Cancel Preloader

সুলতানুল আরেফিন হযরত খাজা বাহাউদ্দিন নকশবন্দ (রহ.)

ইমামুত তরিকত সুলতানুল আরেফিন হযরত খাজা বাহাউদ্দিন নকশবন্দ (রহ.) ৭১৮ হিজরির মহররম মাসে উজবেকিস্তানের বোখারার সন্নিকটে কাসরে আরেফান নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হযরত জালাল উদ্দিন (রহ.)। হযরত খাজা বাহাউদ্দিন (রহ.) নকশবন্দিয়া তরিকার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।


হযরত খাজা বাহাউদ্দিন নকশবন্দ (রহ.)-এর জন্মের পূর্বেই হযরত খাজা সাম্মাসি (রহ.) তাঁর জন্মগ্রহণ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। একদিন খাজা সাম্মাসি (রহ.) হযরত বাহাউদ্দিন (রহ.)-এর পিতাকে বললেন, আপনার একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করবে এবং বাতেনি দিক দিয়ে সে আমারই ফরজান্দ (আওলাদ) হবে। এছাড়াও সে আমার সিলসিলা উজ্জ্বল করবে। জন্মগ্রহণ করা মাত্র হযরত খাজা সাম্মাসি (রহ.) তাঁকে নিজের স্থানরূপে গ্রহণ করেন। শুধু তাই নয়, ওফাতের পূর্বেই নিজের যোগ্যতম মুরিদ হযরত সৈয়দ আমির কালাল (রহ.)-কে অছিয়ত করেন যে, আমার সন্তান বাহাউদ্দিনের প্রতি সদয় ও স্নেহের দৃষ্টি রাখবে এবং তাঁকে রূহানি তালিম করতে কোনো রকম যেন ত্রুটি না হয়। তিনি স্বীয় মোর্শেদের এই নির্দেশটি সর্বোচ্চ সম্মানের সাথে গ্রহণ করেন। হযরত সাম্মাসি (রহ.) আরেফান নামক স্থানে উপস্থিত হলে প্রায়শই বলতেন, “এ স্থানের মাটি হতে এক আল্লাহর পেয়ারা বান্দার খোশবু উঠছে এবং অতি শীঘ্রই তা আরেফানের বালাখানায় পরিণত হবে। এমন একজন বিশিষ্ট বুজুর্গ জন্মগ্রহণ করবেন যিনি শরিয়ত ও তরিকতের একজন প্রখ্যাত ইমাম হবেন।” তিনি একবার সেখানে হাজির হয়ে বললেন, “মনে হচ্ছে উক্ত বুজর্গ দুনিয়ায় তাশরিফ এনেছেন।” এ ঘটনার মাত্র তিনদিন পূর্বে আল্লাহর পেয়ারা হযরত খাজা নকশবন্দ (রহ.) এ স্থানেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন।


হযরত বাহাউদ্দিন (রহ.)-এর জন্মের তৃতীয় দিনে তাঁর পিতা হযরত জালাল উদ্দিন (রহ.) হযরত খাজা সাম্মাসি (রহ.)-এর আরেফানে আগমনের খবর পেয়ে আনন্দচিত্তে শিশু পুত্রকে কোলে করে খাজা সাম্মাসি (রহ.)-এর দয়া ভিক্ষার অভিপ্রায়ে তাঁর দরবারে হাজির হন। তিনি শিশুটিকে দেখেই নিজের কোলে নিলেন। তাঁকে দেখেই সদাশয় প্রফুল্লতার সাথে বাবা সাম্মাসি (রহ.) বলেছিলেন “এই সেই শিশু, আমি যার খোশবু পেতাম। আমি তাকে নিজের ফরজান্দের (আওলাদের) মধ্যে কবুল করে নিলাম।” অতঃপর শিশুর পিতার প্রতি লক্ষ্য করে বললেন, “এই শিশু সন্তানকে হেফাজত করবেন।” নিজের খলিফা হযরত সৈয়দ আমির কালাল (রহ.)-কে সম্বোধন করে বললেন, “আমি আপনাকে যা কিছু দান করেছি তা এই শিশুর আমানত। আমার এই আওলাদের তরিকতের শিক্ষায় যদি আপনি একচুল পরিমাণও গাফিলতি করেন তাহলে কিয়ামতের দিন আমি আপনাকে মাফ করব না।” প্রতি উত্তরে আমির কালাল (রহ.) আরজ করলেন, “যদি আমি তাঁর তরবিয়তে (শিক্ষার) গাফিলতি করি তাহলে আমি মানুষ নই।” এই মহামানব শিশু খান্দানের দিক হতে ইমাম হাসান (রা.) এবং ইমাম হোসাইন (রা.)-এর ছিলেন। তিন দিনের শিশু বাবার সাথে সাম্মাসি (রহ.)-এর দরবারে এসেই মহাসম্মানে ভূষিত হলেন। বাবা সাম্মাসি (রহ.) হযরত খাজা নকশবন্দ (রহ.)-কে কোলে করে তাঁর জবান মোবারক শিশুর মুখে দিলেই তিনদিনের শিশু এত জোরে তাঁর জিহ্বা মোবারক চোষণ করলেন যে জিহ্বা শুকিয়ে গেল। এই ঘটনায় বাবা সাম্মাসি (রহ.) খুশি হয়ে বললেন- “এই শিশুর আলী হিম্মতের নিকট আমি হেরে গিয়েছি।”


হযরত বাহাউদ্দিন নকশবন্দ (রহ.) বলেন, আমার ১৮ বছর বয়সকালে পিতা আমাকে বিবাহ করানোর সংকল্প করলেন। আমাকে হযরত খাজা সাম্মাসি (রহ.)-এর খেদমতে পাঠালেন। সারা রাত হযরত খাজা সাম্মাসি (রহ.)-এর খেদমতে কাটালাম। শেষ রাতের দিকে আমি মসজিদে গিয়ে ২ রাকাত নামাজ আদায় করি। সেজদায় গিয়ে নিতান্ত কাকুতি মিনতির সাথে প্রার্থনা করলাম “হে আল্লাহ্! আমাকে বিপদাপদ বহন করার জন্য আরও অধিক শক্তি দান করুন।” তিনি হযরত বাবা সাম্মাসি (রহ.)-এর নিকট পিতার অভিপ্রায় জ্ঞাপন করলে তিনি তাতে সম্মতি প্রদান করলেন না। তাই বাবা সাম্মাসি (রহ.)-এর জীবনকাল পর্যন্ত হযরত বাহাউদ্দিন (রহ.) বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হননি। তিনি অতঃপর সমরকন্দ গমন করেন। তথাকার মহান অলী-আল্লাহ্গণ হতে ফায়েজ হাসিল করে সেখান হতে বুখারা গমন করেন। পরবর্তীতে বুখারায় বিবাহ করে নিকটতম স্থানে বসবাস শুরু করেন। ইতোমধ্যে হযরত সৈয়দ আমির কালাল (রহ.) বুখারায় শুভাগমন করেন। তখন হযরত বাহাউদ্দিন (রহ.) তাঁর নিকট বায়াত হন এবং রূহানি তালিম হাসিল করতে থাকেন।


রূহানি তালিম সম্পন্ন করার পর হযরত সৈয়দ কালাল (রহ.) হযরত খাজা বাহাউদ্দিন (রহ.)-কে বলেন, “আমি আমার মোর্শেদ বাবা সাম্মাসি (রহ.)-এর নির্দেশ অনুযায়ী আপনার রূহানি তালিমের কাজ করে দিলাম, কিন্তু আপনার যোগ্যতা অনেক ঊর্ধ্বে। অতএব আমি আপনাকে অনুমতি দিচ্ছি যার নিকট হতে ফায়েজ হাসিল করতে চান করতে পারেন।” তাঁর অনুমতি পেয়ে তিনি হযরত শেখ ফাতাহ (রহ.) এবং হযরত খলিল আক্কার (রহ.)-এর খেদমতে গমন করেন। তথায় তাঁদের নিকট হতে বাতেনি ফায়েজ লাভ করেন। হযরত শেখ ফাতাহ (রহ.) বলেন, “বাহাউদ্দিন নকশবন্দের সিনার ভিতরে আল্লাহ্ পাকের অন্বেষণের যে আগুন জ্বলছে বুখারার জমিনে এর দৃষ্টান্ত অতি বিরল।” হযরত খলিল আক্কার (রহ.)-এর খেদমতে তিনি ১২ বছর অতিবাহিত করেন। তাঁরই সঙ্গে তিনি দুবার হজে গমন করেন। কিছুকাল পর খলিল আক্কার (রহ.) ঐ অঞ্চলের এক রাজ্যের শাসনকর্তার পদ লাভ করেন। তিনি সেখানে সুলতান খলিল আক্কার নামে খ্যাত হন। হযরত খাজা বাহাউদ্দিন (রহ.) বলেন, বাদশাহীর জামানায়ও আমি তার মধ্যে যে সমস্ত বিষয় দেখতে পেয়েছি, তাতে তাঁর প্রতি আমার মন আরও বেশি ঝুঁকে পড়ে। তাঁর বাদশাহীর কালে ৬ বছর আমি তাঁর সহবতে ছিলাম। এ সময়ও তিনি আমাকে তরিকতের নানাবিধ শিক্ষা দিতেন।

মানুষ তার পরম সত্তাকে জানার জন্য আজন্ম কৌতুহলী। স্রষ্টাকে খুঁজতে গিয়ে বারবার সৃষ্টির মাঝে তাঁকে অন্বেষণ করেছেন। কিন্তু পরিশেষে তারা অসীমের মাঝে সীমা খুঁজে পেয়েছেন নিজ নিজ অন্তরের অন্তঃস্থলে (ক্বালব)। তাই এই মহাজ্ঞানী মহান তাপস বাল্যকাল হতেই আত্মিক শিক্ষায় মনোনিবেশ করে সদাসর্বদা নির্জনে একাকী নিবিষ্টচিত্তে মাবুদ মাওলার ধ্যান তথা মোরাকাবা ও মোশাহেদা করতে লাগলেন। দুনিয়ার সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে হযরত বাহাউদ্দীন নকশবন্দ (রহ.) মহান আল্লাহ্ পাকের মাঝে পূর্ণ ফানা হয়েছিলেন। যে কারণে উনি খালেছ বাকাও লাভ করেছিলেন। মহান আল্লাহ্ তাঁর পুরস্কারস্বরূপ তাঁর দোয়াও কবুল করেছেন এবং তরিকার সবক নফস থেকে শুরু না করে ক্বালব থেকে শুরু করতে এলহাম-ইলকা লাভ করেছেন। আগের মতো রিয়াজত-মোশাহাদার পরিবর্তে সুন্নতের আমল শুরুতেই শুরু করার নির্দেশ পেয়েছিলেন।


উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্তে তিনি কঠোর সাধনায় ব্রত ছিলেন। রিয়াজত ও মোশাহাদা ছাড়াও তিনি তৎকালীন বোখারার প্রান্তে প্রান্তে দীন-হীন কাঙ্গালের মতো ঘুরে বেড়াতেন। প্রতিটি খান্কা, মাদ্রাসায় পানি সরবরাহ ও দরবেশগণের খেদমত এমনকি শৌচাগার পর্যন্ত পরিষ্কার করে এক পর্যায়ে আল্লাহর রহমতে মোশাক্কাত ও মোজাহেদার পর তিনি ফকিরি হাছিল করেছিলেন। তিনি বলেছেন, “প্রাথমিক জজবাতেই আমার প্রতি এলহাম হয়েছিল- তুমি কীভাবে এইপথ এখ্তিয়ার করতে চাও? আমি আরজ করলাম, আমি যা আকাঙ্খা করি, তা যেন বাস্তবে পরিণত হয়।” প্রতি উত্তরে- “না, যা আমি হুকুম করব, তোমাকে তাই করতে হবে।” এভাবে আলাপ হওয়ার পর ১৫ দিন পর্যন্ত তিনি নিরাশার অন্ধকারে ছিলেন। এপর্যায়ে একসময়ে আবার এলহাম হলো “তুমি যেভাবে চাও সেভাবেই থাক।” ক্রমান্বয়ে হযরত বাহাউদ্দিন নকশবন্দ (রহ.) আত্মিক উন্নতির সোপানগুলি পার হয়েছিলেন। তিনি বোখারার মাজার শরীফসমূহ রাতের পর রাত জিয়ারত করে বেড়াতেন। একদিন তিনি অনুভব করলেন যে, প্রত্যেকটি মাজারের বাতিগুলি তৈলপূর্ণ, অথচ টিম্ টিম করে জ্বলার ব্যথায় ব্যাকুল, তৎক্ষণাৎ তাঁর স্পর্শে বাতিগুলি তেজোদীপ্ত হয়ে উঠত। এমনি রাত্রিসমূহের এক রাত্রিতে তিনি ঘোড়-সওয়ারী ও তলোয়ারধারী বেশে হযরত খাজা মজদে আখন্দ (রহ.)-এর মাজার শরীফে উপস্থিত হয়ে কেব্লামুখী অবস্থায় মোরাকাবা রত হলেন। বাহ্যজ্ঞান শূন্যতার এক পর্যায়ে তিনি দেখলেন যে, মাজার শরীফের কেব্লার দিকের দেওয়াল সরে গেল। সেখানে তখতের উপর বসা এক বুজুর্গ। সম্মুখে সবুজ পর্দা। চারদিকে বহুলোক জমায়েত। তাদের মধ্যে তিনি একমাত্র সাম্মাসি (রহ.)-কে বললেন। এই মহাসম্মেলনে তাঁকে কতক নির্দেশ দেওয়া হলো। এরপর তিনি নিজ গৃহ হতে টুপি সংগ্রহ করে হযরত আমির কালাল (রহ.)-এর নিকট গমন করেন এবং আধ্যাত্মিক বিদ্যা শিক্ষায় মত্ত হয়ে পড়েন। এক সময় আমির কালাল (রহ.) তাঁর সকল খাদেমের সম্মুখে হযরত বাহাউদ্দিন নকশবন্দ (রহ.)-কে বললেন, “হযরত খাজা সাম্মাসি (রহ.) আপনার ভার আমার উপর ন্যস্ত করেছিলেন এবং আমি আমার সাধ্যানুসারে আপনার শিক্ষার কোনো ত্রুটি করিনি। এখন আপনার রূহানি পক্ষী দেহরূপে ডিম হতে বাহির হয়ে যথেষ্ট উচ্চে উড়ার শক্তি সঞ্চয় করেছে। তাই আপনি তুর্কিস্থান, তাজাকিস্তান- যেখানে যাহা কিছু মিলে তা হাছিল করতে পারেন।”


হযরত খিজির (আ.)-এর সাক্ষাত লাভ
একদিন তাঁর মোর্শেদ কেব্লা হযরত আমির কালাল (রহ.)-এর সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশে রওয়ানা হন। পথে জনৈক ব্যক্তির সাথে তার সাক্ষাত হয়। তার মুখমন্ডল কাপড়ে আচ্ছাদিত ছিল। উক্ত ব্যক্তি তার সাথে কথা বলতে চাইলেন, কিন্তু তিনি সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ করলেন না। সোজা স্বীয় পিরের খেদমতে হাজির হলেন। তাঁর পির তাকে বললেন পথে আপনার সাথে যার সাক্ষাত হলো তার সাথে কথা বলেননি কেন? তিনি ছিলেন হযরত খিজির (আ.)। উত্তরে হরযত বাহাউদ্দিন নকশবন্দ বললেন, হুজুর! আমি আপনার খেদমতে আসছিলাম, এজন্য অন্য কোনো দিকে লক্ষ্য করিনি।


তাঁকে নকশবন্দী বলার কারণ
ইতিহাস থেকে জানা যায় হযরত বাহাউদ্দিন নকশবন্দ (রহ.) তাঁর মুরিদদিগকে ‘আল্লাহ্’ শব্দের নকশা লিখে দিতেন, যাতে তারা ধ্যানের মাধ্যমে এই নাম পাকের নকশা স্বীয় ক্বালবে প্রতিফলিত করতে পারে। ‘নক্শবন্দ’ শব্দের অর্থ ‘চিত্রকর’। এই তরিকার সুফিরা আল্লাহর মহিমার চিত্র হৃদয়ে ধারণ করেন, এ অর্থে তাদের বলা হয় নক্শবন্দী। হযরত বাহাউদ্দিন নকশবন্দ (রহ.) এজন্য নকশবন্দী উপাধিতে সুখ্যাতি অর্জন করেন। তিনি যে সিলসিলার বায়াত গ্রহণ করতেন, তা ‘সিলসিলা-ই-নকশবন্দীয়া’ নামে খ্যাতি অর্জন করে। তিনি ও তাঁর সুযোগ্য খলিফাগণের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এ সিলসিলার মাধ্যমে ইসলামের পতাকা দেশে-বিদেশে প্রচার ও প্রসার লাভ করে।


উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য সহজ তরিকা দান
কথিত আছে, তিনি সুদীর্ঘকাল ইবাদত রিয়াজত, মোশাহাদা ও মোরাকাবায় মগ্ন ছিলেন। তিনি দেশে বিদেশে, পাহাড়ে, জঙ্গলে আল্লাহর প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে ঘুরে বেড়াতেন। দুনিয়ার কোনো আকর্ষণই তাঁর ছিল না। প্রায়ই তাঁর পরিধেয় বস্ত্র ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত, নগ্ন পদে কন্টকাকীর্ণ পথ চলতে চলতে তাঁর কদম মোবারক ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যেত। কিন্তু সেদিকে তাঁর কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না। তাঁর একমাত্র ধ্যান ও সাধনা ছিল কীভাবে মাবুদ মাওলার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভ করা যায়। সুদীর্ঘকাল এভাবে পাহাড়ে জঙ্গলে কঠিন ইবাদত-রিয়াজত ও সাধনার মাধ্যমে অতিবাহিত করেন। সে যুগের শ্রেষ্ঠ অলীদের তারবিয়ত (তাসাউফের শিক্ষা) ও সহবত লাভে তিনি ধন্য হন এবং দীর্ঘ প্রায় পঞ্চাশ বছর কঠোর রিয়াজত ও সাধনা দ্বারা কামালিয়াত অর্জন করেন। এ সময় তিনি বুখারার সব খানকাহ ও মাদ্রাসার প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ করতেন, তাছাড়া আল্লাহর অলী ও দরবেশদের খেদমত ও তাঁদের শৌচাগার পরিষ্কার করার কাজও করতেন। উল্লেখ্য যে, নফ্সের পবিত্রতা লাভের জন্য দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর কঠোর পরিশ্রমের পর তিনি চিন্তা করেন যে, পরবর্তী সময়ের মানুষের হায়াত দীর্ঘ হবে না এবং আল্লাহ্ তায়ালার মারেফত ও মহব্বত হাসিলের জন্য তারা এত কষ্ট স্বীকার করতে পারবে না। কারণ, যতই দিন যাবে, ততই মানুষ দুনিয়ামুখী হবে এবং দুনিয়ার ঝামেলায় জড়িয়ে পড়বে। তাই একটি সহজ তরিকা লাভের আশায় তিনি আল্লাহর দরবারে লাগাতার পনের দিন সিজদায় পড়ে থাকেন। নামাজের সময় হলে শুধুমাত্র জামাতে ফরজ নামাজ আদায় করতেন এবং বাকী সময় সিজদায় পড়ে থাকতেন। এ সময় কোনো দিন তিনি এক লোকমা খানা বা এক ফোঁটা পানি, স্পর্শ করেননি। সুতরাং তিনি আল্লাহর কাছে একটা সহজ পথ ভিক্ষা চাইলেন। এই চিন্তার প্রেক্ষিতে তিনি ১৫ দিন এক নাগাড়ে আল্লাহর দরবারে সিজদায় পড়ে রইলেন। এই ১৫ দিন তিনি এক ফোঁটা পানি পর্যন্ত স্পর্শ করেননি। হযরতের আরজ ছিল – “ইয়া আল্লাহ্! আপনি আমাকে এমন তরিকা দান করুন, যে তরিকায় সহজে মারেফত হাছিল হয় এবং মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়।” এই সিজদার মধ্যে হযরতের কখনও কখনও খেয়াল হতো যদি দোয়া কবুল না হয়, তবে তিনি সিজদার মধ্যেই নিজেকে আল্লাহর হুজুরে সোপর্দ করে দিবেন এবং সেজন্যই তিনি আল্লাহর নিকট আরজ করতেন যে, “হে আল্লাহ্! আপনার দরবারে সিজদার মধ্যেই যদি আমার মৃত্যু হয়ে যায়, তাহলে আমার কোনো দুঃখ নেই। তথাপি উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য সহজ তরিকা না নিয়ে সিজদা হতে মাথা উঠাব না।” সিজদার মধ্যে কখনও কখনও এলহাম হতো “আমি যেরূপে চাই, আপনি সেরূপে সিলসিলা গ্রহণ করুন।” আর হযরত আরজ করতেন, “হে আল্লাহ্! আপনার বান্দা বাহাউদ্দিন যেমন সহজ তরিকা চায় দয়া করে তাকে তাই দান করুন।” এভাবে ১৫তম দিবসে আল্লাহ্ তায়ালার তরফ হতে এলহাম হলো “আপনাকে আমি এমন তরিকা দান করব যে তরিকায় দাখিল হবার পর কেহ মাহ্রুম (বঞ্চিত) থাকবে না।”


তার উপর আরো এলহাম হলো- “ইনসান দশ লতিফায় গঠিত। এর মধ্যে পাঁচ লতিফা আলমে আমরের এবং পাঁচ লতিফা আলমে খালকের। আলমে আমরের পাঁচ লতিফা-যথা ক্বালব, রূহ, ছের, খফি ও আখফা হচ্ছে নুরের তৈরি- সেজন্য নুরানি তথা আলোকময়। আর আলমে খালকের পাঁচ লতিফা জুলমাত অর্থাৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন।


হযরত বাহাউদ্দীন নকশবন্দ (রহ.)-এর উপর আরও এলহাম হলো- নফসের এসলাহ খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। যেহেতু ক্বালব নুর হতে সৃষ্ট সেজন্য আপনি প্রথমেই ক্বালবের এসলাহ করুন, তাহলে অতি শীঘ্রই মানুষ বাতেনি নুরের আলোকে আলোকিত হয়ে উঠবে। ‘বুসিস্তান মোকাদ্দস বুদ্ রব পয়বস্তান’ অর্থাৎ দুনিয়ার সমস্ত বস্তু হতে দিলকে ছিন্ন করার পর আল্লাহ্ তায়ালার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা হয়ে থাকে। আপনি প্রথমে পয়বসতান ও পরে বুসিস্তান-এর পথ এখতিয়ার করুন। যখন তালেবে মাওলার দিলে আল্লাহ্ তায়ালার মহব্বতের নুর পয়দা হয়ে যাবে তখন খোদ্-ব-খোদ গায়রুল্লাহর সহিত সম্পর্ক ছিন্ন হবে।
হযরত বাহাউদ্দিন নকশবন্দ (রহ.) আল্লাহর দরবারে শোকর গুজার করত সিজদা হতে মাথা মোবারক উঠালেন এবং সেভাবে তরিকার আমল প্রশিক্ষণের কাজ শুরু করলেন। তিনি হলেন নকশবন্দিয়া তরিকার ইমাম।


এই তরিকার অল্প আমলেই অধিক ফল পাওয়া যায়। কিন্তু এর একমাত্র শর্ত হলো আল্লাহ্ তায়ালার নিকট নিজেকে সোপর্দ করা এবং সুন্নতের পুরোপুরি পায়রবি করার প্রতি বিশেষভাবে খেয়াল রাখা। নীরবে জিকিরই এই তরিকতপন্থীদের উন্নতির সোপান বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।

একব্যক্তি হযরত নকশবন্দ (রহ.)-এর নিকট কারামত দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তিনি জবাবে বললেন, “কারামত তো প্রকাশ হয়েই রয়েছে। কারণ এত গুনাহ করা সত্ত্বেও আমি জামিনের উপর চলাফেরা করছি এবং জমিন ধ্বসে পড়ছে না।” আল্লাহর পেয়ারা দোস্ত হযরত খাজা বাহাউদ্দিন নকশবন্দ (রহ.) বলতেন, “যখন আমার আখেরি ওয়াক্ত আসবে তখন কেমন করে মৃত্যুবরণ করতে হয়, তা সকলকে শিখিয়ে দেবো।”


অবশেষে, সেই মুহূর্ত এসে উপস্থিত হলো। দুহাত উপরে উঠিয়ে রাহমানুর রাহিমের অনন্ত প্রেমের আকর্ষণে মশগুল হৃদয় পূর্ণরপে রুজু করিলেন, দীর্ঘক্ষণ নীরবে কান্না করলেন, আশেক মাশুকের কিসের আলাপন হলো। কত কথা হলো, কী কথা হলো, তা শুধু তারা দুজনেই জানেন। হযরত বাহাউদ্দিন (রহ.) দোয়া শেষ করলেন। দুহাত নিজের চেহারা মোবারকের উপর মুছলেন। তারপরই আল্লাহ্ তায়ালার হুজুরে নিজেকে পূর্ণরূপে সম্পন্ন করলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তিনি রফিকে মাওলা পাকের দরবারে গমন করলেন। সেদিন ছিল ৩ রবিউল আউয়াল, ৭৯১ হিজরি।

হযরত বাহাউদ্দিন (রহ.) ওফাতের পূর্বে অছিয়ত করে গিয়েছিলেন- ‘আমায় জানাজায় নিয়ে যাবার সময় তোমরা কালেমা শাহাদাৎ পাঠ করবে না। এটা আমি আদবের খেলাফ মনে করি। বরং জানাজায় যাবার সময় এই রূবায়িটি (গজল) পাঠ করিও’।


“আমলের দিক হতে দরিদ্রের বেশে
তোমার দুয়ারে আজ দাঁড়ালাম এসে।
দয়া করো জাহের করো দিদারে জামাল
তোমারি অনুকম্পা যাচে মিসকিনের হাল
শতমুখী প্রশংসা প্রভু, কী যে রহমত তোমার
কী খুব ছুরত কী মধুর তোমার দিদার।”

সংকলনে- ড. সৈয়দ মেহেদী হাসান

তথ্যসূত্র:
১. আত্মার বাণী, ১ম বর্ষ, ১ম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ১৯৮১; সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) কর্তৃক সম্পাদিত ও ঢাকা থেকে প্রকাশিত, পৃষ্ঠা ৪-৬
২. হালাতে মাশায়েখে নক্শবন্দীয়া মুজদ্দেদীয়া, ১ম খণ্ড, নারিন্দা, ঢাকা, পৃষ্ঠা ২২৫-২২৬
৩. অনলাইন থেকে সংগৃহীত

সম্পর্কিত পোস্ট