Cancel Preloader

সম্পাদকীয়


মহান রাব্বুল আলামিন তাঁর পরিচয় মানুষের মাঝে তুলে ধরার লক্ষ্যে মোর্শেদরূপে তাঁর প্রিয় বন্ধুদেরকে জগতের বুকে ধারাবাহিকভাবে প্রেরণ করছেন। মহান আল্লাহ্ তাঁর বন্ধুদেরকে দুইটি ভাগে বিভক্ত করে জগতে পাঠিয়েছেন। মানবজাতির হেদায়াতের চিরন্তন ধারা অব্যাহত রাখার জন্য মহান আল্লাহ্ প্রথম ভাগে তাঁদেরকে পথ প্রদর্শক হিসেবে প্রেরণ করেছেন, তাঁদেরকে নবি-রাসুল বলা হয়। নবি-রাসুল প্রেরণের সময়কে ‘নবুয়তের যুগ’ বলা হয়। নবুয়তের যুগের পরিসমাপ্তির পর মহান আল্লাহ্ মোর্শেদ হিসেবে যাঁদেরকে পাঠিয়ে থাকেন, তাঁদেরকে অলী-আল্লাহ্ বলা হয়। অলী-আল্লাহ্ প্রেরণের সময়কালকে ‘বেলায়েতের যুগ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সুতরাং বিষয়টি সুস্পষ্ট যে, আল্লাহ্ তায়ালার পরিচয় জানার জন্য মোর্শেদের সহবতে বা সাহচর্যে যাওয়া অত্যাবশ্যক। মোর্শেদ শব্দটি আরবি শব্দ, যা রুশদুন ধাতু হতে উৎপত্তি হয়েছে, যার অর্থ হচ্ছে পথ। আর মোর্শেদ শব্দের বাংলা অর্থ পথ প্রদর্শক। ইংরেজিতে বলা হয় ‘ঝঢ়রৎরঃঁধষ এঁরফব’। ফারসি ভাষায় মোর্শেদকে ‘পির’ বলা হয়। আমাদের দেশে পির শব্দটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত। কেননা বাংলা-ভারত উপমহাদেশে কোনো নবি-রাসুল আগমন করেননি। পারস্য থেকে অলী-আল্লাহ্গণ এখানে এসে ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন। ফলে আমাদের দেশে ইসলামের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে ফারসি শব্দের অধিক প্রচলন দেখা যায়। যেমন- রোজা, নামাজ, পির, বেহেশত, দোজখ ইত্যাদি। তাই আমাদের দেশে মোর্শেদকে পির বলে আখ্যায়িত করা হয়। ফারসি পির শব্দের বাংলা অর্থ আধ্যাত্মিক শিক্ষা গুরু, পূণ্যাত্মা, মহাপুরুষ, মুরুব্বি। হাদি শ্রেণির অলী-আল্লাহ্গণকে আমাদের সমাজে পির বলে অভিহিত করা হয়। মূলত মোর্শেদ, পির, অলী-আল্লাহ্ অর্থগত ও কার্যগত দিক থেকে একই শব্দ। তাঁদের গুরুত্ব সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ বলেন, “আল্লাহ্ যাকে গোমরাহ করেন, আপনি কখনো তার জন্য কোনো (মোর্শেদ বা) পথপ্রদর্শনকারী অভিভাবক পাবেন না।” (সূরা আল কাহ্ফ ১৮: আয়াত ১৭)


পবিত্র কুরআনের এ আয়াত থেকে বিষয়টি সুষ্পষ্ট যে, যারা গোমরাহ বা পথভ্রষ্ট তাদের ভাগ্যে কোনো মোর্শেদ জুটবে না। সুতরাং বলা যায় যে, মোর্শেদের সহবতে যারা যাবে না, তারা সারাজীবন অন্ধকারে নিপতিত থাকবে। আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে, পবিত্র কুরআন ও হাদিস রয়েছে, তাহলে মোর্শেদের সান্নিধ্যে যাওয়ার প্রয়োজন কী? এই মতবাদে বিশ্বাসীদের মতে, পবিত্র কুরআন ও হাদিস অধ্যয়ন করেই আদর্শ চরিত্র গঠন করা যাবে এবং আল্লাহ্ তায়ালার পরিচয় লাভ করা যাবে। কিন্তু তাদের এই অভিমত সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। মূলত কিতাব বা গ্রন্থ কখনোই মানুষকে চরিত্রবান করতে পারে না। যিনি চরিত্রবান অর্থাৎ মহাগ্রন্থ আল কুরআনের চরিত্র যার হৃদয় মাঝে বিরাজমান, এমন ব্যক্তির সহবতে গিয়ে তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী চলতে পারলে চরিত্রবান হওয়া সম্ভব। নিজের ভেতরে যে ষড়রিপু বিদ্যমান রয়েছে, সেই রিপুগুলো মোর্শেদে কামেলের সহবতে থেকে দমন করা সম্ভব। রিপু দমনের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি আত্মশুদ্ধি লাভ করতে পারে। আত্মশুদ্ধি লাভকারীর ব্যক্তির নিয়ত শুদ্ধ হয়। ফলে ঐ ব্যক্তির সকল ইবাদতই আল্লাহ্র নিকট কবুল হয়ে থাকে। এভাবে সে সাধনার মাধ্যমে এক পর্যায়ে আল্লাহর পরিচয় লাভ করতে সক্ষম হয়ে থাকেন।


সুতরাং আমাদেরকে কিতাবের উপর নির্ভরশীল হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কিতাব পড়ে জ্ঞানী হওয়া যায়, কিন্তু আদর্শ চরিত্রের অধিকারী হওয়া যায় না। মূলত কিতাব মানুষকে হেদায়েত করতে পারে না, বরং হেদায়েতের জন্য অনুসরণযোগ্য কামেল মোর্শেদের প্রয়োজন। এই প্রসঙ্গে হযরত যিয়াদ ইবনে লবীদ (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে- তিনি বলেন, “একদা হযরত রাসুল (সা.) একটি বিষয় আলোচনা করছিলেন। অতঃপর আল্লাহর রাসুল (সা.) বললেন, ‘এটি এলেম বিলুপ্ত হওয়ার সময় সংঘটিত হবে।’ তখন আমি বললাম- ‘হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! এলেম কী করে বিলুপ্ত হবে? অথচ আমরা নিজেরা কুরআন শিক্ষা করছি এবং আমাদের সন্তানদের শিক্ষা দিচ্ছি। অতঃপর আমাদের সন্তানগণ তাদের সন্তানদেরকে শিক্ষা দিতে থাকবে।’ তখন আল্লাহর রাসুল (সা.) বললেন, ‘যিয়াদ! তোমার মা তোমাকে হারিয়ে ফেলুক! এতদিন তো আমি তোমাকে মদীনার একজন জ্ঞানী লোক বলেই মনে করতাম। (তুমি কি লক্ষ্য করোনি) এই ইহুদি ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায় কি তাওরাত ও ইনজিল কিতাব পড়ছে না? অথচ এ কিতাবের, মর্ম অনুযায়ী তারা কর্ম করে না’।” (মুসনাদে আহমদ, সুনানে ইবনে মাজাহ, তিরমিযী ও দারেমী শরীফের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৩৮)


হযরত রাসুল (সা.)-এর উল্লিখিত হাদিস থেকে সুস্পষ্ট যে, কিতাব মানুষকে চরিত্রবান বানাতে ও মুক্তি দিতে সক্ষম নয়। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ বলেন, “হে মু’মিনগণ! তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহ্র, আনুগত্য করো রাসুলের এবং তাঁদের যাঁরা তোমাদের মধ্যে (আল্লাহর সাথে যোগাযোগ করে) ফয়সালা দিতে পারেন।” (সূরা আল নিসা ৪: আয়াত ৫৯) প্রকৃতপক্ষে নবুয়ত পরবর্তী বেলায়েতের যুগে যুগের ইমাম, মোজাদ্দেদ ও আওলিয়ায়ে কেরামের ক্বালবে নুরে হেদায়েত বিদ্যমান থাকায়, তারা হন এত্তেহাদি তাওয়াজ্জোহ শক্তির অধিকারী। ফলে ঐ সকল মহামানব তাওয়াজ্জোহ এত্তেহাদির দ্বারা মানুষের পশু প্রবৃত্তির স্বভাবকে দমন করেন এবং আত্মার ঐশীভাব প্রস্ফুটিত করে দিয়ে মানুষকে সুপথগামী করে তোলেন।
হযরত রাসুল (সা.) বলেন- “যখন ক্বালবে আল্লাহর নুর প্রবেশ করে, তখন ক্বালব খুলে যায় এবং সেটি প্রশস্ত হয়ে যায়।” (তাফসীরে দুররে মানছুর ২৩নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ২১৯) এই প্রসঙ্গে সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) বলেন, “কোনো ব্যক্তি উপযুক্ত শিক্ষক বা মোর্শেদ ছাড়া একাকী সাধনা করে ক্বালবের এ মহামূল্যবান নিয়ামত লাভ করতে পারে না। ফলশ্রুতিতে আল্লাহর পরিচয় লাভ করাও তার পক্ষে সম্ভব হয় না। এজন্যই মোর্শেদ অবলম্বন করা অপরিহার্য।” (শান্তি কোন পথে? পঞ্চম সংস্করণ, পৃষ্ঠা ৫৪)


মহান আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে মহান মোর্শেদের সুমহান শিক্ষা ও আদর্শ গ্রহণ করার তৌফিক এনায়েত করুন। আমিন।

সম্পর্কিত পোস্ট