Cancel Preloader

মুক্তিযুদ্ধে সূফী সম্রাটের বীরত্বগাথা
– ইমাম প্রফেসর ড. আরসাম কুদরত এ খোদা

স্বদেশপ্রেমে উদ্বেলিত সূফী সম্রাট
শৈশব থেকেই দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের ছিল অকৃত্রিম ভালোবাসা। তিনি তাঁর সমস্ত আবেগ, অনুভূতি ও উপলব্ধি দিয়ে স্বদেশকে ভালোবাসতেন। তিনি হৃদয় দিয়ে বিশ্বাস করতেন যে, দেশ ও জাতির প্রতি প্রেমহীন মানুষ সত্যিকারের মানুষ হতে পারে না। যারা নিঃস্বার্থে নিবেদিত চিত্তে দেশকে ভালোবাসে এবং দেশ ও জাতির উপকারে আত্মোৎসর্গ করে, প্রকৃতপক্ষে তারাই মানুষ, তারাই দেশপ্রেমিক। মূলত স্বদেশপ্রেমের উদ্ভব আত্মসম্মানবোধ থেকেই সৃষ্টি হয়। যে জাতির আত্মসম্মানবোধ যত প্রখর, সেই জাতির স্বদেশপ্রেম তত প্রবল। স্বদেশপ্রেম এক প্রকার পরিশুদ্ধ ভাবাবেগ। তাই দেশ যখন বহিঃশত্রু কর্তৃক আক্রমণের শিকার হয়, তখন স্বদেশ প্রেমে নিবেদিত প্রাণ নাগরিক ঘরে বসে থাকতে পারে না। তাঁরা দেশকে মুক্ত করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রুর উপর। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাত্রিতে পাক হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির উপর নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালায়। পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ বাঙালি জাতির এমন চরম সংকটময় মুহূর্তে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিলেন। নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে হলেও দেশকে শত্রুমুক্ত করে স্বাধীনতার স্বর্ণালি সূর্য পূর্ব দিগন্তে উদয়ের জন্য তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। পাকিস্তানী বর্বর বাহিনী দেশের লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছে, মা-বোনদের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, দেশের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধন করছে, তাদেরকে সমুচিত জবাব দেওয়ার জন্য স্বদেশপ্রেমে উদ্বেলিত হয়ে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ
সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান তাঁর পরম শ্রদ্ধেয় দাদা-দাদী, পিতা-মাতা এবং পরিবারের সবার নিকট থেকে বিদায় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হন। সেসময় তাঁর হৃদয় পটে ভেসে উঠছিল রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.)-এর হিজরতের সেই স্মৃতিময় ঘটনা। হযরত রাসুল (সা.) যখন মক্কা ছেড়ে মদীনার পথে পাড়ি দিচ্ছিলেন, তখন তিনি বারবার কাবা গৃহের দিকে করুণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করছিলেন। সেসময় তাঁর চোখ মোবারক অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে। গভীর মমতা ও হৃদয়ে একরাশ বেদনা নিয়ে হযরত রাসুল (সা.) বলছিলেন, “হে মক্কানগরী! তুমি আমার জন্মভূমি, আমি তোমাকে ভালোবাসি। সমগ্র ধরাপৃষ্ঠের মধ্যে তুমিই আমার নিকট প্রিয়তম। কিন্তু তোমার সন্তানগণ আমাকে তোমার বুকে বাস করতে দিচ্ছে না।” এভাবে হযরত রাসুল (সা.)-এর সেই আবেগময় কথা স্মরণ করে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান দেশকে শত্রু মুক্ত করার জন্য দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করেন।
তিনি ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল, রবিবার, স্বাধীনতাকামী ৭২ জন সঙ্গীকে নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় স্থাপিত বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে যোগ দেন। ভারতীয় রেকর্ড অনুযায়ী তাঁর ক্রমিক নম্বর : মুক্তিবাহিনীর এমএফ ভলিউম-৭, পৃষ্ঠা ১১, ক্রমিক নং- ১৮২৮৯২; বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের রেকর্ড অনুযায়ী তাঁর ক্রমিক নম্বর : ভলিউম- ৪, ক্রমিক নং- ৩৪০৬৬; বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল কর্তৃক ১৯৯৮-৯৯ সালে প্রণীত প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা অনুযায়ী তাঁর ক্রমিক নম্বর: জেলা- ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ক্রমিক নং- ০২১২০৮০১৯৩

প্রশিক্ষণে আত্মনিয়োগ
সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান যেদিন তাঁর সাথিদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করলেন, সেদিনই তাঁদের সকলকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে বেঙ্গল রেজিমেন্টের ট্রাকযোগে তেলিয়াপাড়ায় ৩নং সেক্টর হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গিয়ে তিনি এবং তাঁর ৭২ জন সঙ্গী সেকেন্ড লেফটেনেন্ট আব্দুস সালামের নিকট রিপোর্ট করলেন। রিপোর্ট করার পর তাঁদের সকলের ফিটনেস পরীক্ষা করা হয়। ফিটনেস পরীক্ষায় সূফী সম্রাট-সহ ৬০ জন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য মনোনীত হন, বাকি ১২ জন ফিটনেস পরীক্ষায় ব্যর্থ হওয়ায় তাদেরকে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বাছাইকৃত ৬০ জনকে সমান দুইভাগে বিভক্ত করে দুই প্লাটুনে ভাগ করা হয়। অতঃপর সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানকে এক প্লাটুনের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। সেকেন্ড লেফটেনেন্ট আব্দুস সালাম সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানকে দেখিয়ে ৩০ জন প্লাটুনের সবাইকে বললেন, “তিনি এখন থেকে আপনাদের এই প্লাটুনের কমান্ডার অর্থাৎ- এই ৩০ জনের কমান্ডার। তাঁকে আপনারা ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করবেন।” এরপর তাঁদের সবাইকে দুই সপ্তাহ প্রশিক্ষণের জন্য ঐদিনই বিকেলে তেলিয়াপাড়া বাঁশ বাগানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান এবং তাঁর সঙ্গীরা তেলিয়াপাড়া মুক্তিযুদ্ধে প্রশিক্ষণের ১ম ব্যাচ ছিলেন।


প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করার পর, সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান জীবনের সর্বপ্রথম রাইফেল ধরলেন। এরই মধ্যদিয়ে শুরু হলো যুদ্ধের প্রশিক্ষণ। ছাত্র জীবন থেকে তিনি নতুন এক জীবনে প্রবেশ করলেন, যা ছিল তাঁর নিকট একেবারেই নতুন এক অভিজ্ঞতা। এই প্রসঙ্গে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান বলেন, “প্রশিক্ষণের প্রথম দিনে আমাদের পাসওয়ার্ড ছিল ‘লাল পাখি’।” পাসওয়ার্ড হলো সৈনিকদের একটি সাংকেতিক শব্দ, যা যুদ্ধের সময় কৌশলগত কারণে ব্যবহার করা হয়। এদিকে প্রশিক্ষণের সময় সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের হৃদয়পটে ভেসে উঠলো হযরত রাসুল (সা.)-এর স্মৃতিবিজড়িত বিভিন্ন যুদ্ধের ঘটনা। মক্কার কাফেরদের আক্রমণ প্রতিরোধ ও মদীনা রাষ্ট্র রক্ষার জন্য আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে বহু যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হয়েছিল। সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানকেও নিজ দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য যুদ্ধে যোগদান করতে হলো।

রণাঙ্গনে সূফী সম্রাট

শাহবাজপুর যুদ্ধ
শাহাবাজপুর যুদ্ধ ছিল রণাঙ্গনে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের ১ম সম্মুখ যুদ্ধ। তাই এই যুদ্ধটি তাঁর জন্য এক বিশেষ স্মৃতি বহন করে। যুদ্ধটি সংঘটিত হয় ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল, মঙ্গলবার ভোরবেলা। তিনি ২৬ এপ্রিল, সোমবার তেলিয়াপাড়ায় ৩নং সেক্টর হেডকোয়ার্টারে বিশেষ প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। এদিকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় শাহাবাজপুরে পাকিস্তানী সেনাদের নির্মিত সেতুটি চলাচলের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হবে এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তাদের ওপর আকস্মিক হামলা চালানো হবে। এই লক্ষ্যে লেফটেনেন্ট হেলাল মোর্শেদের নেতৃত্বে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান-সহ ১ম ব্যাচের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ২ প্লাটুন মুক্তিবাহিনীকে শাহাবাজপুর অপারেশনে প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। লেফটেনেন্ট হেলাল মোর্শেদ মুক্তিবাহিনীকে আক্রমণের কলাকৌশল ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। অতঃপর পরিকল্পনা মোতাবেক রাতের অন্ধকারে মুক্তিবাহিনী সদস্যরা অপারেশনের উদ্দেশ্যে বের হন। সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানকে ১ সেকশন মুক্তিবাহিনীর কমান্ডারের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। তিনি যেহেতু ১ম সশস্ত্র সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছেন, তাই তিনি মনে মনে কায়মনোবাক্যে মহান আল্লাহর রহমত ও বরকত কামনা করে নিজের সেকশনের সৈনিকদের নিয়ে দৃঢ়চিত্তে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। তখন রাতের শেষ প্রহর। পাকহানাদার বাহিনীর কয়েকজন টহলরত ছিল, আর বাকি সব সৈন্য ঘুমিয়ে ছিল। লেফটেনেন্ট হেলাল মোর্শেদের পরিকল্পনা মোতাবেক মুক্তিবাহিনী শত্রু সেনাদেরকে নিজেদের আয়ত্বের মধ্যে নিয়ে আসেন। অতঃপর নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথে তারা পাকহানাদার বাহিনীকে লক্ষ্য করে অবিরাম গুলিবর্ষণ করতে থাকেন। আকস্মিক এই আক্রমণের শিকার হয়ে ঘুমন্ত পাক সৈন্যরা হতভম্ব হয়ে যায় এবং দিক হারিয়ে ফেলে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অনেক পাক সেনা মৃত্যুর মুখে পতিত হয়। সফলভাবে অপারেশন সম্পন্ন করে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান তাঁর সেকশনের মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক সুরক্ষিত স্থানে চলে আসেন। জীবনের ১ম সম্মুখ যুদ্ধ সফলতার সাথে সম্পন্ন হওয়ায় তিনি মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে বিশেষ শোকরিয়া জ্ঞাপন করেন। অতঃপর সেখান থেকে ২৭ এপ্রিল, সোমবার বিকেলে তিনি তাঁর বাহিনী-সহ মাধবপুরে চলে যান।

মাধবপুর যুদ্ধ
মাধবপুর যুদ্ধটি সংঘটিত হয় ১৯৭১ সালের ২৮ এপ্রিল, বুধবার। শাহবাজপুরে পাকহানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণের শিকার হয় এবং তাদের অনেক সৈন্য হতাহত হয়। তারা নিশ্চিত হয় যে, মুক্তিবাহিনী মাধবপুর, তেলিয়াপাড়া থেকে এসে তাদের ওপর আক্রমণ করেছে। তাই পাকবাহিনী মুক্তিবাহিনীর ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। এই লক্ষ্যে তারা ২৮ এপ্রিল, সকাল ৮টায় মাধবপুরে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর ওপর হামলা চালায়। তারা মুক্তিবাহিনীর ওপর উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক ও ব্যাপক গোলাবর্ষণ করে। তাদের এই হামলায় মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষার চারপাশে ভয়াবহ আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় কোম্পানি কমান্ডার লেফটেনেন্ট হেলাল মোর্শেদ মুক্তিফৌজদের তৎক্ষণাৎ পাল্টা আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দেন। সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান-সহ অন্যান্য মুক্তিফৌজরা সাথে সাথে প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। এদিকে পাকহানাদার বাহিনী ৩টি দলে বিভক্ত হয়ে মুক্তিসেনাদের ওপর আক্রমণ চালাতে থাকে। পাকবাহিনীর ২টি দল ডান ও বাম পাশ থেকে ক্যাপ্টেন মতিনের কোম্পানির ওপর একযোগে হামলা চালায়। পাকবাহিনীর ৩য় দলটি ২ কোম্পানির মধ্যদিয়ে আক্রমণ চালাতে থাকে।


সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান বেলা প্রায় ১১টার সময় নিজ সেকশনের মুক্তিফৌজদের নিয়ে পাকহানাদার বাহিনীর ডান পাশের দলকে পাল্টা আক্রমণের জন্য আলীনগর গ্রামে অবস্থান গ্রহণ করেন। এদিকে পাকবাহিনী দুপুর আনুমানিক ১২টায় মুক্তিবাহিনীর সম্মুখে এসে পৌঁছায়। পাকবাহিনীকে সহায়তা করার জন্য আরও পাকিস্তানী ব্যাটালিয়ন সামনে অগ্রসর হচ্ছিল। কিন্তু মহান রাব্বুল আলামিনের অপার দয়ায় মুক্তিবাহিনী অসীম সাহসিকতার সাথে পাকবাহিনীকে মোকাবিলা করে যাচ্ছিলেন। ইতঃপূর্বে আক্রমণের কৌশল হিসেবে মুক্তিবাহিনী পরিখা (Trence) খনন করে রেখেছিলেন। তাঁরা পরিখা থেকে রাইফেল, মর্টার ও এলএমজি দিয়ে পাকবাহিনীর আক্রমণ নস্যাৎ করে দিচ্ছিলেন। মুক্তিবাহিনীর পাল্টা আক্রমণে পাকহানাদার বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। কিন্তু পাকবাহিনী ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যবর্তী দলটি ডানদিকে অবস্থানরত ক্যাপ্টেন নাসিমের কোম্পানি এবং বামদিকের সম্মুখপানে এগিয়ে যাওয়া ক্যাপ্টেন মতিনের কোম্পানির মধ্যবর্তী স্থান দিয়ে কিছুটা ভিতরে অগ্রসর হয়ে যায়। এতে ক্যাপ্টেন নাসিম ও ক্যাপ্টেন মতিনের সম্মিলিত অবস্থানে কিছুটা ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়। বেলা প্রায় ৩টায় পাকসেনাদের মধ্যবর্তী দলটি উত্তর দিকে এগিয়ে যায়। এভাবে তারা আরও অগ্রসর হয়ে ডান পাশে প্রধান সড়ক মোড়ের নিকট পৌঁছে যায়। সেখানে ক্যাপ্টেন নাসিম মুক্তিবাহিনী নিয়ে অবস্থান করছিলেন। পাকবাহিনী ক্যাপ্টেন নাসিমের অবস্থানে আক্রমণ করে। এতে মুক্তিফৌজের কোম্পানিগুলো পারস্পরিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এদিকে পাকবাহিনীর আক্রমণে ক্যাপ্টেন মতিনের বাম পাশের অবস্থান ভেঙ্গে যায়। এই সুযোগে পাকসেনারা ক্যাপ্টেন নাসিম ও ক্যাপ্টেন মতিনের এলাকায় প্রবেশ করতে উদ্যত হয়। ঠিক সেসময় লেফটেনেন্ট মোর্শেদের কমান্ডে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান ও তাঁর সহযোদ্ধারা পাকবাহিনীর ডান দিকের পেছনের পাশ থেকে অতর্কিত আক্রমণ করে। আকস্মিক এই আক্রমণে পাকবাহিনী হতবিহবল হয়ে পড়ে। তারা নিজেদের জীবন রক্ষার জন্য পেছনের দিকে হটে পড়ে এবং দিকবিদিক হয়ে পালাতে থাকে। পালানোর সময় পাকবাহিনীর একটি দল ক্যাপ্টেন মতিনের প্রতিরোধ অবস্থানে ঢুকে পড়ে। ফলে তাদের অনেকেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়। মাধবপুরের এই যুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীর ২৭০ জন হতাহত হয়। এই অভিযানে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান এবং তাঁর সহযোদ্ধারা অসীম সাহসিকতা ও সফলতার সাথে সম্পন্ন করেন।

পাকবাহিনীর ত্রিমুখী আক্রমণ ব্যর্থ
মাধবপুর যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়া সত্ত্বেও মাধবপুর পাকবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এতে করে মুক্তিবাহিনীর আওতাধীন এলাকা অনেকটাই সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। সেসময় মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল উত্তরে শ্রীমঙ্গল-শায়েস্তাগঞ্জ অঞ্চল থেকে দক্ষিণে তেলিয়াপাড়া, মনতলা-মুকুন্দপুর এবং সিঙ্গার বিল অঞ্চল পর্যন্ত। এদিকে পাকহানাদার বাহিনী তেলিয়াপাড়া-চুনারুঘাট-ইটখোলা মহাসড়কটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য চেষ্টা চালাতে থাকে। কেননা এই মহাসড়কটি উন্মুক্ত থাকলে তারা নিরাপদে চলাচল করতে পারবে।


সেক্টর কমান্ডার মেজর সফিউল্লাহ্ উক্ত এলাকাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তিনি মুক্তিফৌজদের কয়েকটি দলে বিভক্ত করে তাদেরকে পৃথক পৃথক দায়িত্ব অর্পণ করেন। ক্যাপ্টেন মতিনের কোম্পানির ওপর দায়িত্ব অর্পিত হয় ৩নং সেক্টর হেড কোয়ার্টারের তেলিয়াপাড়া। ক্যাপ্টেন মতিনের সহযোগী হিসেবে ছিলেন ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভূঁইয়া। মনতলার দায়িত্ব দেওয়া হয় ক্যাপ্টেন নাসিমের কোম্পানিকে এবং ক্যাপ্টেন মঈনকে হরষপুর এলাকার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এদিকে পাক সেনাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব অর্পন করা হয় লেফটেনেন্ট মোর্শেদের ওপর। সেসময় সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান লে. মোর্শেদের সাথে ছিলেন। তিনি বিভিন্ন অ্যাম্বুসে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন।


তেলিয়াপাড়া থেকে মুক্তিফৌজরা পাক হানাদার বাহিনীর ওপর বারবার আক্রমণ চালাচ্ছেন, তা বুঝতে পেরে পাকবাহিনী তেলিয়াপাড়া দখল করার জন্য বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এই লক্ষ্যে তারা ভিন্ন ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে। তারা কখনো কুমিল্লা হতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মধ্য দিয়ে আক্রমণের প্রচেষ্টা চালায়, আবার কখনো বা ঢাকার দিক থেকে শাহবাজপুর মাধবপুর লাইনে চাপ সৃষ্টি করে। মুক্তিফৌজদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য তারা কখনো সিলেটের দিক থেকে আক্রমণের চেষ্টা করে। কিন্তু মহান রাব্বুল আলামিনের অপার দয়ায় পাকহানাদার বাহিনীর এই ত্রিমুখী আক্রমণ ব্যর্থ হয়। সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান পাকবাহিনীর এই ত্রিমুখী আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য লে. মোর্শেদের সাথে বিভিন্ন অ্যাম্বুসে অংশগ্রহণ করেন। প্রতিটি অ্যাম্বুসে মুক্তিফৌজরা সফল হচ্ছিলেন। ফলে পাকবাহিনীর প্রতিটি আক্রমণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

সিলেট ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহাসড়কে অ্যাম্বুস
১৯৭১ সালের ১১ মে, মঙ্গলবার সেকশন কমান্ডার সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে সিলেট ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহাসড়কে অ্যাম্বুস করতে যান। এই অ্যাম্বুসে মুক্তিফৌজদের নেতৃত্ব দেন লেফটেনেন্ট মোর্শেদ। পরিকল্পনা মোতাবেক গভীর রাতে মহাসড়কে মুক্তিফৌজরা একটি মাইন স্থাপন করে রাখেন। মাইনগুলোর ওপর কয়লাজাত আলকাতরা বিছিয়ে এর উপর গাড়ির টায়ারের দাগ বসিয়ে দেওয়া হয়, যেন পাকহানাদার বাহিনী কিছু বুঝতে না পারে। অতঃপর মুক্তিফৌজ সবাই মহাসড়কের এক পাশে নিরাপদ স্থানে অবস্থান নিয়ে পাকবাহিনীর জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। এদিকে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান কায়মনোবাক্যে মহান আল্লাহর দয়া কামনা করেছিলেন, যেন অ্যাম্বুসটি সফলভাবে সম্পন্ন হয়।


কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর মুক্তিফৌজরা দেখতে পান যে, পাকবাহিনীর একটি জিপ গাড়ি এগিয়ে আসছে এবং এর পিছনে একটি ট্রাকও আসছে। এমতাবস্থায় মুক্তিফৌজরা সবাই দ্রুত যার যার পজিশনে চলে যান। পাকবাহিনীর জিপ ও ট্রাকটি ধীরে ধীরে চলে গেল, কিন্তু একটি মাইনও বিস্ফোরিত হলো না। মাইন বিস্ফোরিত না হওয়ায় মুক্তিফৌজদের মধ্যে কিছুটা হতাশা দেখা দিলো। এরপর তারা লক্ষ্য করলেন পাকবাহিনীর আরেকটি মাল বোঝাই ট্রাক এগিয়ে আসছে। সেসময় মুক্তিফৌজদের মধ্যে কিছুটা আশার সঞ্চার হলো। মাল বোঝাই ট্রাকটি মাইনের উপর দিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে এর চাকার চাপে বিকট শব্দে মাইনটির বিস্ফোরণ ঘটে। আল্লাহর কী অপূর্ব শান! এরপর অন্যান্য মাইনগুলোও একে একে বিস্ফোরিত হতে থাকে। ফলে সড়কের চারপাশ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।

আকস্মিক এই ঘটনায় পাকসেনারা দ্রুতগতিতে পালানোর চেষ্টা করছিল। ঠিক সেসময় অ্যাম্বুসে অংশগ্রহণকারী মুক্তিফৌজরা তাদের রাইফেল, স্টেনগান ও এলএমজি দিয়ে পাকবাহিনীর উপর বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ শুরু করেন। আত্মরক্ষার জন্য পাকসেনারাও মুক্তিফৌজদের উদ্দেশে পাল্টা গুলি চালাতে থাকে। এমতাবস্থায় উভয় পক্ষের সৈন্যদের মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। মুক্তিফৌজরা তাঁদের রণকৌশল ও দৃঢ়মনোবল দিয়ে পাকবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকে। ফলে পাকসেনারা একেবারে কোণঠাসা পয়ে পড়ে। মহান আল্লাহর অপার দয়ায় এই অ্যাম্বুসে পাকসেনাদের হাতে কোনো মুক্তিফৌজ হতাহত হননি। অন্যদিকে মুক্তিফৌজদের সাড়াশি আক্রমণে পাকবাহিনীর অনেক সৈন্য হতাহত হয় এবং তাদের একটি বাস অক্ষত অবস্থায় মুক্তিবাহিনী দখল করে নিতে সক্ষম হন। সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান অ্যাম্বুসের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, “আমরা অল্প কয়েকজন মুক্তিসেনা নিয়ে সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া অ্যাম্বুসে অংশগ্রহণ করি, কিন্তু পাকবাহিনীর সৈন্যসংখ্যা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি থাকা সত্ত্বেও মহান আল্লাহর অপার দয়া আমাদের উপর ছিল বিধায় তারা আমাদের নিকট পরাজিত হয় এবং পালিয়ে যায়।”

বাগসাইর গ্রামে অ্যাম্বুস
১৯৭১ সালের ১৩ মে, বৃহস্পতিবার মুক্তিফৌজরা মাধবপুরের বাগসাইর গ্রামে গিয়ে সিলেট ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কে অ্যাম্বুস করেন। লে. মোর্শেদের নেতৃত্বে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান-সহ ১২ জন মুক্তিফৌজ এই অ্যাম্বুসে অংশগ্রহণ করেন। ইতঃপূর্বে ঐ এলাকাটিতে মুক্তিফৌজরা একটি সেতু বিধ্বস্ত করেন। পাকবাহিনী বিধ্বস্ত করা সেতুর পাশে একটি বিকল্প রাস্তা নির্মাণ করেন। রাস্তাটি উঁচু হওয়ায় সেখানে অ্যাম্বুস করা সহজসাধ্য ছিল না। কিন্তু মুক্তিফৌজরা অসীম সাহসিকতার সাথে সেখানে সফলভাবে অ্যাম্বুস করেন।


মুক্তিফৌজরা গভীর রাতে পাকবাহিনীর নির্মিত রাস্তার উপর দুটি এন্টি ট্যাংক মাইন স্থাপন করে মাটি দিয়ে ঢেকে রাখেন। অতঃপর ভোর থেকেই তারা পাকিস্তানী কনভয় আসার অপেক্ষায় নিরাপদ স্থানে ওঁৎ পেতে থাকেন। দীর্ঘ সময় ধরে তাঁরা অপেক্ষা করছিলেন। সেসময় মুক্তিফৌজরা বেশ ক্ষুধার্ত ছিলেন। কিন্তু তাদের সাথে ক্ষুধা নিবারণের মতো কোনো খাবারও ছিল না। খাবার সংগ্রহের জন্য যেতে হলে পজিশন ছাড়তে হবে, কিন্তু কোনো মুক্তিফৌজ পজিশন ছাড়তে চাচ্ছিলেন না। তাই তাদের সাথে থাকা সামান্য চানাচুর খেয়ে সবাই ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টা করেন। অতঃপর তাঁরা মহান আল্লাহকে স্মরণ করছিলেন, যেন পাকবাহিনীকে আজ সমুচিত জবাব দেওয়া যায়। দীর্ঘসময় অপেক্ষার পর বেলা আনুমানিক ৩টার দিকে পাকবাহিনীর কনভয় সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছিল। কনভয়ের প্রথম গাড়িটি যখন বিকল্প রাস্তার উপর দিয়ে এগিয়ে আসছিল, ঠিক তখনই পেতে রাখা মাইনটির বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের সাথে সাথে পাকবাহিনীর একটি জিপ ও একটি ট্রাক মুহূর্তের মধ্যে উড়ে যায়। জিপটিতে সেসময় পাকবাহিনীর অনেক সৈন্য ছিল। এই অ্যাম্বুসে বহু পাকসেনা হতাহত হয়। অ্যাম্বুসটি সফলভাবে সম্পন্ন করে মুক্তিফৌজরা সেখান থেকে নিরাপদে তেলিয়াপাড়া হেডকোয়ার্টারে ফিরে আসেন।


মাধবপুর বাগসাইর গ্রামে অ্যাম্বুস করতে গিয়ে রণাঙ্গনে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের জীবনে এক নতুন অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়। দেশকে শত্রুমুক্ত করতে গিয়ে তাঁকে নানারকম সংকটের অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু মহান রাব্বুল আলামিনের অপার দয়ার বরকতে তিনি সব সংকট অসীম সাহসিকতার সাথে মোকাবিলা করে নিরাপদে রক্ষা পেয়েছেন। মাধবপুর বাগসাইর গ্রামের অ্যাম্বুসের ভয়াবহ পরিস্থিতির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান বলেন, “আমার যখনই মাধবপুরের ঘটনা মনে পড়ে, তখনই আমার শরীর শিউরে ওঠে। আমার আগে কখনো জানা ছিল না যে, বিষধর সাপ মানুষের কথা বুঝতে পারে এবং নির্দেশ পালন করে। তখন রাত আনুমানিক আড়াইটা বা তিনটা হবে। বনের ভিতর চারিদিক নীরব নিস্তব্ধ, কোথাও কোনো সাড়া শব্দ নেই। অন্ধকার রাত, কিছুই দেখা যায় না। এমন সময় আমি আমার শরীরটা সামান্য একটু নাড়া দেই। এতে আমার হাত কীসের উপর যেন পড়ল। আমি হাতে ঠাণ্ডা অনুভব করলাম। যুদ্ধের সময় অন্ধকারে আলো জ্বালালে শত্রু সেনারা টের পেয়ে গুলি ছুড়বে। এমতাবস্থায় আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ মনে পড়ল ছোটো টর্চের কথা। সেই টর্চটি অন করার পর আমি দেখি আমার অতি নিকটে একটি বিষধর সাপ কণ্ডুলি পাকিয়ে আছে। আমি নার্ভাস না হয়ে দ্রুত উঠে বসলাম। মুহূর্তের মধ্যে সাপটি ফণা তুলে ফোঁস ফোঁস করা শুরু করল। পাকহানাদার বাহিনীকে দেখলে আমার রক্ত টগবগ করে ওঠে, অথচ এই দৃশ্য দেখে আমার শরীরে যেন সাপের শরীরের চেয়েও বেশি ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল। এদিকে সাপটা ফণা তুলে আমার দিকে শুধু ফোঁস ফোঁস করছে। আমি অবাক হলাম সাপটি আমাকে দংশন করতে পারতো, কিন্তু তা করেনি। এমতাবস্থায় আমি সাপটিকে উদ্দেশ করে বললাম, ‘তুমি যাঁর সৃষ্টি, আমিও তাঁরই সৃষ্টি। তুমি তোমার কাজে যাও, আর আমাকে আমার কাজ করতে দাও’। আল্লাহর কী মহিমা! এই কথা বলার সাথে সাথে সাপটি উদ্ধত ফণা ছেড়ে মন্থর গতিতে বনের ভিতর চলে গেলো।”


মাধবপুর বাগসাইর গ্রামের অ্যাম্বুসের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান আরো বলেন, “অ্যাম্বুসের ২দিন আগে থেকে আমাদের পেটে একমুঠো ভাত পড়েনি। আমরা মুক্তিফৌজ সবাই চানাচুর খেয়ে ২দিন অতিবাহিত করি। রাতের অন্ধকারে এন্টি ট্যাংক মাইন স্থাপন করার পর প্রবল বৃষ্টির মধ্যে বসে আমরা পাক সৈন্যদের আগমনের অপেক্ষা করেছিলাম, আর সাথে থাকা চানাচুর খাচ্ছিলাম। কিন্তু আল্লাহর রহমতে কোনো ক্লান্তিবোধ করিনি, বরং মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার দৃঢ় বাসনা আমাদের জাগ্রত করে তুলছিল। আমাদের চোখে সামান্য তন্দ্রা পর্যন্ত আসেনি। আমরা সারারাত পাক সেনাদের জন্য অধীর আগ্রহে বসেছিলাম। কিন্তু তখন পর্যন্ত তারা আসেনি। এমতাবস্থায় লে. মোর্শেদ সামান্য বিশ্রাম নেওয়ার জন্য আমাদের পাশের একটি গ্রামে নিয়ে যান। আমাদেরকে দেখেই গ্রামবাসীরা বুঝতে পারলেন আমরা মুক্তিফৌজ। তারা অত্যন্ত খুশি হয়ে যান। আমাদের ভেজা কাপড় বদলানোর জন্য তারা দ্রুত শুকনা কাপড় এনে দিলেন। শুধু তাই নয়, তারা আমাদেরকে খাওয়ানোর জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন। গ্রামবাসীর আন্তরিকতায় আমরা মুগ্ধ হয়ে গেলাম, আমাদের সকল কষ্ট যেন নিমিষেই দূর হয়ে গেল। কিন্তু তাদের আপ্যায়ন আমরা গ্রহণ করতে পারলাম না। কেননা একটু পরেই বিকট শব্দে মাইন বিস্ফোরিত হয়। আমাদের সারা রাতের শ্রম সফল হলো। পাকবাহিনীর একটি কনভয় সিলেট থেকে ঢাকার দিকে যাচ্ছিল, মাইন বিস্ফোরিত হয়ে তা সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়। এতে তাদের একটি জিপ ও একটি ট্রাক ধ্বংস হয় এবং কয়েকজন সৈন্য হতাহত হয়। গ্রামবাসীর অনুরোধ সত্ত্বেও আমরা সেখান থেকে অন্যত্র চলে যাই। সেদিন আমি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করলাম যে, সৃষ্টির মাঝে যেমন আনন্দ আছে, ধ্বংসের মাঝেও আনন্দ আছে। এই আনন্দ আছে বলেই সত্যিকার দেশপ্রেমিকেরা হাসতে হাসতে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে পারেন।”


উল্লিখিত যুদ্ধগুলো ছাড়াও সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান তেলিয়াপাড়ায় অ্যাম্বুস, মনতলা যুদ্ধ, মুকুন্দপুরে প্রত্যক্ষ যুদ্ধসহ আরো অনেক গেরিলা আক্রমণে অংশগ্রহণ করেন।

বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী
মুকুন্দপুরে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান হেজামারায় ৩নং সেক্টর হেড কোয়ার্টারে ১১তম ইস্ট বেঙ্গলের অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে অবস্থান করছিলেন। এই প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান বলেন, “দিনটি ছিল ২০ নভেম্বর, ১৯৭১। সেদিন প্রচণ্ড কামানের শব্দে হেজামারার হেড কোয়ার্টারে সমস্ত মুক্তিযোদ্ধার ঘুম ভেঙ্গে যায়। আমরা বুঝতে পারলাম মকুন্দপুরে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। আর এটিই ছিল পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে মুক্তিফৌজদের দেশ শত্রুমুক্ত করার প্রত্যক্ষ আক্রমণ। ফলে সকাল থেকে ৩নং সেক্টরের ১১তম ইস্টবেঙ্গলকে সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়।


প্রচণ্ড গোলাগুলি শব্দের মধ্যেই ১১তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের শিবিরে ঈদুল ফিতর নামাজের জামাতের আয়োজন করা হয়। সমস্ত অফিসার ও মুক্তিসেনারা বিষন্ন মন নিয়ে ঈদের নামাজে যোগ দেন। বরাবরের মতো সকল ধর্মীয় অনুষঙ্গ পরিচালনা-সহ ঈদের জামাতের ইমামতির দায়িত্বও ছিল সূফী সম্রাট হুজুরের উপর। জামাত শুরু হলো, একদিকে আত্মীয় স্বজনের বিচ্ছেদ যাতনা, অন্যদিকে কখনো দেশ স্বাধীন হবে কিনা, ইত্যাদি সংশয়ে সবাই তখন দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে ঈদের জামাতের খুৎবা শুনছিল।


মহান রাব্বুল আলামিনের কী অপার মহিমা! তিনি বাঙালি জাতির প্রতি তাঁর দয়া ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। খুৎবার মাঝেই স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী প্রদান করা হলো। সেদিন সমস্ত মুক্তিফৌজকে উদ্দেশ করে সূফী সম্রাট হুজুর বলেছিলেন, “আল্লাহর কসম! আগামী বকরা ঈদের আগে দেশ স্বাধীন হবে। আমি আপনাদের নিয়ে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ঈদুল আজহার নামাজ আদায় করব।” (তাফসীরে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮৭০)


উল্লেখ্য যে, সেদিন সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের আবেগময়ী বক্তব্য শুনে উপস্থিত মুক্তিফৌজ সবাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তিনি খুৎবা দিতে গিয়ে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন, “ঈদের চাঁদ ফিরে যাও তাদের কাছে, যারা আমার মা বোনদের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে।” সেসময় কেউ কেউ পিতা-মাতা, ভাই-বোন ও আত্মীয় স্বজনের কথা স্মরণ করে দু’চোখের পানি ফেলে অঝোর নয়নে কাঁদতে ছিলেন।


সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান প্রদত্ত স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী এবং তা বাস্তবায়নের ঘটনাটি পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা এই ঐতিহাসিক ঘটনাটি প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী ছিলেন, তারা তাদের লিখিত গ্রন্থ ও বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকা এবং বাণীতে গুরুত্ব সহকারে উপস্থাপন করেন।


১১তম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের অ্যাডজুটেন্ট মেজর নাসির উদ্দিন ‘যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতা’ গ্রন্থের ৩১৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন যে, “২০শে নভেম্বর। সেদিন ছিল ঈদ। প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দের মধ্যেই ১১তম ইষ্ট বেঙ্গল শিবিরে অনুষ্ঠিত হলো ঈদের জামাত। সৈনিক এবং অফিসার অনেকেই বিষন্ন মন নিয়ে যোগ দিল নামাজে। মুনাজাতের সময় ইমাম অঝোরে কাঁদছিলেন। তিনি বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির জন্য সৃষ্টিকর্তার অনুকম্পা চাইলেন।”


মহান আল্লাহর অপার দয়ায় ঈদের দিন বিকেলে মুক্তিফৌজরা অসীম সাহসিকতার সাথে পাকবাহিনীকে পরাজিত করে মুকুন্দপুরে ঘাঁটি দখল করে ফেলেন। এই যুদ্ধে বহু পাকিস্তানী সৈন্য মারা যায় এবং অনেক সৈন্য আহত হয়। এছাড়া ৩১ জন পাকসেনা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দি হয় এবং মুক্তিবাহিনী ২টি এলএমজি, ২টি স্টেনগান, ১টি ৩” মর্টার, ২৭টি রাইফেল-সহ বিপুল পরিমান সমরাস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করে। এই যুদ্ধের একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল, মুক্তিফৌজদের মধ্যে কেউ কোনো মারাত্মক আঘাত পাননি।

মুকুন্দপুরের বিজয় মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মবিশ্বাসকে আরো সুদৃঢ় করে এবং এই বিজয় স্বাধীনতার পথে তাদেরকে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা জোগায়। মূলত এই বিজয় ছিল সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ। কেননা তিনি দুপুরে বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করেন, আর সেদিন বিকেলের মধ্যেই মুক্তিবাহিনী মুকুন্দপুর থেকে পাকবাহিনীকে পরাস্ত করেন।
মূলত বীর মুক্তিযোদ্ধা সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান যে জন্মগতভাবে একজন অলী-আল্লাহ্, তা তাঁর শুভজন্ম থেকে শুরু করে বিভিন্ন ঘটনা দ্বারা প্রকাশ পেয়েছে। তাই মহান আল্লাহ্ তাঁর বন্ধুর পবিত্র মুখ থেকে নিঃসৃত ঈদের জামাতের খুৎবা মহান আল্লাহ্ কবুল করে নিলেন। আল্লাহর বন্ধু সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী প্রদান করার পর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর আল্লাহ্ তায়ালার বিশেষ রহমত বর্ষিত হতে থাকে।


উল্লেখ্য যে, সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের ঐতিহাসিক ভবিষ্যদ্বাণীর মাত্র ২৭ দিন পর, ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে এবং তিনি ঢাকার তদানীন্তন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে অনুষ্ঠিত ঈদুল আজহার জামাতে ইমামতি করেন।

[লেখক: মোহাম্মদী ইসলামের নেতৃত্ব প্রদানকারী ইমাম; পরিচালক, সমন্বয়ক ও সমস্যার ফয়সালাকারী, দেওয়ানবাগ শরীফ; প্রফেসর, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি]

সম্পর্কিত পোস্ট