Cancel Preloader

মু‘জিঝাতুল আম্বিয়া (পর্ব-০৪)

হযরত আদম (আ.)-এর প্রার্থনায় স্বর্ণ ও রৌপ্যের উৎপত্তি যেভাবে হলো
হযরতুল আল্লাম এমরান হোসাইন মাজহারী
মহান আল্লাহ্ আমাদের প্রতিপালক, তিনি জগতসমূহ সৃষ্টি করেছেন। আর সকল সৃষ্টির রিজিকের দায়িত্ব তিনি নিয়েছেন। আল্লাহ্ বলেন- “ভূপৃষ্ঠে বিচরণকারী সকলের রিজিকের দায়িত্ব আল্লাহ্রই।” (সূরা হুদ ১১ : আয়াত ৬)
রিজিকদাতা এতই দয়ালু যে, সৃষ্টি তাঁর সাথে অন্যায় করার পরেও দয়াময় আল্লাহ্ রিজিক প্রদান করে থাকেন। মহান আল্লাহ্র অসংখ্য সৃষ্টিরাজির মধ্যে আশরাফুল মাখলুকাত হলো মানুষ। যাদেরকে মহান আল্লাহ্ অনেক ভালোবেসে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ করে তৈরি করেছেন। পরম করুণাময় আল্লাহ্ মানুষ সৃষ্টির পর মানবের কল্যাণের জন্য সকল ব্যবস্থা তিনি করেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি মানুষের সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য স্বর্ণ ও রৌপ্য তৈরি করেছেন। যাতে করে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ এ স্বর্ণ ও রৌপ্যের দ্বারা উপকৃত হতে পারে।
মহান আল্লাহ্ তাঁর বান্দাকে পার্থিব জীবনে যেমনিভাবে স্বর্ণ ও রৌপ্য দ্বারা সুশোভিত করেছেন, তেমনিভাবে মু’মিনদেরকে জান্নাতে সুশোভিত করবেন। স্বর্ণ ও রৌপ্য একটি মূল্যবান ও অতীব প্রয়োজনীয় সম্পদ। যা অতীতকাল থেকে অদ্যাবধি মানুষ ব্যবহার করছে। এ অতীব প্রয়োজনীয় মূল্যবান সম্পদ স্বর্ণ ও রৌপ্য মহান রাব্বুল আলামিন কখন, কীভাবে উৎপত্তি করেছেন, এ বিষয়টি আমরা অনেকেই অবগত নই। হযরত মাওলানা তাহের সুরাটী (ভারত) কর্তৃক প্রণীত কুরআন ও হাদিসের আলোকে ‘কাসাসুল আম্বিয়া’ নামক কিতাব থেকে হুবহু উপস্থাপন করা হলো-
স্বর্ণ ও রৌপ্যের উৎপত্তি
‘হযরত আদম (আ.) তখন বার্ধক্যে উপনীত হয়েছেন। তাঁর সন্তানসন্তুতির মোট সংখ্যা ছিল ২৩৯ জন এবং বর্ণনান্তরে ৩৬১ জন তা আগেই উল্লেখ করেছি। তাঁর সমস্ত সন্তানই জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি হয়েছিল। তবু সন্তানদের মোট সংখ্যা বেজোড় হবার কারণ হল, তাঁর একজন সন্তান শীস (আ.) ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন একাকী। তাঁর সাথে তাঁর কোনো বোন সৃষ্টি হলো না। আর এ শীস (আ.)-ই ছিলেন নুরে মোহাম্মদীর ধারক। হযরত আদম (আ.) হতে নুরে মোহাম্মদী হযরত শীস (আ.)-এর ললাটে স্থান লাভ করেছিল। হযরত আদম (আ.)-এর পর তিনি নবি আদম (আ.)-এর স্থলবর্তী আল্লাহ্র বিধান প্রচারক।
হযরত আদম (আ.)-এর বার্ধক্যকাল, এমনকি তাঁর ওফাতের সময় পর্যন্ত একমাত্র পুত্র হাবীল ব্যতীত কোনো সন্তানই মৃত্যুবরণ করেননি। আর কাবীলের মৃত্যু সম্পর্কে তাঁর কোনো খোঁজখবর ছিল না। এ দুজন ব্যতীত তাঁর নিজ সন্তানের সংখ্যা ২৩৯ বা ৩৬১ জন হলেও উক্ত সন্তানদের সন্তানসন্তুতিতে হযরত আদম (আ.)-এর জীবদ্দশায় বনি আদম বা আওলাদের মোট সংখ্যা (৪০০০) চার হাজারে পৌঁছেছিল এবং হযরত আদম (আ.)-এর ওফাতের পূর্বে এদের কারও মৃত্যু হয়নি।
উল্লিখিত সংখ্যক মানব সন্তানের পৃথিবীতে প্রাথমিক অবস্থায় ভরণ-পোষণের সমস্যা সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। তখন কৃষি কাজের প্রচলন যদিও হয়েছিল, তবু তাদের প্রয়োজনের চাহিদা অনুসারে তা পর্যাপ্ত ছিল না। তখন হযরত আদম (আ.)-এর বংশধরগণ একদিন তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে বলল যে, ওহে! আপনি তো বার্ধক্যে উপনীত হয়েছেন, অতএব আপনি জীবিত থাকতেই আমাদের জন্যে এমন একটি বস্তু রেখে যান, যার দ্বারা আমরা স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে জীবিকা নির্বাহ করতে পারি।
বংশধরদের কথা শুনে হযরত আদম (আ.) আল্লাহ্র দরবারে হাত উঠিয়ে মোনাজাত করলেন- “হে মাবুদ! আপনি তো সবই জানেন। এইমাত্র আমার নিকট আমার বংশধরগণ কী কথা বলে গেল, তাও আপনি অবগত। এখন আপনি আমার জন্য একটি ব্যবস্থা করে দিন যার মাধ্যমে আমি আমার বংশধরদের খুশি করতে পারি।”
হযরত আদম (আ.)-এর দোয়া শুনে আল্লাহ্ তায়ালা ফেরেশতা জিব্রাইলকে আদেশ করলেন হে জিব্রাইল! তুমি বেহেশত হতে দু’মুষ্টি র্স্বর্ণ ও রূপা নিয়ে গিয়ে আদমের কাছে দিয়ে আস। জিব্রাইল সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ্র আদেশ মতো দু’মুষ্টি স্বর্ণ ও রৌপ্য এনে হযরত আদম (আ.)-এর হাতে দিলেন। তিনি বললেন, হে জিব্রাইল (আ.)! এ সামান্য স্বর্ণ ও রৌপ্য দ্বারা চার হাজার লোকের কী উপকার হবে? এর দ্বারা তারা কী করতে পারবে? এতেই কী তাদের প্রয়োজন মিটবে?
জিব্রাইল (আ.) বললেন, আল্লাহ্ পাক আদেশ করেছেন, এ স্বর্ণ ও রৌপ্যটুকু আপনি পাহাড়ের উপরে নিক্ষেপ করুন এবং তাদেরকে বলুন, ঐ পাহাড় হতে কিছু কিছু স্বর্ণ-রৌপ্য নিয়ে যেন ব্যবসা-বাণিজ্য করে। এতে তাদের যে পরিমাণ মুনাফা হবে, তা দ্বারাই তারা সচ্ছলভাবে জীবন যাপন করতে পারবে। আর ঐ স্বর্ণ-রৌপ্য কোনোদিনই শেষ হবে না, যখন তাদের প্রয়োজন তখনই যেন তারা ঐ পাহাড় হতে প্রয়োজন মতো স্বর্ণ-রৌপ্য নিয়ে আসে।
হযরত আদম (আ.) বাস্তবিক ঐ স্বর্ণ ও রৌপ্য একটি পাহাড়ের উপরে নিক্ষেপ করলেন তখন হতে তাঁর বংশধরগণ ঐভাবে স্বর্ণ-রৌপ্য নিয়ে তা দ্বারা ব্যবসা-বাণিজ্য করে সুখে শান্তিতে কালাতিপাত করতে লাগল।
বলাবাহুল্য যে, এর আগে জমিনে কোনো স্বর্ণ-রৌপ্য ছিল না। হযরত আদম (আ.)-এর দোয়ায় এভাবে সেদিনই পৃথিবীতে স্বর্ণ ও রৌপ্যের আবির্ভাব ঘটেছে। পৃথিবীতে এখন যে স্বর্ণ-রৌপ্য রয়েছে, তা সবই সে স্বর্ণ ও রৌপ্যের অংশ। মহান আল্লাহ্ পাকের অসীম কুদরতে সে সামান্য পরিমাণ স্বর্ণ ও রৌপ্য আপনা হতে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে সারা দুনিয়ায় এখন যে কী পরিমাণে পৌঁছেছে তা অনুমান করা সম্ভব নয়।’
স্বর্ণ ও রৌপ্য ব্যবহার প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ বলেন- “নারী, সন্তান, রাশিকৃত স্বর্ণ-রৌপ্য আর চিহ্নিত অশ্বরাজি, গবাদিপশু এবং ক্ষেত-খামারের প্রতি আকর্ষণ মানুষের জন্য সুশোভিত করা হইয়াছে। এইসব ইহজীবনের ভোগ্য বস্তু। আর আল্লাহ্, তাঁহারই নিকট রহিয়াছে উত্তম আশ্রয় স্থল।” (সূরা আলে ইমরান ৩ : আয়াত ১৪)।
দয়াময় আল্লাহ্র প্রতি অবনত মস্তকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি যে, তিনি আমাদের আদি পিতা বাবা আদম (আ.)-এর প্রার্থনায় জগতে আদম সন্তানদের জন্য যে মূল্যবান সম্পদ স্বর্ণ ও রৌপ্য দান করেছেন এর ফলে আজও আমরা এর দ্বারা উপকৃত হচ্ছি। রাব্বুল আলামিনের নিকট প্রার্থনা এ মূল্যবান সম্পদ নিজের জীবনে অর্জনের মাধ্যমে ইহলৌকিক কল্যাণ করার মাধ্যমে তাঁর ইচ্ছায় জীবন পরিচালনা করে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
[লেখক: গবেষক, আল কোরআন গবেষণা কেন্দ্র, খতিব, বাবে রহমত, দেওয়ানবাগ শরীফ; ইসলামি আলোচক, বিভিন্ন টিভি চ্যানেল এবং সমন্বয়ক, দেওয়ানবাগীর দল ওলামা মিশন বাংলাদেশ।]

সম্পর্কিত পোস্ট