Cancel Preloader

যাকাত: একটি পর্যালোচনা – ইমাম প্রফেসর ড. কুদরত এ খোদা

যাকাতের সংজ্ঞা

যাকাত শব্দের অর্থ বৃদ্ধি, পবিত্রতা। যাকাত দানে যাকাতদাতার সম্পদ বাস্তবে কমে না, বরং বৃদ্ধি পায় এবং যাকাতদাতা কৃপণতার কলুষতা থেকে পবিত্রতা লাভ করে। প্রকৃতপক্ষে সম্পদের যাকাত আদায় করলে সম্পদ পবিত্র হয় এবং এতে বরকত নাজিল হয়ে বৃদ্ধি পায়। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ বলেন “খুয মিন আমওয়ালিহিম সাদাক্বাতান তুত্বাহহিরুহুম ওয়া তুঝাক্কীহিম বিহা ওয়া সাল্লি ‘আলাইহিম, ইন্না সালাতাকা সাকানুল লাহুম।” অর্থাৎ- “[(হে রাসুল (সা.)!] আপনি তাদের সম্পদ থেকে সদকা গ্রহণ করুন, যাতে তা দিয়ে আপনি তাদের পবিত্র করবেন এবং পরিশুদ্ধ করবেন। আর আপনি তাদের জন্য দোয়া করুন। নিশ্চয় আপনার দোয়া তাদের জন্য চিত্ত স্বস্তিকর (অন্তরে প্রশান্তি এনে দেবে)।” (সূরা আত তাওবাহ ৯ : আয়াত ১০৩)

শরিয়তের পরিভাষায় যাকাত বলা হয়, নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক কর্তৃক বছরান্তে তার সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ যাকাতের হকদার ব্যক্তিকে প্রদান করা। নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকের উপর যাকাত আদায় করা ফরজ। যাকাত ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে চতুর্থ স্তম্ভ। ইমান, নামাজ ও রোজার পরেই যাকাতের স্থান।

যাকাতের নিসাব

যে পরিমাণ সম্পদ থাকলে যাকাত দিতে হয় সেই পরিমাণকৃত সম্পদকে ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় যাকাতের নিসাব বলে। কোনো স্বাধীন, সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন ও প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলমান যদি সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা (প্রায় ৬১৩ গ্রাম) অথবা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ (প্রায় ৮৮ গ্রাম) কিংবা সমমূল্যের টাকা বা ব্যবসায়িক মালের মালিক হয়, তবে এ মালকে শরিয়তের পরিভাষায় ‘যাকাতের নিসাব’ বলা হয়। উক্ত মাল এক বছর কাল তার মালিকানাধীন থাকলে তার উপর যাকাত আদায় করা ফরজ হবে।যে ব্যক্তি উল্লিখিত পরিমাণ মালের মালিক হবে, তাকে মালিকে নিসাব বা সাহিবে নিসাব বলা হয়। অবশ্য এ মাল ঋণমুক্ত এবং তার মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত হতে হবে। উক্ত মালের চল্লিশ ভাগের এক ভাগ হিসাবে অর্থাৎ একশত টাকায় দুই টাকা পঞ্চাশ পয়সা হারে হিসাব কষে যাকাত আদায় করে দিতে হবে। যাকাত দিতে হবে সন্তুষ্টচিত্তে। মনে রাখতে হবে, এ পৃথিবীতে আমি কোনো সম্পদ নিয়ে জন্মগ্রহণ করিনি। আমার সকল সম্পদই আল্লাহ্ প্রদত্ত, যার কাছে আমাকে ফিরে যেতে হবে। সুতরাং আমি আল্লাহ্ প্রদত্ত সম্পদ থেকে তাঁর নির্দেশ মোতাবেক যাকাত আদায় করছি।

যে সমস্ত বিষয়ের যাকাত দিতে হয়

১। স্বর্ণ ও রৌপ্য: কারো মালিকানায় নিসাব (উল্লিখিত হিসাব অনুযায়ী সম্পদ) পরিমাণ স্বর্ণ-রৌপ্য থাকলে এবং তা এক বছর স্থায়ী হলে তার উপর ঐ স্বর্ণ-রৌপ্যের যাকাত আদায় করা ফরজ। এ স্বর্ণ-রৌপ্য যে অবস্থায়ই থাকুক, অলংকার আকারে ব্যবহৃত বা অব্যবহৃত ব্যাংকে, এমনকি কারো নিকট গচ্ছিত অথবা ব্যবসায়ী পণ্য হিসেবে কোনো পাত্র ইত্যাদি আকারে থাকুক। মোটকথা যে অবস্থায়ই থাকুক অবশ্যই তার যাকাত আদায় করতে হবে।

২। ব্যবসায়ী পণ্যের যাকাত: ব্যবসায়ী পণ্য যে প্রকারেরই হোক যদি এর মূল্য স্বর্ণ বা রৌপ্যের নিসাব পরিমাণ হয় এবং এক বছর কাল স্থায়ী ও মুক্ত হয়, তাহলে পূর্ণ মালের (শতকরা ২.৫০) চল্লিশ ভাগের একভাগ যাকাত হিসেবে আদায় করতে হবে।
৩। অর্থের যাকাত: নগদ টাকা, ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট ও সঞ্চয়পত্র, যদি নিসাব পরিমাণ হয়, তাহলে এর যাকাত দেওয়া ফরজ।
(ক) বাড়ি ভাড়া বাবদ যা আয় হয়, যথানিয়মে এতে যাকাত দেওয়া ফরজ।
(খ) শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যবসায় নিসাব পরিমাণ টাকা হলে তার যাকাত দেওয়া ফরজ।

৪। পশুর যাকাত: (ক) উট কমপক্ষে ৫টি এক বছর মালিকানায় থাকলে যাকাত দেওয়া ফরজ। (খ) গরু বা মহিষ ৩০টি এক বছর মালিকানায় স্থায়ী হলে যাকাত দেওয়া ফরজ। (গ) ছাগল, ভেড়া, দুম্বা কমপক্ষে এক বছর বয়সী ৪০টি হলে যাকাত দেওয়া ফরজ।

৫। কৃষিজাত পণ্যের যাকাত: ধান, গম, যব, খেজুর ও আঙ্গুর প্রভৃতি শস্য ও ফলমূল বিনা সেচে বৃষ্টির পানিতে জন্মিলে অল্প হোক বা বেশি হোক সামষ্টিক ফসলের দশ ভাগের এক ভাগ যাকাত হিসেবে দিতে হয়। একে ‘ওশর’ (এক দশমাংশ) বলে। এই সব ফসল সেচের মাধ্যমে জন্মিলে সামষ্টিক ফসলের বিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত হিসেবে দিতে হয়।

যাকাত প্রদানের খাত

যাকাতের মাল যাদেরকে দেওয়া বৈধ, শরিয়তের পরিভাষায় যাকাতের খাত হিসেবে তাদেরকে বুঝায়। পবিত্র কুরআনে যাকাত প্রদানের আটটি খাত বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ বলেনÑ “ইন্নামাস সাদাক্বাতু লিলফুক্বারাই ওয়াল মাসাকীনি ওয়াল ‘আমিলীনা ‘আলাইহা ওয়াল মুআল্লাফাতি ক্বুলূবুহুম ওয়া ফির রিক্বাবি ওয়াল গারিমীনা ওয়া ফী সাবীলিল্লাহি ওয়াবনিস সাবীলি, ফারীদ্বাতাম মিনাল্লাহি, ওয়াল্লাহু ‘আলীমুন হাকীম।” অর্থাৎ- “যাকাত তো শুধু তাদের হক, যারা গরিব, মিসকিন, যারা যাকাত আদায়ের কাজে নিযুক্ত, যাদের অন্তর (ইসলামের দিকে) আকৃষ্ট করা প্রয়োজন, দাস মুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহ্র পথে এবং মুসাফিরদের জন্য; এটি আল্লাহ্র নির্ধারিত বিধান। আল্লাহ্ সবকিছু জানেন, তিনি মহাবিজ্ঞানী।” (সূরা আত তাওবাহ ৯ : আয়াত ৬০)

যাকাতের খাতসমূহের ব্যাখ্যা

১। ফকির বা গরিব: যে ব্যক্তি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক নয়, সে ব্যক্তি ইসলামি শরিয়তে গরিব বলে গণ্য।

২। মিসকিন: মিসকিন বলা হয় এমন ব্যক্তিকে, যার কিছুই নেই এবং সে মানুষের কাছে হাত পেতে বেড়ায়। পানাহার ও পোশাকপরিচ্ছদের জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী থাকতে হয়।

৩। ‘আমিল’ তথা যাকাত আদায়ের কাজে নিযুক্ত কর্মচারী: হযরত রাসুল (সা.) মুসলমানদের থেকে যাকাত আদায়ের জন্য অনেক সাহাবিকে দায়িত্ব দিয়ে তাদেরকে বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করতেন। অতঃপর আদায়কৃত যাকাত থেকেই তাদের পারিশ্রমিক দেওয়া হতো।

৪। ‘মুয়াল্লাফাতুল ক্বুলূব’ তথা যাদের অন্তর ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করা প্রয়োজন: মোহাম্মদী ইসলামের প্রতি অন্তর আকৃষ্ট করার জন্য যাকাতের অর্থ প্রদান করা। ইসলামের স্বর্ণযুগে এদের কিছু ছিল মুসলমান, কিছু অমুসলিম। অর্থাৎ মুসলমানদের মধ্যে কেউ ছিল চরম অভাবগ্রস্ত এবং নও মুসলিম, এদের অন্তর ইসলামের দিকে আকর্ষণের জন্যই এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়, যেন ধর্মের প্রতি তাদের বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয়। অমুসলিমদের মধ্যেও এমন অনেকে ছিল, যাদের শত্রæতা থেকে বাঁচার জন্য তাদের সন্তুষ্ট রাখার দরকার ছিল। পাশাপাশি ধর্মের প্রতি তাদের আকৃষ্ট করা।

৫। দাস মুক্তির জন্য: যে লোক কারো মালিকানাধীন দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ, সে সাধারণ গরিব-মিসকিনদের তুলনায় আরো অধিক কষ্টে আছে।

৬। ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি: যে লোক কারো কাছে ঋণী এবং পাওনাদার ঋণ পরিশোধের জন্য বারবার তাগাদা করছে, কিন্তু সে তা আদায় করতে পারছে না।

৭। আল্লাহ্র পথে: প্রেরিত মহামানবের নির্দেশ সত্তে¡ও যারা কেবল অর্থের অভাবে আল্লাহ্র পথে শরিক হতে পারছে না। এমনিভাবে যে ব্যক্তি সৎকাজ কিংবা এমন ইবাদত করতে চায়, যাতে অর্থের প্রয়োজন।

৮। মুসাফির: যার কাছে সফরকালে প্রয়োজনীয় অর্থ-সম্পদ নেই, স্বদেশে তার যত অর্থ-সম্পদই থাকুক না কেন, এমন মুসাফিরকে যাকাতের মাল দেওয়া যেতে পারে, যাতে করে সে তার সফরের প্রয়োজনাদি সমাধান করতে পারে এবং স্বদেশে ফিরে যেতে সমর্থ হয়।

যারা যাকাত পাওয়ার অধিক হকদার

উল্লিখিত ব্যক্তিদের যে কাউকে যাকাত দিলে যাকাত আদায় হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যাকাত দিতে এ বিষয়গুলো স্মরণে রাখা উত্তম। অনাত্মীয় গরিব, মিসকিনের তুলনায় আত্মীয় গরিব মিসকিন অধিক হকদার। আত্মীয়ের মধ্যে সর্বাধিক হকদার যাকাত দাতার আপন ভাই, তারপর বোন, তারপর ভাই-বোনের সন্তানগণ, তারপর চাচা, তারপর ফুপু, তারপর মামা, তারপর খালা, তারপর রক্তের সম্পর্কিত অন্যান্য আত্মীয় এবং তাদের পরবর্তী হকদার প্রতিবেশি।

যাকাতের হাকিকত

যাকাত হচ্ছে ‘ইবাদতে মালি’ বা আর্থিক ইবাদত। মহান আল্লাহ্র দয়ায় বান্দা সম্পদ উপার্জন করে থাকে। ধনী মুসলমানের জন্য আল্লাহ্র হুকুমে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থেকে যাকাতের সম্পদ আল্লাহ্র ঘোষণা অনুযায়ী ৮ শ্রেণির লোককে প্রদান করা আবশ্যক। আল্লাহ্র হুকুমে নির্ধারিত হিসাব অনুসারে যাকাত আদায় করলে বান্দার সম্পদ পবিত্র হয়।


ধনী ও গরিবের সম্পদের মাঝে সমন্বয় করাই হচ্ছে যাকাতের হাকিকত। ধনী মুসলমান সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলবে, অপরদিকে তার অপর মুসলিম ভাই সম্পদের অভাবে না খেয়ে কষ্টে জীবনযাপন করবে, এটা ইসলাম সমর্থন করে না। ধনীদের সম্পদে গরিব মুসলমানদেরও হক রয়েছে। ধনী মুসলমানগণ আল্লাহ্র বিধান অনুযায়ী যাকাত আদায় করার ফলে তাদের সম্পদ পবিত্র হওয়ার পাশাপাশি সম্পদে বরকত বৃদ্ধি পায়। অপরদিকে যাকাতের সম্পদ লাভ করায় গরিব মুসলমান আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে এবং মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্রে দারিদ্র্য বিমোচন দ্রæত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়। যাকাতের বিধান মুসলিম সমাজে বাস্তবায়িত হলে ধনী ও গরিবের মাঝে বৈষম্য দূর হয়। এমনকি এর ফলে ধনী ও দরিদ্রের বৈষম্যের কারণে সমাজে সংঘটিত চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, খুন ও সন্ত্রাসের মতো অপরাধ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়।


আল্লাহ্র অলীগণ আর্থিক যাকাত আদায়ের পাশাপাশি মানুষকে মহান আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের জ্ঞান বিতরণ করে আত্মিকভাবে যাকাত আদায় করেন।

[লেখক: মোহাম্মদী ইসলামের নেতৃত্ব প্রদানকারী ইমাম; পরিচালক, সমন্বয়ক ও সমস্যার ফয়সালাকারী, দেওয়ানবাগ শরীফ; প্রফেসর, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।]

সম্পর্কিত পোস্ট