Cancel Preloader

সুলতানুল আরেফিন হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.)


প্রখ্যাত সুফিসাধক সুলতানুল আরেফিন হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.)-এর নাম বাংলাদেশে যুগ পরম্পরায় মানুষ স্মরণ করে আসছে। এর কারণ হচ্ছে তিনি বাল্যকালেই মাতৃভক্তির বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বায়েজিদ বোস্তামির মাতৃভক্তি ছিল অসামান্য। মায়ের দোয়ার বরকতে তিনি একদিন বিশ্ববিখ্যাত আল্লাহর অলীতে পরিণত হন। তিনি তৎকালীন পারস্যের বর্তমান ইরানের সেমনান প্রদেশের বোস্তাম শহরে ৮০৪ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন। তার প্রকৃত নাম আবু ইয়াজিদ তাইফুর ইবনে ইসা ইবনে সুরাশান আল বোস্তামি। তার পিতামহ সুরাশান একজন যরথুস্ত্র ধর্মাবলম্বী ছিলেন বলে জানা যায়। পরবর্তীতে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তার তিন ছেলে ছিল- তারা হলেন আদম, তায়ফুর এবং আলী। তায়ফুর (রহ.) অত্যন্ত সাধক প্রবন মানুষ ছিলেন। তাঁর ঘরে জন্ম হয়েছিল বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.)-এর। যাকে বলা হয় সুলতানুল আরেফিন। তিনি স্রষ্টায় বিলীন হওয়ার তত্তের জন্য বিখ্যাত। বাল্যকাল হতেই তিনি বেশিরভাগ সময় কাটাতেন ঘরে কিংবা মসজিদে, একাকী ও নিভৃতে।


সুফিবাদ তথা তাসাউফের আলোচনা করার জন্য তিনি লোকজনকে নিজের বাড়িতে আমন্ত্রণ করতেন। বায়েজিদ (রহ.) কঠোর সাধনা করতেন এবং সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য লাভের আসায় দুনিয়ার সকল আনন্দ-ফুর্তি থেকে নিজেকে দূরে রাখতেন। তিনি মারেফতের তত্ব একটি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। তিনি আধ্যাত্মিক দর্শন ‘ওয়াহদাত আল উজুদ’ তথা স্রষ্টায় নিজেকে বিলীন করার শিক্ষা সম্পর্কে গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি সুফিবাদে ধার্মিকতা ও আল্লাহ্র বন্দেগি এ ধারণা আরও সম্প্রসারিত করে সংযোগ করলেন স্রষ্টার প্রেমতত্ব ।


বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.) সৃষ্টিকর্তার প্রেমে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। তার একটি বিখ্যাত উক্তি, আমি একবার স্বপ্নে দেখলাম, আল্লাহ্কে আমি জিজ্ঞেস করছি, “তাঁকে পাওয়ার পথ কী?” তিনি বললেন, “নিজেকে ত্যাগ করো, দেখবে পৌঁছে গিয়েছ।” তিনি কঠোর তপস্যার মাধ্যমে আল্লাহ্ তায়ালার সান্নিধ্য লাভের আশায় দুনিয়ার ভোগ-বিলাস থেকে নিজেকে দূরে রাখতেন। সুফিবাদের মতানুযায়ী, এমন কঠোর সাধনাই পারে কোনো মানুষকে সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য লাভের কাছাকাছি পর্যায়ে নিয়ে যেতে। এভাবে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ কম মানুষই করার সুযোগ পায়। তিনি জীবনে ৩০টি বছর অতিবহিত করেন সুফিবাদ প্রচারে। তিনি বলেন- যে ব্যক্তি শরিয়ত এবং সুন্নতের অনুসরণ ছাড়া নিজেকে তরিকতপন্থি বলে দাবি করে সে আসলেই মিথ্যাবাদী। কারণ শরিয়তের অনুসরণ ছাড়া তরিকত হাসিল হয় না।


শিক্ষাজীবন
হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.)-এর পিতা ও মাতা ছোটোবেলা থেকেই তাঁর বিদ্যাশিক্ষার ওপর বিশেষ জোর দিয়েছিলেন। শিক্ষা অর্জনের জন্য তাঁর জন্য বাসায় কয়েকজন শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। তাঁর পিতাও তাঁকে শিক্ষাদান করতে থাকেন। এভাবেই একটি সুন্দর পরিবেশে বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.) বড়ো হতে থাকেন। তাঁর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গৃহশিক্ষকের ওপর নির্ভর করতে না পারায় তাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেওয়া হয়। কিন্তু কিছু সময়ের মধ্যেই তাঁর পিতা মৃত্যুবরণ করেন। তবে পিতার মৃত্যু তাঁর শিক্ষাজীবন ব্যাহত করতে পারেনি। কারণ বায়েজিদ (রহ.)-এর মাতা ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমতী মহিলা। স্বামীর অকাল মৃত্যুতে তিনি বিচলিত হননি। তার পরিবারে আর্থিক অবস্থা মোটামুটি সচ্ছল ছিল। বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.) মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তাই মাদ্রাসায় তিনি সহজেই শিক্ষকদের সুনজরে আসেন।


হযরত বায়েজিদ (রহ.) বাল্যকালে মাদ্রাসায় পড়ার সময় পবিত্র কুরআন শিক্ষার এক পর্যায়ে শিক্ষকের কাছ থেকে সুরা লোকমানের একটি আয়াতের ব্যাখ্যা শুনলেন। আয়াতটির অর্থ হলো- “শোকরগুজারি করো আমার প্রতি এবং তোমার পিতামাতার প্রতি।” শিক্ষকের অনুমতি নিয়ে বাড়ি এসে মাকে বললেন: আমি কুরআনের একটি আয়াতে উপনীত হয়েছি, যেখানে আল্লাহ্ আদেশ দিচ্ছেন তাঁকে এবং তোমাকে শোকরগুজারি করার। আমিতো একই সাথে দুইটি ঘরের ব্যবস্থাপক হতে পারবো না। আমাকে এ আয়াত জীবনের ভুল ভেঙে দিয়েছে। হয়তো তুমি আমাকে আল্লাহর কাছ থেকে চেয়ে নাও, যাতে আমি সম্পূর্ণরূপে তোমার হয়ে যেতে পারি, নয়তো আমাকে শিক্ষানবিশ হিসেবে আল্লাহর কাছে ছেড়ে দাও, যাতে আমি আল্লাহর মধ্যে বাস করতে পারি। মা বললেন: আমি তোমাকে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করে দিলাম, যাও আল্লাহর হয়ে যাও। (তাজকিরাতুল আউলিয়া, আত্তার)।
তারপর তিনি মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যান ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করার জন্য। উচ্চ মাকাম অর্জনের জন্য ১১৩ জন বিশিষ্ট শিক্ষকের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা লাভ করেন। তার বিশিষ্ট শিক্ষকের মধ্যে ছিলেন হযরত ইমাম সাদিক (রহ.) ও হযরত শফিক বলখি (রহ.)।


মাতৃভক্তি
শৈশবে হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.) অন্য শিশুদের মতো খেলাধুলা ও হৈ-হুল্লায় অযথা সময় নষ্ট করেননি। তিনি শৈশব থেকেই মহান আল্লাহর ইবাদত ও মায়ের খেদমতে লিপ্ত থাকতেন। তার ছোটোবেলার জনপ্রিয় একটি ঘটনা আমরা স্কুলে থাকতে পড়ে এসেছি যেখানে বায়েজিদের মাতৃভক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। শৈশবে প্রতিটি বাঙালির মুখে মুখে যে কবিতাটি মুখস্থ ছিল তা হলো কালিদাস রায়ের ‘মাতৃভক্তি’ কবিতা।


বায়েজিদ বোস্তামি- শৈশব হতে জননীর সেবা করিতেন দিবাযামী।
দুপুর রাত্রে জননী জাগিয়া ডাকিলেন, ‘বাছাধন,
বড়ই পিয়াস পানি দাও’ বলি মুদিলেন দু’নয়ন।
দেখিল বালক ঘরের কোণের কলসিতে নেই পানি,
বহুদূর পথ ঝরনা হইতে কলসি ভরিয়া আনি।
মায়ের তৃষ্ণা মিটাইবে বলি গভীর অন্ধকারে
ছুটিয়া বাহির হইল একাকী কলসি লইয়া ঘাড়ে।
জল ঢালি পিয়ালায়
সুপ্তা মাতার নয়ন শিয়রে দাঁড়ায়ে রহিল ঠায়।
ভাঙালে নিদ্রা হবে অপরাধ, কখন ভাঙিবে নিদ,
সেই ভরসায় পানি হাতে খাঁড়া রহিল যে বায়েজিদ।
পূর্ব গগন ফর্সা হইল, ডাকিয়া উঠিল পাখি,
জননী মেলিল আঁখি।
দেখিল শিয়রে দাঁড়ায়ে রয়েছে দশ বছরের ছেলে
পানি হাতে কেন, বুঝিল না মাতা প্রথম নয়ন মেলে।
সহসা পড়িল মনে, গভীর রাতে পিপাসায় পানি চেয়েছিল বাছাধনে।
কহিল মা, মরি মরি!
বাছারে আমার, পানি হাতে করে সারা রাত্রটি ধরি
দাঁড়াইয়া আছ? ঘুমাওনি আজ?’ চোখে এল জল ভরি।
পুত্রেরে কোলে নিয়ে মা চুমিল বার বার মুখখানি।
কহিল জননী, ‘নয়নের মণি, সাধারণ শিশু নও,
খোদার দোয়ার বরকতে তুমি জগতপুজ্য হও।
পুত্র গড়বে গর্বিত বুকে, খোদা স্মরি তব নাম,
তোমারে আমার জীবনের এই সম্বল সঁপিলাম।’
বিফল হয়নি মায়ের আশিস, হৃদয়ের প্রার্থনা
জগৎ-বন্দ্য জ্ঞানগুরুদের বায়েজিদ একজনা।

ঘটনাটি ছিল- এক রাতে তাঁর মহীয়সী মা ঘুম ভেঙে গেলে পানি পান করতে চাইলেন। কিন্তু ঘরে পানি ছিল না। তখন বালক বায়েজিদ (রহ.) পানি আনতে বেরোলেন বাইরে। দূরের এক ঝরনা থেকে পানি নিয়ে তিনি যখন ঘরে ফিরলেন, তখন তার মা আর জেগে নেই। আবারও ঘুমিয়ে পড়েছেন। কিন্তু বায়েজিদ (রহ.) মায়ের ঘুম না ভাঙিয়ে শিয়রের কাছে সারা রাত দাঁড়িয়ে রইলেন পানির গøাস হাতে করে এই ভেবে যে, যদি মা আবার উঠে পানি পান করতে চান। রাত পেরিয়ে সকাল হলে মায়ের ঘুম ভাঙল। তিনি দেখলেন বায়েজিদ (রহ.) দাঁড়িয়ে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে। মায়ের প্রতি এই আবেগ দেখে মা উদ্বেলিত হয়ে পড়লেন। মা প্রাণ ভরে ছেলের জন্য দোয়া করেন। আল্লাহ্ মায়ের দোয়া কবুল করলেন। পরে জগত বিখ্যাত অলী-আল্লাহ্ বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.) নামে পরিচিত হলেন।


বোস্তামির মাজারের বিস্ময়কর কাছিম
চট্টগ্রাম নগরীর একটি পাহাড়ে অবস্থিত বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.)-এর প্রতিরূপ মাজার। এই মাজারের অবয়ব সর্বপ্রথম ১৮৩১ সালে পাহাড়ের উপরিভাগে একটি দেয়ালঘেরা আঙিনার মাঝে আবিষ্কার করা হয়। মাজারটির পাদদেশে রয়েছে একটি বিশালাকার পুকুর। আর ওই পুকুরের মূল আকর্ষণ বিস্ময়কর কচ্ছপ বা কাছিম বা গজার মাছ। স্থানীয়রা তাদের মাজারি ও গজারি বলেই আখ্যায়িত করেন। এ কচ্ছপ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অত্যন্ত বিরল এবং বিপন্নপ্রায় প্রজাতি। বর্তমানে বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.)-এর মাজার ছাড়া তাদের বিশ্বের আর কোথাও দেখা যায় না। তাই দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য খুব আকর্ষণীয় এ কচ্ছপ। বিশালাকার কচ্ছপগুলো দেখলে বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়। এই কচ্ছপগুলোর অনেকেরই বয়স প্রায় ২০০-২৫০ বছর। মাজারের বড়ো বড়ো এ কচ্ছপগুলোকে প্রতিদিনই দর্শনার্থীরা খাবার দেন। ১৯৩১ সালে প্রাণিবিজ্ঞানী ম্যালকম স্মিথ তার ‘ফনা অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া গ্রন্থে’ উল্লেখ করেন, ভারতবর্ষে ‘নিলসোনিয়া নিগরিকেন টার্টেল’ বা বোস্তামি কাছিম একমাত্র বায়েজিদ বোস্তামির মাজারেই পাওয়া যায়। স্থানীয় লোকজনের বিশ্বাস, হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.) ইরান থেকে চট্টগ্রামে আসার সময় এ কাছিমগুলো নিয়ে আসেন। প্রাণিবিজ্ঞানীদেরও ধারণা ছিল বোস্তামি কাছিম উপমহাদেশ অঞ্চলের প্রাণী নয়। সা¤প্রতিক এক গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা দাবি করছেন, বোস্তামি কাছিম বাংলাদেশ অঞ্চলের নিজস্ব প্রাণী।


চট্টগামে বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.)
বায়েজিদ বোস্তামি চট্টগ্রামে এসেছিলেন বলে অনেকে বলে থাকেন। ধারণা করা হয়, সুফিসাধক ও আউলিয়ায়ে কেরাম চট্টগ্রামে ইসলাম ধর্ম প্রচারের সময় সচরাচর পাহাড়ের উপরে কিংবা জঙ্গলঘেরা অঞ্চলে আবাস স্থাপন করেন এবং এসব জায়গায় মাজার কিংবা এ ধরনের বিভিন্ন স্থাপনা প্রতিষ্ঠা করেন। বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.)-এর মাজারটাও মূলত তাকে উৎসর্গ করে প্রতিষ্ঠিত একটি প্রতিরূপ মাত্র। জনশ্রুতি আছে, বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.) চট্টগ্রামে আগমন করেছিলেন। চট্টগ্রামে অবস্থানের পরে প্রস্থানকালে ভক্তকুল তাকে সেখানে থেকে যাওয়ার অনুরোধ করলে তিনি তাদের ভালোবাসা ও ভক্তিতে মুগ্ধ হয়ে কনিষ্ঠ আঙ্গুল কেটে কয়েক ফোঁটা রক্ত মাটিতে পড়ে যেতে দেন। পরবর্তীতে ওই রক্ত ফোঁটা পড়ার জায়গায় বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.)-এর নামে মাজার গড়ে ওঠে। অনেকে বলেন, বোস্তামি নিজেই মাজার গড়ে তোলার কথা বলে গিয়েছিলেন। এই জনশ্রুতির পক্ষে অষ্টাদশ শতাব্দীর চট্টগ্রামের কিছু কবির কবিতার উল্লেখ করা হয় যেখানে শাহ সুলতান নামক একজন মনীষীর নাম বর্ণিত আছে। বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.)-কে যেহেতু সুলতানুল আরেফিন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় যেই সূত্রে এই শাহ সুলতান আর সুলতানুল আরেফিনকে একই ব্যক্তি হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি বিভাগের শিক্ষক মুমিত আল রশিদ ইরান ভ্রমণকালে হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.)-এর মাজার জিয়ারত করেন। তিনি বাংলাদেশে হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.)-এর মাজার রয়েছে- এই বিষয়ে জানতে গেলে তার ইরানি শিক্ষক ড. ইবরাহীম খোদাইয়ার তাকে জানালেন আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু-এর মূল সমাধি ইরাকের নাজাফ শহরে বিদ্যমান, তবে এর পাশাপাশি আফগানিস্তানের মাজার-ই-শরীফে আরেকটি সমাধি ফলকের উপস্থিতির কথাও উল্লেখ করেন। সঙ্গে এটাও বলেন, ইসলাম-পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সুফি সাধক ইসলাম প্রচারে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে গমন করেছেন এবং তাঁরা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সময় সেখানে অবস্থানকালীন ইবাদতের স্থানটিতে তাঁদের ভক্ত-অনুসারীরা তাঁদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দরগাহ স্থাপন করেছেন। সেমনান বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষক ড. নাসের রাহিমির মতে, হয়তো বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.) ধর্ম প্রচারে বাংলাদেশে গমন করেছিলেন, তবে তাঁর মূল সমাধি যে বাস্তাম গ্রামে এটা তিনি নিশ্চিত বলেই জানালেন। তাদের গাইড শাহ হুসাইনি জানালেন, বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.)-এর নামে আরও একটি দরগাহ রয়েছে ইরানের পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশে। কথিত আছে, কোনো এক ভক্ত রাতে স্বপ্ন দেখেছিলেন বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.) তাঁকে বলছেন তাঁর জন্য একটি গম্বুজ আকৃতির সমাধিফলক বানিয়ে সেখানে বায়েজিদের দেহখানা স্থাপনের জন্য। গম্বুজ তৈরি শেষ হলে একেবারে শেষের দিন অপর এক ভক্ত স্বপ্নে দেখেন বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.) তাঁকে বলছেন তাঁর দেহখানা উন্মুক্ত আকাশের নিচে রাখার জন্য। সেই থেকেই মাতৃসেবক বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.) শুয়ে আছেন উন্মুক্ত প্রান্তরে। তবে বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.) সকল মানবপ্রেমী মানুষের অন্তরে শুয়ে আছেন। সুলতানুল আরেফিন হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.) মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.)-এর সেজরা শরীফ অনুযায়ী হযরত রাসুল (সা.)-এর ৬ষ্ঠ-তম অধঃস্তন মহামানব। হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.) ৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে স্রষ্টার ডাকে সাড়া দিয়ে দারুল বাকায় তাশরিফ গ্রহণ করেন। ইরানের বোস্তাম শহরে তাঁকে রওজাস্থ করা হয়।


বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.)-এর কিছু মূল্যবান নছিহত
একবার বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.)-এর কাছে প্রশ্ন করা হলো, মানুষ আত্মশুদ্ধির চূড়ান্ত অবস্থায় কখন পৌঁছাতে পারে? তিনি জবাব দিলেন, যখন মানুষ সৃষ্টিজগৎ থেকে পৃথক হয়ে নির্জনে নিজের দোষত্রুটির কথা চিন্তা-ভাবনা করে এবং তা থেকে নিজেকে শুধরে নেয়। তিনি আরও বলেন, এর দ্বারা আল্লাহর নৈকট্যও হাসিল হয়।
বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.)-কে লোকেরা জিজ্ঞেস করল, হুজুর! নামাজের খাঁটি ও আসল পরিচয় কী? তিনি জবাব দিলেন, যার দ্বারা দিদারে এলাহি হতে পারে, সেটাই প্রকৃত নামাজ। তবে তা খুব কঠিন কাজ, কিন্তু মানুষের সাধ্যাতীত নয়।
আমি ভেবে দেখলাম যে, আমার শাস্তি পাওয়ার মূল হেতু কোন বস্তু? দেখা গেল গাফিলতি (আলস্য) ছাড়া আর কিছু নয়। পরে তিনি বললেন, মানুষের সামান্য গাফিলতি দোজখের আগুনের কারণ হবে। অতএব সাবধান হও।
বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.) বেশি বেশি আল্লাহর জিকিরে মগ্ন থাকতেন। তারপরও বলতেন, ওহে মাবুদ! সারা জীবন আমি আপনার নাম স্মরণ করেছি একান্ত উদাসীনভাবে। আমি এক চরম অকৃতজ্ঞ। জানি না, আপনার সঙ্গে আমি সাক্ষাতের যোগ্য বলে বিবেচিত হবো কি না। তিনি মানুষকে বেশি বেশি জিকিরের প্রতি তাগাদা দিতেন।
বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.) বলতেন, আমি দুনিয়া পরিত্যাগ করে সম্পূর্ণ একাকী অবস্থায় বলতে লাগলাম, হে মাবুদ! তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই। তবে তুমি যখন আমার আছ, আমার সব কিছুই আছে। আল্লাহ্ তায়ালার মেহেরবানির ফলে আমার মানসিক অবস্থা ও অনুভূতির পরিবর্তন ঘটল। অনুভব করলাম, যারা আল্লাহর আদেশ পালন করেছে, তারা পুরস্কার লাভ করেছে ও পুরস্কারের প্রতি আসক্ত হয়েছে, কিন্তু আমি প্রভু আল্লাহ্ তায়ালা ছাড়া অন্য কিছুতেই আসক্ত হইনি।
আল্লাহর প্রেমের নিদর্শন হলো, তিনি তাঁর প্রেমিককে ৩টি জিনিস দান করে থাকেন। সমুদ্রের মতো বদান্যতা, সূর্যের মতো দয়া এবং পৃথিবীর মতো নম্রতা।


সংকলনে- ড. সৈয়দ মেহেদী হাসান

তথ্যসূত্র:
১। মুহাম্মদ মিজানুর রহমান, অলিকুল শিরোমণি বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.), দৈনিক যুগান্তর, ০১ অক্টোবর, ২০২১
২। সাইফ ইমন, প্রখ্যাত সুফি সাধক বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.), বাংলাদেশ প্রতিদিন ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯
৩। নিউজ লেটার, অক্টোবর ২৭, ২০১৬, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ঢাকা থেকে প্রকাশিত
৪। সৈয়দ রেজাউল করিম, সুফিবাদ ও সুফিদের স্বরূপ সন্ধানে, বাংলা একাডেমী, ঢাকা থেকে প্রকাশিত, ১ম প্রকাশ জুন ২০২০, পৃষ্ঠা ১৩৩-১৪২

সম্পর্কিত পোস্ট