়ার সুযোগ পান। পরবর্তীতে তাঁরা সারা বিশ্বে রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.)-এর আদর্শ প্রচারের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেন।

পটভূমি
মহান আল্লাহর নির্দেশে হযরত রাসুল (সা.) মক্কা থেকে হিজরত করে ১ হিজরির ১২ রবিউল আউয়াল (২৪ সেপ্টেম্বর, ৬২২ খ্রি.), শুক্রবার মদীনায় পৌঁছানোর মাধ্যমে মসজিদে নববির ইতিহাস রচিত হয়। তিনি ‘কাসওয়া’ নামক উটনীর পিঠে আরোহণ করে মদীনায় প্রবেশ করার পর আনসারদের বিভিন্ন গোত্রের সকলেই তাঁকে নিজ গৃহে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল ছিলেন। প্রত্যেকেই হযরত রাসুল (সা.)-কে তাঁদের দাওয়াত কবুল করার নিবেদন করেছিলেন। হযরত রাসুল (সা.) তাদের আন্তরিক অভ্যর্থনার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, “আমার এই উটনী যার গৃহদ্বারে বসবে, আমি সেই গৃহেই অবস্থান করব।” সকলেই উৎসুক হয়ে স্বাধীনভাবে চলতে থাকা উটনীর গতিবিধি লক্ষ্য করতে লাগলেন।
অবশেষে উটনীটি নাজ্জার গোত্রের এলাকায় হযরত আবু আইয়ুব আনসারি (রা.)-এর বাড়ির পাশে একটি অনাবাদী জমিতে হাটু গেড়ে বসে পড়ল। তাই আল্লাহর রাসুল (সা.) হযরত আবু আইয়ুব আনসারি (রা.)-এর বাড়িতেই অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিলেন। অতঃপর হযরত রাসুল (সা.) সেই অনাবাদী জমিতে নিজ বাসস্থান এবং একটি মসজিদ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। উটনীটি যে জমিতে থেমে যায়, সেই জমিটি নাজ্জার গোত্রের সাহল ও সুহাইল নামের এতিম সহোদর বালকের ছিল। যখন তারা জানতে পারল যে, মসজিদ নির্মাণ করার জন্য হযরত রাসুল (সা.) তাদের জমি পছন্দ করেছেন, তখন তারা হযরত রাসুল (সা.)-এর নিকট গিয়ে তাঁকে জমিটি উপহার দেওয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু হযরত রাসুল (সা.) ন্যায্য মূল্য ১০ দিনার দিয়ে জমিটি ক্রয় করে নেন। সেই স্থানেই হযরত রাসুল (সা.) ‘মসজিদে নববি’ নির্মাণ করেন। এই ঐতিহাসিক মসজিদের পাশেই তিনি নিজ বাসস্থান নির্মাণ করেন।

মসজিদে নববি নির্মাণ
১ হিজরির ১২ রবিউল আউয়াল (২৪ সেপ্টেম্বর, ৬২২ খ্রিষ্টাব্দ) হযরত রাসুল (সা.) নিজেই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে মসজিদে নববির নির্মাণ কাজ শুরু করেন। আল্লাহর রাসুল (সা.) নিজেই তাঁর পিতা হযরত আবদুল্লাহ্ (আ.)-এর স্মৃতিবিজড়িত একটি বর্শা দিয়ে সীমারেখা টেনে মসজিদের সীমানা নির্ধারণ করেন, যার দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ১১৫ ফুট এবং প্রস্থ ছিল প্রায় ১০০ ফুট। ফলে মসজিদের আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ১১,৫০০ বর্গফুট। অতঃপর হযরত রাসুল (সা.)-এর নির্দেশক্রমে উক্ত স্থানের খেজুর গাছগুলো কেটে জমি সমান করা হয়। জমির একদিকে নিচু হওয়ায় প্রথমে নিচু অংশ ভরাট করা হয়। এরপর কিছু পাথর দিয়ে মসজিদের ভিত তৈরি করা হয়। মসজিদ নির্মাণের জন্য মদিনার ‘আল খাবখাবা’ নামক উপত্যকা থেকে কাদা মাটি এনে তা রোদে পুড়িয়ে ইট তৈরি করা হয় এবং সিমেন্ট হিসেবে ঐ কাদা মাটিই ব্যবহার করা হয়। ইট প্রস্তুত করা হয়েছিল বর্তমান জান্নাতুল বাকির নিকটে অবস্থিত মসজিদে ইবরাহিম-এর উত্তর দিকে। হযরত রাসুল (সা.) নিজে ইট তৈরিতে সাহাবিদেরকে সাহায্য করেছেন। এরপর প্রথমেই মসজিদের সীমানা দেওয়াল নির্মাণ করা হয়। ৪.৫ ফুট গভীর গর্ত খনন করে ভিতরের অংশে পাথর ও উপরের অংশ রোদে পোড়ানো কাঁচা ইট দিয়ে দেওয়ালের ভিতটি তৈরি করা হয়। নির্মাণ কার্যে হযরত রাসুল (সা.) নিজেই অংশগ্রহণ করেন এবং ইট-পাথর বহন করার সময় সাহাবায়ে কেরামকে উৎসাহ প্রদানের জন্য কবিতার ছন্দে বলেন, “খায়বরের সুস্বাদু খেজুর ও সুস্বাদু আঙুরের বোঝা বহন করা অপেক্ষা এই ইটের বোঝা বহন করা অধিকতর প্রীতিকর। হে আমাদের প্রভু! ইহাই তোমার নিকট পুণ্যতম ও পবিত্রতম।” (বোখারি শরীফ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭১, ৫৫৫ ও ৫৬০; যাদুল মা’আদ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৬) হযরত রাসুল (সা.)-এর সাথে সাহাবিগণও সমবেত কণ্ঠে কবিতাটি আবৃত্তি করতেন।

ঐতিহাসিক মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক বলেন, “মসজিদ এবং বাসস্থান নির্মাণ পর্যন্ত হযরত রাসুল (সা.) হযরত আবু আইয়ুব আনসারি (রা.)-এর বাড়িতে অবস্থান করেন এবং মুসলমানদেরকে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য হযরত রাসুল (সা.) নিজে নির্মাণ কাজে অংশগ্রহণ করেন। হযরত রাসুল (সা.)-এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে মুহাজির এবং আনসারগণও এ নির্মাণ কাজে যোগদান করেন।” এ প্রসঙ্গে জনৈক মুসলিম কবি বলেন, “আমরা বসে থাকব আর নবিজি (সা.) কাজ করবেন, আমাদের এ কর্ম হবে কেবলই বিভ্রান্তিকর।” নির্মাণ কাজ চলাকালে মুসলমানরা সমবেত কণ্ঠে আবৃত্তি করতেন, “পরকালের সুখই পরম সুখ, অন্য কিছু নয়। হে আল্লাহ্! রহম করো তুমি আনসার এবং মুহাজিরগণকে।” তখন হযরত রাসুল (সা.)-ও বলতেন, “পরকালের সুখই পরম সুখ, অন্য কিছু নয়। হে আল্লাহ! রহম করো মুহাজির আর আনসারগণকে।”

মসজিদে নববি নির্মাণকালে মুসলমানদের কেবলা ছিল বায়তুল মোকাদ্দাস। তাই মসজিদে নববির কেব্লা ছিল উত্তর দিকে অর্থাৎ বায়তুল মোকাদ্দাসমুখী। কেবলা নিদের্শক হিসেবে দেওয়ালের গায়ে একটি পাথর স্থাপন করা হয়। মসজিদটির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে মক্কা থেকে আগত মুহাজির সাহাবিদের জন্য খেজুর পাতার ছাউনি দিয়ে একটি বারান্দা নির্মাণ করা হয়। এই স্থানটিকে বলা হয় ‘আল সুফফাহ’। আরবি ‘সুফফাহ’ শব্দের বাংলা অর্থ বারান্দা। এই স্থানে যে সকল সাহাবি বসবাস করতেন তাঁদেরকে ‘আহলে সুফফাহ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। আবু নাঈম রচিত ‘আল হেলইয়া’ গ্রন্থে তাদের সংখ্যা ১০০-এরও অধিক বলে উল্লেখ রয়েছে। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘আমি ৭০ জন সুফফা বাসিন্দাকে দেখেছি।’ (ওয়াফাহ আল ওয়াফাহ, ২য় খণ্ড; নূরুদ্দিন সামহুদী)

দরজাসমূহ
মসজিদে নববিতে প্রবেশের জন্য সেসময় ৩টি দরজা ছিল। এগুলো হলো-
১. দক্ষিণ দিকের দরজা: এটি ছিল মসজিদে নববি-এর প্রধান প্রবেশ পথ। এই দরজা দিয়ে সাধারণ মুসল্লিরা মসজিদে প্রবেশ করত এবং বের হতো।
২. পশ্চিম দিকের দরজা: এই দরজাটির নাম ছিল ‘বাবে রহমত’ বা ‘বাব আল আতিক’।
৩. পূর্ব দিকের দরজা: এই দরজাটির নাম ছিল ‘বাব আল জিব্রাইল’। এই দরজা দিয়েই হযরত রাসুল (সা.) মসজিদে নববিতে প্রবেশ করতেন বিধায় একে ‘বাব উন নবি’-ও বলা হয়।
রোদের তাপের কষ্ট লাঘবের উদ্দেশ্যে উত্তরমুখী করে মসজিদের ছাদ নির্মাণ করা হয়। ছাদটি খেজুর গাছের কাণ্ডের স্তম্ভের উপর খেজুর পাতার ছাউনির সাথে কাদামাটির প্রলেপ দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল। বৃষ্টির পানি নামার জন্য ছাদটি কিছুটা ঢালু করে তৈরি করা হয়। প্রত্যেকটি সারিতে ১৮টি করে দুই সারিতে ৩৬টি স্তম্ভ ছিল। ছাদটি সর্বপ্রথম ২১ ফুট উচ্চতায় নির্মাণ করা হয়। এই সম্পর্কে হযরত রাসুল (সা.) বলেন, “মসজিদের ছাদ মুসা (আ.)-এর ছাদের অনুরূপ ৭ গজ (২১ ফুট) উঁচু করে তৈরি করো।” ওজুর সুবিধার্থে মসজিদের বাইরে একটি কূপ স্থাপন করা হয়। এভাবে দীর্ঘ ৭ মাস কাজ করার পর ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যভাগে মসজিদে নববির নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়।

আজানের প্রচলন
মসজিদে নববির প্রথম পর্যায়ে আজানের প্রচলন ছিল না। পরবর্তীতে খাজরাজ গোত্রের হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জায়েদ ইবনে আবদে রাব্বি (রা.)-কে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে স্বপ্নযোগে সবুজ পোশাক পরিহিত এক ব্যক্তির দ্বারা আজানের বাক্যগুলো বলে দেওয়া হয়। হযরত উমর (রা.)-ও স্বপ্নের মাধ্যমে আজানের বাক্যগুলো জানতে পারেন। এরপর হযরত রাসুল (সা.) আজানের মাধ্যমে নামাজের আহ্বান জানানোর নির্দেশ দেন। তৎকালীন মসজিদে কোনো মিনার না থাকায় হযরত রাসুল (সা.) মসজিদ সংলগ্ন একটি উঁচু বাড়ির ছাদ থেকে হযরত বিলাল (রা.)-কে আজান দেওয়ার নির্দেশ দেন, যেন দূর থেকে আজানের ধ্বনি শোনা যায়। পরবর্তীতে মসজিদের পূর্ব পাশে অবস্থিত হযরত হাফসা (রা.)-এর ঘরের পাশে একটি ছোটো স্থানে দাঁড়িয়ে হযরত বিলাল (রা.) আজান দিতেন।

মেহরাব
মসজিদে ইমামের নামাজ আদায়ের স্থানে আলাদাভাবে ঘেরাও করা স্থানকে ‘মেহরাব’ বলা হয়। প্রথমাবস্থায় মসজিদে নববিতে হযরত রাসুল (সা.)-এর নামাজ আদায়ের স্থানে এই রকম কোনো মেহরাব ছিল না। পরবর্তীতে ৫ম উমাইয়া খলিফা ১ম ওয়ালিদ-এর সময়ে হযরত রাসুল (সা.)-এর নামাজ আদায়ের স্থানগুলোতে মেহরাব তৈরি করা হয়। হযরত রাসুল (সা.)-এর স্মৃতি বিজড়িত ২টি মেহরাব-এর বর্ণনা নিম্নে দেওয়া হলো-
০১) মেহরাব-এ-নববি: হযরত রাসুল (সা.) যে নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়িয়ে নামাজের ইমামতি করতেন ঐ স্থানটিকে মেহরাব-এ-নববি বলা হয়। এই মেহরাবটি রিয়াজুল জান্নাত-এর মধ্যে এবং ‘উস্তায়ানায়ে আয়েশা/মোহাজেরিন’ নামক স্তম্ভের নিকটে অবস্থিত।
০২) তাহাজ্জুদের মেহরাব: হযরত রাসুল (সা.) হযরত ফাতেমা (রা.)-এর হুজরা শরীফের নিকটে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করতেন। উক্ত স্থানটি ‘তাহাজ্জুদের মেহরাব’ নামে পরিচিত। মেহরাব-এ তাহাজ্জুদ মসজিদে নববির পূর্ব দিকে অবস্থিত ‘বাব উন নবি’-এর সমান্তরালে এবং হযরত রাসুল (সা.)-এর রওজা মোবারকের পিছনে অবস্থিত। এই মেহরাবটির স্থানে বর্তমানে একটি লাইব্রেরি করা হয়েছে।

বাসস্থান নির্মাণ
মসজিদে নববির নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হতে প্রায় ৭ মাস সময় অতিবাহিত হয়। এই ৭ মাস আল্লাহ্র রাসুল (সা.) হযরত আইয়ুব আনসারি (রা.)-এর বাড়িতেই অবস্থান করেন। মসজিদের নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর মসজিদের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে হযরত রাসুল (সা.)-এর জন্য দুটি কক্ষ নির্মাণ করা হয়। উম্মুল মু’মেনিন হযরত আয়েশা (রা.)-এর হুজরা শরীফ ছিল মসজিদে নববির পূর্ব দরজা বরাবর, যেখানে বর্তমানে হযরত রাসুল (সা.)-এর রওজা মোবারক অবস্থিত। আর উম্মুল মু’মেনিন হযরত সাওদা (রা.)-এর হুজরা শরীফ ছিল মসজিদের দক্ষিণ দেওয়ালের দিকে। মসজিদের দেওয়াল ও ছাদের ন্যায় হুজরা শরীফের দেওয়াল ও ছাদ নির্মাণ করা হয়। উল্লেখ্য যে, মদিনায় হিজরতের ৭ মাস পর হযরত মা সাওদা (রা.) হযরত রাসুল (সা.)-এর তিন কন্যা-সহ হযরত জায়েদ (রা.)-এর সাথে মদীনা শরীফে তাশরিফ নেন। আর হযরত মা আয়েশা (রা.) তাঁর ভাই হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আবু বকর (রা.)-এর সাথে মদীনায় আগমন করেন।

রিয়াজুল জান্নাত
হযরত রাসুল (সা.)-এর পবিত্র হুজরা শরীফ বা বর্তমান রওজা মোবারক থেকে তাঁর মিম্বরের মধ্যবর্তী স্থানকে হযরত রাসুল (সা.) বেহেশতের একটি বাগান বলে উল্লেখ করেছেন, যাকে ‘রিয়াজুল জান্নাত’ বলা হয়। এই অংশটি বর্তমানে সবুজ-সাদা রংয়ের গালিচা দ্বারা আচ্ছাদিত। এই সম্পর্কে হযরত রাসুল (সা.) বলেছেন, “আমার ঘর ও মিম্বরের মধ্যবর্তী স্থান জান্নাতের বাগানগুলোর একটি বাগান আর আমার মিম্বর অবস্থিত আমার হাউজে কাউসার-এর উপরে।” (বোখারি শরীফ হাদিস নং ১১৯৬; মুসলিম শরীফ হাদিস নং ১৩৯১)

সংস্কার কার্যক্রম
মসজিদে নববি নির্মাণের পর থেকে আজ অবধি বহুবার এর সংস্কার ও সম্প্রসারণ করা হয়েছে। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে নিম্নে উল্লেখযোগ্য সংস্কার ও সম্প্রসারণ কার্যক্রমের বিবরণ উপস্থাপন করা হলো-

১ম সংস্কার
উদ্যোগ গ্রহণকারী: হযরত রাসুল (সা.)
সময়: ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দ (২ হিজরি)
বিবরণ: ২য় হিজরির রজব মতান্তরে শাবান মাসে (৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে) হযরত রাসুল (সা.) মহান আল্লাহ্র পক্ষ থেকে কেব্লা পরিবর্তনের নির্দেশ পান। তখন মসজিদে নববি অনেকটা নতুন করে নির্মাণ করার প্রয়োজন দেখা দেয়। অতঃপর মসজিদটির কেব্লা উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ দিকে অর্থাৎ পবিত্র কাবা শরীফের দিকে পরিবর্তন করা হয়। এসময় কেব্লার ছাদ এবং নামাজের স্থান উভয়ই উত্তর থেকে দক্ষিণে স্থানান্তর করা হয়। কেবলা নির্দেশক পাথরটি দক্ষিণ দেওয়ালে স্থাপন করা হয়। আহলে সুফফাকে উত্তর দিকে এবং মসজিদের প্রধান দরজা দক্ষিণ থেকে উত্তরে স্থানান্তর করা হয়। ফলে দক্ষিণের দরজাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই সংস্কারের কারণে প্রায় ১৫ দিন এখানে নামাজ আদায় করা সম্ভব হয়নি। এমতাবস্থায় নামাজ আদায় করা হতো হযরত রাসুল (সা.)-এর হুজরা শরীফের পাশে অবস্থিত ‘আয়েশা/মোহাজেরিন’ নামক স্তম্ভের পিছনে।

২য় সংস্কার
উদ্যোগ গ্রহণকারী: হযরত রাসুল (সা.)
সময়: ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দ (৭ হিজরি)
বিবরণ: হযরত রাসুল (সা.) খায়বার যুদ্ধের পরপর হিজরি ৭ সালে (৬২৯ খ্রিষ্টাব্দ) এই মসজিদের প্রথম সম্প্রসারণ করেছিলেন। তখন মসজিদের দৈর্ঘ্য ৫০ ফুট বাড়িয়ে প্রায় ১৬৫ ফুট এবং প্রস্থ ৬৫ ফুট বাড়িয়ে প্রায় ১৬৫ ফুট করা হয়। ফলে মসজিদের আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ২৭,২২৫ বর্গফুট (১৬৫ ফুট১৬৫ ফুট)। তখন মসজিদের পশ্চিম সীমানা দেওয়াল মিম্বর থেকে ৫ কলাম দূরে ছিল। নতুন দেওয়ালের ভিত্তি পাথর দিয়ে এবং দেওয়ালগুলো পূর্বের মতো রোদে পোড়া কাঁচা ইট দিয়ে নির্মিত হয়। সম্প্রসারণ কাজের সময়ও হযরত রাসুল (সা.) নিজে ইট বহন করে সাহাবিদেরকে সাহায্য করেছেন। মসজিদের স্তম্ভগুলো খেজুর গাছ দ্বারা নির্মাণ করা হয় এবং ছাদ খেজুর পাতা দ্বারা আচ্ছাাদিত করা হয়। ১ম সম্প্রসারণের জমিটি হযরত উসমান (রা.) এক আনসার সাহাবি থেকে ক্রয় করেছিলেন। তিনি আল্লাহ্র রাসুল (সা.)-এর নিকট এসে আরজ করলেন, যেন জান্নাতের একটি গৃহের বিনিময়ে তার এই জায়গাটি হযরত রাসুল (সা.) ক্রয় করেন।
উল্লেখ্য যে, মসজিদে নববি সংলগ্ন হযরত হারেস ইবন নোমান আনসারি (রা.)-এর একটি বাড়ি ছিল। তিনি এই বাড়িটি হযরত রাসুল (সা.)-কে উপহার স্বরূপ প্রদান করেন। উক্ত স্থানে হযরত রাসুল (সা.)-এর পরিবারের সদস্যদের বসবাসের জন্য পূর্বের ২টি কক্ষের সাথে নতুন করে আরো ৭টি কক্ষ যুক্ত করে মোট ৯টি কক্ষে উন্নীত করা হয়। নবিনন্দিনী হযরত ফাতেমা (রা.)-এর হুজরা শরীফ ছিল হযরত আয়েশা (রা.)-এর হুজরা শরীফের বরাবর। দুটি হুজরা শরীফের মধ্যবর্তী দেওয়ালে এক কপাট বিশিষ্ট একটি কাঠের দরজা ছিল। হযরত রাসুল (সা.) যখনি হুজরা শরীফে প্রবেশ করতেন; সর্বপ্রথম হযরত ফাতেমা (রা.)-এর গৃহে প্রবেশ করে হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু, হযরত ফাতেমা (রা.), হযরত ইমাম হাসান (রা.) এবং হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর সাথে কুশল বিনিময় করতেন। কখনও কখনও হযরত আলী (কা.) নিজ হাতে খাবার প্রস্তুত করে দয়াল রাসুল (সা.)-এর খেদমতে পেশ করতেন। আহার শেষে হযরত রাসুল (সা.) হযরত মা আয়েশা (রা.)-এর গৃহে প্রবেশ করতেন। পরবর্তীতে এই দুই হুজরা শরীফের মধ্যবর্তী দেওয়ালের দরজাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। (জজবুল কুলুব, ওয়াফাহ আল ওয়াফাহ ১ম খণ্ড)

হযরত রাসুল (সা.) এর হুজরা শরীফগুলোর অবস্থান
হযরত রাসুল (সা.) এর প্রত্যেক সহধর্মিণীর সাথে অবস্থানের জন্য ভিন্ন ভিন্ন হুজরা শরীফ ছিল। এগুলো হলো
১. দক্ষিণ দিকে- হযরত মা সাওদা (রা.) এবং হযরত মা সাফিয়্যা (রা.)-এর হুজরা শরীফ।
২. উত্তর দিকে- হযরত মা উম্মে সালমা (রা.), হযরত মা উম্মে হাবিবা (রা.), হযরত মা জয়নব (রা.), হযরত মা জুয়াইরিয়্যা (রা.) এবং হযরত মা মাইমুনা (রা.)-এর হুজরা শরীফ।
৩. পূর্ব দিকে- হযরত মা আয়েশা (রা.) এবং হযরত মা মারিয়া (রা.)-এর হুজরা শরীফ।
সবগুলো হুজরা শরীফই ছিল মসজিদ অভিমুখী এবং প্রত্যেকটি হুজরা শরীফেই ইবাদতের জন্য আলাদা স্থান ছিল।

মিম্বর
প্রথমদিকে মসজিদে নববিতে মিম্বরের ব্যবস্থা ছিল না বিধায় হযরত রাসুল (সা.) মেহরাব সংলগ্ন পশ্চিম দিকে দাঁড়িয়ে খুৎবা প্রদান করতেন। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে খুৎবা প্রদান করার সময় তিনি মাঝে মাঝে সেখানে স্থাপিত খেজুর গাছের একটি খুঁটিতে হেলান দিতেন। একনাগাড়ে র্দীঘক্ষণ দাঁড়িয়ে খুৎবা প্রদান করা আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর জন্য কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। তখন সাহাবিগণ হযরত রাসুল (সা.)-কে খুৎবা প্রদানের স্থানে একটি মিম্বর স্থাপন করার প্রস্তাব দিলেন। হযরত রাসুল (সা.) তাঁদের এই প্রস্তাবে সম্মত হন। আল্লাহ্র রাসুল (সা.) যখন মিম্বর তৈরির বিষয়ে সাহাবিদের সাথে পরামর্শ করছিলেন, তখন তাঁর চাচা হযরত আব্বাস (রা.) বলেন, “আমার গোলাম কিলাব ভালো কাঠ মিস্ত্রি, সে মিম্বর তৈরি করতে পারবে।” অতঃপর হযরত আব্বাস (রা.) কিলাব-কে জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে মিম্বর তৈরির আদেশ দেন। কিলাব তিন ধাপ বিশিষ্ট বর্গাকৃতির একটি মিম্বর তৈরি করেন। মিম্বরটির উচ্চতা ছিল ৩ ফুট এবং দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ছিল ১.৫ ফুট। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, আবিসিনীয় কাঠ মিস্ত্রি বাক্কুম মিম্বরটি তৈরি করেন। মিম্বরটি স্থাপন করা হয় ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে (৮ হিজরি)। হযরত রাসুল (সা.) মিম্বরের ৩য় ধাপে বসতেন এবং ২য় ধাপে কদম মোবারক রাখতেন। মিম্বর তৈরির পর হযরত রাসুল (সা.) দুই খুৎবার মাঝে একবার সেখানে বসে বিশ্রাম নিতেন। উল্লেখ্য যে, আমির মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান (শাসনকাল: ৬৬১-৬৮০ খ্রি; ৪১-৬০ হি.) ৬৭০ খ্রিষ্টাব্দে (৫০ হিজরি) হযরত রাসুল (সা.)-এর মিম্বরটি মদীনা থেকে সিরিয়ার দামেস্কে সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এই উদ্দেশ্যে যখন তিনি মিম্বরটি উত্তোলন করেন; ঠিক তখনি হঠাৎ সূর্যগ্রহণ আরম্ভ হয়, প্রবল বেগে বাতাস বইতে শুরু করে, আকাশে বিদ্যুৎ চমকাতে থাকে এবং ভূমিকম্প হতে থাকে। এর ফলে সবার মধ্যে ভীষণ আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। তখন মুয়াবিয়া বলেন, “মিম্বরকে মাটিতে খেয়ে ফেলেছে কিনা, তা পরীক্ষা করে দেখাই আমার উদ্দেশ্য ছিল।” অতঃপর বিভিন্ন ব্যক্তির পরামর্শে তিনি এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। (হৃদয় তীর্থ মদীনার পথে, মূল: জজবুল-কুলুব ইলা দিয়ারিল মাহবুব, শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দেস দেহলভী (রহ.),অনুবাদ- মুহিউদ্দীন খান, পৃষ্ঠা ৭০)

আলোর ব্যবস্থা
প্রথম পর্যায়ে মসজিদে নববিতে খেজুর গাছের আঁশ বা ছাল জ্বালিয়ে আলোর ব্যবস্থা করা হতো। কিন্তু পরবর্তীতে ৯ম হিজরিতে হযরত তামিম (রা.) মসজিদে নববির আলোর এই দুরবস্থা দেখে ফানুস (এক প্রকার হারিকেন জাতীয় ল্যাম্প)-এর ব্যবস্থা করেন। এর ফলে মসজিদের অভ্যন্তরে পর্যাপ্ত আলো সরবরাহ নিশ্চিত হয়। মসজিদে আলোর এই সুব্যবস্থা দেখে হযরত রাসুল (সা.) অত্যন্ত খুশি হন এবং হযরত তামিম আলদ্বারি (রা.)-কে বলেছিলেন, “আমাদের মসজিদ তুমি আলোকিত করলে, আল্লাহ্ তোমাকে আলোকিত করুন।” (স্মৃতি অম্লান মদীনা মোনাওয়ারা, আবদুল কাইয়ুম আব্বাসী, পৃষ্ঠা ৮২)
(চলবে)
[লেখক: পরিচালক, দেওয়ানবাগ শরীফ; সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, দি পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ]

সম্পর্কিত পোস্ট