নসিহত এবং অছিয়ত: একটি পর্যালোচনা
শাহ শিবলী নোমান
নসিহত এবং অছিয়ত দুটি আরবি শব্দ। ব্যবহারগতভাবে এই দুটি শব্দই বিদেশি শব্দ হিসেবে বাংলা ভাষায় অনুপ্রবেশ করে যুগ যুগ ধরে ইংরেজি চেয়ার, টেবিল ইত্যাদি শব্দের মতো ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বিশেষ করে ধর্মীয় পরিভাষায় শব্দদ্বয়ের ব্যবহার বহুল প্রচলিত। পাশাপাশি বাংলা কিংবা ইংরেজি অর্থ অনুযায়ী মানুষের স্বাভাবিক ব্যবহারিক জীবনে এটির ব্যবহার অনস্বীকার্য।
একদিকে বিদেশি শব্দ হওয়াতে এবং অপরদিকে উচ্চারণগত সাদৃশ্য (Phonetic Similarity) থাকাতে অনেক সময় এই দুটো শব্দের ব্যবহারগত মিশ্রণজনিত (Amalgamation) দ্বন্দ্ব তৈরি হয়।
নসিহত শব্দের অর্থ উপদেশ, পরামর্শ (Advice)। সুতরাং কেবল ধর্মীয় উপদেশই নয়, যে কোনো উপদেশই মূলত নসিহত। যেমন এটা করো না, ওটা করো… ইত্যাদি। পিতা-মাতা, বড়ো ভাই-বোন, মুর“ব্বি, শিক্ষা গুর“, বন্ধুবান্ধব নসিহত বা উপদেশ প্রদান করতে পারেন৷ এমনকি ডাক্তার, উকিল, রাজনীতিবিদ ক্ষেত্র মতো নসিহত করতে পারেন। নসিহত সাধারণত উপদেশ গ্রহীতার কল্যাণার্থে করা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রদত্ত নসিহত বা উপদেশটি উপদেশদাতার জন্য প্রযোজ্য হয় না, বা প্রয়োজন হয় না। নসিহতদাতা তার অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থেকে অপরের কল্যাণের জন্য নসিহত করে থাকেন। নসিহত বা উপদেশের ক্ষেত্রে উপদেশ গ্রহীতার কল্যাণটাই মূখ্য। নসিহত বা উপদেশ গ্রহীতা প্রদত্ত উপদেশ মানতে বাধ্য নন। তিনি উপদেশটি মানতেও পারেন, নাও মানতে পারেন। এখানে উপদেশ গ্রহীতা স্বেচ্ছাধীন বা নিজস্ব এখতিয়ারাধীন।
অছিয়ত আরবি শব্দ। যার অর্থ- সুপারিশ, আদেশ, উইল বা ইচ্ছা। Dictionary of Modern Written Arabic-এ অছিয়তের অর্থ উল্লেখ করা হয়েছে-Direction, Instruction, Disposition, Injunction, Order, Will, Request. সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষে অছিয়তের অর্থ করা হয়েছে- ভার অর্পণ, নির্দেশ। পরিভাষা শব্দ হিসেবে শেষ ইচ্ছা, ইচ্ছা পত্র বা ইচ্ছাপত্র যোগে প্রদত্ত সম্পত্তি। ‘ফাতাওয়া ও মাসাইল’ গ্রন্থে রয়েছে, অছিয়ত শব্দের অর্থ কোনো কাজের অঙ্গীকার গ্রহণ করা, নির্দেশ প্রদান করা।
অছিয়ত শব্দটি বলতেই আমাদের চিন্তায় সাধারণত সম্পত্তির বিলিবন্টন বিষয়ক একটা চিত্র ভেসে উঠে, কিন্তু তা নয়। সম্পত্তির বিলিবন্টন সম্পর্কিত ছাড়াও যে কোনো দায়দায়িত্ব বা কার্যসম্পাদন সম্পর্কেও অছিয়ত হতে পারে এবং তা সম্পত্তি সংশ্লিষ্ট বিলি বন্দোবস্ত রক্ষণাবেক্ষণ পরিচালনা বিষয়ক হতে পারে, কোনো ‘তত্ত্ব বা আদর্শ’ সংরক্ষণ কিংবা চলমান, রক্ষণ কিংবা অগ্রসরণ, কার্যকরণ বা পরিচালনার ক্ষেত্রেও হতেও পারে। দায়দায়িত্ব অর্পণ বা কার্যসম্পাদনের ক্ষেত্রে অছিয়তকারী কর্তৃক নিযুক্ত বা অছিয়তকৃত ব্যক্তি বা প্রতিনিধিকে ফিকহ্ শাস্ত্রের পরিভাষায় ‘ওসী’, অছিয়তকৃত বিষয়বস্তুকে ‘মূসাবিহি’ এবং অছিয়তকারীকে ‘মূসী’ বলা হয়।
অছিয়ত একজন ব্যক্তির ইচ্ছা থেকে উদ্ভূত ‘ইচ্ছার প্রকাশ’, যা ক্ষেত্রমতে আদেশ কিংবা অনুরোধ আকারে প্রকাশ করা হয় এবং এই ইচ্ছার প্রকাশটা সাধারণত অছিয়তকারীর অন্তিম বা মৃত্যুকালীন করা হয়। মৃত্যুপূর্ববর্তী জীবদ্দশার যে কোনো সময়েও হতে পারে। অছিয়তকারী তার অছিয়ত (ইচ্ছা বা উইল) তার মৃত্যুর পূর্বে তার জীবদ্দশায় যে কেনো সময় পরিবর্তন বা প্রত্যাহার করতে পারেন, কারণ, অছিয়ত অছিয়তকারীর মৃত্যুর পর কার্যকর হয়। সেজন্য অছিয়তকে শেষ ইচ্ছাও বলা হয়ে থাকে।
অছিয়ত হলো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টির উপর মৃত্যুকালীন দিয়ে যাওয়া অর্পিত দায়িত্ব, যা পালন করা আবশ্যিক। যেমন কেউ বলল আমি মারা গেলে আমাকে অমুক স্থানে দাফন করবে, অমুক ব্যক্তি আমার জানাজা পড়াবে, উমুক এতো টাকা পাবে, যা তাকে দিয়ে দিবে, এতো জন এতিমকে খাওয়াবে বা আমার সমুদয় সম্পত্তির এতো অংশ অমুক প্রতিষ্ঠান পাবে… ইত্যাদি। একথাগুলো যাকে বা যাদেরকে বলা হবে তা পালন করা বা কার্যকর করা সেই ব্যক্তির উপর আবশ্যিক। অছিয়ত লিখিত বা মৌখিক যেকোনো প্রকারেই হতে পারে।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অছিয়ত ‘গ্রহণকারী’ বা ‘স্বীকারকারী’র জন্য অছিয়তের নির্দেশ বা অনুরোধ পালন বা কার্যকর করা বাধ্যতামূলক। এমনকি সে অছিয়তে বর্ণিত মতে অছিয়ত মোতাবেকই অছিয়ত পালন করাটা বিধান।
স্যার ডি. এফ. মুল্লা রচিত ‘মুসলিম আইনের মূলনীতি’ নামক গ্রন্থে বর্ণিত মতে, অছিয়তকারীর মৃত্যুর পর অছিয়ত গ্রহণকারী বা স্বীকারকারী বা সম্মতি প্রদানকারীর জন্য অসিয়ত মান্য করা এবং কার্যকর করা বাধ্যতামূলক।
এ সম্পর্কে সূরা বাকারার ১৮১নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে- “যদি তা (অছিয়ত) শোনার পর কেউ তাতে কোনো রকম পরিবর্তন করে, তবে যারা পরিবর্তন করবে তাদের উপর এর পাপ বর্তাবে। নিশ্চয় আল্লাহ্ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।” (সূরা বাকারাহ ২: আয়াত ১৮১)
অছিয়ত প্রসঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণনা করা হয়েছে- তিনি বলেন, “আল্লাহ্র বাণী- ‘যদি অছিয়ত শোনার পরে কেউ তাতে কোনো রকম পরিবর্তন করে তবে যারা পরিবর্তন করবে এটার পাপ তাদের উপরই বতার্বে।’ কিন্তু অছিয়তকারী অছিয়তের প্রতিদান আল্লাহ্র নিকট পাবে এবং সে পাপ হতে মুক্ত থাকবে।” এ পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ্ বলেন- নিশ্চয়ই আল্লাহ্ সবকিছু শোনেন এবং জানেন। (তাফসীরে তাবারী ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১২২ এবং তাফসীরে দুররে মানছুর ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪২৫)
অছিয়ত প্রসঙ্গে তাফসীরে তাবারীর ২য় খণ্ডের ১২২ পৃষ্ঠায় হযরত সুদ্দি (রা.) হতে বর্ণনা করা হয়েছে, তিনি বলেন, “মহান আল্লাহ্র বাণী- ‘যদি অছিয়ত শোনার পর কেউ তাতে কোনো রকম পরিবর্তন করে তবে যারা পরিবর্তন করবে এটার পাপ তাদের উপরই বতার্বে।’ বর্ণনাকারী বলেন, যে ব্যক্তি মৃত ব্যক্তির কল্যাণজনক অছিয়ত পরিবর্তন করবে এ পরিবর্তনের পাপ তার উপরই বতার্বে। কেননা সে অছিয়ত পরিবর্তন করে জুলুম করেছে।”
আমার মহান মোর্শেদ দেওয়ানবাগ শরীফের প্রতিষ্ঠাতা সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান ওফাৎ লাভের ১ দিন পূর্বে ২৭শে ডিসেম্বর, ২০২০ইং, রবিবার তাঁর অবর্তমানে মোহাম্মদী ইসলাম কীভাবে পরিচালিত হবে, সেই বিষয়ে পরিবারবর্গের সম্মুখে অছিয়ত প্রদান করেন। সেই অছিয়তের মাধ্যমে তিনি ঘোষণা করেন, “আমি মেজো হুজুরকে (ইমাম ড. আরসাম কুদরত এ খোদা) মোহাম্মদী ইসলাম পরিচালনার নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য দায়িত্ব দিয়েছি।” এছাড়া অছিয়তে বিভিন্ন বিষয়ে আরো দিক নির্দেশনা রয়েছে। সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজান প্রদত্ত অছিয়তনামা যথাযথভাবে পালন করা সবার জন্য অত্যাবশ্যক। সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজানের সাহেবজাদা-সাহেবজাদিগণ, তাঁর স্ত্রী ও পুত্রবধুদের স্বাক্ষর সংবলিত অছিয়তনামাটি মোহাম্মদী ইসলাম পরিচালনার সংবিধান।
[লেখক: ইসলামি গবেষক, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট]