Cancel Preloader

সম্পাদকীয়

সৃষ্টির সূচনা থেকে পবিত্র মহররম মাসের ১০ তারিখ নানা স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়। যে মহিমান্বিত ঘটনার জন্য ১০ই মহররম সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব ও তাৎপর্য বহন করে তা হলো- এ তারিখে বিশ্বজাহানের মহান স্রষ্টা মহান রাব্বুল আলামিন প্রতিপালক হিসেবে আরশে সমাসীন হন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ বলেন, “নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ্, যিনি সৃষ্টি করেছেন আসমান ও জমিন ছয় দিনে, তারপর তিনি সমাসীন হন আরশে, তিনি পরিচালনা করেন প্রতিটি কাজ।” (সূরা ইউনুস ১০: আয়াত ৩)


পবিত্র আশুরার দিনটি মহান স্রষ্টার জন্য যেমন অভিষেকের দিন হিসেবে অত্যন্ত আনন্দের দিন, ঠিক তেমনি স্রষ্টার সৃষ্টির জন্যও এ দিনটি অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ একটি দিন। তাই যথাযথ মর্যাদার সাথে আশুরার দিনটি উদ্যাপন করা কুল কায়েনাতের সকলের জন্য অপরিহার্য। মানবজাতি যদি এই দিনটি ভক্তি, শ্রদ্ধা ও প্রেমপূর্ণ আবেগ-অনুভূতির সাথে পালন করে, তাহলে স্রষ্টার অবারিত রহমত মানবজাতির উপর বর্ষিত হবে। আশুরার দিনটি কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম বা জাতির জন্য নয়, এ দিনটি কুল কায়েনাতের সবার জন্য অবারিত রহমত লাভের দিন। এর প্রমাণ পাওয়া যায়, এ দিনই মানবজাতির আদি পিতা হযরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয় এবং পরবর্তীতে এ দিনেই তাঁকে প্রতিনিধি করে দুনিয়াতে পাঠানো হয়। এছাড়া আশুরার পবিত্র দিবসে হযরত আদম (আ.)-এর অপরাধ ক্ষমা করা হয়। এ পবিত্র দিনে মহাপ্লাবনকালে হযরত নূহ (আ.)-এর নৌকা তাঁর অনুসারীদের নিয়ে জুদি পাহাড়ের পাদদেশে এসে থেমেছিল। পবিত্র আশুরার দিনেই হযরত ইব্রাহিম (আ.) ভূমিষ্ঠ হন এবং এদিনে তিনি নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে উদ্ধার লাভ করেন। শুধু তাই নয়, এ দিনে তিনি নিজের প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ.)-কে আল্লাহর নামে উৎসর্গ করে ‘খলিলুল্লাহ্’ উপাধিতে ভূষিত হন। পবিত্র আশুরার দিবসে হযরত আইউব (আ.) রোগমুক্ত হন। এ দিনে হযরত ঈসা (আ.) জন্মগ্রহণ করেন এবং ৪র্থ আসমানে উত্থিত হন; হযরত দাউদ (আ.) মহান আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমা পান; হযরত সোলায়মান (আ.) তাঁর হারানো রাজত্ব পুনরুদ্ধারে সক্ষম হন; হযরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট হতে মুক্তি পান; হযরত ইয়াকুব (আ.) তাঁর হারানো পুত্র হযরত ইউসুফ (আ.)-কে ৪০ বছর পর ফিরে পান। পবিত্র আশুরার দিনে ফেরাউনের মু’মিনা স্ত্রী বিবি আছিয়া (আ.) শিশু মুসা (আ.)-কে গ্রহণ করেন; আবার এ দিনে হযরত মুসা (আ.) স্বীয় অনুসারীদের নিয়ে লোহিত সাগর অতিক্রম করেন, অন্যদিকে খোদাদ্রোহী ফেরাউন সদলবলে লোহিত সাগরে ডুবে মারা যান। মহান রাব্বুল আলামিন মানবজাতির মুক্তির জন্য পবিত্র আশুরার দিবসে ২ হাজার নবি ও রাসুল পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। অর্থাৎ ২ হাজার নবি ও রাসুলের শুভ জন্ম হয় ১০ই মহররম।
সার্বিক দিক বিবেচনায় উল্লিখিত বিষয়গুলো প্রমাণ করে আশুরার বরকতময় দিনের অসিলায় নবুয়তের যুগে বহু নবি-রাসুল আপদ-বিপদ, বালা-মুসিবত হতে রক্ষা পেয়েছেন। সুতরাং এ দিনটি রহমত ও বরকতে পরিপূর্ণ একটি দিন। মূলত আশুরা হলো মহান আল্লাহর বান্দাদের জন্য আল্লাহর নিকট চাইবার এবং পাবার দিন। এ দিন বান্দা কোনো কিছু চাইলে মহান প্রভু কর্তৃক তা অপূর্ণ থাকার কথা নয়।

উল্লেখ্য যে, আশুরার দিনটি বিশ্ব মুসলিমের নিকট যে কারণে সবচেয়ে স্মরণীয় ও হৃদয়বিদারক, তা হলো এ দিনেই দুরাচারী এজিদ বাহিনী রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র, আমিরুল মু’মিনিন শেরে খোদা হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু ও নবিনন্দিনী খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতেমা (রা.)-এর হৃদয়ের ধন ইমাম হোসাইন (রা.)-কে সপরিবারে কারবালার প্রান্তরে নির্মমভাবে শহিদ করে। ইমাম হোসাইন (রা.) মাত্র ৭২ জন সঙ্গী নিয়ে এজিদের ২২ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে অসম যুদ্ধ করে শাহাদত বরণের মাধ্যমে সত্য ও ন্যায়ের জন্য আত্মত্যাগের এক মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। কারবালার প্রান্তরে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর প্রতি তাঁর পরিবারের সদস্য ও কতিপয় আশেকে রাসুলের আনুগত্য ও প্রেম মোহাম্মদী ইসলামের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে আছে। ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শহিদ হওয়ার মধ্য দিয়ে পবিত্র আশুরার দিনে মোহাম্মদী ইসলামের স্বর্ণালি সূর্যের অস্তমিত ঘটে, আবার ১৯৮৫ সালের ১০ই মহররম পবিত্র আশুরার দিনেই মহান রাব্বুল আলামিনের অপার দয়ায় সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) বিশ্বময় মোহাম্মদী ইসলাম প্রচার ও প্রসারের জন্য দেওয়ানবাগ শরীফ প্রতিষ্ঠা করেন। জগৎশ্রেষ্ঠ এ মহামানব বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া হযরত রাসুল (সা.)-এর সুমহান শিক্ষা ও আদর্শ সংবলিত ‘মোহাম্মদী ইসলাম’ জগতের বুকে পুনর্জাগরণ করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় মোহাম্মদী ইসলাম তার হারানো গৌরব ফিরে পেয়েছে এবং বিশ্বময় হযরত রাসুল (সা.)-এর ধর্মের নবজাগরণ সূচিত হয়েছে। ১০ই মহররম পবিত্র আশুরার দিবসে দেওয়ানবাগ শরীফের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। প্রতিবছর মহান আল্লাহর অভিষেকের অনুষ্ঠান এবং দেওয়ানবাগ শরীফের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে দেওয়ানবাগ শরীফে আশেকে রাসুল (সা.) সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই বছর অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থেকে আশেকে রাসুলেরা রহমত ও বরকত লাভের প্রত্যাশায় সম্মেলনে অংশগ্রহণ করবেন।


উল্লেখ্য, পূর্বে ধারণা ছিল পবিত্র আশুরা শুধুমাত্র শিয়াদের অনুষ্ঠান। সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান এ ভুল ধারণা সংশোধনের জন্য পবিত্র কুরআন ও হাদিসের আলোকে আশুরার গুরুত্ব, তাৎপর্য, হাকিকত ও রহস্য মুসলিম উম্মাসহ জগদ্বাসির নিকট তুলে ধরেন। এ লক্ষ্যে তিনি ১৯৮৫ সালে পবিত্র আশুরার গুরুত্ব ও তাৎপর্য সংবলিত লক্ষ লক্ষ হ্যান্ডবিল তৈরি করে সর্বসাধারণের নিকট বিতরণের ব্যবস্থা করেন। মহান রাব্বুল আলামিনের অপার দয়ায় তাঁর প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৫ সালে পবিত্র আশুরার গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরে তথ্য বিবরণী প্রকাশ করে এবং দেশবাসীকে এ দিনটি গুরুত্বের সাথে পালন করার আহ্বান জানান। এতে মানুষের মাঝে পবিত্র আশুরার জাগরণ সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের প্রস্তাবে পবিত্র আশুরার গুরুত্ব ও তাৎপর্য উপলব্ধি করে বাংলাদেশ সরকার দিবসটি রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত নেন এবং তখন থেকেই পবিত্র আশুরা রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হচ্ছে।

পরিশেষে মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে প্রার্থনা তিনি যেন দয়া করে আমাদের সকলকে তাঁর অভিষেকের অনুষ্ঠান যথাযথভাবে পালন করার তৌফিক ভিক্ষা দিন। আমিন।

সম্পর্কিত পোস্ট