Cancel Preloader

সম্পাদকীয়

লক্ষ কোটি শুকরিয়া জানাই মহান রাব্বুল আলামিনের নুরের কদম মোবারকে, তাঁর অপার দয়ার বরকতে তাঁরই সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.)-এর ১৪৯৭তম (হিজরি সাল অনুযায়ী) শুভ জন্মদিন ১২ই রবিউল আউয়াল অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে দেশ ও বিদেশের হাজার হাজার রাসুল প্রেমিকদের নিয়ে যথাযথ মর্যাদায় উদযাপন করতে পেরেছি। আমার মহান মোর্শেদ মহান সংস্কারক মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.)-এর অন্যতম সংস্কার হলো পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.)। রহমত ও বরকতে পরিপূর্ণ এই দিনটিকে তিনি ‘সৃষ্টিকুলের শ্রেষ্ঠ ঈদ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁরই প্রস্তাবে ১৯৯৬ সাল থেকে ১২ই রবিউল আউয়াল ফাতেহায়ে দোয়াজ-দাহম ও সিরাতুন্নবি (সা.)-এর পরিবর্তে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে পালন করা শুরু হয় এবং মহিমান্বিত এই দিনটিকে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়।


প্রতি বছর যেভাবে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) আমরা পালন করতাম, এই বছর আমি ভিন্ন আঙ্গিকে উৎসবমুখর পরিবেশে এই দিনটি দেশ ও বিদেশের সকল আশেকে রাসুল ভাই ও বোনদের নিয়ে পালন করি। ইতঃপূর্বে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.)-এর অনুষ্ঠানে একেক জন বক্তা ১৫/২০ মিনিট নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর আলোচনা করতেন। এ বছর সেইভাবে না করে টকশো স্টাইলে আলোচনা পর্ব সাজিয়েছি। অনুষ্ঠানে সর্বমোট ৭টি আলোচনা পর্ব ছিল। প্রতিটি পর্বে উপস্থাপকের সাথে ৪/৬ জন করে বক্তা ছিলেন। সঞ্চালক হযরত রাসুল (সা.)-এর গৌরবদীপ্ত জীবন, মোহাম্মদী ইসলাম প্রচার ও প্রসারে তাঁর ত্যাগ, তিতিক্ষা ও অবদান, হযরত রাসুল (সা.)-এর ওফাতের পরবর্তী পর্যায় মোহাম্মদী ইসলামের অবস্থা, মোহাম্মদী ইসলাম পুনর্জীবনদানে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের অবদান এবং ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) সরকারিভাবে বাস্তবায়নে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের ভূমিকা সম্পর্কিত নানা বিষয়ে বিজ্ঞ আলোচকবৃন্দকে প্রশ্ন করেন এবং তারা সেই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর প্রদান করেন। এছাড়া সঞ্চালক ও বক্তাদের প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ হওয়ার পর দর্শক সারি থেকে আলোচকদের নানা বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। ফলে পুরো আলোচনা পর্বটি প্রাণবন্ত হয়ে উঠে। প্রতিটি আলোচনা পর্বের শেষে নাতে রাসুল ও দয়াল বাবাজানের শানে গজল পরিবেশন করা হয় এবং আঞ্চলিক দরবার শরীফ, খানকাহ্ শরীফ, আশেকে রাসুল মজলিসগুলোতে কীভাবে ঈদ উদ্যাপন করা হচ্ছে, তা সরাসরি সম্প্রচার করা হয় এবং প্রতিনিধিরা তাদের অভিমত ব্যক্ত করেন। এছাড়া বিভিন্ন দেশের আশেকে রাসুলগণ ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সরাসরি সংযুক্ত হন এবং তাঁরা পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) উদযাপন করছেন, সেই বিষয়ে তাদের অভিমত প্রকাশ করেন। আরেকটি পর্বে যুক্তরাজ্যের লন্ডন স্টুডিও থেকে সেখানকার ৪ জন আশেকে রাসুল ইংরেজি ভাষায় টকশোর মাধ্যমে তারা কীভাবে হযরত রাসুল (সা.)-এর পবিত্র জন্মদিন কীভাবে পালন করছেন, তা ব্যক্ত করেন এবং হযরত রাসুল (সা.)-এর শান-মান ও মর্যাদা উপস্থাপন করেন।


অনুষ্ঠানে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের অন্যতম সংস্কার হযরত রাসুল (সা.)-এর ওফাৎ দিবস ‘১২ই রবিউল আউয়াল নয়, ১লা রবিউল আউয়াল’-এই বিষয়টি পাওয়ার প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়, যার ফলে সংস্কারটির সত্যতা সহজে সকলের নিকট প্রমাণিত ও গ্রহণযোগ্য হয়। এছাড়া সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান ও হযরত রাসুল (সা.)-এর গৌরবদীপ্ত জীবনী মোবারকের উপর দুটি প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শন করা হয় এবং হযরত রাসুল (সা.)-এর শানে মোহাম্মদী ইসলামের মিলাদ শরীফ পাঠ করা হয়। সর্বশেষ আমার আলোচনা ও আখেরি মোনাজাতের মাধ্যম অনুষ্ঠানের পরিসমাপ্তি হয়। অনুষ্ঠানটি সকাল ৯.৩০ মি. থেকে শুরু হয়ে বিকাল ৪.৩০ মিনিটে শেষ হয়। এই মহতী অনুষ্ঠানে দেশবরেণ্য ওলামায়ে কেরাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক, সরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ও আশেকে রাসুল আইনজীবী, যারা ইসলামি গবেষক ও চিন্তাবিদ হিসেবে খ্যাত, তারা আলোচনা পর্বে ছিলেন।

প্রিয় পাঠক! পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) উদযাপনের বিষয় নিয়ে অনেকে জানতে চান যে, এই বিষয়ে পবিত্র কুরআনে কোনো নির্দেশনা আছে কি? এবং সাহাবায়ে কেরাম কি হযরত রাসুল (সা.)-এর শুভ জন্মদিন উদযাপন করতেন? পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.)-এর দিনটি মহান আল্লাহর জন্য সবচেয়ে আনন্দের দিন। তাই মহান আল্লাহ্ সবাইকে আনন্দ প্রকাশের নির্দেশ দিয়ে এরশাদ করেন, “[হে রাসুল (সা.)]! আপনি বলুন এটি আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতের; সুতরাং এতে [মোহাম্মদ (সা.)এর আগমনে] তারা আনন্দিত হউক, তারা যে সম্পদ জমা করে তার চেয়ে তিনি [মোহাম্মদ (সা.)] অনেক উত্তম।” (সূরা ইউনুছ ১০: আয়াত ৫৮) বিভিন্ন হাদিস থেকে জানা যায়, হযরত রাসুল (সা.)-এর পবিত্র জন্মদিনের ফজিলত এতো বেশি যে, তাঁর জীবদ্দশাতেও সাহাবিগণ তাঁদের বাড়িতে বাড়িতে ধুমধামের সাথে মিলাদ শরীফের আয়োজন করতেন। এই প্রসঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, “একদা তিনি তাঁর ঘরে লোকদেরকে একত্রিত করে রাসুলুল্লাহ্ (সা.)-এর জন্মদিনের বর্ণনা করছিলেন, যা শুনে উপস্থিত সবাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে রাসুল (সা.)-এর প্রশংসা করছিলেন (অর্থাৎ- প্রশংসাসূচক আলোচনা করে দরূদ ও সালাম পেশ করছিলেন) এমন সময় হযরত রাসুল (সা.) সেখানে উপস্থিত হলেন এবং খুশি হয়ে তাদের উদ্দেশে বললেন- ‘তোমাদেরকে শায়াফাত করা আমার জন্য ওয়াজিব হয়ে গেছে।” (দুররুল মুনাজ্জাম)


হযরত ইমাম বোখারি (রহ.) বোখারি শরীফের ‘কিতাবুন নিকাহ’ অধ্যায়ে বর্ণনা করেন- “হযরত উরওয়া (রা.) বলেন- সুয়াইবা ছিলো আবু লাহাবের দাসি এবং আবু লাহাব তাকে [মোহাম্মদ (সা.)-এর শুভজন্মের সংবাদ দেওয়ার কারণে খুশি হয়ে] আজাদ করে দিয়েছিলো। এরপর সে রাসুলুল্লাহ্ (সা.)-কে দুধ পান করায়। অতঃপর আবু লাহাব যখন মারা গেলো, তার একজন আত্মীয় তাকে স্বপ্নে দেখল যে, সে ভীষণ কষ্টের মধ্যে রয়েছে। তাকে জিজ্ঞেস করল, তোমার সাথে কীরূপ ব্যবহার করা হয়েছে? আবু লাহাব বলল- যখন তোমাদের থেকে দূরে রয়েছি, তখন থেকেই ভীষণ কষ্টে আছি। তবে দাসি সুওয়াইবাকে এই আঙ্গুলের ইশারায় (শাহাদাত অঙ্গুলি) আজাদ করার কারণে আমাকে পানীয় পান করানো হয়।” (বোখারি শরীফ ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭৬৪; ই.ফা.বা. কর্তৃক অনূদিত, বোখারি শরীফ ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪০৪ ও ৪০৫, হাদিস নং ৪৭৩৪)


এ হাদিসের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) তার বিখ্যাত ফতহুল বারি কিতাবে বর্ণনা করেন- “হযরত সুহাইলি (রা.) কর্তৃক হযরত আব্বাস (রা.) থেকে এক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। আব্বাস (রা.) বলেন- যখন আবু লাহাব মৃত্যুবরণ করল, তার বছর খানেক পর আমি তাকে স্বপ্নে দেখি, সে অত্যন্ত কষ্টকর অবস্থার মধ্যে আছে। অতঃপর আবু লাহাব তার অবস্থা সম্পর্কে জানায়, তোমদের ছেড়ে আসার পর থেকে আমি শান্তির মুখ দেখিনি, তবে নিশ্চয় সপ্তাহের প্রতি সোমবার আমার আজাব লাঘব করা হয়। হযরত আব্বাস (রা.) বলেন- সোমবার আবু লাহাবের এ আজাব লাঘবের কারণ হলো- নিশ্চয় হযরত রাসুল (সা.)-এর জন্মদিন ছিল সোমবার। তাঁর শুভ জন্মের সুসংবাদ নিয়ে আসায় দাসি সুওয়াইবাকে সে খুশি হয়ে মুক্তি দিয়েছিল।” (ফতহুল বারী ৯ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১১৮)


এই প্রসঙ্গে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান বলেন, “হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর জন্মের সংবাদে খুশি হওয়ায় একজন কাফির হয়েও যদি আবু লাহাবের আজাব লাঘব হতে পারে, তাহলে সেই রাসুল (রা.)-এর উম্মত হয়ে, যদি তাঁর শুভ জন্মদিন আমরা মহাধমুধাম ও আনন্দের সাথে মিলাদ পাঠের মাধ্যমে উদযাপন করি, তাহলে নিঃসন্দেহে আমরাও সৌভাগ্য লাভ করে উপকৃত হতে পারবো।” (মুক্তি কোন পথে? পঞ্চম সংস্করণ, পৃষ্ঠা ২৮)


এ বছর আমার আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশ ও বিদেশের আশেকে রাসুলবৃন্দ পশু জবাই, বাড়িতে বাড়িতে আলোক সজ্জা, মানুষের মাঝে মিষ্টি, চকলেট, কেক ও ফুল বিতরণ এবং নতুন জামা কাপড় পরিধান-সহ উন্নতমানের খাবার রান্না করে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) উদযাপন করেছেন। এর জন্য আমার পক্ষ থেকে আপনাদের প্রতি রইলো আন্তরিক মোবারকবাদ এবং ঈদ মোবারক। মহান মালিক আমাদের সকলের সহায় হোন। আমিন।

সম্পর্কিত পোস্ট