Cancel Preloader

মানবতার কবি শেখ সাদি (রহ.)

ড. সৈয়দ মেহেদী হাসান

পর্ব-০২
বাংলাদেশে শেখ সাদির কাব্যচর্চা
শেখ সাদি (রহ.)-এর সাহিত্য কর্মের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্য সংকলন হলো ‘সাদী নামে’, যা পরবর্তীতে ‘বুস্তান’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। তিনি ১২৫৭ খ্রিষ্টাব্দে গ্রন্থটি রচনা করেন। ‘বুস্তান’ গ্রন্থটিতে তিনি বিভিন্ন বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে দশটি অধ্যায়ে বিভক্ত করেন। এ কাব্যের প্রতিটি অধ্যায়ে কবি বাস্তব জীবনের বিভিন্ন সমস্যাবলি তুলে ধরেন এবং স্বীয় অভিজ্ঞতার আলোকে একাধিক গল্প বর্ণনার মাধ্যমে সমাধানের পন্থা নির্দেশ করেন। তাঁর এই কাব্য আলাদাভাবে এবং ‘কুল্লিয়াতে সাদী’ (সাদীর রচনাবলি) রূপে বহুবার প্রকাশিত হয়। এছাড়া ফারসি কাব্যসাহিত্যে শেখ সাদির অন্যান্য অবদানগুলো হলো: কাসায়েদ, দিওয়ানে গাজালিয়াত, মারসিয়া, সাহেবিয়া, খাবিছাত (বিদ্রুপাত্মক কবিতা), রুবা’ঈ (চতুষ্পদী কবিতা), মাসনাবি, কেতয়াত ও মুফরাদাত।
শেখ সাদি (রহ.) শুধু ইরানের প্রথম সারির কবিদের অন্যতমই ছিলেন না, বরং গদ্য লেখক হিসেবেও তিনি সমান মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। তাঁর চিরঞ্জীব গদ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে ‘গুলিস্তান’ গ্রন্থখানা অন্যতম। তিনি ১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর এ গদ্য গ্রন্থখানা রচনা করেন। ফারসি গদ্যসাহিত্য সাদির অন্যান্য অবদানগুলো হলো- মাজালিসে পাঞ্জেগানা, রেসালে দার আকল ও ইশক, নাসিহাতুল মুলুক ও তাকরিরাতে ছালাছা।


বাংলা কবি-সাহিত্যিকগণের মধ্যে যিনি শেখ সাদির কাব্যের দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়েছেন তিনি হচ্ছেন কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার (১৮৩৪-১৯০৭)। শেখ সাদি (রহ.)-এর গুলিস্তান গ্রন্থ এ কবিকে দান করেছিল এক প্রকার স্বস্তি। কৃষ্ণচন্দ্র তাঁকে (সাদি) নীতি কবিতার অনুসরণীয় ব্যক্তি বলে গ্রহণ করেছিলেন।


শেখ সাদি (রহ.) অপব্যয়ের কুফল সম্পর্কে ফারসি ভাষায় কবিতার মাধ্যমে প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে মোহাম্মদ আলী ফরুগী রচিত ‘কুল্লিয়াতে সাদি’ কাব্যগ্রন্থের পৃষ্ঠা ৪৯ থেকে কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার তার অপব্যয়ের কবিতার কাব্যানুবাদ করেন।
কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার তাঁর অপব্যয়ের ফল কবিতার কাব্যানুবাদ করেছেন এভাবে:
‘যে জন দিবসে মনের হরষে
জ্বালায় মোমের বাতি;
আশুগৃহে তার দেখিবে না আর
নিশিতে প্রদীপ ভাতি।’৭

মূল কবিতা
“আবলাহি কু রোজে রওশন শামে কুফরি নাহাদ
জুদ বিনিহি কেশ বি সাব রোগান না বশাদ দার চেরাগ।”
নৈতিক কবি সাদি গীবত বা পরনিন্দা হতে বিরত থাকার উপদেশ দিয়েছেন। কবি শেখ সাদীর রচিত ‘কুল্লিয়াতে সাদী’ গ্রন্থের ২৪৪ পৃষ্ঠায় মোহাম্মদ আলী ফরুগীর লিখিত পরনিন্দা কবিতাটি কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার তার নিন্দুক কবিতার মাধ্যমে জাতির কাছে প্রকাশ করেছেন।
কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার তার নিন্দুক কবিতায় সাদির প্রতিধ্বনি করে বলেন:
‘পরদোষ তোমার নিকট যে কয়,
বলে সে তোমার দোষ অপরে নিশ্চয়।’

মূল কবিতা
“হারকেহ ইবে দিগারন র পিশেতু অবারদো শেমরদ বিগুমন ইবে তু পিশে দিগারন খহাদ বোদ।”১০
নৈতিক কবি সাদি গরিব-দুঃখীদের দুঃখে সমব্যথী হওয়ার জন্য উপদেশ দিয়েছেন। পরবর্তীতে কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার শেখ সাদি (রহ.) রচিত ‘কুল্লিয়াতে সাদী’ কিতাবের ৪২ পৃষ্ঠায় মোহাম্মদ আলী ফরুগীর রচিত সাদী গ্রন্থ থেকে বাংলায় অনুবাদ করেন।
কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার তার সুখী দুঃখীর দুঃখ বুঝে না শীর্ষক কবিতায় সাদির এই কবিতার প্রতিচ্ছবি করে বলেছেন:
‘চির সুখীজন ভ্রমে কি কখন
ব্যথিত বেদন বুঝিত পারে?
কি যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে
কভু আশীবিষে দংশেনি যারে?
যতদিন ভবে না হবে না হবে
তোমার অবস্থা আমার সম;
ঈষৎ হাসিবে শুনে না শুনিবে
বুঝে না বুঝিবে যাতনা মম।’১১

মূল কবিতা
“তান দুরস্তান র না বশাদ দার দেরিশ, জুয হামদার দি না গুইয়াম দার দি খিশ গুফতান আয জামবুর বি হসেল বুয়াদ বইয়েকি দার উমরে খুদ ন খুরদেহ নিশ। ততর হলি না বশাদ হাম চু ম হলে ম বশাদ তু র আফসনেহ পিশ। সুওজে মান ব দিগারি নেজবাত মাকন উ নামাক বার দাসত ও মান বার উজবেরিশ।১২


কবি শেখ সাদি (রহ.) অন্যের দুঃখ-কষ্ট দেখে নিজের দুঃখ কষ্টের কথা ভুলে গিয়ে ধৈর্যধারণ করার উপদেশ দিয়েছেন। এ সম্পর্কে সাদি তার গুলিস্তান গ্রন্থে ব্যক্তিগত জীবন থেকে একটি গল্প বর্ণনা করেন।


পরবর্তীতে গুরগানী সম্পাদিত ‘গুলিস্তানে সাদী’ থেকে কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার অনুবাদ করেছেন। তিনি শেখ সাদির উল্লিখিত গল্পের কাব্যরূপ দিয়েছেন এভাবে:
‘একদা ছিল না জুতো চরণ যুগলে,
দহিল হৃদয় বন সেই ক্ষোভানলে।
ধীরে ধীরে চুপিচুপি দুঃখাকুল মনে,
গেলাম ভজনালয়ে ভজন কারণে।
দেখি তথা একজন পদ নাহি তার,
অমনি জুতোর খেদ ঘুচিল আমার।
পরের অভাব মনে করিলে চিন্তন,
আপন অভাব ক্ষোভ রহে কতক্ষণ?’১৩

মূল কবিতা
“হারগেজ আয দোওরে জামান নানলিদেআস ও রুইয়ে আযগার বেশিঅর সিমন দার হাম নাকিশিদে আম মাগার ওয়াকতিকেহ গায়াম বেরেহনেহ মনদেহ বুদে এসতে ত আত পইয়ি পুসি না দস্তাম বহ জমে কুফেহ দার অমাদাম তানগ দেল ইয়েদি র দিদাম কেহ পইয়ি না দসত সিফাসেহ নেহমাতে হায বেহ জইয়ি অবারদাম ও বার বি কাফসি ছার করদাম।”১৪


বাংলা সাহিত্যের আরেকজন খ্যাতিমান কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনিও সাদীর কাব্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কবিতা রচনা করেন। শেখ সাদী (রহ.) ভদ্রলোকের আত্মমর্যাদা সম্পর্কে তার বুস্তান গ্রন্থে গল্প বর্ণনা করেছেন। পরবর্তীতে গোলাম হোসাইন ইউসুফী সম্পাদিত ‘বুস্তানে সাদী’ থেকে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা ভাষায় সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন।

কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত নৈতিক কবি সাদীর গল্পকে তার ‘অধম ও উত্তম’ কবিতায় কাব্যরূপ দিয়েছেন। কবির ভাষায়:
সাগি পয়ি ছাহর নিশিনি গাজিদ
বেহ খাসসি কেহ জাহরাশ জে দানদন চেকিদ
সাব আয দারদ বি চরেহ খবাশ নাবুরদ
বেহ খেইল আন দারাশ দকতারি বুদ খোরদ
ফেদার র জাফ কারদো তুনদি গুদ
কেহ অখের তুহ র নিয দানদন না বুদ।
পাস আয গেরিয়ে মারদে ফারহ গানদেহ রোজ
বেখানদিদ কেহ মমকেহ দল ফুরুজ
মার আগার চেহ হাম শালতানাত বুদ ও বিশ
দারিগ অমাদাম কম ও দনেদান খিশ
মহল আসত আগার তিগবার ছার খুরাম
কেহ দানদন বেহ পয়ি ছাগ আনদার বারাম
তাবন কারদ ব ন কাছন বদ রাগি
ওয়ালিকন না অইয়াদ যে মারদম ছাগি। ১৫

অনুবাদ:
কুকর আসিয়া এমন কামড়
দিল পথিকের পায়,
কামড়ের চোটে বিষ দাঁত ফুটে
বিষ লেগে গেল তায়।
ঘরে ফিরে এসে রাত্রে বেচারা
বিষম ব্যথায় জাগে,
মেয়েটি তাহার তারি সাথে হায়
জাগে শিয়রের আগে।
বাপেরে সে বলে ভৎসনা-ছলে
কপালে রাখিয়া হাত,
‘তুমি কেন বাবা ছেড়ে দিলে তারে?
তোমার কি নেই দাঁত?’
কষ্টে হাসিয়া আর্ত কহিল
‘তুইরে হাসালি মোরে,
দাঁত আছে বলে কুকুরের পায়
দংশি কেমন করে?
কুকুরের কাজ কুকুর করেছে
কামড় দিয়েছে পায়,
তা’ বলে কুকুরে কামড়ানো কিরে
মানুষের শোভা পায়। ১৬
(মণি-মঞ্জুষা)

মোবারক আলী কবি শেখ সাদীর অসৎ সঙ্গ অবলম্বনের কুফল সম্পর্কে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। শেখ সাদীর কবিতাটি কবি মোবারক আলী মোহাম্মদ আলী ফরুগী রচিত ‘কুল্লিয়াতে সাদী’-গ্রন্থ থেকে অনুবাদ করেছেন:
মেঘ যদি অমৃত বারি করে বরিষণ।
ঝাউ গাছে ফুল নাহি ধরিবে কখন।
ইতর সংসর্গ সদা করহ বর্জন।
নল খাগড়া হতে চিনি পাবে না কখন।১৮

মূল কবিতা
আবরে আগার অবে জিন্দেগি বরাদ
হারগেজ আয শখে বিদ বার না খুরিদ
বফুরুমহে রুজিগর মরার
কাজনিইয়ে বুরিঅ শেখার না খুরিদ।১৭


ফারসি কবি সাহিত্যকগণের মধ্যে কবি শেখ সাদীই হচ্ছেন বাংলাদেশে সর্বপেক্ষা জনপ্রিয় ফারসি ভাষার কবি। তাঁর বিখ্যাত বুস্তান ও গুলিস্তান নৈতিক গ্রন্থ দুটি এ দেশের কবি সাহিত্যিকসহ সর্বস্তরের মানুষের হৃদয়পটে স্থান করে নিয়েছে। যা কবি শেখ সাদীকে সাহিত্য জগতে অমর করে রেখেছে। বর্তমান যুব সমাজকে দায়িত্ব, কর্তব্যবোধ ও নীতিবোধে উজ্জীবিত করে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে গ্রন্থ দুটির গুরুত্ব অপরিসীম- যা ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সুশৃঙ্খল ও সমুন্নত পথ নির্দেশক। গ্রন্থ দুটির যথার্থ অনুসরণ একজন মানুষকে সৎ. আদর্শ ও নান্দনিক জীবন-যাপনে অভ্যস্ত করে তুলতে সহায়তা করবে। তাই আমি মনে করি যে, শেখ সাদীর গুলিস্তান ও বুস্তান শীর্ষক নৈতিক গ্রন্থ দুটি বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সকল পর্যায়ে পঠন-পাঠন এবং উচ্চ পর্যায়ে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।


সহায়ক গ্রন্থ:
১। ড. মোঃ ওসমান গনী, বাংলাদেশে শেখ সাদীর কাব্যচর্চা: একটি পর্যালোচনা, আইবিএস জার্নাল, অষ্টাদশ সংখ্যা ১৪১৭
২। হাসান আনওয়ারী, শুরীদেহ ওয়া বিকারার দার বারেয়ে জিন্দেগী ওয়া আছারে সা’দী (তেহরান, নাশরে কাতরে) পৃষ্ঠা ১৮
৩। আল্লামা শিবলী নোমানী, শেরুল আজম, ২য় খণ্ড (লাহোর: ইশরাত পাবলিশিং হাউস, তা.বি.), পৃ. ৪৪-৪৫
৪। আদাব নামেয়ে ইরান, পৃ. ৫১২
৫। শেরুল আজম ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৪-৪৫
৬। সুশান্ত সরকার, কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার, পৃ ৫১
৭। সুশান্ত সরকার, কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার, পৃ ৫৩
৮। মোহাম্মদ আলী ফরুগী, কুল্লিয়াতে সা’দী পৃ. ৪৯
৯। সুশান্ত সরকার, কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার, পৃ ৬০
১০। মোহাম্মদ আলী ফরুগী, কুল্লিয়াতে সা’দী পৃ. ২৪৪
১১। সুশান্ত সরকার, কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার, পৃ ৭৩
১২। মোহাম্মদ আলী ফরুগী, কুল্লিয়াতে সা’দী পৃ. ৪২
১৩। সুশান্ত সরকার, কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার, পৃ ৭৩
১৪। গুরাগানী (সম্পাদিত), গুলিস্তানে সা’দী পৃ. ১৭৭
১৫। গোলাম হোসাইন ইউসুফী সম্পাদিত, বুস্তানে সা’দী পৃ. ১২৩-১২৪
১৬। সত্যেন্দ্র কাব্যগুচ্ছ সাহিত্য সংসদ, ১ম প্রকাশ ১৯৮৪, পৃ. ৫৪৭
১৭। শায়খ সা’দী (রহ.)-এর গুলিস্তা, পৃ. ৮
১৮। মোহাম্মদ আলী ফরুগী, কুল্লিয়াতে সা’দী পৃ. ৪১
[লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক]

সম্পর্কিত পোস্ট