Cancel Preloader

মিথ্যার উপর সত্যের বিজয় চিরন্তন

ইমাম প্রফেসর ড. আরসাম কুদরত এ খোদা
সত্য ও মিথ্যার সংঘাত চিরদিনের। সত্যের পাশাপাশিই মিথ্যার অবস্থান। তবে মিথ্যা দিয়ে সত্যকে কখনো চাপা রাখা যায় না। সত্য আপন মহিমায় উদ্ভাসিত হয়। সততা ও নিষ্ঠার কারণেই মানুষ উন্নতির উচ্চ শিখরে আরোহণ করতে সক্ষম হয়। অপরদিকে মিথ্যা একটি সামাজিক ব্যাধি, যা মানুষের সকল অগ্রগতির পথকে রুদ্ধ করে দেয়। তাই সত্যকে আঁকড়ে ধরে এবং মিথ্যাকে চিরতরে পরিহার করে পথ চলতে পারলেই সার্থক জীবন গড়ে তোলা সম্ভব। সুতরাং নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, বিজয়ের রাজমুকুট সত্যের মস্তকেই শোভা পায়। সত্যের কোনো সমকক্ষ নেই। সত্যের কোনো বিকল্প নেই। সত্যের বিজয় নিশান চিরকাল সমুন্নত থাকে। এই সত্য মাঝে মাঝে মিথ্যা, ভণ্ডামি ও কূপমণ্ডুকতা দ্বারা সাময়িক অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। মিথ্যার গুমোট মেঘের অন্ধকার মাঝে মাঝে সত্যকে ঢেকে রাখতে চায়। এই ঢেকে রাখা অতটা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সত্যের তেজোদীপ্তের কাছে পরাভূত হয় মিথ্যার দাপট। সত্যের সাথে মিথ্যার সংমিশ্রণের ব্যাপারে মহান রাব্বুল আলামিনের সুস্পষ্ট সতর্কবাণী রয়েছে। পবিত্র কুরআনে তিনি এরশাদ করেন- “তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশিয়ে দিও না এবং জানা সত্ত্বে সত্যকে তোমরা গোপন করো না।” (সূরা আল বাকারা ২: আয়াত ৪২)


সত্য শাশ্বত, সত্য চিরন্তন। যুগে যুগে মানব সম্প্রদায়ের মাঝে এই সত্যকে মিথ্যার সাথে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে দেখা গেছে। সত্যের চিরতেজোদীপ্ত সূর্য কখনোই অস্তমিত হয় না। সত্যের নিজস্ব সংবিধানে ‘অস্তমিত’ শব্দটি নেই। তবে ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে, সময়ের নিদারুণ পালাবদলে ‘সত্য‘ মিথ্যার অপঘাতে জর্জরিত হয়। সাময়িক অবরুদ্ধ হয়। এই অবরুদ্ধ অবস্থা হতে উত্তরণের জন্যে সত্যকে অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। মূলত এই অগ্নিপরীক্ষার মাধ্যমে সত্য আরো মসৃণ হয়, সময়োপযোগী হয় এবং ধৈর্য ও গাম্ভীর্যতার প্রকৃষ্ট উদাহরণও হয়। কখনো কখনো অকস্মাৎ মিথ্যার কালো মেঘ মানব সমাজকে গ্রাস করে ফেলে। চারিদিকে নেমে আসে আলোহীনতার সময়। বচনে, বিশ্বাসে, নিঃশ্বাসে, কর্মে ধীরে ধীরে মানুষের বিবেক মিথ্যার কাছে বিক্রি হয়ে যায়। মিথ্যার অপকৌশলে ধরাশায়ী হয়ে যায় সাধারণ মানুষেরা। ঠিক তখন সত্যেকে নির্বাসিত মনে হলেও আদতে সত্য তখন উদ্ভাসিত হওয়ার তরে অপেক্ষার প্রহর গুনে। কারণ ধৈর্য হচ্ছে সত্যের জন্মগত গুণ। এই গুণের পাঠ শেষ করেই সত্যকে মিথ্যার উপর বিজয় নিশান উড়াতে উদ্যোগী হতে হয়। যুগে যুগে মহান প্রভু মিথ্যার উপর সত্যকে কায়েম করেছেন। যুগে যুগে তিনি সত্যকে উদ্ভাসিত করেছেন মিথ্যার দম্ভোক্তিকে চূর্ণবিচূর্ণ করতে। সমাগত সত্যের জানান দিতে পবিত্র কুরআনে তিনি নাজিল করেছেন- “বলুন সত্য এসেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে। নিশ্চয় মিথ্যা বিলুপ্ত হওয়ারই।” (সূরা বনী ইসরাইল ১৭: আয়াত ৮১)
মহিমান্বিত আল্লাহর বাণী মোবারক দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, সময়কে একটু ত্বরান্বিত করে যদিও মহাসত্য উদ্ভাসিত হয়, তবুও সত্য আপন গতিপথে উদিত হলে মিথ্যা অবলিলাক্রমেই বিলুপ্ত হতে বাধ্য। নিঃসন্দেহে মিথ্যার দাপট ক্ষণস্থায়ী। মিথ্যা কখনো কখনো সাময়িকভাবে সত্যের রূপধারণ করে, কখনো কখনো সত্যের অবিকলে অভিনয় করে, যা স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার অপছন্দনীয়। যে কারণে তিনি সত্যধারণকারী আলোকবর্তিকাকে প্রেরণ করেন। মানবিক অন্ধকার দূরীকরণের প্রয়াসে সত্য প্রেরণের এই মহৎ কাজটি দয়াময় আল্লাহরই নিয়ন্ত্রণাধীন। তিনি নিজেই সত্যকে মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত করেন। সর্বযুগেই তিনি তা করেছেন। যেহেতু মিথ্যার দাপট ক্ষণস্থায়ী, সেহেতু মিথ্যা সাময়িক একটি লোভনীয় প্রক্রিয়া মাত্র। দিন শেষে সত্যের মস্তকে শোভা পায় বিজয়ের মুকুট। আমাদেরকে ব্যক্তি জীবনে খুব সতর্ক হতে হবে সত্য ও মিথ্যার ব্যাপারে। জীবনের যে কোনো মুহূর্তে আমাদেরকে মিথ্যা পরিহার করে চলতে হবে। সমষ্টিগত মিথ্যা ধীরে ধীরে ধাবিত হয় ফেতনার দিকে। আর ফেতনাকে দয়াময় আল্লাহ্ হত্যার মতো জঘন্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, ফেতনা, ফ্যাসাদ, ভয়ানক মিথ্যাচার, সবকিছুর উপর দয়াময়ের ইচ্ছা ও বিধানই কার্যকর হয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ সুস্পষ্টভাবে বলেছেন-“বরং আমি সত্যকে মিথ্যার উপর নিক্ষেপ করি, অতঃপর সত্য মিথ্যার মস্তক চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়, অতঃপর মিথ্যা তৎক্ষণাৎ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তোমরা যা বলছ, তার জন্যে তোমাদের দুর্ভোগ।” (সূরা আম্বিয়া ২১: আয়াত ১৮)


প্রিয় রাসুল হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর মক্কাবিজয়ের দিনে পবিত্র কুরআনের একটি বাণী মোবারক উদ্বৃতি করেন, যেটি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে- “আল্লাহর নবি (সা.) (মক্কা বিজয়ের দিন) যখন মক্কায় প্রবেশ করেন, তখন কাবাঘরের চারপাশে ৩৬০টি মূর্তি ছিল। হযরত মোহাম্মদ (সা.) নিজের হাতের লাঠি দিয়ে মূর্তিগুলো আঘাত করতে থাকেন আর বলতে থাকেন- সত্য এসেছে ও মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে। নিশ্চয়ই মিথ্যা বিলুপ্ত হওয়ারই।” (বোখারী শরীফ, হাদিস: ২য় খণ্ড পৃষ্ঠা ৬৮৬)


আল্লাহর প্রিয় হাবিব হযরত মোহাম্মদ (সা.) মিথ্যাকে পরিহার করার জন্য তাঁর সাহাবিদের প্রতি কঠোরভাবে নির্দেশ করেছেন। অপরদিকে, সত্য কথা বলার এবং সৎ পথে চলার ব্যাপারে উপদেশ দান করেছেন। আমাদের প্রিয় নবি হযরত রাসুল (সা.) তাঁর ৬৩ বছরের হায়াতে জিন্দেগিতে একটি মিথ্যাও বলেননি। কিন্তু আমরা তাঁর উম্মত হয়ে মিথ্যা বলাকে অপরাধ মনে করি না। বরং অনেক ক্ষেত্রে মিথ্যা কথা বলেও গর্ববোধ করে থাকি। অথচ আল্লাহ্র রাসুল বলেন, “মিথ্যা সকল পাপের জননী।” কারো সম্পর্কে সঠিক তথ্য না জেনে কিছু বলা, মিথ্যা বলার শামিল, অথচ এমন প্রবণতা আমাদের সমাজে অহরহই লক্ষ্য করা যায়। অনেকে সঠিক তথ্য না জেনে অলী-আল্লাহর বিরুদ্ধে নানাবিধ মিথ্যা ও অপপ্রচার চালিয়ে থাকে। যা শুধু অপরাধই নয়, চরম গর্হিত ও পাপের কাজও বটে। যুগে যুগে বিপথগামীরা নবি রাসুল ও অলী-আল্লাহর জীবনের উপরে মিথ্যার প্রলেপ লাগানোর অপচেষ্টা করেছে। কিন্তু পরিণতিতে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংস হয়েছে। যদিও মিথ্যারোপ করে মানুষকে সাময়িকভাবে কিছুটা বিব্রত করা সম্ভব হয়, কিন্তু চূড়ান্ত বিজয় সত্যেরই হয়ে থাকে, মিথ্যার নয়। তাহলে মিথ্যা বলে লাভ কী?


আমাদের বর্তমান সমাজের দিকে তাকালে দেখা যায়, মিথ্যাচার করাটা যেন আজ একটা সামাজিক রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। উল্লেখ্য যে, আল্লাহর মহান বন্ধু, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) লিখিত ‘বিশ্বনবীর স্বরূপ উদ্ঘাটনে সূফী সম্রাট: হযরত রাসূল (সঃ) সত্যিই কি গরীব ছিলেন?’ কিতাবে হযরত রাসুল (সা.)-এর সুউচ্চ মর্যাদাকে সমুন্নত করা হয়। অথচ তথাকথিত কিছু সংখ্যক আলেম নামধারী ব্যক্তি এই কিতাবের রেফারেন্স দিয়ে হযরত রাসুল (সা.) সম্পর্কে মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য উপস্থাপন করে বলেন- সূফী সম্রাট রাসুল (সা.)-কে উলঙ্গ দেখেছেন। তারা এমন মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়ে গোটা মুসলিম জাতির বিবেকের উপর আঘাত করে। অথচ সূফী সম্রাটের লিখিত কোনো কিতাবেই এমন কোনো কথা লেখা হয়নি। তাদের এই প্রচারণা ছিল মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর। মূলত সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজানের বিশ্বময় সুনাম ও সুখ্যাতিতে ইর্ষান্বিত হয়ে এক শ্রেণির নামধারী আলেম দেশব্যাপী অরাজকতা সৃষ্টির লক্ষ্যে এই ধরনের মিথ্যার কারণেই অপপ্রচার চালায়। তবে তাদের এই কুটকৌশল সফল হয়নি। বিশ্বনবি হযরত রাসুল (সা.)-এর সহধর্মিণী হযরত মা আয়েশা (রা.)-এর চরিত্র নিয়ে কতিপয় মুসলমান নামধারী ব্যক্তি মিথ্যা অভিযোগ আরোপ করেছিল। মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে আয়াত নাজিল করে হযরত মা আয়েশা (রা.)-এর চারিত্রিক পবিত্রতা সম্পর্কে ঘোষণা দেন। মহান আল্লাহ্ বলেন- “নিশ্চয়ই যারা এ অপবাদ রটনা করেছে, তারাতো তোমাদেরই মধ্য থেকে একটি ক্ষুদ্র দল। তোমরা এ অপবাদকে তোমাদের জন্য মন্দ বলে মনে করো না, বরং এটাতো তোমাদের জন্য কল্যাণকর।” (সূরা আন নূর ২৪: আয়াত ১১) সুতরাং সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী।


মহান আল্লাহর প্রিয় হাবিব হযরত মোহাম্মদ (সা.) ছোটোবেলা থেকেই সত্যবাদী ছিলেন। আরবের কাফেররাই কিশোর বয়সে তাঁকে ‘আল আমিন’ বা ‘বিশ্বস্ত’ উপাধি দিয়েছে। সত্যকথা বলা তথা সত্যবাদী হওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। বর্তমান এই তথ্য প্রযুক্তির যুগে ফেইসবুক ব্যবহার করে মানুষ নানাবিধ মিথ্যাচার করছে। ফলে মানুষের মধ্যে অরাজকতা ও অশান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। শুধু তাই নয়, অনেক মিথ্যা ও অলীক কাহিনী বানিয়ে নির্দোষ মানুষের বিরুদ্ধে নানাবিধ মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়ে তাদের চরিত্র হনন করছে। যা একদিক দিয়ে মানবাধিকার লংঘন এবং অপরদিক দিয়ে চরম গর্হিত ও পাপের কাজ। আইনের দৃষ্টিতে এ কাজ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অনেক সময় এমনও দেখা যায় যে, একজন সম্মানিত ব্যক্তির ছবি এডিটিং-এর মাধ্যমে অশ্লীলভাবে পোস্ট করে তাকে সমাজে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, অনেক কুরুচিসম্পন্ন ব্যক্তি অলী-আল্লাহ্দের নিয়েও এমন চরম অপরাধমূলক কাজ করে থাকে। যদিও এটা সাময়িকভাবে ঐ মহামানবের মান সম্মান কিছুটা লাঘব করে বটে, কিন্তু পরবর্তীতে তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে মিথ্যাবাদীর ঘাড়েই তা পতিত হয় এবং তার মুখোশ জনসমক্ষে খুলে যায়। এ ধরনের অপকর্ম থেকে বিরত থাকা একান্ত জরুরি। সততা মানুষকে এই চিরন্তন বিষয়টিই শিক্ষা দিয়ে থাকে। কোনো অলী-আল্লাহর বিরুদ্ধে এ ধরনের মিথ্যাচার করা হলে, সমাজে ফেতনার সৃষ্টি হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঐ মিথ্যাবাদীই অপমানিত হয়। গ্রাম বাংলায় একটি প্রবাদ আছে- ‘মিছার কপালে পিছা’। অর্থাৎ- মিথ্যাবাদীকে তার কৃতকর্মের জন্য ঝাটার আঘাত খেতে হয়। মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে তাঁর অলীদের সম্পর্কে বলেন- “জেনে রেখো নিশ্চয়ই আল্লাহর বন্ধুদের কোনো ভয় নেই, আর তারা দুঃখিতও হবে না।” (সূরা ইউনুস ১০: আয়াত ৬২) আসলে সত্য চিরদিনই সত্য। মিথ্যার প্রলেপ দিয়ে এটাকে সাময়িকভাবে ঢেকে রাখা গেলেও শেষ পর্যন্ত আরো বেশি তেজস্বীতা নিয়ে সত্য প্রকাশিত হয়ে থাকে। সুতরাং সত্যের কোনো মৃত্যু নেই। এর আলো নিজ গতিতে আরো বেশি বৃদ্ধি পেয়ে তেজোদীপ্তের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। অপরদিকে মিথ্যা মানুষের মুখে চুলকানি লেপন করে মিথ্যাবদীকে সমাজে ঘৃণিত ও লাঞ্ছিত করে তোলে।


আল্লাহর মহান বন্ধু সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান তাঁর আলোচনায় বলতেন- মিথ্যা বলা মহাপাপ। কেননা, একটা মিথ্যা কথা বললে ৪০ দিন পর্যন্ত ঐ ব্যক্তির কোনো দোয়া আল্লাহ্র দরবারে কবুল হয় না। আমাদের সমাজের বহু আলেম এবং মসজিদের ইমাম আলোচনার মধ্যে কামেল পির মাশায়েখ তথা অলী-আল্লাহর বিরুদ্ধে নানাবিধ অপপ্রচার করে থাকেন। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ঐ হুজুরের দেওয়া তথ্যগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। এই মিথ্যা বলার কারণে আল্লাহর দরবারে তার কোনো মোনাজাত কবুল হয় না। ফলে বিপদ-আপদও দূর হয় না। কিন্তু কোনো অলী-আল্লাহ্ তাঁর জবান মোবারক থেকে কিছু বললেই আল্লাহ্ তা কবুল করেন। কেননা, অলী-আল্লাহরা মিথ্যা কথা বলেন না।

উদাহরণ স্বরূপ বিখ্যাত অলী-আল্লাহ্ বড়ো পির হযরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.)-এর শৈশবকালীন জীবনের একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। কিশোর বয়সে হযরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.)-কে তাঁর মা লেখাপড়ার জন্য বাগদাদে পাঠালেন। তিনি যে কাফেলার (দল) সাথে বাগদাদে যাচ্ছিলেন, পথিমধ্যে তাঁরা ডাকাতের কবলে পড়লেন। হঠাৎ ডাকাত দলের একজন হযরত আবদুল কাদের জিলানির কাছে এসে বলল- হে বালক! তোমার কাছে কিছু আছে কী? তিনি জবাব দিলেন- হাঁ, আমার নিকট ৪০টি দিনার (স্বর্ণমুদ্রা) রয়েছে। একথা শুনে ডাকাতের বিশ্বাস হচ্ছিল না। সুতরাং সে কোনোরূপ তল্লাশি না করিয়াই চলে গেলো। কেননা, এতটুকু বালকের কাছে এত বিপুল পরিমাণ স্বর্ণমুদ্রা (বর্তমান মূল্যে কয়েক লক্ষ টাকা) থাকা সম্ভব নয়। এরপর আবার একজন ডাকাত আসলো। সেও এসে তার নিকট একই প্রশ্ন করল। বালক আবদুল কাদের জিলানি আবার একই উত্তর দিলেন। সে মনে করলো বালকটি ঠাট্টা করছে। ডাকাতটি কোনো গুরুত্বারোপ না করে চলে গেলো। অবশেষে তারা উভয়ে বালকের রহস্যজনক উক্তির কথা তাদের সরদারের নিকট জানালো। সরদার বালকটিকে তার নিকট নিয়ে আসার জন্য ডাকাতদ্বয়কে হুকুম করল। তারা বালক আব্দুল কাদের জিলানির নিকট আসলো এবং তাঁকে সরদারের নিকট নিয়ে গেলো। সরদার তাকে জিজ্ঞাস করলো -হে বালক! তোমার নিকট কী আছে সত্য করে বলো। বালক আবদুল কাদের জিলানি বললেন, আমার কাছে ৪০টি স্বর্ণমুদ্রা ছাড়া আর কিছুই নেই। তখন ডাকাত সরদার বলল, কোথায় তোমার স্বর্ণমুদ্রা? তখন হযরত আবদুল কাদের জিলানি বললেন- স্বর্ণমুদ্রাগুলো জামার নিচে। আমার মা জামা সেলাই করে তা আটকিয়ে দিয়েছেন। একথা শুনে ডাকাত সরদার হযরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.)-কে স্বর্ণমুদ্রা বের করতে বলল। সে আরো বলল- হে বালক! তুমি যদি বলতে আমার কাছে কিছু নেই, তাহলেতো আমরা তোমার স্বর্ণমুদ্রা খুঁজে পেতাম না। তখন আল্লাহর অলী হযরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.) বললেন- আমার মা বলেছেন, বাবা! কখনো মিথ্যা কথা বলবে না। কেননা, মিথ্যা বলা মহাপাপ। তাই আমি মায়ের নির্দেশ পালন করেছি। একথা শুনে ডাকাত সরদার অবাক হয়ে গেলো। তার মধ্যে সত্য প্রেমের ভাবাবেগ দেখা দিল। তখন তার দু’চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াতে লাগলো। তারপর ডাকাত সরদার একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল- তুমি তোমার মায়ের একটি মাত্র নসিহত লঙ্ঘন করতে সাহস করলে না, অথচ আমি আমার পরওয়ারদিগারের নাফরমানি বছরের পর বছর ধরে করে আসছি। এই বলে ডাকাত সরদার বালক আবদুল কাদের জিলানির কদমপাকে লুটিয়ে পড়লো এবং তার হাত ধরে তওবা করল, সে জীবনে আর কখনো ডাকাতি করবে না। তার দলের সকলেই ডাকাত সরদারের অনুসরণ করল। তারা কাফেলার লুন্ঠিত দ্রব্যাদি ফিরিয়ে দিলো। এমনিভাবে হযরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.)-এর সততায় মুগ্ধ হয়ে ঐ দুর্ধর্ষ ডাকাত পাপের পথ পরিত্যাগ করল এবং সিরাতুল মোস্তাকিমের পথে ধাবিত হলো।


বালক হযরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.)-এর এই অনুসরণীয় ও শিক্ষণীয় ঘটনা প্রমাণ করে যে, সত্য মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দিয়ে থাকে। সত্য চিরকালই সুন্দর। আর এই সুন্দরকে যে ধারণ করতে পারে তার হৃদয় সত্যের আলো দ্বারা উদ্ভাসিত হয়ে থাকে। সেই হৃদয়ের অধিকারী মানুষের দ্বারা কখনো পাপ কাজ সংঘটিত হতে পারে না।


মূলত সত্যের বিজয় চিরদিনই অমর ও অক্ষয় হয়ে থাকে। সুতরাং আমাদের জীবনের সকল ক্ষেত্র থেকে মিথ্যা নামক এই চরম ঘৃণ্য পাপ কর্মটি দূরিভূত হয়ে যাক এবং উদিত হোক সত্যের বিজয় নিশান। সুতরাং সত্যের হেফাজতকারী মহান মালিক আমাদেরকে তাঁর প্রতিষ্ঠিত সত্যের পথ ও মতের উপর কায়েম থাকার তাওফিক দান করুক। আমিন।


[লেখক: মোহাম্মদী ইসলামের নেতৃত্ব প্রদানকারী ইমাম; পরিচালক, সমন্বয়ক ও সমস্যার ফয়সালাকারী, দেওয়ানবাগ শরীফ; প্রফেসর, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি]

সম্পর্কিত পোস্ট