Cancel Preloader

পবিত্র আশুরা ও শুহাদায়ে কারবালা

অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান মিয়া: আশুরা আরবি শব্দ, এর অর্থ দশম। মহররম মাসের দশম দিবসকে আশুরা বলা হয়। ইসলামের ইতিহাসে এ দিবসের গুরুত্ব অপরিসীম। মহান আল্লাহ্ আরশ, কুরছি, লওহ, কলম, আসমান ও জমিন সৃষ্টি করে পবিত্র আশুরার দিনে প্রভু হিসেবে নিজে আরশে সমাসীন হয়েছেন। এ দিবসে মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তাঁকে বেহেশতে স্থান দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে এ দিনেই দুনিয়াতে পাঠিয়ে মহান আল্লাহ্ তাঁকে প্রতিনিধির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছেন। পবিত্র আশুরার এ দিনে হযরত ইব্রাহিম (আ.) জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি এ দিনে নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে উদ্ধার লাভ করেন। পবিত্র আশুরার এ দিনে হযরত ইউনুছ (আ.) মাছের পেট হতে মুক্তি লাভ করেন। হযরত ইয়াকুব (আ.) তাঁর হারানো পুত্র হযরত ইউসুফ (আ.)-কে দীর্ঘ ৪০ বছর পর ফিরে পান এবং হযরত সোলায়মান (আ.) তাঁর হারানো রাজত্ব পুনরুদ্ধারে সক্ষম হন। পবিত্র আশুরার দিবসেই মহাপ্লাবনে পতিত হযরত নুহ (আ.)-এর নৌকা তাঁর অনুসারীদের নিয়ে জুদি পাহাড়ের পাদদেশে এসে ভিড়ে। হযরত ঈসা (আ.) আশুরার দিনে জন্মলাভ করেন। আবার এ দিবসেই তিনি চতুর্থ আসমানে উত্থিত হন।


আশুরার এ দিনটি শুধু মুসলিম জাতির জন্যই নয়, বরং সমগ্র মানব জাতির নিকট অতীব পবিত্র ও সম্মানিত। এ দিনের তাৎপর্য সম্পর্কে বহু হাদিস বর্ণিত হয়েছে। হযরত রাসুল (সা.) ফরমান- “রমজান মাসের পর যদি তুমি আরো কোনো রোজা রাখতে চাও তবে মহররমের রোজা পালন করো। কেননা, এই মাসটি হলো আল্লাহ্র মাস। এতে এমন একটি দিন আছে যেদিন আল্লাহ্ তায়ালা এক সম্প্রদায়ের তাওবা কবুল করেছিলেন এবং আগামীতেও তিনি আরেক স¤প্রদায়ের তাওবা এই দিনে কবুল করবেন।” (তিরমিজি শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৫৭)


পবিত্র আশুরা বিশ্ব মুসলিমের কাছে যে কারণে স্মরণীয়, এ সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী, যুগের ইমাম, আম্বিয়ায়ে কেরামের ধর্মের দায়িত্ব ও বেলায়েত লাভকারী, আল্লাহ্র দেওয়া পুরষ্কার: পূর্ণিমার চাঁদে বাবা দেওয়ানবাগীর জীবন্ত প্রতিচ্ছবি সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান বলেন- “আশুরা হচ্ছে আল্লাহ্র অভিষেকের দিন। মহান আল্লাহ্ সৃষ্টিজগত সৃজন করে এ দিবসে আরশে সমাসীন হয়েছেন। অপর দিকে এ দিনেই দুরাচারী এজিদ বাহিনী হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)-কে সপরিবারে কারবালার প্রান্তরে নির্মমভাবে শহিদ করে।”


বিশ্বমানবতার মুক্তির অগ্রদূত, সাইয়্যেদুল মুরসালিন, রাহ্মাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুলে করিম (সা.) যাঁদেরকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন, যাঁদের মনে সামান্যতম কষ্ট হলেই হযরত রাসুল (সা.) হৃদয়ে আঘাত পেতেন; শিশুকালে যাঁদের বিন্দুমাত্র কান্নাও সহ্য করতে পারতেন না; সেই প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হাসান (রা.) ও হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) এ দুজনই সত্য ও ন্যায়ের জন্য আত্মউৎসর্গ করে বিশ্ববাসীর কাছে অমর হয়ে আছেন।


হযরত ইমাম হাসান (রা.) শহিদ হয়েছেন কুখ্যাত এজিদের প্ররোচনায় স্বীয় স্ত্রী কর্তৃক বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে এবং হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) শহিদ হয়েছেন হযরত রাসুল (সা.)-এর আদর্শ মোহাম্মদী ইসলামের সত্য ও ন্যায়ের ঝাণ্ডাকে জগতের বুকে সমুন্নত রাখার জন্য কুখ্যাত এজিদ বাহিনীর সাথে কারবালা প্রান্তরে সংগ্রাম করতে গিয়ে। তাই কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা আজও মুসলিম জাতিকে সত্যের পথে সংগ্রাম করার অনুপ্রেরণা জোগায় এবং স্মরণ করিয়ে দেয় হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) ও তাঁর পরিবারবর্গের মহান আত্মত্যাগের কথা। আজ থেকে বহু বছর পূর্বে পবিত্র আশুরার দিনে কারবালা প্রান্তরে সংঘটিত হয় সেই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড, যা আমাদেরকে প্রতি বছর মহান ত্যাগের শিক্ষা দিয়ে থাকে।


প্রতি বছর মহররম মাসের আশুরার দিনে (১০ই মহররম) বিশ্বের মুসলমানগণ কারবালার শহিদানদের কথা স্মরণ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। কারবালার কাহিনি যে কত মর্মান্তিক এবং হৃদয় বিদারক তা ব্যক্ত করার ভাষা নেই।


কারবালার শহিদগণের নামের তালিকা
হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর সঙ্গে নবি পরিবারের সদস্যসহ ৭২ জন কারবালায় শহিদ হয়েছিলেন। এছাড়া প্রথম শহিদ হয়েছিলেন হযরত মুসলিম বিন আকিল (রা.), যিনি ইমাম হোসাইন (রা.)-এর চিঠি নিয়ে কুফায় গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁকে শহিদ হতে হয়। কারবালায় নবি পরিবারের ৮ জন মহিলা এবং ইমাম জয়নাল আবেদিন (রহ.)-সহ ৯ জন জীবিত ছিলেন।

নিম্নে কারবালা প্রান্তরে ৭২ জন শহিদের নামের তালিকা দেওয়া হলো-
(১) নবিদৌহিত্র বেহেশতের যুবকদের সর্দার শেরে খোদা হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহুর কনিষ্ঠ সাহেবজাদা ইমাম হোসাইন (রা.), (২) হযরত আলী আকবর ইবনে হোসাইন (ইমাম হোসাইনের জ্যেষ্ঠ সন্তান), (৩) হযরত আলী আজগর ইবনে হোসাইন (ইমাম হোসাইনের ৬ মাসের শিশু সন্তান), (৪) হযরত আব্বাস ইবনে আলী (ইমাম হোসাইনের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা এবং হযরত আলী (রা.)-এর সন্তান) (৫) হযরত জাফর ইবনে আলী (ইমাম হোসাইনের বৈমাত্রীয় ভ্রাতা এবং হযরত আলী (রা.)-এর সন্তান), (৬) হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আলী (ইমাম হোসাইনের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা এবং হযরত আলী (রা.)-এর সন্তান), (৭) হযরত উসমান ইবনে আলী (ইমাম হোসাইনের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা এবং হযরত আলী (রা.)-এর সন্তান), (৮) মোহাম্মদ ইবনে আলী (হযরত আলী (রা.)-এর সন্তান), (৯) হযরত আবু বকর ইবনে হাসান (ইমাম হাসানের সন্তান), (১০) হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে হাসান (ইমাম হাসানের ১১ বছরের সন্তান), (১১) হযরত কাসিম ইবনে হাসান (ইমাম হাসানের সন্তান), (১২) হযরত আওন ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে জাফর আল তাইয়ার (হযরত আলী (রা.)-এর কন্যা হযরত জয়নাবের সন্তান), (১৩) হযরত মোহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে জাফর আল তাইয়ার (হযরত আলী (রা.)-এর কন্যা হযরত জয়নাবের সন্তান), (১৪) হযরত জাফর ইবনে আকিল ইবনে আলী, (১৫) হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মুসলিম ইবনে আকিল, (১৬) হযরত আবু আবদুল্লাহ ইবনে মুসলিম ইবনে আকিল, (১৭) হযরত মোহাম্মদ ইবনে আবু সাঈদ ইবনে আকিল, (১৮) হযরত সোলায়মান (ইমাম হোসাইনের গোলাম), (১৯) হযরত কারিব (ইমাম হোসাইনের গোলাম), (২০) হযরত মুনজে (ইমাম হোসাইনের গোলাম), (২১) হযরত মুসলিম ইবনে আওসাজা আল আসাদি (রা.) [হযরত রাসুল (সা.)-এর সাহাবি, যিনি ইমাম হোসাইন (রা.)-কে কারবালায় সহযোগিতা করেছিলেন, (২২) হযরত সাঈদ ইবনে আবদুল্লাহ আল হানাফি (যিনি কুফা থেকে মুসলিম বিন আকিলের দেওয়া চিঠি ইমাম হোসাইনের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন), (২৩) হযরত বিসর ইবনে আমর আল খাদরামি, (২৪) হযরত ইয়াজিদ ইবনে আল হাসিন, (২৫) হযরত ইমরান ইবনে আল কালব আল আনসারি, (২৬) হযরত নাঈম ইবনে আল আজলান আল আনসারি, (২৭) হযরত জোহায়ের ইবনে কাইন আল বাজালি (রা.) [হযরত রাসুল (সা.)-এর সাহাবি, (২৮) হযরত আমর ইবনে কুরজাহ আল আনসারি, (২৯) হযরত হাবিব ইবনে মোজাহের (রা.) [হযরত রাসুল (সা.)-এর সাহাবি, (৩০) হযরত হোর ইবনে ইয়াজিদ (এজিদের একজন সেনাপতি ছিলেন, যিনি কারবালায় ইমাম হোসাইনকে রক্ষা করতে ফিরে আসেন), (৩১) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আল উমাইর আল কালবি, (৩২) হযরত নাফি ইবনে আল হিলাল আল জামালি আল মুরাদি, (৩৩) হযরত আনাস ইবনে খলিল ইবনে আল হারদ আল আসাদি, (৩৪) হযরত কায়েস ইবনে আল মুসসাহার, (৩৫) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উরবা ইবনে আল হাররাখ আল গিফারি, (৩৬) হযরত আবদুর রহমান ইবনে উরবা ইবনে আল হাররাখ আল গিফারি, (৩৭) হযরত সাবিব ইবনে আবদুল্লাহ, (৩৮) হযরত জাউন, (৩৯) হযরত হুজ্জাজ ইবনে জায়িদ সাদি, (৪০) হযরত কাসিত ইবনে জোহাহির, (৪১) হযরত কুরস (মুকসিত) ইবনে জোহাহির, (৪২) হযরত কিনানা ইবনে আতিক, (৪৩) হযরত ধারগাম ইবনে মালিক, (৪৪) হযরত জোয়ায়িন ইবনে মালিক, (৪৫) হযরত জায়িদ ইবনে থুবায়িদ আল কায়েসি, (৪৬) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জায়িদ ইবনে থুবায়িদ আল কায়েসি, (৪৭) হযরত উবায়দুল্লাহ ইবনে জায়িদ ইবনে থুবায়িদ আল কায়েসি, (৪৮) হযরত আমির ইবনে মুসলিম, (৪৯) হযরত কানাব ইবনে আমর আল নামারি, (৫০) হযরত সেলিম, (৫১) হযরত সাইফ ইবনে মালিক, (৫২) হযরত জোয়াহের ইবনে বাসি আল খাতামি, (৫৩) হযরত জায়িদ ইবনে মিকাল, (৫৪) হযরত হুজ্জাজ ইবনে মাশরুক [হযরত রাসুল (সা)-এর সাহাবি], (৫৫) হযরত মাসুদ ইবনে হাজ্জাজ, (৫৬) হযরত মাসুদ ইবনে হাজ্জাজের সন্তান (নাম জানা যায়নি), (৫৭) হযরত মাজমা ইবনে আবদুল্লাহ, (৫৮) হযরত আম্মার ইবনে হাসান ইবনে সোরাইব আল তাঈ, (৫৯) হযরত হাইয়ান ইবনে হারিস আল সালমানি, (৬০) হযরত জুনদব ইবনে হুজাইর আল খানলানী, (৬১) হযরত ওমর ইবনে খালিদ আল সায়দাবি, (৬২) হযরত সাইদ, (৬৩) হযরত ইয়াজিদ ইবনে জিয়াদ, (৬৪) হযরত জহির, (৬৫) হযরত জাবালা ইবনে আলী আল সায়বানি (যিনি সিফফিনের যুদ্ধে হযরত আলীকে সহযোগিতা করেছিলেন, (৬৬) হযরত সালিম, (৬৭) হযরত আসলাম ইবনে খাতির আল আজদি, (৬৮) হযরত জোয়াহের ইবনে সোলায়েম আল আজদি, (৬৯) হযরত কাসিম ইবনে হাবিব আল আজদি, (৭০) হযরত ওমর ইবনে আল ওহদুদ আল হাদরামি, (৭১) হযরত আবু থামামা, ওমর ইবনে আবদুল্লাহ আল সায়েদি (৭২) হযরত হানজালা ইবনে আসাদ আল সামি।
কারবালার যুদ্ধে নবি পরিবারের মহিলা সদস্যগণ যাঁরা বেঁচে ছিলেন, তাঁদের নাম নিম্নে দেওয়া হলো-
(১) হযরত উম্মে রাবাব (আলী আজগরের মাতা), (২) হযরত উম্মে ফারওয়া (ইমাম হাসানের স্ত্রী), (৩) উম্মুল বানিন [হযরত আব্বাস (রা.)-এর মাতা], (৪) হযরত উম্মে কুলসুম [হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর কনিষ্ঠ কন্যা], (৫) হযরত ফাতিমা কুবরা (ইমাম হোসাইনের জ্যেষ্ঠ কন্যা), (৬) হযরত ফাতিমা ছোগরা (ইমাম হোসাইনের কন্যা), (৭) হযরত সকিনা (ইমাম হোসাইনের কন্যা), (৮) হযরত জয়নাব বিনতে আলী (শেরে খোদা হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহুর কন্যা, ইমাম হোসাইনের বোন)।
রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.)-এর সুযোগ্য উত্তরসূরি, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী, সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান কারবালার হৃদয় বিদারক ঘটনা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বর্ণনা করে মুসলমান জাতিকে কারবালার বীর শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের শিক্ষা দিয়েছেন। তাই তিনি প্রতিবছর তাঁর দরবার শরীফে পবিত্র আশুরা উপলক্ষ্যে সম্মেলন করেছেন। সূফী সম্রাটের সুযোগ্য উত্তরসূরি, মোহাম্মদী ইসলামের নেতৃত্ব প্রদানকারী মহামানব ইমাম প্রফেসর ড. কুদরত এ খোদা (মা. আ.) হুজুরও এই আশুরার অনুষ্ঠান অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পালন করে থাকেন।


তথ্যসূত্র:
১. ঐতিহাসিক কারবালা, ড. এস. এম. ইলিয়াছ, মধুকুঞ্জ প্রকাশনী, ঢাকা-১২০১।
২. https://www.news9live.com/knowledge/muharram-2022-check-complete-list-of-72-martyrs-at-battle-of-karbala

[লেখক: সাবেক ভাইস প্রিন্সিপাল, জাতীয় আইন কলেজ, ঢাকা]

সম্পর্কিত পোস্ট