Cancel Preloader

আদর্শ সমাজ গঠনে সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লার শিক্ষা – কামরুজ্জামান বাবু

বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতিপালক মহান রাব্বুল আলামিন। তিনি বিপুলা এই ধরণীর মাঝে নানান বিস্ময়কে লুক্কায়িত করে রেখেছেন। কখনো সুপ্তাবস্থায়, আবার কখনো প্রস্ফুটিত অবস্থায়। কেবল জ্ঞান বিকাশের মাধ্যমেই এর যথার্থ উপলব্ধি করা যায়। আল্লাহ্র সৃষ্ট জগত একটি নির্দিষ্ট নিয়মে আবর্তিত হচ্ছে। প্রতিদিন সূর্য যেমন পূর্ব দিকে উঠে, আবার পশ্চিম দিকে অস্তমিত হয়, তেমনি দিনের পর রাত সংঘটিত হয়। এটিই প্রকৃতির নিয়ম। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ মতে জানা যায়, সূর্য যেদিন পশ্চিম দিকে উদিত হবে, সেদিন কিয়ামত (মহাপ্রলয়) সংঘটিত হবে। সুতরাং বলা যায়, যদি কখনো নিয়মের বিপরীত কিছু ঘটে তবে সৃষ্টি তার ভারসাম্য হারায় এবং একসময় ধ্বংস হয়ে যায়।
আমরা প্রতিদিনই আমাদের সমাজের চারপাশে নানা ধরনের অনিয়ম ও উচ্ছৃঙ্খলতা দেখতে পাই, যা মহান প্রভুর নীতিবিরুদ্ধ। যা প্রকৃতি ও সমাজের জন্যও হুমকিস্বরূপ। এরূপ পরিস্থিতি দীর্ঘসময় অতিবাহিত হলে সমাজের ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং প্রকৃতিও তার ভারসাম্য হারায়। তাছাড়া মানুষের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয় এবং জনজীবনে অশান্তি নেমে আসে। এমতাবস্থায় প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখতে মহান প্রভু তাঁর প্রতিনিধিদেরকে জাতির জন্য মোর্শেদ তথা শিক্ষকরূপে প্রেরণ করেন। মহান প্রভুর প্রতিনিধিদেরকে নবুয়তের যুগে নবি-রাসুল বলে অভিহিত করা হয়েছে আর বেলায়েতের যুগে অলী-আল্লাহ্ (আল্লাহ্র বন্ধু) বলা হয়। মহান প্রভু কর্তৃক প্রেরিত মহামানবগণ জগতে আগমন করে মানুষকে আদর্শ মানুষ, সমাজকে আদর্শ সমাজ, রাষ্ট্রকে আদর্শ রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁরা মানুষকে সঠিক শিক্ষা দিয়ে সুপথে পরিচালিত করেন। বেলায়েতের যুগের তেমনি একজন মহামানব ছিলেন সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ- খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.)। যিনি সাধনার মাধ্যমে মহান আল্লাহ্র পক্ষ থেকে বহু আধ্যাত্মিক লকবে ভূষিত হয়েছিলেন। তিনি জীবদ্দশায় মানুষকে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষার পাশাপাশি আদর্শ সমাজ গঠনের শিক্ষা দিয়েছিলেন। ‘আদর্শ সমাজ গঠনে সূফী সম্রাট হুজুরের শিক্ষা’ শিরোনামে তাঁর এই মহান কর্মযজ্ঞ উপস্থাপন করব। তার আগে সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক জগতে মহামানব বা আল্লাহ্র প্রতিনিধি আগমনের প্রেক্ষাপট।
মহামানব আগমনের সূচনা
মহান আল্লাহ্র সৃষ্টির মাঝে অন্যতম সৃষ্টি হলো মানুষ। এই মানুষের মাঝে মহান প্রভু স্বীয় রুহ হতে রুহ ফুঁকে দেওয়ার মাধ্যমে জগতে প্রতিনিধি প্রেরণ শুরু করেছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, “যখন আমি তাকে সুঠাম করব এবং তার মধ্যে আমার রুহ থেকে ফুঁকে দেবো, তখন তোমরা তার প্রতি সিজদাবনত হবে।” (সূরা হিজর ১৫: আয়াত ২৯) মূলত এটি আদি পিতা হযরত আদম (আ.)-এর জীবনপ্রবাহ থেকে পরিস্ফুট হয়েছে। তখন থেকেই মানব জাতি এবং শিক্ষক বা আল্লাহ্র প্রতিনিধি আগমনের সূচনা হয়। এই শিক্ষকগণই যুগে যুগে আবির্ভূত হয়ে মানুষকে সঠিক শিক্ষা দিয়ে পৃথিবী, রাষ্ট্র ও সমাজের ভারসাম্য বজায় রাখেন।
আদর্শ সমাজ গঠনে সূফী সম্রাট হুজুরের শিক্ষা
জগতে মহামানবগণ জাতির পথপ্রদর্শক হিসেবে আগমন করে থাকেন। তাঁরা মানুষকে সরল ও সঠিক পথে পরিচালিত করেন এবং তাদেরকে আদর্শ জাতি হিসেবে গড়ে তুলেন। ফলে এই জাতির দ্বারাই আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে উঠে। তদ্রুপ সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) জাতি, ধর্ম, বর্ণ ভেদ না করে সবাইকে আদর্শ সমাজ গঠনের শিক্ষা দিয়েছেন। আদর্শ সমাজ গঠনে সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজানের শিক্ষাসমূহ উপস্থাপন করা হলো-
আত্মশুদ্ধির শিক্ষা
আমাদের সমাজে যত অনিয়ম, উচ্ছৃঙ্খলতা দেখা যায় তার সবই ব্যক্তির দ্বারা সংঘটিত হয়। সমাজ কখনো মন্দ হয় না। ব্যক্তি সমাজকে মন্দ করে তোলে। সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজান এই বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন সমস্যাটি সমাজের নয়, সমস্যাটি ব্যক্তির। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, আদর্শ সমাজ গঠন করতে প্রথমে ব্যক্তিকে শুদ্ধ করা জরুরি। তাই তিনি বলতেন, “আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে ব্যক্তি শুদ্ধ হয় এবং ব্যক্তি শুদ্ধির মাধ্যমে সমাজ শুদ্ধ হয়।” তিনি আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে ব্যক্তিকে শুদ্ধ করে আদর্শ সমাজ গঠনের শিক্ষা দিয়েছেন।
দিল জিন্দা
ভালো-মন্দ বিচার না করে নিজের ইচ্ছাশক্তির জোরে যে কোনো কাজ করার মতো লোকের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। হোক সেই কাজ উত্তম অথবা নিকৃষ্ট। এরকম ব্যক্তিকে ‘বালহুম আদাল’ অর্থাৎ ‘পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট’ বলা হয়েছে। এরকম কর্ম প্রবণতার অন্যতম কারণ হলো হৃদয়ঙ্গম বোধ না থাকা অর্থাৎ আত্মোপলব্ধি করার ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া। মানুষের হৃদয় বা দিল পাপ কর্মের কারণে পুণ্য কর্ম থেকে সরে যায়। দীর্ঘদিনের পাপ কর্মের অভ্যাস পুণ্য কর্ম থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। এভাবেই একসময় ভালো-মন্দ বিচার করার ক্ষমতা লোপ পেতে থাকে। এরূপ মানবহৃদয়কে মৃত হৃদয়ের সাথে তুলনা করা হয়। মৃত দিল বা হৃদয়ের অধিকারী মানুষের দ্বারা কখনো আদর্শ সমাজ গঠন করা যায় না বরং সমাজে অশান্তি সৃষ্টি হয়। সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজান বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি মানুষকে দিলজিন্দার শিক্ষা দিয়েছিলেন। এই শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে মানুষ সূক্ষ্ম ও সুচারুরূপে বিচার করার ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে আদর্শ সমাজ গঠনে সক্ষম হবেন।
সাম্যের শিক্ষা
আমাদের চারপাশে একে অন্যকে তাচ্ছিল্য বা ছোটো-বড়ো করে দেখার মতো লোকের সংখ্যাও কম দেখা যায় না। অর্থের দিক থেকে, ক্ষমতার দিক থেকে, গোত্রের দিক থেকে, ধর্ম ও সম্প্রদায়ের দিক থেকে, জ্ঞানের দিক থেকে, সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে অর্থাৎ চতুর্দিকে অসমতা বিরাজমান। সকল মানুষ একই গ্রহে বাস করার পরেও একে অন্যের সাথে ভেদাভেদ করে। ফলে সৃষ্টি হয় দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার, ক্ষমতার অপব্যবহার ও বৈষম্যের। একসময় এ থেকে নানান ধরনের অপরাধ সৃষ্টি হয়। এরূপ পরিস্থিতিতে সমতা বা সাম্যের চর্চা করা অতীব জরুরি, যা আমাদের সমাজে বিলুপ্তপ্রায়। অতীতে অনেক দার্শনিক এই সাম্য নীতির কথা বললেও এর চর্চা বর্তমানে নেই বললেই চলে। সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজান এই নীতির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করলেন এবং এই মহান শিক্ষার বিস্তৃতি ঘটাতে আরম্ভ করলেন। তিনি জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, ধনী-গরিব নির্বিশেষে সকলকে এক প্ল্যাটফরমে উন্নীত করেন। এই শিক্ষার বাস্তব প্রতিফলন ঘটানো ব্যতীত কোনো সমাজ গঠিত হলে তা কখনোই আদর্শ সমাজ হবে না, বরং তা হবে বৈষম্যের সমাজ। সুতরাং আদর্শ সমাজ গঠন করতে হলে সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজানের সাম্যের শিক্ষা চর্চার বিকল্প নেই।
চরিত্রবান হওয়ার শিক্ষা
সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজান ৭১ বছরের জীবনের অধিকাংশ সময় মানুষকে চরিত্রবান হওয়ার শিক্ষা দিয়েছিলেন। পাপ পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত মানুষের মাধ্যমে কখনোই আদর্শ সমাজ গঠন সম্ভব নয়। তাসাউফবিহীন সমাজে চরিত্রবান ব্যক্তির সংখ্যা মুষ্টিমেয়। তারা আবার পারিপার্শ্বিক চাপে নিজেদের গুটিয়ে চলাফেরা করতেন। সূফী সম্রাট হুজুর বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন যে, আদর্শ সমাজ ব্যবস্থার মানদণ্ড হলো আদর্শ মানুষ। চরিত্রহীন মানুষ কখনো আদর্শ মানুষ হতে পারে না। যে সমাজে আদর্শ মানুষ যত বেশি, সেই সমাজ তত বেশি উন্নত ও অনুসরণীয়। আদর্শ মানুষের মানদণ্ড হলো চরিত্র। তাই একজন মানুষকে আদর্শ মানুষে পরিণত হতে হলে তাকে চরিত্রবান হতে হবে। সেই লক্ষ্যে সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজান মানুষকে চরিত্রবান হওয়ার বিদ্যা চর্চার কথা বলতেন। তিনি বলেন, “চরিত্রই ধর্মের মূল। যার চরিত্র নেই, তার কোনো ধর্ম নেই।” চরিত্রবান ব্যক্তিই পারে আদর্শ সমাজ গঠন করতে। তাই বলা যায়, পূর্ববর্তী অন্যান্য মহামানবের ন্যায় আদর্শ সমাজ গঠনের লক্ষ্যে সূফী সম্রাট হুজুর মানুষকে চরিত্রবান হওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন।
সামগ্রিক পর্যালোচনা
মানব জাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে মহান প্রভু সমাজ ব্যবস্থার সাথে যুগোপযোগী করে অসংখ্যা মহামানব প্রেরণ করেছেন। তাঁরাও মানুষকে আদর্শ সমাজ গঠনের লক্ষ্যে আত্মশুদ্ধি ও চরিত্রবান হওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন। কালের পরিক্রমায় মানুষ যখন মহামানবের অনুসরণ ছেড়ে দিয়ে অজ্ঞতায় পর্যবসিত হয়, তখনই একজন মহামানবের আবির্ভাব ঘটে থাকে। যিনি ধর্মকে সজীব করার পাশাপাশি আদর্শ সমাজ গঠনের শিক্ষা দেন। তাঁর পূর্বেও অসংখ্যা মহামানব এই শিক্ষা দিয়েছেন। বর্তমানেও কোনো না কোনো মহামানব এই শিক্ষা দিচ্ছেন এবং ভবিষ্যতেও এই শিক্ষা মহামানবগণ দিয়ে যাবেন। তবে আদর্শ সমাজ গঠনে সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজানের যে শিক্ষা পদ্ধতি তা বর্তমান সময়োপযোগী। তাঁর এই শিক্ষা লাভ করে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষ নিজেকে আদর্শ মানুষে পরিণত করতে সক্ষম হবেন। আর এই আদর্শ মানুষের মাধ্যমেই আদর্শ সমাজ গঠন সম্ভব হবে। সার্বিকভাবে বলা যায় যে, আদর্শ সমাজ গঠনের জন্য সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজানের শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। এই শিক্ষা বর্তমানে বিশ্বময় ইমাম প্রফেসর ড. কুদরত এ খোদা (মা. আ.) হুজুর প্রচার করছেন। মহান প্রভু আমাদের সবাইকে সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজানের শিক্ষার আলোকে আদর্শ সমাজ গঠন করার সুযোগ দান করুক। আমিন।
[ইসলাম বিষয়ক লেখক]

সম্পর্কিত পোস্ট