Cancel Preloader

সারাবিশ্বে একই দিনে ইসলামি অনুষ্ঠান পালনের পদ্ধতি

মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী, সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান
[সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজান রচিত ‘সূফী সম্রাটের যুগান্তকারী ধর্মীয় সংস্কার’ ১ম খণ্ড কিতাব থেকে লেখাটি সংকলন করা হয়েছে।-সম্পাদক]


বর্তমান বিশ্বে আমরা প্রায় ১৭০ কোটি মুসলমান বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক সীমারেখার অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও নিজেদেরকে এক আল্লাহ্র বান্দা এবং এক রাসুল (সা.)-এর উম্মত হিসেবে স্বীকার করি। আমরা একই কুরআনের অনুসারী এবং শ্রেষ্ঠ ইবাদত নামাজ আদায়ের জন্যে একই কাবাকে কেব্লা করে থাকি। অথচ ঈদসহ অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান বিশ্বব্যাপী একই দিনে প্রতিপালনের পরিবর্তে বিভিন্ন দিনে উদ্যাপন করে থাকি। এমনকি ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনে চান্দ্রমাস গণনার বিজ্ঞান ভিত্তিক সুনির্দিষ্ট কোনো পদ্ধতি না থাকায় একই দেশের মুসলমানগণ ভিন্ন ভিন্ন দিনে একই ধর্মানুষ্ঠান পালনের নজিরও রয়েছে। এর ফলে মুসলমানদের মধ্যে কোন্দলের সৃষ্টি হয় এবং ধর্মানুষ্ঠান পালন অনেক ক্ষেত্রে নিষ্ফল হয়ে যায়।


এরূপ আচরণ মুসলমানদেরকে বিধর্মীদের কাছে কেবল হেয় প্রতিপন্নই করে না, ধর্ম পালনে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যও ব্যাহত করে। একই ধর্মানুষ্ঠান বিভিন্ন দিনে পালনকে পবিত্র কুরআন, হাদিস ও ফেকায় সমর্থন করে না। কেননা অনুষ্ঠান পালনে দিনের বিভিন্নতা মুসলিম সংহতিকে বিনষ্ট করে। অথচ পরিতাপের বিষয় হচ্ছে এই যে, আমরা এ ব্যাপারে উদাসীন থেকে একই দিনে ধর্মানুষ্ঠান পালনের স্বপক্ষে মাযহাবের ইমামগণের তাগিদ পর্যন্ত উপেক্ষা করি। আমাদের সমাজে প্রচলিত ধারণা হলো, আমাদের দেশে যে কোনো ধর্মানুষ্ঠান সৌদি আরবের চেয়ে ২/১ দিন পরে অনুষ্ঠিত হবে। এর বৈধতা ও সার্থকতা নিয়ে আমরা কখনো চিন্তা করি না। একই ধর্মানুষ্ঠান বিভিন্ন দিনে পালনের কুফল ও এর ফলে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা নিরসনের লক্ষ্যে আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা.) মুসলিম বিশ্বের জন্যে পালনীয় বিজ্ঞান ভিত্তিক একটি চান্দ্রপঞ্জিকা প্রবর্তন করেন। বিভিন্ন দিনে একই ধর্মানুষ্ঠান পালনের ভ্রান্ত রীতি ইসলাম ধর্মের গৌরব ক্ষুণœকারী। তাই হযরত ওমর (রা.)-এর আমলে প্রবর্তিত আট বছর চক্রের চান্দ্রপঞ্জিকা পুনরুদ্ধার ও মুসলিম বিশ্বে তা পুনঃপ্রবর্তনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি।
মুসলমানগণ বিশ্বব্যাপী জুমার নামাজ একই দিনে অর্থাৎ শুক্রবারে আদায় করে থাকেন। কোথাও একদিন আগে বা একদিন পরে জুমার নামাজ আদায় করা যেরূপ অন্যায়, বিভিন্ন দিনে একই ধর্মানুষ্ঠান পালন করা তদ্রুপ অন্যায় নয় কি? এখন কোনো মুসলমানকে যদি এক/দুই দিন পর জুমার নামাজ পড়তে বলা হয়, তবে আমরা কি তা মেনে নেবো? যদি মেনে না নিই তাহলে এক/দুই দিন বিলম্বে ঈদ কিংবা রোজা পালনকে কীভাবে সঠিক বলে মেনে নিচ্ছি? তাছাড়া উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে কেউ যদি বাংলাদেশ থেকে রোজা রেখে সৌদি আরব গমন করেন, সেখানে গিয়ে তিনি দেখবেন, ঈদ পালিত হচ্ছে। আবার সৌদি আরব থেকে যদি কেউ ঈদের নামাজ পড়ে ঢাকার উদ্দেশে বিমান যাত্রা শুরু করেন, তবে এখানে পৌঁছে দেখবেন, রোজা পালিত হচ্ছে। এমতাবস্থায় সৌদি আরব ও বাংলাদেশে রোজা পালনের ক্ষেত্রে ২/১ দিনের পার্থক্য থাকায় ভ্রমণকারী কারো জন্যে রোজা হবে ২৮ দিনের আবার কারো জন্যে ৩২ দিনের হবে, যা কোনোমতেই ইসলামের বিধিসম্মত নয়।


আল্লাহ্ আমাদের প্রভু। আর ইসলাম হচ্ছে তাঁর মনোনীত একমাত্র পূর্ণাঙ্গ ও শান্তিময় জীবন ব্যবস্থা। আল্লাহ্কে প্রভু হিসেবে মেনে নিলে ধর্মানুষ্ঠান পালন অবশ্যই তাঁর মনোনীত সময়ে হওয়া প্রয়োজন। এর অন্যথা করলে তাঁর রহমত ও বরকত লাভের পরিবর্তে অসন্তুষ্টি ও লাঞ্ছনা ভোগ করতে হবে। ধর্মানুষ্ঠান পালনে আল্লাহ্ কর্তৃক মনোনীত ও পছন্দনীয় সময় কোনটি, সেই সম্পর্কে পবিত্র কুরআন, হাদিস ও মাযহাবের ইমামগণের সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠির মনগড়াভাবে এর সময় নির্ধারণের কোনো সুযোগ নেই। যুগে যুগে আল্লাহ্র মনোনীত প্রতিনিধিগণ আল্লাহ্র কাছ থেকে ধর্মানুষ্ঠান পালনের সঠিক সময় অবগত হন এবং মানুষকে তা জানিয়ে দেন।


ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হওয়া সত্ত্বেও তা সঠিকভাবে পালন না করার ফলে আজ বিশ্বের মুসলমানগণ নানা সমস্যায় জর্জরিত। প্রকৃতপক্ষে অসময়ে ধর্মানুষ্ঠান পালনে কোনো সার্থকতা নেই। যেমন, পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, রমজান মাসে শবে কদরের ইবাদত হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও উত্তম। এমনিভাবে ১০ই মহররম তারিখের আশুরা, ৯ই জিলহজ তারিখে হজ, ১০ই জিলহজ তারিখে কোরবানি, ১৪ই শাবান তারিখে শবে বরাত, ২৭শে রজব তারিখে শবে মি‘রাজ ইত্যাদি অনুষ্ঠানগুলো চাঁদের বিভিন্ন মাসের নির্দিষ্ট তারিখে উদ্যাপনের জন্যে পবিত্র কুরআন ও হাদিসে নির্দেশ রয়েছে। অন্য সময় এগুলো পালন করলে কোনো লাভ হবে না। বরং অনেক ক্ষেত্রে পরিশ্রম বৃথা যাওয়া কিংবা বিপরীত ফল প্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকে। কোনো দানশীল ব্যক্তির প্রতিশ্র“ত দান গ্রহণের জন্যে নির্দিষ্ট তারিখ ছাড়া অন্য সময় হাজির হলে যেমন খালি হাতে ফিরে যেতে হয়, তেমনি অসময়ে ধর্মানুষ্ঠান পালনকারী ব্যক্তি কেয়ামতের দিন আল্লাহ্র কাছ থেকে খালি হাতে ফিরবে।


তাছাড়া ইসলাম ধর্মমতে রোজার দিনে পানাহার করা কিংবা ঈদের দিনে রোজা রাখা হারাম। তাই তারিখ নির্ধারণের হেরফেরের কারণে যদি রোজা ও ঈদ পালনের ক্ষেত্রে ভুল করি, তবে আল্লাহ্র নিষেধ অমান্য করায় সীমালংঘনকারী হিসেবে আমরা কি আযাবগ্রস্ত হবো না? অধিকন্তু, এ ধর্মানুষ্ঠান কেউ একদিন আগে, কেউ একদিন পরে আবার কেউবা উভয় দিন পালন করায় সঠিক দিন কোনটিÑ প্রত্যেকের মনে এ সন্দেহ থেকে যায়। ফলে সন্দেহমুক্ত না হতে পারায় কারো ইবাদত আল্লাহ্র কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। কেননা সন্দেহযুক্ত ইবাদত বন্দেগি অশুদ্ধ। হাদিস শরীফে বলা হয়েছে- “বিশ্বাসযোগ্য বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করা যেমন অশুদ্ধ, সন্দেহজনক বিষয়ে বিশ্বাস করাও তেমনি অশুদ্ধ।”


একই ধর্মানুষ্ঠান বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রে বিভিন্ন দিনে উদ্যাপন কিংবা একই রাষ্ট্রে বিভিন্ন দিনে উদ্যাপনের ফলে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ, কলহ ও দলাদলির মনোভাব সৃষ্টি করে এবং বিশ্ব মুসলিম সংহতি ও ভ্রাতৃত্ব ব্যাপকভাবে ক্ষুণœ হয়। ইসলাম একটি পরিপূর্ণ ধর্ম। এর কোনো বিধিবিধান অসম্পূর্ণ কিংবা ত্র“টিপূর্ণ থাকতে পারে না। আবার ইসলাম একটি বিজ্ঞান ভিত্তিক ধর্ম। তাই মানুষের জন্যে ইসলামের বিধি-নিষেধ হবে বিজ্ঞানসম্মত। বর্তমানে জ্ঞান বিজ্ঞানে উন্নত বিশ্বে মুসলমানদের ধর্মানুষ্ঠান পালনের তারিখ নির্ধারণের বিভিন্নতা অবৈজ্ঞানিক বা বিজ্ঞানের পরিপন্থী। আধুনিক বিশ্বে একই নবির অনুসারী হয়ে আমরা মুসলমানেরা একই ধর্মানুষ্ঠান বিভিন্ন দিনে পালনের মাধ্যমে নিজেদেরকে অন্য ধর্মাবলম্বীদের কাছে হেয় ও হাস্যকর করে তুলছি। পৃথিবীর মেরু অঞ্চল, যেখানে ছয় মাস রাত কিংবা ছয় মাস দিন থাকে, সেখানে বসবাসকারী মুসলমান কীভাবে চাঁদ দেখে রোজা রাখবে কিংবা ঈদ পালন করবে? স্বভাবতই প্রশ্ন আসতে পারেÑ চাঁদ দেখে মাস গণনার পদ্ধতি এরূপ সমস্যার সমাধান দিতে সক্ষম কিনা? তাই মেরু অঞ্চলে এবং অদূর ভবিষ্যতে চাঁদে কিংবা মহাশূন্যে বসবাসকারী মানুষের জন্যে চাঁদের তারিখ গণনা করা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই।
ঠিক সময়ে ধর্মানুষ্ঠান পালনের জন্যে সবার আগে জানা দরকারÑ ঠিক সময় কোনটি? প্রিয় নবি হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর জীবদ্দশায় মুসলমানগণ তাঁর নির্দেশে ধর্মানুষ্ঠান পালন করেছেন। এজন্যে তখন কোনো পঞ্জিকা দেখার প্রয়োজন ছিল না। মহানবি (সা.) আল্লাহ্র কাছ থেকে নির্দেশ পেয়ে সেই অনুসারে তিনি উম্মতদেরকে ধর্মানুষ্ঠান পালনের নির্দেশ দিতেন। যতদিন মুসলিম বিশ্বের পরিধি আরবে সীমাবদ্ধ ছিল, ততদিন পঞ্জিকার সাহায্য ছাড়াই হযরত রাসুল (সা.)-এর নির্দেশমত ধর্মানুষ্ঠান পালন সম্ভব ছিল। এমনকি খোলাফায়ে রাশেদিনের সময় পর্যন্ত আল্লাহ্ কর্তৃক মনোনীত ব্যক্তির নির্দেশে ধর্মানুষ্ঠান পালন করা কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু হযরত ওমর (রা.)-এর খেলাফতকালে মুসলিম রাষ্ট্রের পরিধির বিস্তৃতির কারণে এবং দ্রুত যোগাযোগের কোনো মাধ্যম না থাকায় ধর্মানুষ্ঠান পালনে ও রাষ্ট্রীয় কাজ পরিচালনার জন্য একটি সুষ্ঠু পঞ্জিকা অনুসরণ করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। আমিরুল মু’মিনিন হযরত ওমর ফারুক (রা.) তখন হযরত ওসমান (রা.), হযরত আলী (রা.) ও অন্যান্য বিশিষ্ট সাহাবি এবং তৎকালীন পণ্ডিতবর্গের পরামর্শক্রমে গণনা ভিত্তিক একটি চান্দ্রপঞ্জিকা প্রবর্তন করেন। তখন থেকেই হিজরি সন গণনার প্রচলন হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, বিজ্ঞানের চরম উন্নতির যুগে আমরা যে হিজরি পঞ্জিকা অনুসরণ করছি সেটা গণনা ভিত্তিক নয়, চাঁদ দেখার উপর নির্ভরশীল। অথচ ‘সময়’ দেখার কোনো বিষয় নয়, গণনার বিষয়। ইসলামের প্রাথমিক যুগে ঘড়ি ছিল না। তাই চন্দ্র ও সূর্যকে ব্যবহার করে সময় গণনার নির্দেশ পবিত্র কুরআনে দেওয়া হয়েছে এভাবে- “তিনিই সৃষ্টি করেছেন বিশ্রামের জন্য রাত ও গণনার জন্যে সূর্য ও চন্দ্র। এ সবই পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞের নির্ধারণ।” (সূরা আনআম ৬: আয়াত ৯৬) চাঁদ ও সূর্যকে ব্যবহার করে যে সঠিকভাবে সময় গণনা করা যায়, সে সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “তিনি এমন সত্তা যিনি বানিয়েছেন সূর্যকে প্রচণ্ড দীপ্তিময় এবং চন্দ্রকে স্নিগ্ধ আলোকময় এবং নির্ধারিত করেছেন এর জন্য মনজিল যাতে তোমরা জানতে পার বছরের গণনা ও হিসাব। আল্লাহ্ এসব নিরর্থক সৃষ্টি করেননি। তিনি বিশদভাবে বিবৃত করেন আয়াতসমূহ সেসব লোকের জন্য যারা জ্ঞান রাখে।” (সূরা ইউনুস ১০: আয়াত ৫)


তখন বছর গণনার একক ছিল ‘মাস’ ও মাস গণনার একক ছিল ‘দিন’। এক সূর্যোদয় থেকে পরবর্তী সূর্যোদয় কিংবা এক সূর্যাস্ত থেকে পরবর্তী সূর্যাস্ত পর্যন্ত ছিল একটি নির্দিষ্ট তারিখের দিনের মেয়াদ। ক্ষুদ্রতর সময়ের একক গণনার পদ্ধতি আবিষ্কারের পর দিনের ২৪ ভাগের ১ অংশ হয়েছে ঘন্টা, ঘন্টার ৬০ ভাগের ১ অংশ হয়েছে মিনিট। এখন ইলেকট্রনিক ঘড়ির কল্যাণে সেকেন্ডের শতাংশ সঠিকভাবে মাপা কোনো ব্যাপার নয়। এমনকি ১০০ বছরের নির্ভুল পঞ্জিকাও এখন ঘড়ির মধ্যেই বিদ্যমান। সে যুগে ঘড়ি না থাকায় দিন ও রাত্রিকে ভিত্তি করে বর্ষ গণনার হিসেব করার কথা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ হয়েছে- “আমি রাত ও দিনকে দুটি নিদর্শন করেছি। রাতের নিদর্শনকে করেছি আলোকহীন ও দিনকে করেছি আলোকময়, যাতে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার ও যাতে বর্ষ সংখ্যা ও হিসাব স্থির করতে পার।”(সূরা বনী ইসরাইল ১৭: আয়াত ১২)


হযরত রাসুল (সা.)-এর আমলে আধুনিক যুগের ন্যায় ঘড়ি আবিষ্কৃত হয়নি বলে সময় গণনা করার একক ছিল দিন। সূর্যোদয় কিংবা চন্দ্রোদয় থেকে দিন গণনা করা হতো। আকাশের দিকে তাকিয়ে সূর্য ও চন্দ্রের উদয় কিংবা অস্ত সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া লাগত। রমজানের দিনে ইফতারের সময় জানার জন্যে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো। আমাদের দেশেও ঘড়ির ব্যাপক ব্যবহার শুরুর আগে ইমাম সাহেবগণ কাঠির ছায়া মেপে যোহর ও আছর নামাজের সময় নির্ধারণ করতেন। এখন ঘড়ির ব্যবহার খুব ব্যাপক। আধুনিক যুগে সময় মাপার একক হচ্ছে ‘সেকেন্ডে‘, এমনকি সেকেন্ডের ভগ্নাংশ এখন হাত ঘড়িতেই মাপা যায়। ইলেকট্রনিক ঘড়িতে সময়ের গণনা এতই যথার্থ যে, এর কোনো হের-ফের সমন¦য় করতেও হয় না। আমরা নিশ্চিন্তে এ ঘড়ির উপর নির্ভর করি, ঘড়ি ধরেই আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম চলে, সূর্যের বা চাঁদের দিকে তাকিয়ে আমাদের অফিস আদালত চলে না। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সঠিক সময় গণনা করে ঘড়ি দেখেই আমরা সাহ্রি-ইফতারসহ নামাজের সময় নির্ধারণ করতে সক্ষম হই। প্রায় দেড় হাজার বছর আগে হযরত ওমর (রা.) চান্দ্রমাস গণনার বিজ্ঞান ভিত্তিক যে সমাধান মুসলমানদের দিয়ে গেছেন, বিধর্মীদের চক্রান্তে আজ আমরা তা হারিয়ে ফেলেছি। আট বছর চক্রের প্রাচীন সেই চান্দ্রপঞ্জিকা পুনঃপ্রবর্তনের মাধ্যমে সঠিক সময়ে একই সাথে বিশ্বব্যাপী ধর্মানুষ্ঠান পালন করা সম্ভব।


হযরত রাসুল (সা.)-এর যুগে ঘড়ি আবিষ্কৃত হয়নি, তাই সূর্যের অবস্থানকে মান হিসেবে ধরে আল্লাহ্ তায়ালা নামাজের সময় নির্ধারণ করে দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে এ প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে- “ওয়াআক্বিমিস্ সালাতা তারাফাইন্নাহারি ওয়াঝুলাফাম মিনাল্লাইলি।” অর্থÑ “নামাজ কায়েম করো, দিনের দুই প্রান্তভাগে ও রাতের প্রথম অংশে।”(সূরা হুদ ১১: আয়াত ১১৪) অন্যত্র বলেন- “তোমরা সন্ধ্যায় ও সকালে আল্লাহ্র পবিত্র মহিমা কীর্তন করো। আর বিকাল ও দুপুরে। আকাশ ও পৃথিবীতে সকল প্রশংসা তাঁরই।” (সূরা রূম ৩০: আয়াত ১৭-১৮)


প্রাচীনকালে আরব অঞ্চলে পঞ্জিকা হিসেবে চান্দ্রমাস অনুসরণ করা হলেও বর্ষ গণনার কোনো সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি প্রচলিত ছিল না। তাই ঋতু পরিবর্তন ও ফসল ফলানোর হিসাব রাখার সুবিধার্থে চান্দ্রবর্ষকে সৌরবর্ষের সাথে সমন¦য় সাধন করার জন্যে ১৩ বা ১৪ চান্দ্রমাসে বছর গণনা করা হতো। এ ভ্রান্তরীতির অবসানকল্পে আল্লাহ্ তায়ালা ঘোষণা দিলেন- “আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহ্র বিধানে আল্লাহ্র কাছে মাস গণনায় মাস বারটি, তার মধ্যে চারটি মাস নিষিদ্ধ, এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান।” (সূরা তাওবাহ্ ৯: আয়াত ৩৬)


হযরত মোহাম্মদ (সা.) মক্কা হতে মদীনায় হিজরত করার এক বছর পর আল্লাহ্ তায়ালা মুসলমানদের উপর রোজার বিধান প্রবর্তন করেন। তিনি তখন সাহাবাগণকে ডেকে রমজানের রোজা থাকার নির্দেশ দিলেন। তাঁরা জিজ্ঞেস করেন, “ইয়া রাসুলাল্লাহ্! আমরা কবে থেকে রোজা রাখবো? তখন আরবে চান্দ্র বছর গণনার কোনো সুষ্ঠু নিয়ম না থাকাতে এবং মুসলমানরা স্বল্প পরিসরে মদীনা ও তার উপকন্ঠে বসবাস করতো বিধায় হযরত মোহাম্মদ (সা.) ফরমান- “তোমরা চাঁদ দেখে রোজা রাখ ও চাঁদ দেখে রোজা ভাঙ্গ, অর্থাৎÑ ঈদ করো।” সেসময় মুসলমানদের মধ্যে এ বিধান চলতে থাকে, কিন্তু পরবর্তীতে দিনে দিনে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং মুসলিম রাষ্ট্রের পরিধি মদীনা থেকে স্ফীত হয়ে সমগ্র আরব জাহানে ছড়িয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় মুসলমানরা যাতে সুষ্ঠু ও সঠিকভাবে ধর্ম-কর্ম করতে পারে, সেজন্যে হযরত মোহাম্মদ (সা.) তাঁর শেষ জীবনে চান্দ্র মাস গণনার উপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি ফরমান- “আমরা উম্মি লোক। লিখতেও পারি না, হিসাব রাখতেও জানি না। মাস হয় এই, এই ও এইতে। এই বলে তিনি দুই হাতের দশ আঙ্গুল তিনবার দেখালেন এবং তৃতীয়বারে (এক হাতের) বৃদ্ধ আঙ্গুল বন্ধ রাখলেন। অর্থাৎÑ ঊনত্রিশ দিনে। অতঃপর ফরমান, “মাস হয় এই, এই ও এইতে। এই বলে তিনি দুই হাতের দশ আঙ্গুল তিন বার দেখালেন। অর্থাৎÑ পূর্ণ ত্রিশ দিনে। কাজেই এক বার ঊনত্রিশ দিনে আরেক বার ত্রিশ দিনে।” (বোখারী ও মুসলিম)। তখন থেকে মুসলিম জাতি চাঁদ দেখার পরিবর্তে চান্দ্র মাস গণনার পদ্ধতি অনুসরণ করতে শুরু করে। কিন্তু বর্ষ গণনার সুনির্দিষ্ট কোনো পদ্ধতি তখন পর্যন্ত অনুসৃত হতো না।


ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা আমিরুল মু’মিনিন হযরত ওমর ফারুক (রা.)-এর খেলাফতকালে তিনি রাষ্ট্রীয় কার্যের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামি নীতি অবলম্বন করার চেষ্টা করেন। তিনি ভাবলেন, মুসলমান জাতি সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি হওয়া সত্ত্বেও কেন অমুসলিমদের সৌরপঞ্জিকার সাথে মিলিয়ে সন গণনা করবে? মুসলিম জাতির বর্ষগণনার জন্যে আলাদা একটি হিসাব থাকা উচিৎ। এছাড়াও সরকারি কাজ-কর্মে সুষ্ঠু রেকর্ড রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে তিনি চান্দ্র বর্ষ গণনার একটি স্বতন্ত্র রীতির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন।
হযরত ওমর ফারুক (রা.) এ ব্যাপারে একটি সুষ্ঠু সমাধান বের করার জন্যে তাঁর উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হযরত ওসমান (রা.), হযরত আলী (রা.), হযরত তালহা (রা.), হযরত জুবায়ের (রা.) প্রমুখ বিশিষ্ট সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে বৈঠকে বসেন। তাঁরা সবাই বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে এর সমাধানের জন্যে বিভিন্ন প্রস্তাব উত্থাপন করলেন। হিজরি সন গণনা শুরু করার ব্যাপারে কেউ কেউ প্রস্তাব করেন- হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর জন্ম তারিখ থেকে; আবার কেউবা বলেন, মক্কা বিজয়ের তারিখ থেকে। এভাবে বিভিন্ন জনে বিভিন্ন রকম প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু হযরত আলী (রা.) বললেন, মুসলিম ইতিহাসে হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আল্লাহ্র দ্বিনকে প্রতিষ্ঠার জন্যে হযরত রাসুল (সা.) সবকিছুর মায়া উপেক্ষা করে সাহাবাদের নিয়ে মাতৃভূমি পরিত্যাগ করেন। সুতরাং এ হিজরতের ঘটনাকে অবিস্মরণীয় করার জন্যে ঐ তারিখ থেকে বর্ষ গণনা করা উচিৎ। হযরত আলী (রা.)-এর প্রস্তাব সবার মনঃপুত হলো। সবাই একবাক্যে এ প্রস্তাব মেনে নিলেন। তখন আমিরুল মু’মিনিন হযরত ওমর ফারুক (রা.) হযরত রাসুল (সা)-এর চান্দ্র মাস গণনার পদ্ধতিকে বাস্তবায়ন করে হিজরতের বছর থেকে সন গণনা শুরু করেন এবং এ পঞ্জিকার নামকরণ করেন হিজরি পঞ্জিকা। সেসময় থেকে সমগ্র মুসলিম জাহানে হিজরি পঞ্জিকার ব্যবহার শুরু হয় এবং মুসলিম বিশ্বে একই সাথে ইসলামি অনুষ্ঠানাদি পালন হতে থাকে। হযরত ওমর (রা.) কর্তৃক পঞ্জিকা প্রবর্তনের ইতিহাস ঊহপুপষড়ঢ়বফরধ ড়ভ ইৎরঃধহরপধ-এ উল্লেখ করা আছে। তিনিই মহররম মাস থেকে বর্ষ গণনার প্রচলন করেন এবং এ মাসের দিনের সংখ্যা ৩০ ধরা হয়। পরবর্তী মাসসমূহ ক্রমান¦য়ে ২৯ ও ৩০ দিন ধরে নবম মাস রমজানকে ৩০ দিনে গণনা করা হয় এবং তারাবি নামাজের সুবিধার্থে পবিত্র কুরআনকে ৩০ পারায় বিভক্ত করা হয়।


আল্লাহ্ তায়ালা চন্দ্র ও সূর্যকে সময় গণনার জন্যে সৃষ্টি করেছেন বলে পবিত্র কুরআনে উল্লেখ আছে। বর্তমানে প্রচলিত জুলিয়ান বা খ্রিষ্টীয় বর্ষপঞ্জি সূর্যভিত্তিক সময় গণনা পদ্ধতির একটি উৎকৃষ্ঠ উদাহরণ। এ পঞ্জিকা অনুসারে খ্রিষ্টানগণ তাদের ধর্মানুষ্ঠান পালন করে থাকেন। সম্পূর্ণ গণনা ভিত্তিক হওয়ায় এ পঞ্জিকা অনুসারে বিশ্বব্যাপী তারিখের কোনো হেরফের করার সুযোগ নেই। ফলে সারাবিশ্বের খ্রিষ্টান বিশ্বব্যাপী একই দিনে এবং একই তারিখে ধর্মানুষ্ঠান পালনে সক্ষম। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২৫শে ডিসেম্বর বা বড়ো দিনের অনুুষ্ঠান বিশ্বব্যাপী একই দিনে উদযাপিত হয়Ñ কোথাও ২/১ দিনের তারতম্য হয় না। সূর্যোদয়ের সময়ের পার্থক্য হেতু পৃথিবীর পূর্ব দিকের দেশসমূহে দিন শুরু হয় আগে। এজন্যে পৃথিবীর আহ্নিক গতি দায়ী। এ সময়ের পার্থক্যকে মেনে নিয়ে বিভিন্ন দেশের স্থানীয় সময় গণনার সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। প্রত্যেক দেশের স্থানীয় সময় অনুসারে তারিখের শুরু ও শেষ গণনা করা হয়। যেখানে দিন শুরু হয় দু’ঘন্টা আগে, সেখানে দু’ঘন্টা আগেই অনুষ্ঠান শুরু হয়। অনুরূপভাবে গণনাভিত্তিক চান্দ্রপঞ্জিকা অনুসরণের মাধ্যমে মুসলমানদের ধর্মানুষ্ঠান বিশ্ব্যব্যাপী একই দিনে উদ্যাপন করা সম্ভব। বিভিন্ন দেশের মধ্যে বিদ্যমান স্থানীয় সময়ের পার্থক্য হেতু যেমন জুমার নামাজের ওয়াক্তের তারতম্য হওয়া সম্ভব কিন্তু বারের ক্ষেত্রে কোনো তারতম্য হয় না। (চলবে)
[লেখক: প্রতিষ্ঠাতা, দেওয়ানবাগ শরীফ]

সম্পর্কিত পোস্ট