Cancel Preloader

পূর্ণাঙ্গ ধর্মীয় জ্ঞান ব্যতীত স্রষ্টার রহস্য বুঝা সম্ভব নয়

ড. পিয়ার মোহাম্মদ

ধর্ম মানুষের জন্য মহান স্রষ্টা প্রদত্ত জীবন বিধান। এ ধর্মের উৎপত্তি প্রথম মানুষ আদি পিতা হযরত আদম (আ.)-এর সৃষ্টির সময় থেকে। মহান আল্লাহর একত্ববাদের বাণী নিয়ে নবি-রাসুলগণ যুগে যুগে আগমন করেছেন। যে ধারা পরিপূর্ণতা লাভ করেছে কুল কায়েনাতের রহমত, দোজাহানের বাদশাহ এবং নবিকুল শিরোমণি হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর আগমনের মাধ্যমে। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই আল কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “আজ তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপর আমার অনুগ্রহ সম্পন্ন করলাম, আর ইসলামকে তোমাদের ধর্ম হিসেবে মনোনীত করলাম।” (সূরা মায়িদাহ : আয়াত ৩) হযরত রাসুল (সা.)-ও তাঁর বিদায় হজের ভাষণে ইসলামের পরিপূর্ণতাকে একইভাবে ব্যক্ত করেছেন। তাহলে প্রশ্ন জাগে এ ধর্ম নিয়ে এতো মতভেদ আর এতো ভুল বুঝাবুঝি কেন? এর কারণ হিসেবে ধর্মকে জানা, বুঝা আর উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির জ্ঞানের ভিন্নতাকে দায়ী করা যেতে পারে।

ধর্মকে আমরা যে যতটুকু বুঝি সেভাবেই পালন করার চেষ্টা করি এবং সবার সামনে সেভাবেই এটা উপস্থাপন করতে সচেষ্ট হই। কেউ দ্বিমত পোষণ করলে রাগান্বিত হয়ে উঠি। কখনো বুঝতে চেষ্টা করি না আমার জানার বাইরেও আরো কিছু থাকতে পারে। হযরত রাসুল (সা.) বলেছেন- “শরিয়ত আমার কথা, তরিকত আমার কাজ, হাকিকত আমার অবস্থা এবং মারেফত আমার নিগূঢ় রহস্য।” তাহলে স্পষ্ট যে, ধর্মের চারটি অংশ। এ চারটি অংশ যিনি বুঝেন বা মানেন, তিনিই ধর্ম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখার দাবী করতে পারেন। আমাদের সমাজে দেখা যায় ধর্মের এ চারটি অংশতো দূরের কথা, ধর্ম সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের চেষ্টাও খুব একটা গুরুত্ব পায় না। তাছাড়া ভয়ঙ্কর হলো যিনি একটি অংশ কিছুটা বুঝেন, তিনি অন্য অংশ যে ধর্মের বিষয়বস্তু তা মানতে নারাজ। তাতে বিভিন্ন সমস্যা পুঞ্জিভুত হয়ে চরম রূপ নিয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি বিষয়ের যে জাহেরি ও বাতেনি দিক আছে, তা বেশিরভাগ মানুষই বুঝতে চান না। সেখানেই ধর্মের সমস্যাগুলো একত্রিত হয়ে মেঘমালার মতো ঘোরপাক খেতে থাকে।
মহান আল্লাহ্ ছিলেন গুপ্ত ধনাগারে। তাঁর নিজেকে প্রকাশ করার বাসনা জাগায় তিনি মানুষ সৃষ্টি করলেন। আল্লাহ্ মাটি, পানি, বায়ু ও আগুন দিয়ে দুনিয়ার প্রথম মানুষ হযরত আদম (আ.)-এর দেহ তৈরি করেন। সেই মাটির দেহে আল্লাহর রূহ থেকে রূহ ফুঁকে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আদম (আ.) মানবরূপে জীবন শুরু করেন। মহান আল্লাহ্ প্রকৃতপক্ষে প্রথমে তাঁর রূহ থেকে নুরে মোহাম্মদী সৃষ্টি করেন। সেই নুরে মোহাম্মদী হতে মানুষ-সহ সৃষ্টি জগতের সব কিছুই সৃজিত হয়। হযরত আদম (আ.)-এর সৃষ্টির পর তাঁরই ইচ্ছার পরিপ্রেক্ষিতে মহান আল্লাহ্ মা হাওয়া (আ.)-কে সৃষ্টি করেন। তাঁদের দু’জনের মাধ্যমেই পৃথিবীতে মানুষকে আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর প্রতিনিধি করে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে প্রেরণ করেছেন। অথচ সেই মানুষই আল্লাহর কার্যক্রম নিয়ে বিভ্রান্তিকর প্রশ্ন করে থাকে। কেউ কেউ বলেন আল্লাহ্ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, সব দায়িত্ব তাঁরই, মানুষের কেন পাপ হবে? অর্থাৎ এ শ্রেণীর মানুষ আল্লাহর মহিমা উপলব্ধি করতে অপারগ এবং তাঁর শোকর গোজার করতে নারাজ। কেউ কেউ বলেন, আল্লাহ্ যদি আদম (আ.)-কে পৃথিবীতেই পাঠাবেন, তবে কেন প্রথমে বেহেশ্তে রেখে ঘটনার মাধ্যমে পৃথিবীতে পাঠালেন? এসব প্রশ্নের জবাব পেতে হলে ধর্ম সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান অর্জন করা জরুরি। অন্যথায় কোনোভাবেই মেলানো যাবে না। যিনি ধর্মের সবগুলো দিক বুঝতে পারেন, তিনি সহজেই উপলদ্ধি করতে পারেন যে, আল্লাহর সব কাজ নিখুঁত, আর এসব প্রশ্ন জ্ঞানের স্বল্পতা বা অজ্ঞতারই নামান্তর। এ বিষয়ে সুফি সাধকগণের মতামত হলো হযরত আদম (আ.) ও হযরত হাওয়া (আ.)-কে সৃষ্টির পর ইয়েমেনের একটি বেহেশ্ততুল্য ফল বাগানে রাখা হয়েছিল। সেখান থেকে গন্ধম খেয়ে তাঁরা বিতাড়িত হন। মানুষকে সৃষ্টিই করা হয়েছে দুনিয়ার জন্য, তাকে দুনিয়া ছাড়া অন্য কোথাও রাখা মূল উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। সুফিগণের এই ব্যাখ্যা ও মতামত সংগতিপূর্ণ এবং গ্রহণযোগ্য, কিন্তু অন্যেরা কি তা মানতে চাইবেন? মানুষ তার নিজ জ্ঞান ও অবস্থান থেকেই সব কিছু ভাবতে চেষ্টা করে। নিজ পরিধির বাইরে যাওয়া সম্ভব হয় না। এটাই বাস্তবতা এবং এভাবেই বুঝা না বুঝার মধ্যস্থলে চলছে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের ধর্মীয় জীবন, সেটাই সমস্যা।

অনেকেই বলে থাকেন যুগে যুগে অসংখ্য নবি-রাসুল আগমনের কারণে নানান ধর্মের উদ্ভব ঘটেছে বিধায় মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব কলহ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের বক্তব্য হলো- একজন নবি বা রাসুল পাঠিয়ে মানুষের করণীয় সম্পর্কে জানিয়ে দিলে এমন হতো না। আর বেলায়েতের যুগের অলী-আল্লাহ্দের কথাতো তারা কানে তুলতেই পারেন না। এসব উদ্ভট কথা শুনলে তাদের ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞানের পরিধি সহজেই অনুমান করা যায়। মহান আল্লাহ্ যুগে যুগে সকল নবি-রাসুলকেই আল্লাহর একত্ববাদের বাণী দিয়ে পাঠিয়েছেন। হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে সকল নবি-রাসুলই ইসলামের মর্মবাণী প্রচার করে গেছেন। এখনো মহান আল্লাহ্ বেলায়েতের যুগে অলী-আল্লাহ্ প্রেরণ করে মানুষকে একই শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন। পবিত্র কুরআনে এ সকল অলী-আল্লাহর মর্যাদা সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে- “হে বিশ্বাসীগণ, আল্লাহ্কে ভয় করো এবং সত্যাশ্রয়ীদের সঙ্গ লাভ করো।” (সূরা তওবা : আয়াত ১১৯) হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, হযরত রাসুল (সা.) ফরমান- “নিশ্চয়ই মহাপরাক্রমশালী সম্ভ্রান্ত আল্লাহ্ প্রত্যেক শতাব্দীর শিরোভাগে উম্মতের জন্যে এমন এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করেন, যিনি দ্বীন (ধর্ম)-কে সজীব ও সতেজ করে তোলেন (মেশকাত শরীফ ও আবু দাউদ শরীফ)। সেজন্য আল্লামা রুমি (রহ.) বলেন- ‘‘এক জামানা সোহবতে বা আউলিয়া/বেহতের আয সাদ সালাতাতে বেরিয়া’’ অর্থাৎ-এক মুহূর্ত কোনো অলী-আল্লাহর সান্নিধ্যে থাকা একশত বছর বেরিয়া (নিরহংকার) ইবাদত হতে উত্তম (মসনবী শরীফ)। এসব কথা যারা বুঝতে চায় না তাদের জাগ্রত করা খুবই কঠিন।

অনেকে ধারণা পোষণ করেন আমরা পাপ করি নফ্স বা রিপুর কারণে। রিপু আমাদের ভিতরে না থাকলে আমরাও পাপ করতাম না। নফ্স আছে বলেই কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য আমাদের উপর রাজত্ব করছে। তাদের উদ্দেশে বলতে চাই, ভুলে গেলে চলবে না যে, মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব করে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে। ফেরেশতাদের রিপু নেই বিধায় তারা কোনো পাপ কাজ করে না। তারাও ফেরেশতা না হয়ে মানব জনম পেলে ধন্য হতো। শ্রেষ্ঠ কে না হতে চায়? প্রথম মানব হযরত আদম (আ.)-কে মহান আল্লাহর আদেশে ফেরেশতাদের সিজদাহ করতে হয়েছে। তাহলে আমরা এত মর্যাদা পেয়েও কেন বুঝার চেষ্টা করি না। আমাাদের নফ্স না থাকলে তো মানুষ এবং ফেরেশতা এক হয়ে যেত। মানুষের ভিতর নফ্স আছে বলেই মানুষের মর্যাদা ফেরেশতাদের চেয়ে বেশি। হযরত আলী র্কারামমাল্লাহু ওয়াজহাহু বলেন- “যে নিজের নফ্সকে চিনতে পেরেছে, সে তার প্রভুকে চিনতে পেরেছে (মুসনাদে ইমাম আলী-১ম খণ্ড)। নফ্স দ্বারাই মানুষ আল্লাহর হুজুরে পৌঁছাতে পারে। এ নফ্স দ্বারাই সাধকের ফানাফিল্লাহ ও বাকাবিল্লাহ অর্জিত হয়। নফ্সকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে যেমন সে মানুষের ক্ষতির কারণ হয়, তেমনি নফ্সকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে তার দ্বারা অন্য মানুষের কল্যাণও হয়। নফ্সের দ্বারা মানুষ আল্লাহর অলী হতে পারে, আবার নফ্সের ধোঁকায় পড়ে জাহান্নামে পতিত হতেও পারে। নফ্স না থাকলে আল্লাহ্কে পেয়ে মানব জীবন ধন্য হতে পারত না।

নফ্সের সুবিধা পেতে একে নিজের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য চেষ্টা করাই মানুষের কাজ। মর্যাদা পেতে হলেতো কিছু পরিশ্রম করতেই হবে। তা না হলে মর্যাদার কোনো মূল্য থাকবে না। চেষ্টা করতে গিয়ে বাধা বিপত্তি থাকবে, ভুল হবে, পাপ হবে, কিন্তু চিন্তা নেই। আল্লাহ্ পাকও জানেন মানুষ পাপ করবে, সে কারণে তিনি মর্যাদাবান মানুষের জন্য রেখেছেন অসীম ক্ষমার সুযোগ। মহান আল্লাহ্ প্রত্যেক মানুষকেই মানবীয় গুণ ও বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টির সেরা করেছেন। আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, “অবশ্যই আমি মানুষকে সর্বোত্তম অবয়বে সৃষ্টি করেছি।” (সুরা তীন- ৯৫ : আয়াত ৫) আমাদের নফ্স আমাদের জন্য আল্লাহর বিশেষ রহমত। মনে রাখতে হবে আমরা রিপুর সাথে বসবাস করব, কিন্তু রিপু যেন আমাদের গ্রাস করতে না পারে। আমরা আস্তে আস্তে রিপুকে বশ করে যে নফ্স আমাদের বিভ্রান্ত করে, সেই যেন আমাদের সহায়তা করে সে অবস্থা সৃষ্টি করতে হবে। তাহলেই আমরা সফল হবো। সেটাই আমাদের কাজ এবং সেখানেই সফলতা। আমাদের সাথে নফ্স বা রিপু থাকার রহস্য এখানেই নিহিত।
পিরানে পির দস্তগির সুলতানুল মাশায়েখ, সুলতানিয়া-মোজাদ্দেদিয়া তরিকার ইমাম সৈয়দ আবুল ফজল সুলতান আহমদ (রহ.)-কে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল- “আল্লাহ্কে দেখা যায় কি না। তিনি জবাবে বলেছিলেন- দেখা যায় এটাও সত্য, দেখা যায় না এটাও সত্য। তারপর তিনি উদাহরণ দিয়ে বললেন- একটি পুঁটি মাছ সাগরে বাস করলে তার কাছে সাগরের বিশালতার কারণে সাগর নিরাকার, আবার পুকুরে বাস করলে তার কাছে মনে হয় পুকুরের আকার আছে।” পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “তোমরা যেদিকে তাকাবে, সেদিকেই আল্লাহর চেহারা মোবারক রয়েছে।’’ (সুরা আল বাকারাহ-২; আয়াত ১১৫) তিনি আরো ঘোষণা করেন- নিশ্চয় তোমরা শীঘ্রই আমার চেহারা মোবারক পূর্ণিমার চাঁদে দেখতে পাবে এবং দেখলে চিনতে পারবে। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘‘আস্সালাতু মে’রাজুল মু’মেনীন’’ অর্থাৎ নামাজ মু’মেন ব্যক্তির জন্য মেরাজ। হযরত রাসুল (সা.)-এর এ বাণীর মধ্যেই নিহিত রয়েছে আল্লাহর চেহারা মোবারক আছে এবং একজন মু’মিন তা নামাজের মাধ্যমে দেখতে পাবেন। বোখারী ও মুসলিম শরীফের সূত্রে মেশকাত শরীফে বলা হয়েছে- “নিশ্চয় আল্লাহ্ আদম (আ.)-কে তাঁর নিজের সুরতে সৃষ্টি করেছেন।” এ থেকে বুঝা যায় যে, মহান আল্লাহ্র চেহারা মোবারক আছে এবং সে চেহারা মোবারক মানুষের চেহারার মতো। নুরময় সেই চেহারা মোবারক দেখার জন্য চক্ষু থাকা শর্ত। যাদের অন্তরের চক্ষু আল্লাহ্র নুরে আলোকিত, তারা আল্লাহ্কে দেখতে পান, আর যাদের অন্তর অন্ধকার তারা কীভাবে সেই নুরময় সত্তাকে দেখবেন? এ দেখা না দেখা নির্ভর করে একজন মানুষের আত্মিক উৎকর্ষ সাধনের উপর। তাসাউফ চর্চার মাধ্যমে যে মহান আল্লাহ্ এবং রাসূল (সা.)-এর সাথে যোগাযোগ করা যায়- যাদের তাসাউফ সম্পর্কে ধারণা নেই তারা তা বিশ্বাস করবেন কীভাবে? তাদের কাছে আল্লাহ্ নিরাকার হবেন এটাই স্বাভাবিক।

সমাজে বেশির ভাগ লোকের বিশ্বাস আল্লাহ্ সাত আসমানের উপর অবস্থান করেন। আবার তারাই বলেন- মসজিদ আল্লাহর ঘর, আবার বলেন আল্লাহ্ সর্বত্র অবস্থান করেন। হযরত রাসুল (সা.) বলেন, ”কুলুবুল মু’মিনিনা আরশুল্লাহ” অর্থাৎ মুমিনের ক্বাল্ব আল্লাহ্র আরশ। তাহলে আল্লাহ্ কোথায়? এ প্রশ্নের জবাব পেতে যিনি আল্লাহ্কে চিনেন ও জানেন এমন ব্যক্তির কাছে গিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করে সাধনা করলে জানা যায়। আমাদের প্রিয় নবি হযরত মোহাম্মদ (সা.) ছিলেন এ বিষয়ের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। তিনি স্বয়ং আল্লাহ্র কাছ থেকেই এ শিক্ষা অর্জন করেছিলেন এবং কুল কায়েনাতের শিক্ষক ও রহমত হিসেবে পৃথিবীতে আবির্ভুত হয়েছিলেন। তাঁর শিক্ষা যিনি অর্জন করেছেন এবং সিরাজাম মুনিরার অধিকারী হয়েছেন, তিনি এ শিক্ষা দিতে পারেন। বর্তমান বেলায়েতের যুগে একজন প্রকৃত অলী-আল্লাহ্ই পারেন মানুষকে আল্লাহর পথ দেখাতে। কিয়ামত পর্যন্ত অলী-আল্লাহ্গণ হয়রত রাসুল (সা.)-এর সেই শিক্ষা দিয়ে যাবেন। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “হে বিশ্বাসী বান্দারা! তোমরা আল্লাহ্কে ভয় করো এবং আল্লাহ্কে পাওয়ার জন্য অসিলা অন্বেষণ করো।” (সূরা মায়েদা : আয়াত ৩৫) আরো বলা হয়েছে, “তোমরা যদি রহমান (আল্লাহ্) সম্পর্কে জানতে চাও, তবে যিনি তাঁর সম্পর্কে জানেন তাঁকে জিজ্ঞেস করো।” (সূরা ফুরকান : আয়াত ৫৯) বন্ধুর পরিচয় যেমন বন্ধু জানেন, অনুরূপভাবে আল্লাহর পরিচয় জানেন অলী-আল্লাহ্ বা আল্লাহ্র বন্ধুগণ। মোরাকাবার মাধ্যমে হৃদয়ের আলো জাগ্রত করে আল্লাহ্র পরিচয় লাভ করতে হয়। সাত আকাশের উপরে আল্লাহ্কে খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি মারেফত বিশ্বাসই করেন না তাকে এ বিষয় বুঝানো যায় কীভাবে?

অনেকেই পাপ করে বলে থাকে আমরা অন্যায় করলে আল্লাহ্ সাজা দিবেন, আমাদের ধ্বংস করে দিবেন। এতে বুঝা যায়, আল্লাহর ক্ষমতার ব্যাপারে তাদের উদাসীনতা রয়েছে। এটা আজ নতুন নয়, আগেও যুগে যুগে নবি-রাসুলগণকে মানুষ বলেছে- আমরা যদি আপনাদের শিক্ষা না মেনে অন্যায় করি, তাহলে আল্লাহ্কে বলেন- আমাদের ধ্বংস করে দিক। আবার তাদের ধ্বংস করে দিতে গেলে তারাই মহান আল্লাহ্র কাছে শেষ বারের মতো ক্ষমা প্রার্থনা করেছে। তাতে অনেক জাতি মহান করুণাময়ের বিশেষ করুণা পেয়েছেও। আবার অনেকে হাজারো ফরিয়াদ করেও ফেরাউনের মতো ক্ষমা পায়নি। আসলে কোনো নবি-রাসূলই বিশেষ অবস্থা ছাড়া কোনো অবাধ্য জনগোষ্ঠীরও ধ্বংস কামনা করেননি। সকল পয়গম্বরের আকুতি এটাই যে, কোনো কাফিরও যেন আজাবে পতিত না হয়। আবার মহান আল্লাহ্ও কোনো নবি-রাসুলের উপস্থিতিতে কাউকে শাস্তি দিতে চান নি। সেজন্য কোনো নবি-রাসুল ও আওলিয়ায়ে কেরাম যে জনপদে অবস্থান করেন, সেখানে আল্লাহ্ কখনো আজাব ও গজব প্রেরণ করেন না। বর্তমানে চলছে শেষ রাসুল হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সা.)-এর পরে তাঁরই অনুসরণে বেলায়েতের যুগ। সেই কারণে এখনো কোনো অবাধ্য গোষ্ঠীর উপর আজাব গজব আল্লাহ্ সহজে দিতে চান না। সেজন্য অনেক অবাধ্য লোকজন বুঝতে না পেরে ভাবতে থাকে তারা ধর্মকে গুরুত্ব না দিয়ে ঠিকই করছে, না হলে তো আল্লাহ্ তাদের উপর গজব দিতেন। শুধুমাত্র যারা এ বিষয় বুঝার যোগ্যতা অর্জন করেছেন, তারাই মহান আল্লাহর রহমতের রহস্য বুঝতে পারেন।

আমরা কথায় কথায় বলি- শিশুরা নিষ্পাপ। প্রশ্ন হলো- শিশুরা যদি নিস্পাপই হয়ে থাকে, তাহলে সব শিশু পৃথিবীতে একই ভাগ্য নিয়ে আসছে না কেন? কেউ সুস্থ হয়ে, কেউবা বিকলাঙ্গ হয়ে জন্মগ্রহণ করছে। কেউ ধনীর ঘরে জন্ম গ্রহণ করে স্বাচ্ছন্দে বেড়ে উঠছে, আবার কেউ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে দিন যাপন করছে। মানুষ সাধারণ ধারণা নিয়ে বলেন, সবই আল্লাহর ইচ্ছা। আল্লাহর ইচ্ছা একথা অবশ্যই সত্য, কিন্তু আল্লাহ্তো ন্যায় বিচারক। তিনি কারণ ছাড়া কোনো আত্মাকে এভাবে পৃথিবীতে পাঠান না। এ বিষয়ের নিগূঢ় রহস্য জানতে তাসাউফের জ্ঞান থাকা জরুরি। সেজন্য হৃদয়ের কান ও চোখ খোলা প্রয়োজন। প্রতিটি আত্মাই তার কর্মের ফল ভোগ করবে, এখানেও তাই ঘটছে। বিষয়টি বুঝার জন্য সাধারণ বা শুধুমাত্র শরিয়তের জ্ঞান যথেষ্ট নয়। আত্মা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন করা প্রয়োজন। আবার কর্মক্ষেত্রেও আমরা অনেক সময় কোনো কাজের ইপ্সিত ফল লাভ করতে না পেরে হতাশ হয়ে পড়ি। আসলে মহান আল্লাহ্ সব সময় আমাদের মঙ্গল কামনা করেন। যা কিছু হয় সবই আমাদের কল্যাণে হয়ে থাকে। আমরা বুঝতে না পেরে হতাশ হই। এ বিষয়গুলো বুঝার জন্য যে জ্ঞান থাকা আমাদের প্রয়োজন, তা না থাকায় এমন চিন্তার উদ্ভব হয়ে থাকে। এসব বিষয় সংক্রান্ত যদি জাহেরি জ্ঞানের সাথে বাতেনি জ্ঞান থাকত, তাহলে বুঝা যেত ঘটনার বাস্তবতা কত নিখুঁত।

এখনো আমরা অনেকেই বলি আশুরা শিয়াদের অনুষ্ঠান। এটিও আমাদের জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে বলে থাকি। এ আশুরার দিনটি মহান আল্লাহর আরশে অভিষেক-সহ ইসলামের ইতিহাসে শতাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার দিন। সেজন্য রাসূল (সা.)-এর পূর্ব থেকেই এ দিনটি পালিত হয়ে আসছে। বিষয়টি শুনে রাসুল (সা.) বললেন আমরা মুসা (আ.)-এর অধিকতর ঘনিষ্ঠ ও নিকটবর্তী। অতপর রাসুল (সা.) রোজা পালন করলেন- এবং অন্যদের পালনের নির্দেশ দিলেন (বুখারী ও মুসলিম)। সেই বিবেচনায় রাসুল (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় এ দিনটিকে মুসলিম জাহানের জন্য মর্যাদাপূর্ণ দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। পরবর্তিতে এ দিনে ঘটে কারবালার হৃদয় বিদারক ঘটনা। হযরত রাসুল (সা.) বলে গেছেন- আমরা যদি আল কুরআন আর তাঁর আহলে বাইতকে আঁকড়ে থাকতে পারি, তাহলে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। অথচ আমরা আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য ইমাম হোসাইন (রা.) সেদিনের আত্মত্যাগকে মোটেই স্মরণ করতে চাই না। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে বুঝার তৌফিক দিবেন, সেটাই কামনা।
এখানেই শেষ নয়। প্রতি মুহূর্তে মানুষ নানান ধরণের উদ্ভট প্রশ্ন ও বিতর্ক তুলে ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান বললেও বিভিন্ন বিষয়ে স্পষ্টতার অভাব রয়েছে। এক বর্ণনার সাথে আরেক বর্ণনার মিল নেই এসব কথায়। আসলে আল কুরআন এমন এক ঐশী গ্রন্থ, যার প্রতিটি শব্দ মহান আল্লাহ্ পাকের, যেখানে বিন্দু মাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। সমস্যা হলো- আমাদের বুঝার ভুল। আল কুরআনের প্রতিটি আয়াতের জাহেরি ও বাতেনি মর্মার্থ রয়েছে। তা বুঝতে না পেরে জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে মনগড়া ধারণা করে আমরা নানান বিভ্রান্তি সৃষ্টি করি। এর একমাত্র সমাধান ধর্মের সব দিক সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন করে তারপর এ ধরনের মতামত দেওয়া। তখন দেখা যাবে, সব কিছু সরল অংকের মতো মিলে যাবে।
মহান আল্লাহ্ পাকের এসব রহস্য পরিপূর্ণরূপে বুঝার জন্য ধর্ম সম্পর্কে জাহেরি ও বাতেনি জ্ঞান থাকা আবশ্যক। সেই জ্ঞান প্রদানের জন্যই মহান আল্লাহ পাক নবি-রাসুল প্রেরণ করেছেন এবং এখনো তাঁর অলী বন্ধুদের জগতে প্রেরণ করে আসছেন। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘‘আমি আমার সৃষ্টির (মানুষ) মধ্যে এমন এক দলকে সৃষ্টি করেছি, যারা মানুষকে সৎপথ দেখাবে এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করবে।’’ (সুরা আরাফ : আয়াত ১৮১) নবুয়তের যুগে নবি রাসুলগণ ছিলেন এ শ্রেণির, বর্তমান বেলায়েতের যুগে অলী-আল্লাহ্গণ সেই কাজ করে যাচ্ছেন। বর্তমান যুগের ইমাম সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেব্লাজান সেই দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। ধর্মের বিভিন্ন জটিলতা দূরীকরণে তিনি অনেকগুলো সংস্কার করেছেন। এসব সংস্কার নানান প্রশ্নের সমাধান দিতে সক্ষম হয়েছে। সমস্যা হলো- এসব কথা বুঝার মতো জ্ঞান থাকাওতো দরকার। সাধনার মাধ্যমে আমাদের আল্লাহ্ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হয়। সেজন্য আল্লাহ্কে পাওয়ার বিদ্যা শিক্ষা করতে হবে। সেই বিদ্যা নিজ নিজ দেহের ভিতরেই। কারো এ বিষয়ে জ্ঞান না থাকলে তাকে বুঝানো সম্ভব নয় বিধায় ধর্মের বিষয়গুলো তাদের কাছে বোধগম্য হয় না। জ্ঞান অর্জন করতে পারলে নিজেরাই বুঝতে পারে রহস্য কোথায়।

মানুষকে মহান রাব্বুল আলামিন তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে সৃষ্টি করে পৃথিবীর বুকে প্রেরণ করেছেন। সূূফী সম্রাট বলেন, প্রতিনিধিত্ব করার জন্য মালিকের সাথে যোগাযোগ করেই সব সমস্যার সমাধান পেতে হয়। তিনি আরো বলেন- একমাত্র আধ্যাত্নিক শিক্ষার মাধ্যমেই দিল জিন্দা করা যায় এবং ক্বাল্বে আল্লাহর জ্বিকির জারি হয়। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “যাদের ক্বাল্ব আল্লাহর জ্বিকির থেকে গাফেল রয়েছে, তারা প্রাকাশ্য গোমরাহ বা পথভ্রষ্ট।” (সুরা যুমার : আয়াত ২২) পবিত্র কুরআনে আরো বলা হয়েছে, “তোমরা যখন নামাজ শেষ করো তখন দাঁড়ানো, বসা ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহর জ্বিকির করো।” (সুরা নিসা : আয়াত ১০৩) দুনিয়াতে আধ্যাত্নিক সাধনার মাধ্যমে আল্লাহ্ ও হযরত রাসুল (সা.)-এর পরিচয় লাভ করতে না পারলে মানব জীবন নিস্ফল হবে।

মহান আল্লাহ্ পাক আমাদের সেই সৌভাগ্য দান করুন, আমরা যেন যুগের ইমামের কদম মোবারকে থেকে সাধনার মাধ্যমে মোহাম্মদী ইসলামের সকল শাখার প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করে আল্লাহ্র প্রকৃত রহস্য বুঝতে পারি। নিজেরাই আল্লাহ্ ও রাসুল (সা.)-এর সাথে যোগাযোগ করে সব প্রশ্নের জবাব পেতে পারি। মনের সকল কালিমা দূর করে প্রকৃত ইমানদার হতে পারি। যারা এখনো ধর্ম সম্পর্কে উদ্ভট প্রশ্ন নিয়ে ইসলামের মাঝে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছেন, মহান আল্লাহ্ পাক তাদেরকেও প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের সুযোগ করে দিন। সবাই যেন ধর্মের প্রকৃত রহস্য বুঝে সফলকাম হতে পারেন, সেটাই কামনা। আমিন।

সম্পর্কিত পোস্ট

4 Comments

  • অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা।

  • অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলচনা অনেক কিছু জানতে পারলাম ।

  • অনেক মূল্যবান আলোচনা

  • আত্বাবানী পরে আমি বুঝতে পারলাম
    অলি আল্লহর কদমে না যাওয়া পযর্ন্ত
    আল্লহর পরিচয় পাওয়া যাবেনা
    আত্বাবানী পড়ে আমার অনেক ভাল লাগছে
    আমার আত্বার শান্তি পেলাম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *