Cancel Preloader

মোরাকাবা : তাসাউফভিত্তিক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ

ইমাম ড. আরসাম কুদরত এ খোদা
মোরাকাবা শব্দটি আরবি। এর অর্থ- ধ্যান করা, পর্যবেক্ষণ করা, অনুসন্ধান করা, নিয়ন্ত্রণ করা, নজরে রাখা, মনোযোগ দেওয়া, পাহারা দেওয়া ইত্যাদি।

সংজ্ঞা
‘মোর্শেদের দরবারে মুরীদের করণীয়’ নামক কিতাবের ১৮৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে- “যে ধ্যানের মাধ্যমে মহান আল্লাহ্ ও হযরত রাসুল (সা.)-এর পরিচয় লাভ করা যায় ও তাঁদের নির্দেশমত চলা যায় এবং সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিতত্ত্ব সম্বন্ধে অবগত হওয়া যায়, তাকেই প্রকৃত অর্থে মোরাকাবা বলে।”

  • কোনো কোনো সাধকের মতে, যে ধ্যানের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর সাথে যোগাযোগ করতে পারে এবং তাঁর ইচ্ছায় নিজেকে পরিচালিত করে সিরাতুল মুস্তাকিমে উপনীত থেকে জীবন অতিবাহিত করতে পারে তাকে মোরাকাবা বলে।
  • মোরাকাবা প্রসঙ্গে ‘নূরুল আসরার বা নূরতত্ত্ব’ নামক কিতাবে যা উল্লেখ করা হয়েছে এর থেকে প্রতীয়মান হয় যে মোরাকাবা ও ইবাদত এমন একটি সাধনা কর্ম এর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়।
  • মোরাকাবা প্রসঙ্গে সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর বলেন- “মোরাকাবা বা ধ্যান হচ্ছে সৃষ্টি তার স্রষ্টার সাথে যোগাযোগ করার সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম, মোরাকাবা বিহনে স্রষ্টার সাথে যোগাযোগ করা কঠিন।”

মোরাকাবার গুরুত্ব
পবিত্র হাদীসসমূহ :
হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, “যখন [আল্লাহর পক্ষ থেকে হযরত রাসুল (সা.)-এর নিকট] সত্যের বাণী (ওহি) আসলো, সে সময় রাসুল (সা.) হেরা গুহায় ছিলেন।”

  • হযরত আবু হুরায়রাহ (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, “এক ঘন্টা মোরাকাবা করা ষাট বছরের ইবাদতের চেয়েও উত্তম।” (তাফসীরে দুররে মানছুর- ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪১০)
  • অন্যত্র আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, “এক ঘণ্টা মোরাকাবা করা, সত্তর বছরের ইবাদত বন্দেগি করার চেয়ে উত্তম।” (সিররুল আসরার, পৃষ্ঠা ২৪)
  • হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, “রাত ও দিনের পরিবর্তনকারী আল্লাহ্কে নিয়ে এক ঘন্টা মোরাকাবা করা আশি বছরের ইবাদতের চেয়েও উত্তম।” (তাফসীরে দুররে মানছুর- ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা ৪১০)
  • আল্লাহর রাসুল (সা.) আরও এরশাদ করেন, “এক ঘন্টা সময় মোরাকাবা করা এক হাজার বছরের চেয়েও উত্তম।” (সিররুল আসরার, পৃষ্ঠা ২৪)

বিশ্লেষণ
মানবজাতির আদি পিতা ও নবি হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে সবশেষ বিশ্বনবি হযরত রাসুল (সা.) পর্যন্ত যত নবি-রাসুল জগতের বুকে তশরিফ নিয়েছিলেন, তাঁদের প্রত্যেকেই মোরাকাবার মাধ্যমে আল্লাহর সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়েছেন। নবুয়ত পরবর্তী বেলায়েতের যুগে আওলিয়ায়ে কেরাম একই পদ্ধতিতে আল্লাহর সাথে যোগাযোগ করেন। মহান আল্লাহর দিদার বা দর্শন লাভ, মোরাকাবার মাধ্যমেই সম্ভব। আল্লাহর সাথে যোগাযোগের ৫টি মাধ্যম রয়েছে। যথা : ১। স্বপ্ন, ২। ফায়েজ, ৩। কাশফ, ৪। এলহাম ও ৫। মোরাকাবা। এদের মধ্যে মোরাকাবা হচ্ছে অন্যতম।

পবিত্র কুরআন
মোরাকাবা প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে বলেন, “তারাই তত্ত্বজ্ঞানী, যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহ্কে স্বরণ করে এবং আসমান ও জমিনের সৃষ্টির বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা বা মোরাকাবা করে।” (সূরা আলে ইমরান ৩ : আয়াত ১৯১)

মানুষের ক্বালব বা হৃদয় আল্লাহর বাসস্থান। যুগে যুগে যত মানুষ মহান আল্লাহ্কে পেয়েছেন, তাদের সকলেই এ হৃদয়ের মাঝে অনুসন্ধান করেই প্রভুর পরিচয় লাভ করেছেন। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে- ‘‘একদা মহান আল্লাহ্ হযরত দাউদ (আ.)-এর কাছে ওহি করেন, হে দাউদ! আপনি আপনার নফ্স বা হৃদয়ের পরিচয় উদঘাটনে সচেষ্ট হোন, তবেই আপনি আমার পরিচয় পেয়ে যাবেন।” (তাফসীরে মাজহারী-১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৪৯)

মোরাকাবার মাধ্যমে হৃদয়ের পরিশুদ্ধতা লাভ করে আত্মিক উন্নতি সাধন করা যায়। এমনইভাবে আল্লাহ্ প্রাপ্তির পথের একজন সাধককে মোরাকাবার মাধ্যমে নিজের অন্তর চক্ষু জাগ্রত করতে হয়। আর এই অন্তর চক্ষু জাগ্রত হলেই সাধক মহান আল্লাহর সন্ধান পেয়ে যায়।

আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, হাদীসে কুদসিতে মহান আল্লাহ্ বলেন, “আমার জমিন আমাকে ধারণ করতে পারে না, আমার আসমানও আমাকে ধারণ করতে পারে না। কেবল আমার মুমিন বান্দার ক্বালব বা হৃদয় আমাকে ধারণ করে থাকে।” (তাফসীরে মাজহারী-৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৬০)

মোরাকাবা বা ধ্যানের কেবলা হচ্ছে আপন ক্বালব। আর ক্বালবের ভেতর প্রবেশের জন্য সাধককে আপন ক্বালবের অভ্যন্তরে ৭টি স্তর অতিক্রম করতে হয়। ক্বালবের ১ম স্তরের নাম হচ্ছে সুদুর, এই স্তরে শয়তান অবস্থান করে। ফলে সাধকের একার পক্ষে এই স্তর অতিক্রম করা কঠিন। কেননা শয়তানের কাজই হচ্ছে আল্লাহর কাছে যেতে বাধা সৃষ্টি করা। এজন্য প্রয়োজন আল্লাহর চরিত্রে চরিত্রবান একজন মোর্শেদ তথা পথ প্রদর্শকের পথনির্দেশনা অনুসরণ করা। মূলে মোর্শেদের শিক্ষা ও সাহায্য নিয়েই পর্যায়ক্রমে ক্বালবের স্তরসমূহ যথা- সুদুর, নশর, শামসি, নুরি, কুরব, মকিম- এই ৬টি স্তর অতিক্রম করে সর্বশেষ ৭ম স্তর অর্থাৎ ‘খোদে খোদ আল্লাহর মোকাম’ নাফসির স্তরে পৌঁছতে হয়। আর এখানে মহান মালিকের সাক্ষাৎ লাভের সৌভাগ্য হয়।

প্রকৃতপক্ষে সাধনায় সফলতা লাভ করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন একজন কামেল মোর্শেদ। প্রত্যেক মানুষের ক্বালবের ৭ম স্তর নাফসির মোকামে আল্লাহ্ বিরাজ করেন। যিনি সাধনা করে হৃদয়ে আল্লাহ্কে জাগ্রত করতে পারেন, তিনিই হন আল্লাহময় এবং পরিণত হন আল্লাহর বন্ধুতে।

রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.) জাবালে নুর-এর হেরাগুহায় সুদীর্ঘ ১৫ বছর মোরাকাবা বা ধ্যানের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই সাধনার দ্বারা নিজে আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জন করেছিলেন, সেই শক্তির মাধ্যমেই তিনি বর্বর আরবজাতিকে সুসভ্য, আদর্শ-চরিত্রবান রূপে গড়ে তোলেন। এজন্য নবুয়তের যুগে নবি ও রাসুলগণ এবং নবুয়ত পরবর্তী বেলায়েতের যুগে অলী-আল্লাহ্গণ মোরাকাবার মাধ্যমে আল্লাহর সাথে যোগাযোগের পদ্ধতি শিক্ষা দিয়ে থাকেন। এর ফলে মানুষ আত্মিক পরিশুদ্ধতা লাভ করে ধর্ম পালনের সুযোগ যেমন লাভ করে, তেমনি বিপদ থেকে রক্ষা পেয়ে ধর্মের শান্তি এই দুনিয়াতেই উপলব্ধি করতে পারে।

অতএব মোরাকাবার গুরুত্ব অপরিসীম। আমরা যেন মোরাকাবার মাধ্যমে নিজের অন্তরের কলুষতা দূর করে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি। দয়াময় আল্লাহ্ আমাদেরকে সেই তৌফিক দান করুন। আমিন।
[লেখক : পরিচালক, সমন্বয়ক ও সমস্যার ফয়সালাকারী, দেওয়ানবাগ শরীফ; সহকারী অধ্যাপক, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি]

সম্পর্কিত পোস্ট