অলী-আল্লাহ্গণের পরিচয় – পর্ব ০৩
অলী-আল্লাহ্গণের পরিচয়
মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী, সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান
[সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজান রচিত ‘মুক্তি কোন পথে?’ কিতাব থেকে লেখাটি সংকলন করা হয়েছে।-সম্পাদক]
পর্ব ০৩
অলী-আল্লাহ্র বাসস্থানকে ‘দরবার শরীফ’ বলা হয় কেন?
‘দরবার’ ফারসি শব্দ। এর অর্থ বৈঠকখানা। আর ‘শরীফ’ আরবি শব্দ, এর অর্থ সম্মানিত, মর্যাদাবান। আল্লাহ্র প্রেরিত মহামানব অলী-আল্লাহ্গণ যে স্থানে অবস্থান করে সাধারণ মানুষকে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলের আদেশ, নিষেধ ও উপদেশ, ইত্যাদি শিক্ষা দিয়ে থাকেন, ঐ স্থানকেই ‘দরবার শরীফ’ বলা হয়।
অলী-আল্লাহ্গণ পরশ পাথরতুল্য। অলী-আল্লাহ্র সংস্পর্শে গিয়ে পাপী তাপী মানুষ উত্তম চরিত্র গঠনের মাধ্যমে সোনার মানুষে পরিণত হয়। অলী-আল্লাহ্র সংসর্গ রহমত, বরকত ও ফজিলতে পরিপূর্ণ। সুফিদের বর্ণনা হতে জানা যায়- “অলী-আল্লাহ্ যে পথ দিয়ে হেঁটে যান, তাঁর সম্মানের খাতিরে আল্লাহ্ ঐ এলাকার কবরবাসীদের শাস্তি মাফ করে দেন।” দিব্য দৃষ্টির অধিকারী কোনো কোনো সাধক বলেন- “যে স্থানে অলী-আল্লাহ্র পদস্পর্শ পড়ে ঐ স্থানের মাটি ধন্য হয়ে যায় এবং পার্শ্ববর্তী স্থানের মাটিকে বলে- আমি আল্লাহ্র অলীর পদস্পর্শে ধন্য হয়েছি।” যে সমস্ত বস্তু নিয়মিত অলী-আল্লাহ্র সংসর্গ এবং স্পর্শ লাভ করে থাকে, সেগুলোকে ভক্তগণ বিশেষ সম্মান দিয়ে থাকেন। কারণ অলী-আল্লাহ্গণ, যাঁরা আধ্যাত্মিক শিক্ষকের ভূমিকায় থাকেন, তাঁদেরকে সম্মান দেখাতে গিয়ে ভক্তগণ তাঁদের সংস্পর্শে যারা থাকেন, তাদেরকেও সম্মান দেখানো প্রয়োজন মনে করেন। এটি অলী-আল্লাহ্গণের পক্ষ থেকে ফায়েজ লাভের একটি উপায়।
মহান আল্লাহ্ বলেন- “কেউ আল্লাহ্র নিদর্শনাবলিকে সম্মান করলে, এটি তো তার ক্বালবে (হৃদয়ে) তাকওয়া বৃদ্ধি করবেই।” (সূরা আল হাজ্জ ২২: আয়াত ৩২) প্রকৃতপক্ষে আওলিয়ায়ে কেরামের ক্বালব বা দিল হলো আল্লাহ্র আরশ। হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে-“ক্বালবুল ‘আরিফি ‘আরশুল্লাহ।” অর্থাৎ- “আরেফ তথা আল্লাহ্র পরিচয় লাভকারী ব্যক্তির ক্বালব বা হৃদয় আল্লাহ্র আরশ।” (তাফসীরে রুহুল বয়ান ১০ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৯৪)
আল্লাহ্র রাসুল (সা.) আরো এরশাদ করেন, হাদিসে কুদসিতে সুমহান আল্লাহ্ ফরমান-“লা ইয়াসা‘উনী আরদ্বী ওয়ালা সামায়ী ওয়ালাকিই ইয়াসা‘উনী ক্বালবু ‘আবদিল মু’মিন।”অর্থাৎ- “আমার জমিন আমাকে ধারণ করতে পারে না, আমার আসমানও আমাকে ধারণ করতে পারে না। কেবল আমার মু’মিন বান্দার ক্বালব আমাকে ধারণ করে থাকে।” (তাফসীরে মাজহারী ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৬০) প্রকৃতপক্ষে আওলিয়ায়ে কেরামের সুউচ্চ মর্যাদার কারণেই তাঁদের দরবার বা বৈঠকখানা সম্মানিত। এ প্রসঙ্গে হযরত ইবনে উমর (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন- “আমি নবি (সা.)-কে কাবা শরীফ তাওয়াফ করতে দেখলাম। তখন তিনি বলছিলেন- (হে কাবা!) তুমি কত পবিত্র এবং কতই না পবিত্র তোমার ঘ্রাণ! কতই না বড়ো মর্যাদা সম্পন্ন তুমি এবং তোমার সম্মান কতই না উচ্চ! যাঁর হাতে মোহাম্মদ (সা.)-এর প্রাণ নিবদ্ধ, তাঁর শপথ করে বলছি- আল্লাহ্র নিকট মু’মিনের মর্যাদা তোমার মর্যাদার চেয়েও অনেক বেশি। তাঁর জানমাল এবং তাঁর ধারণা সবই কল্যাণকর।” (তাফসীরে দুররে মানছুর ২৬নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৬৫ এবং সুনানে ইবনে মাজাহ, পৃষ্ঠা ২৮২; ই.ফা.বা. কর্তৃক অনূদিত সুনানে ইবনে মাজাহ ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৫৭)
উচ্চ মার্যাদার অধিকারী অলী-আল্লাহ্ যেখানে বসবাস করেন এবং তাঁর অনুসারীদের মারেফাতের শিক্ষা দান করেন, সেই স্থান অবশ্যই ভক্তগণের নিকট অতি পবিত্র। অলী-আল্লাহ্গণ আল্লাহ্র কাছে অতি সম্মানিত ব্যক্তি। সুতরাং তাঁদের সম্মানের খাতিরেই এরূপ স্থানকে ‘দরবার শরীফ’ বলা হয়। আসলে অলী-আল্লাহ্গণ যে স্থানে বসে মানুষকে আল্লাহ্কে পাওয়ার পদ্ধতি শিক্ষা দেন, একইভাবে হযরত রাসুল (সা.)-এর উত্তম আদর্শ ও চরিত্র শিক্ষা দান করেন এবং ভক্তকুলের সমস্যা শ্রবণ করে সেটি সমাধান করে দেন, মূলত ঐ স্থানটি দরবার শরীফ।
উল্লেখ্য, হিজরতের পর আল্লাহ্র রাসুল (সা.) ইয়াসরিব নামক যে পল্লিতে বসবাস শুরু করেন, ঐ স্থানের মাটিও তাঁর পবিত্র পদস্পর্শে ধন্য হয় এবং পর্যায়ক্রমে দেশ-বিদেশ থেকে এখানে লোক আসতে শুরু করে, কালক্রমে এটি ‘মদীনা শরীফ’ বা পবিত্র শহর নামে পরিচিত হয়। সুতরাং মহান আল্লাহ্র বন্ধু ও হযরত রাসুল (সা.)-এর উত্তরসূরিগণ যে স্থানে বসবাস করেন, সেই স্থানের পবিত্রতা সম্পর্কে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই।
অলী-আল্লাহ্র দরবার শরীফে জুতা খুলে যাওয়ার প্রয়োজন কেন?
হযরত মুসা (আ.) তুর পাহাড়ে যখন আল্লাহ্র দিদার লাভ করেন, তখন আল্লাহ্ তাঁকে পা থেকে জুতা খুলে ফেলার নির্দেশ দেন। এরশাদ হচ্ছে- “ইন্নী আনা রাব্বুকা ফাখলা‘ না‘লাইকা, ইন্নাকা বিলওয়াদিল মুকাদ্দাসি ত্বোওয়া।” অর্থাৎ- “নিশ্চয় আমিই তোমার প্রতিপালক। তুমি তোমার জুতা খোল। তুমি পবিত্র তুয়া উপত্যকায় এসেছ।” (সূরা ত্বাহা ২০: আয়াত ১২)
এরূপ নির্দেশের মাধ্যমে আল্লাহ্ তায়ালা এ কথা বুঝাতে চেয়েছেন, তাঁর দর্শন বা নৈকট্য প্রত্যাশী ব্যক্তিকে আত্ম অহমিকা ভুলে নিজেকে অতি তুচ্ছ বলে মনে করতে হবে। পবিত্র হজ পালনের সময় হাজিগণ খালি পায়ে কাবা গৃহ তাওয়াফ করে থাকেন। এর উদ্দেশ্য কাবাঘরের পবিত্রতা রক্ষা এবং আল্লাহ্র কাছে নিজের তুচ্ছতা প্রকাশ করা। এ প্রসঙ্গে হযরত সাঈদ ইবনে জোবায়ের (রহ.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন- “প্রতিটি ব্যক্তিকে পবিত্র কাবা গৃহে প্রবেশ করার সময় জুতা খুলে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অনুরূপ ঐ স্থানেরও পবিত্রতা রক্ষার্থে জুতা খুলে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ বলেন- পবিত্র স্থান মাত্রই খালি পায়ে চলার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।” (তাফসীরে ইবনে কাছীর ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২১২)
উল্লিখিত হাদিসে বিষয়টি আরো বেশি সুস্পষ্ট হয়েছে যে, মু’মিন ব্যক্তির সম্মান কাবাঘরের চেয়েও বেশি। অলী-আল্লাহ্গণ অবশ্যই মু’মিন; উপরন্তু তাঁরা যেমন আল্লাহ্র বন্ধু, তেমনি তারা মানুষকে মু’মিন হওয়ার পদ্ধতি শিক্ষা দেন। এজন্য তাঁদের মর্যাদা আল্লাহ্র কাছে কাবাঘরের চেয়ে অনেক বেশি। বস্তুত কাবাঘরে আল্লাহ্কে খুঁজে পাওয়া যাবে না। মু’মিন ব্যক্তির ক্বালবে আল্লাহ্ বিরাজ করেন।
সাধারণ মানুষকে জিয়ারতের জন্য কাবাঘরে যেতে হয়। পক্ষান্তরে কোনো কোনো অলী-আল্লাহ্র জিয়ারতে কাবাঘর গিয়েছিল, এমন ঘটনাও জানা যায়। এ প্রসঙ্গে ‘হালাতে মাশায়েখ’ কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে- “একবার হযরত মুজাদ্দেদে আলফেসানি (রহ.)-এর কাবা শরীফ জিয়ারতের প্রবল বাসনা হয়। যখন তাঁর দিল এই সম্পর্কে খুবই বেকারার ও বেচয়েন ছিল, সেই সময় একদিন তিনি দেখলেন, তামাম আলম ও জিন-ইনসান তাঁর প্রতি সিজদা করে নামাজ পড়ছে। এতে হযরত মুজাদ্দেদে আলফেসানি (রহ.) পেরেশান হয়ে পড়েন। অতঃপর তিনি মোরাকাবা করে জানতে পারেন, তাঁর জিয়ারতের জন্য কাবা শরীফ সিরহিন্দ শরীফে আগমন করায়, সকলেই কাবাকে সিজদা করছে। সেজন্যই এই সিজদা তাঁর প্রতি বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। ইত্যবসরে এলহাম হলো- ‘আপনি কাবা শরীফের জিয়ারতের জন্য ব্যাকুল ছিলেন, সেই জন্য আমি কাবাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছি’।” (হালাতে মাশায়েখে নক্শবন্দীয়া মুজাদ্দেদীয়া (রহ.) ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪২)
অনুরূপভাবে হয়রত রাবেয়া বসরি (রহ.)-কে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য তাঁর সামনেও পবিত্র কাবাঘর উপস্থিত হয়েছে। ঘটনাটি ‘তাযকেরাতুল আওলিয়া’ কিতাবে হযরত রাবেয়া বসরি (রহ.)-এর জীবনীতে উল্লেখ করা হয়েছে। আর সেটি হলো- “হযরত ইবরাহীম আদহাম মক্কা শরীফে গমনকালে পথিমধ্যে প্রতি কদমে দুই রাকাত নামাজ পড়ে চৌদ্দ বছরে কাবা শরীফে পৌঁছেছিলেন। তিনি প্রতিটি মুহূর্তে মনে মনে বলতেন- “লোকেরা এই পথে পায়ে হেঁটে চলে, আমি চক্ষু দ্বারা এই পথ দেখে দেখে হাঁটব।” তিনি মক্কা শরীফে প্রবেশ করে খানায়ে কাবাকে যথা স্থানে দেখতে পেলেন না। তিনি মনে মনে বললেন, হায়! একি ব্যাপার! সম্ভবত আমার চোখে কোনো সমস্যা হয়েছে। তৎক্ষণাৎ গায়েব থেকে আওয়াজ আসল- তোমার চোখে কোনো সমস্যা হয়নি; বরং কাবা শরীফের ঘর এক দুর্বল বৃদ্ধার সম্মানার্থে ইস্তেকবালের (সম্মান) জন্য গমন করেছে, সেই বৃদ্ধা এদিকে আসছে। হযরত ইবরাহীম আদহাম মনের দুঃখে ও ক্ষোভে চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে বললেন- সেই বৃদ্ধা রমণী কে? এ কথা বলতে না বলতে হযরত রাবেয়া বসরি (রহ.) লাঠি ভর করে সেখানে এসে পৌছালেন এবং সঙ্গে সঙ্গে কাবা গৃহও এসে যথা স্থানে কায়েম হলো। হযরত ইবরাহীম আদহাম বললেন- ‘রাবেয়া! দুনিয়ার বুকে তুমি এ কেমন হুলুস্থুল কাণ্ড ঘটালে? রাবেয়া বসরি (রহ.) আদহামকে জিজ্ঞেস করলেন- তুমি কেন কাবাঘরে এসেছ? ইবরাহীম আদহাম জবাব দিলেন- আমি কাবাঘর জিয়ারত করার উদ্দেশ্যে এখানে এসেছি। রাবেয়া বসরি (রহ.) বললেন- আমি তো কাবার মালিক আল্লাহ্র জিয়ারতের জন্যে এসেছি’।” (তাযকেরাতুল আওলিয়া ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫০)
অলী-আল্লাহ্গণ অন্তরে আল্লাহ্র নুর পূর্ণ বিকশিত ও জীবন্ত রূপে ধারণ করেন। এজন্য তাঁদের যথাযথ মর্যাদা রক্ষার্থে তাঁদের সান্নিধ্যে এসে নিজেকে মিসকিনের ন্যায় পেশ করতে হয়। অলী-আল্লাহ্র খাতিরে, তাঁর দরবারও আল্লাহ্র নিকট পবিত্র। ফুল ফুটলে সেটির সুঘ্রাণ যেমন সারা বাগানে ছড়িয়ে পড়ে, তেমনি অলী-আল্লাহ্র পক্ষ থেকে ফায়েজ, রহমত ও বরকত তাঁর দরবারের সর্বত্র বিরাজ করে। যারা অলী-আল্লাহ্র সাথে গভীর ভালোবাসা রাখেন, তারা দরবার শরীফে প্রবেশ করা মাত্র বাইরের দুনিয়ার সাথে এর পার্থক্য নিজের আত্মায় অনুভব করেন। তাই জুতা পায়ে দরবার শরীফে প্রবেশ করা আদবের খেলাফ। তাছাড়া খালি পায়ে থেকে দরবার শরীফে চলাফেরা করে মুরিদগণ সর্বদা মাটির স্পর্শে নিজেদেরকে মাটির ন্যায় নিচু বলে মনে করেন। ফলে তারা প্রচুর ফায়েজ-বরকত লাভ করেন। আত্মঅহমিকা অলী-আল্লাহ্র নিকট থেকে রুহানি নিয়ামত লাভের পথে অন্তরায় স্বরূপ। এছাড়াও অলী-আল্লাহ্গণের দরবার শরীফে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অসংখ্য লোকের সমাগম ঘটে এবং দায়রা শরীফে বড়ো জামাতের সাথে নামাজ আদায় করা হয়ে থাকে। সুতরাং এর পবিত্রতা রক্ষার জন্য অলী-আল্লাহ্র দরবার শরীফে যাওয়ার সময় সবাইকে আল্লাহ্র বিধান অনুসরণে স্বেচ্ছায় জুতা খুলে খালি পায়ে সেখানে গমন করতে হয়। এজন্যই মহান আল্লাহ্ তুর পাহাড়ে হযরত মুসা (আ.)-কে জুতা খোলার নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন- তুমি তোমার জুতা খোল। তুমি পবিত্র তুয়া উপত্যকায় রয়েছ।
অলী-আল্লাহ্গণ ওফাতের পরেও মানুষের উপকার করতে পারেন
আল্লাহ্র অলীগণ সম্পর্কে হযরত রাসুল (সা.) ফরমান- “আলা ইন্না আওলিয়াআল্লাহি লা ইয়ামূতূনা।” অর্থাৎ- “জেনে রেখো, নিশ্চয়ই অলী-আল্লাহ্গণ অমর।” অন্য হাদিসে আল্লাহ্র রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “আওলিইয়াউল্লাহি লা ইয়ামূতূনা ওয়ালাকিই ইয়ানকুলূনা মিন দারিন ইলা দার।” অর্থাৎ- “আল্লাহ্র অলীগণ মৃত্যুবরণ করেন না, বরং তাঁরা এক ঘর থেকে অন্য ঘরে স্থানান্তরিত হন মাত্র।” (তাফসীরে কাবীর ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৮৮১)
এ বাণী মোবারকের মর্ম হচ্ছে- ওফাত লাভের পরেও আল্লাহ্র সাথে তাঁদের বন্ধুত্ব অটুট থাকে। এজন্য দেখা যায়, ওফাত লাভের পরেও অলী-আল্লাহ্গণ মানুষের উপকার করতে সক্ষম। বিপদে পড়ে মানুষ কোনো অলী-আল্লাহ্র মাজারে গিয়ে তাঁর উসিলায় আল্লাহ্র অনুগ্রহ কামনা করে, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে আল্লাহ্র কাছে কান্নাকাটি করে বিপদ মুক্ত হতে পারে।
অনেকে আবার অলী-আল্লাহ্র মাজারে মানত করে থাকে, যার বিনিময়ে আল্লাহ্ তার মনোবাসনাপূর্ণ করেন। অলী-আল্লাহ্র মাজার জিয়ারত অত্যন্ত বরকতপূর্ণ। শুদ্ধ অন্তর নিয়ে এরূপ জিয়ারতের মাধ্যমে অলী-আল্লাহ্র রুহানি ফায়েজে মানুষের দোয়া কবুল হয় এবং জিয়ারতকারীর আত্মিক প্রশান্তি লাভ হয়। অলী-আল্লাহ্গণ নায়েবে রাসুল হওয়ায় তাঁরাও জগদ্বাসীর জন্য রহমতস্বরূপ। কুল-কায়েনাতের রহমত হযরত মোহাম্মদ (সা.) ওফাত লাভের পরেও যেমন মানুষকে উপকার করতে পারেন, তদ্রুপ অলী-আল্লাহ্গণ হযরত রাসুল (সা.)-এর হিদায়েতের নুর আপন সিনায় ধারণ করার কারণে, তাঁরাও ওফাত লাভের পর মানুষকে উপকার করতে পারেন। এ প্রসঙ্গে হযরত আলউতবী (রা.) হতে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি বলেন- “আমি আল্লাহ্র রাসুল (সা.)-এর রওজা মোবারকের নিকট বসেছিলাম। তখন একজন বেদুইন আগমন করল, সে হযরত রাসুল (সা.)-কে উদ্দেশ্য করে বলল- “আস্সালামু আলাইকা ইয়া রাসুলাল্লাহ (সা.)!” আমি শুনেছি, আল্লাহ্ তায়ালা ঘোষণা করেছেন- ‘যদি তারা নিজেদের উপর জুলুম করার পর আপনার কাছে আসত এবং আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করত, আর রাসুল (সা.)-ও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতেন, তবে নিশ্চয় তারা আল্লাহ্কে তওবা কবুলকারী এবং পরম দয়াময় হিসেবে পেতো।’ হে আল্লাহ্র রাসুল (সা.)! আমি আমার পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে এবং আমার প্রতিপালকের নিকট আমার জন্য আপনার শাফায়াত পাওয়ার আশায় আগমন করেছি, এ বলে বেদুইন লোকটি প্রস্থান করল। এ সময় আমার চোখে নিদ্রা এসে গেলো। আমি আল্লাহ্র রাসুল (সা.)-এর দিদার পেলাম, তিনি আমাকে বললেন- হে উতবী! তুমি বেদুইন লোকটির সাথে সাক্ষাৎ করো এবং তাকে সুসংবাদ দাও যে, আল্লাহ্ তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।” (তাফসীরে ইবনে কাছীর ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭৬৯ ও ৭৭০)
এরই ধারাবাহিকতায় নবুয়ত পরবর্তী বেলায়েতের যুগে অলী-আল্লাহ্গণ ও ওফাতের পরে মানুষের উপকার সাধন করে থাকেন। আল্লাহ্ বলেন- “আলা ইন্না আওলিয়াআল্লাহি লা খাওফুন ‘আলাইহিম ওয়ালাহুম ইয়াহঝানুন।” অর্থাৎ- “জেনে রেখো! আল্লাহ্র বন্ধুদের কোনো ভয় নেই এবং তাঁরা দুঃখিতও হবে না।” (সূরা ইউনুস ১০: আয়াত ৬২) প্রকৃতপক্ষে তাঁরা আল্লাহ্র বন্ধু বলেই আল্লাহ্ তায়ালা স্বীয় বন্ধুর খাতিরে মানুষের জন্য রহমত প্রদান করেন।
[লেখক: প্রতিষ্ঠাতা, দেওয়ানবাগ শরীফ]