Cancel Preloader

সম্পাদকীয়

আরবি শাবান মাসের ১৪ তারিখ (১৮ মার্চ, ২০২২ইং) দিবাগত রাতে পবিত্র শবে বরাত বা বরকতময় রজনি। তাফসীরে জালালাইনের ৪১০ পৃষ্ঠায় তাফসীরে সা’বীর সূত্রে এ রাতের চারটি নাম উল্লেখ করা হয়েছে। যথা- আল লাইলাতুল মুবারাকাহ (বরকতময় রজনি), লাইলাতুল বারাআহ (মুক্তির রজনি), লাইলাতুর রাহমাহ (দায়িত্বপ্রাপ্তির রজনি) ও লাইলাতুস সাক (বন্টনের রজনি)। পবিত্র কুরআনের সূরা আদ্ দুখানের ১ হতে ৬নং আয়াত পর্যন্ত শবে বরাতের রজনি সর্ম্পকে আলোকপাত করা হয়েছে। মহান আল্লাহ্ বলেন, “এ রজনিতে (শবে বরাতের) প্রত্যেক হিকমতপূর্ণ বিষয়ের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় আমার নির্দেশক্রমে।” (সূরা আদ্ দুখান ৪৪: আয়াত ৪-৫) শবে বরাতের মহিমান্বিত রজনিতে লাওহে মাহফুজে সংরক্ষিত কুরআন সপ্তম আকাশ হতে ও দুনিয়ার আকাশে একত্রে নাজিল করা হয়। এ প্রসঙ্গে হযরত ইকরামা (রা.) বলেন, “অর্ধ শাবান বা শবে বরাতের রজনিতে আল্লাহ্ তায়ালা এ কুরআন লাওহে মাহফুজ তথা সপ্তম আকাশ হতে দুনিয়ার নিকটবর্তী আকাশে নাজিল করেন।” (তাফসীরে জালালাইন, পৃষ্ঠা ৪১০) শবে বরাত ও শবে কদরের মধ্যে মূল পার্থক্য এখানেই। মুলত শবে বরাতের রজনিতে সম্পূর্ণ কুরআন সামায়ে দুনিয়া বা দুনিয়ার আকাশে নাজিল হয়। আর শবে কদরের রজনিতে মানব মুক্তির বিধান হিসেবে ধারাবাহিকভাবে কুরআন নাজিলের যাত্রা শুরু হয়। এ প্রসঙ্গে মহান সংস্কারক মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান বলেন, “এ বিষয়টি বাস্তবে সংঘটিত হয় এভাবে শবে বরাতের রজনিতে সম্পূর্ণ কুরআন লাওহে মাহফুজ হতে সামায়ে দুনিয়া অর্থাৎ হযরত রাসুল (সা.)-এর ক্বালবের সপ্তম স্তর নাফসির মোকাম থেকে প্রথম স্তর সুদুরের মোকামে নাজিল করা হয়। আর এ জন্যই এ রাতকে লাইলাতুম্ মুুবারাকাহ বা বরকতময় রজনি বলা হয়। অতঃপর পবিত্র কদরের রজনিতে হযরত রাসুল (সা.)-এর ক্বালবের প্রথম স্তর সুদুরের মোকাম হতে আস্তে আস্তে কুরআন নাজিলের যাত্রা শুরু হয়।” (তাফসীরে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৮৯) সম্পূর্ণ কুরআন এক সাথে নাজিল হওয়ার কারণে শবে বরাতের রাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। এ রাতেই সৃষ্টিজগতের সকল মানুষের ভাগ্যলিপি এক বৎসরের জন্য নির্ধারণ করা হয়। এ বৎসরে নতুন করে কারা পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করবে, কারা মৃত্যুবরণ করবে, কাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হবে, আর কারা হবে দুর্ভাগা এ সবকিছুই নির্ধারিত হয় শবে বরাতের এ রাতে।


এই প্রসঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, “এক ব্যক্তি মানুষের সাথে চলাফেলা করছে, অথচ তার মৃত্যুর সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। অতঃপর হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) আল্লাহর এ বাণী পাঠ করেন- ‘নিশ্চয়ই আমি একে (কুরআন) বরকতময় রাতে নাজিল করেছি, নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক হিকমতপূর্ণ বিষয়ের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।’ অতঃপর বর্ণনাকারী বলেন, ‘পৃথিবীর প্রতিটি বিষয়ের এক বৎসরে সিদ্ধান্ত শবে বরাতে এ রাতেই গ্রহণ করা হয়’।” (তাফসীরে তাবারী ২৫নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০৯)
শবে বরাত রজনির গুরুত্ব ও মর্যাদার বিষয়ে বহু হাদিস বর্ণিত হয়েছে। হযরত ইকরামা (রা.) হতে বর্ণনা করা হয়েছে- তিনি বলেন, “মহান ও মহিমান্বিত আল্লাহর বাণী- ‘এ রাতে প্রত্যেক হিকমতপূর্ণ বিষয়ের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।’ হযরত ইকরামা (রা.) বলেন, ‘অর্ধ শাবান বা শবে বরাতের রাতে পূর্ণ এক বৎসরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। হায়াত ও মওতের ফয়সালা হয়। হাজিদের তালিকা করা হয়। অর্থাৎ এ বৎসর যতজন হজ করবে তার সিদ্ধান্ত হয়। আর বাস্তবে দেখা যায় যে, সিদ্ধান্তকৃত সংখ্যা থেকে একজন বেশিও হয় না, কমও হয় না’।” (তাফসীরে তাবারী, ২৫নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০৯)


রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.) অত্যন্ত গুরুত্ব ও মর্যাদার সাথে শবে বরাতের রজনি পালন করতেন। এ প্রসঙ্গে আমিরুল মু’মিনিন শেরে খোদা হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু বলেন, ‘আমি আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে অর্ধ শাবান বা শবে বরাতের রজনিতে ১৪ রাকাত নামাজ আদায় করতে দেখেছি।” (তাফসীরে দুররে মানছুর, ২৫নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪০২) উম্মুল মু’মিনিন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) হতে বর্ণনা করা হয়েছে তিনি বলেন, “একরাতে আল্লাহর রাসুল (সা.) নামাজ আদায় করছিলেন। তিনি দীর্ঘ সময় সিজদারত ছিলেন, আমি ধারণা করলাম- তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আমি গিয়ে তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলিতে নাড়া দিলাম। তিনি নড়েচড়ে উঠেন। আমি সেখান থেকে ফিরে আসলাম। অতঃপর তিনি সিজদা হতে মাথা উঠিয়ে নামাজ শেষ করেন। অতঃপর তিনি বললেন, ‘হে আয়েশা! হে হুমাইরা! তুমি কি মনে করেছ যে, আল্লাহর রাসুল তোমার সাথে দুর্ব্যবহার করেছেন?’ আমি বললাম, না, তবে আপনার দীর্ঘ সিজদার কারণে আমি মনে করেছিলাম আপনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি বললেন, ‘তুমি কি জানো এটা কোন রাত্রি? আমি বললাম, এ ব্যাপারে আল্লাহ্ ও আল্লাহর রাসুল ভালো জানেন। তিনি বললেন, ‘এটি মধ্য শাবান বা শবে বরাতের রজনি। এ রাতে ক্ষমা প্রার্থনাকারীকে ক্ষমা করা হয়। রহমত কামনাকারীকে রহমত দান করা হয়। আর প্রতিহিংসাপরায়ণ ব্যক্তিকে তার আগের অবস্থার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়’।” (তাফসীরে দুররে মানছুর, ২৫নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪০৩) পবিত্র কুরআন ও হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী পবিত্র শবে বরাতের রজনির গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতি বছর শবে বরাতের রাতটি দেওয়ানবাগ শরীফে যথাযথ মর্যাদায় উদযাপন করা হয়। এ বরকতময় রজনিতে আশেকে রাসুলেরা সারারাত ইবাদত বন্দেগির মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করেন।

উল্লেখ্য যে, এ মার্চ মাসের ২৬ তারিখ বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাত্রিতে পাক হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির উপর নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালায়। এ নির্মম ঘটনায় সূফী সম্রাট দেওয়ানাবাগী হুজুর কেবলাজান অত্যন্ত ব্যথিত হন। তিনি দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। য্দ্ধু চলাকালে ১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর ঈদুল ফিতরের নামাজের খুৎবায় তিনি বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করেন। মহান আল্লাহর অপার দয়ায় তাঁর পবিত্র মুখ থেকে উৎসারিত এ ভবিষ্যদ্বাণীর মাত্র ২৭ দিন পর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতাযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে এবং তিনি ঢাকায় তদানীন্তন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে অনুষ্ঠিত ঈদুল আজহার জামাতে ইমামতি করেন। মহান স্বাধীনতা দিবসে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানসহ সকল বীর মুক্তিযোদ্ধাকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

সম্পর্কিত পোস্ট