Cancel Preloader

বিশ্বখ্যাত সুফি দার্শনিক মুহিউদ্দিন ইবনুল আরাবি (রহ.)

মরমি কবি, সুফি ও দার্শনিক হযরত মুহিউদ্দিন ইবনুল আরাবি (রহ.) বিশ্বের মহান আধ্যাত্মিক শিক্ষকদের অন্যতম। সুফিতত্তে তাঁর অনবদ্য অবদানের কারণে তিনি শাইখুল আকবার মুহিউদ্দিন ইবনুল আরাবি নামেই সমধিক পরিচিত। ‘মুহিউদ্দিন’ (ধর্মের পুনর্জীবনদানকারী) এবং ‘শাইখুল আকবার’ (সুফিবাদের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক) নামে পরিচিত। তাঁর মূল নাম মোহাম্মদ এবং পারিবারিক নাম ছিল আবু আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনুল আলী ইবনুল মোহাম্মদ ইবনুল আরাবি। তিনি ৫৬১ হিজরির ১৭ই রমজান (২৮শে জুলাই, ১১৬৫ খ্রি.) তৎকালীন আন্দালুসিয়া বর্তমান স্পেনের মুরসিয়া নগরীতে এক ধনাঢ্য মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।


আধুনিক মুসলিম দার্শনিকদের মধ্যে হযরত মুহিউদ্দিন ইবনুল আরাবি (রহ.) ছিলেন তৎকালীন সর্বশ্রেষ্ঠ সুফি দার্শনিক। তাঁর দর্শন কেবল পবিত্র কুরআন, হাদিস এবং তাফসিরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং ইসলামি বিজ্ঞানের সকল শাখা, বিশেষ করে ফিক্হ শাস্ত্র, ধর্মতত্ত¡, দর্শন, মরমিবাদে তাঁর অবদান রয়েছে। তাঁর ইসলামি মরমিবাদ ‘ওয়াহদাতুল ওজুদ’ মতবাদের জন্য বিশেষভাবে আলোচিত।
তাঁর পরিবার ছিল কর্ডোভার সবচেয়ে প্রভাবশালী পরিবারগুলোর মধ্যে একটি। এর কারণ কেবল এই নয় যে তার পিতা হযরত আলি ইবনে আল আরাবি (রহ.) ছিলেন কর্ডোভার প্রধান বিচারপতি। বরং, তাঁর পরিবারের ছিল গৌরবের এক সুদীর্ঘ ইতিহাস, যার শুরু ইতিহাসখ্যাত হাতেম তাইয়ের সময় থেকে। হাতেম তাই এই পরিবারের পূর্বপুরুষদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বলতম নাম।
হযরত মুহিউদ্দিন ইবনুল আরাবি (রহ.)-এর বয়স যখন ৮ বছর, মুরসিয়া শহর তখন পার্শ্ববর্তী এক রাজার আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন তারা চলে যান লিসবন শহরে। কিন্তু সেখানেও বসবাসের যোগ্য না হওয়ায় সিভিল শহর হয় তাঁর পরবর্তী ঠিকানা। এ শহরেই তিনি শিক্ষা দীক্ষায় পূর্ণতা লাভ করেন। তখন সিভিল শহর ছিল মধ্যযুগের সুফিবাদ চর্চার কেন্দ্রস্বরূপ। এখানে অনেক বিখ্যাত সুফির সাক্ষাৎ লাভ করেন হযরত মুহিউদ্দিন ইবনুল আরাবি (রহ.)।

হযরত মুহিউদ্দিন ইবনুল আরাবি (রহ.)-এর পিতা তাঁকে অল্প বয়সেই বিখ্যাত ফিক্হ শাস্ত্রবিদ হযরত আবু বকর ইবনে খালাপ (রহ.)-এর কাছে পবিত্র কুরআন শিক্ষার জন্য প্রেরণ করেন। তিনি সাতভাবে কুরআন তেলাওয়াত করতে শিখেছিলেন। এরপর একে একে সিভিলের সব বিখ্যাত সুফি দার্শনিকদের কাছে আরবি ব্যাকরণ, কুরআনের ব্যাখ্যা, হাদিসের ব্যাখ্যা, আইনশাস্ত্র, দর্শনশাস্ত্র এবং ফিক্হশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। কৈশোরে পদার্পণ করেই আধ্যাত্মিকতার দিকে ঝুঁকে পড়েন তিনি। সমকালীন বিখ্যাত সুফিদের সাথে তাঁর ভাব জমে ওঠে। বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ইবনে রুশদ ছিলেন ইবনুল আরাবির বাবার বন্ধু। সেই সুবাদে ইবনে রুশদের সংস্পর্শেও আসেন তিনি। ২০ বছর বয়সে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে সুফিবাদকে জীবনের লক্ষ্য হিসেবে বেছে নেন। তিনি ইসলামি মরমি ভাবাদর্শে মগ্ন হয়ে পড়েন এবং এ সময় থেকেই তিনি নির্জন স্থানে মহান রাব্বুল আলামিনের ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। একবার তিনি এক নৈশভোজে যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে মদ পরিবেশন করা হয়। তিনি এক গ্লাস মদ নিয়ে পান করার জন্য যে মাত্র ঠোঁটের কাছে আনলেন, তখনই এক গায়েবি আওয়াজ তার কানে এলো- ‘‘হে মোহাম্মদ, এ কাজের জন্য তোমাকে সৃষ্টি করা হয়নি।” তিনি তৎক্ষণাৎ মদের গ্লাস ফেলে দিলেন। এই ঘটনার পর তিনি খোলা মাঠের মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে দেখা পেলেন এক মেষপালকের। মেষপালকের সাথে হাঁটতে হাঁটতে তিনি শহরের বাহিরে চলে এলেন। কোনো এক নির্জন স্থানে এসে মেষপালককে অনুরোধ করলেন পোশাক বদলের জন্য। অতঃপর মেষপালকের ময়লা ছেঁড়া জামা গায়ে জড়িয়ে অজানা গন্তব্যের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। হাঁটতে হাঁটতে একটি গুহায় প্রবেশ করলেন এবং সেখানে আল্লাহ্র ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে যান। তাঁর এই ধ্যান ভাঙে ৪ দিন পর! সেদিন গুহা থেকে বের হয়ে তিনি বুঝতে পারেন নিজের মধ্যে গুণগত পরিবর্তন চলে এসেছে। তিনি দিব্যজ্ঞান লাভ করেছেন! হযরত ইবনুল আরাবি (রহ.) বলেন- “আমার একাকীত্ব যাপন শুরু হয় ফজরের সময়, যখন সূর্যকিরণ ধীরে ধীরে সব অন্ধকার দূর করে দিতে থাকে। তখন ‘গায়েবি’ (অদৃশ্য) জগতের রহস্যগুলো আমার কাছে একে একে জট খুলতে থাকে। ১৪ মাস আমি নির্জনে ধ্যান করেছি, সেগুলো দেখেছি আর লিখে রেখেছি।”


এই ঘটনার পর ইবনুল আরাবি (রহ.)-এর জীবনধারা চিরতরে পাল্টে যায়। তিনি প্রায় ১৪ মাস একটানা নিভৃতচারীর মতো জীবন যাপন করেন। এ সময় তিনি কেবলই একজন মানুষের সাথে সাক্ষাৎ করতেন, কথাবার্তা বলতেন। তিনি হচ্ছেন তাঁর দীক্ষা গুরু শেখ ইউসুফ বিন ইউখালফ আল কুমি (রহ.)। টানা ১৪ মাসের নিভৃতযাপন শেষে তিনি নিজ বাসস্থানে ফিরে গেলেও কোনো কাজে আর যোগ দেননি। যাবতীয় অর্থ সম্পদের মোহ ত্যাগ করে তিনি কেবল ধ্যান-সাধনায় সময় ব্যয় করতেন।
দ্রুতই হযরত ইবনুল আরাবি (রহ.)-এর আধ্যাত্মিক গুণের কথা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়লো পুরো স্পেনে। তাঁর বাবার বন্ধু ইবনে রুশদও তাঁর ব্যাপারে অবগত হন এবং তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এই সাক্ষাৎ দুটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রথমত, ইবনে রুশদের সাথে ইবনুল আরাবির শৈশবে সাক্ষাৎ হয়েছিল, বয়সকালে আর হয়ে ওঠেনি। দ্বিতীয়ত, দুজন দুই মেরুর শ্রেষ্ঠ মানুষের সাক্ষাৎ ছিল এটি। ইবনে রশিদ ছিলেন একজন আপাদমস্তক যুক্তিবাদী মানুষ, যিনি সকল প্রকার জ্ঞানকে যুক্তির ছাঁচে ফেলে ঝালিয়ে নিতেন। অন্যদিকে ইবনুল আরাবি (রহ.) ছিলেন আধ্যাত্মিকতার উচ্চতর মাকামে। এই সাক্ষাৎ দুজনের জন্যই বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ইবনে রশিদ এই সাক্ষাতে আধ্যাত্মিকতা ও দিব্যজ্ঞান সম্পর্কে প্রশ্ন করেন। তাছাড়া ইবনুল আরাবি (রহ.)-এর নিভৃত জীবনযাপনের নানাদিক নিয়ে জানার কৌতূহল দেখান তিনি। হযরত ইবনুল আরাবি (রহ.)-এর সাথে এই সাক্ষাতের পরই আধ্যাত্মিকতা নিয়ে পুনরায় চিন্তাভাবনা শুরু করেছিলেন রশিদ। অন্যদিকে ইবনুল আরাবি (রহ.)-ও দর্শনের খুঁটিনাটি জানার সুযোগ পান। যদিও আরাবি নিজেও একজন উৎকৃষ্ট দার্শনিক ছিলেন, তথাপি মোর্শেদের প্রতি তাঁর ছিল অগাধ শ্রদ্ধা। আধ্যাত্মিকতার মাঝে বিচরণ করেই কীভাবে দার্শনিকতায় নিজেকে সমৃদ্ধ করা যায়, সেই অনুপ্রেরণা তিনি মোর্শেদের কাছেই পেয়েছিলেন।
৪০ বছরের মধ্যেই জীবনের ভ্রমণ অংশটাও সম্পন্ন করেন হযরত মুহিউদ্দিন ইবনুল আরাবি (রহ.)। তিউনিস, ফেজ, মারাক্কেশ, বাগদাদ, সিরিয়া, কায়রো, আলেকজান্দ্রিয়া-সহ তৎকালীন পৃথিবীর মোটামুটি সকল গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞানকেন্দ্রগুলোতে ভ্রমণ করেন তিনি। এরপর তিনি পবিত্র মক্কা নগরীতে ভ্রমণ করেন হজব্রত পালনের জন্য। কিন্তু কাবাশরীফ তাওয়াফ করাকালীন তিনি আবারো একটি দৈব আদেশ পান। তাঁকে মক্কায় কিছুকাল থাকার জন্য বলা হয়। আদেশ মেনে তিনি মক্কায় ৪ বছর অবস্থান করেন এবং চারটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন। এদের মধ্যে ‘মিশকাত আল আনওয়ার’ বা হাদিস সমগ্র, ‘রুহু আল কুদুস’ বা আন্দালুসিয়ার সুফিদের জীবনী, ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দলিল। অন্যদিকে মক্কায় থাকাকালীনই হযরত ইবনুল আরাবি (রহ.) তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ রচনা ‘ফুতুহাত আল মাক্কিয়াহ’ রচনার কাজ শুরু করেন।
ক্রুসেডের সময় ইবনুল আরাবি আনাতোলিয়ার (তুরস্ক) শাসক সুলতান কায় কাউসের নিকট চিঠি লিখে কঠোর হস্তে ক্রুসেডারদের দমনের অনুরোধ জানান। এর কিছুকাল পর তিনি নিজেই আনাতোলিয়া ভ্রমণ করেন কায় কাউসের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য। সেখানে বেশ কয়েক বছর বসবাস করে দামস্কে স্থায়ী হবার পরিকল্পনা করেন। এখানে থাকাকালীনই বিগত ৩০ বছরের আধ্যাত্মিক শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে রচনা করেন ‘ফুতুহাত আল মাক্কিয়াহ’।
কথিত আছে যে, ৫৮৬ হিজরিতে করডোভাতে হযরত ইবনুল আরাবি (রহ.) এক অবিশ্বাস্য দিব্যদৃষ্টি লাভ করেন। তিনি হযরত আদম (আ.) থেকে রাহ্মাতুল্লিল আলামিন হযরত মোহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত সকল নবি-রাসুলের আধ্যাত্মিক সত্তার সাক্ষাৎ পান। হযরত হুদ (আ.) তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন এবং তাদের সকলের একসঙ্গে ইবনুল আরাবির সঙ্গে সাক্ষাতের কারণ ব্যাখ্যা করেন। এ বিষয়টি তিনি ‘আর রুহ আল-কুদস’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন।
হযরত মুহিউদ্দিন ইবনুল আরাবি (রহ.) দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন মরমি সাধক ছিলেন। তিনি তার অসংখ্য গ্রন্থে কীভাবে দিব্যদৃষ্টিতে মিরাজ, নবি-রাসুলের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও কথোপকথন, কাবা শরীফ প্রদক্ষিণ করেন সেই বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দেন। তাঁর আত্মিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি ছিল যেমন প্রখর ও প্রগাঢ়, তেমনি দৈহিক পরিভ্রমণের ক্ষমতাও ছিল প্রবল। তাঁর রচনা ছিল সমন্বয়ধর্মী। তিনি প্রেম বন্ধনে সকল জাতি, সকল ধর্ম, সকল গোত্রকে একত্রিত করতে চেয়েছিলেন। তাঁর দর্শন মানেই সুফিবাদ বা মরমী দর্শন, যেখানে তিনি ভালোবেসেছেন সকল মানুষকে, কেননা তিনি মহান প্রভুকে সন্ধান করেছেন সবার মাঝে। আর নিজের ক্বালবে বা হৃদয়ে পেয়েছেন সকলের উপাস্যকে। তিনি বলেন, “আমি প্রেমের ধর্মকে অনুসরণ করি: প্রেমের উট যে পথ দিয়েই যাবে, তাই আমার ধর্ম ও বিশ্বাস হবে।”
একদা হযরত শায়েখ আল-উরায়বি (রহ.) হযরত মুহিউদ্দিন ইবনুল আরাবি (রহ.)-কে হযরত শায়েখ খিজির (রহ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়ে দেন। তাঁরা দুজনই ছিলেন সেই সময়ের বিখ্যাত মরমি সাধক। তখন হযরত মুহিউদ্দিন ইবনুল আরাবি (রহ.)-কে শায়েখ খিজির (রহ.) বলেছিলেন, “তোমার শিক্ষাগুরুর কথা মেনে চলো।” ইবনুল আরাবি (রহ.)-এর এটাই ছিল শায়েখ খিজির (রহ.)-এর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ। ১১৯৩ সালে ২৯ বছর বয়সে ইবনুল আরাবি (রহ.) তিউনিসে গমন করেন। তিনি সেখানে হযরত আবদুল আজিজ মাহদায়ি (রহ.) এবং হযরত আবু মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল-কিনানি (রহ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং সেখানে প্রায় এক বছর অতিবাহিত করে মহান আল্লাহ্র গোলাম হওয়ার যোগ্যতা অর্জনের গুণাবলি শিক্ষা লাভ করেন। তিউনিস থেকে ফেরার পথে হযরত ইবনুল আরাবি (রহ.)-এর শায়েখ খিজির (রহ.)-এর সঙ্গে দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ হয়। এক পূর্ণিমার রাতে তিনি যখন নৌকায় করে তিউনিস থেকে ফিরছিলেন তখন দেখলেন যে, এক ব্যক্তি পানির ওপর দিয়ে হেঁটে তার দিকে এগিয়ে আসছেন। নৌকার কাছে এসে ব্যক্তিটি পানির ওপর দাঁড়িয়ে তার পা দেখিয়ে ইবনুল আরাবি (রহ.)-কে বললেন যে, “দেখো, আমার পা শুকনো। কোথাও কোনো পানি লাগেনি।” এই ব্যক্তিটি ছিল শায়েখ খিজির (রহ.)। শায়েখ খিজির (রহ.) তাঁর সঙ্গে এমন ভাষায় কথা বললেন যে, তা ইবনুল আরাবির বোধগম্য হল না। আন্দালুসিয়াতে পৌঁছানোর পর ইবনুল আরাবি (রহ.)-এর তৃতীয়বারের মতো শায়েখ খিজির (রহ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এবার তিনি একটি অলৌকিক ঘটনার নিদর্শন দেখান ইবনুল আরাবি (রহ.)-এর সঙ্গির প্রমাণের জন্য, যিনি অলৌকিক ঘটনায় বিশ্বাস করতেন না। এভাবে, শায়েখ খিজির (রহ.)-এর মতো একজন অতি সমৃদ্ধশালী সুফির সাহচর্যের মাধ্যমে ইবনুল আরাবি (রহ.) আধ্যাত্মিকতার উচ্চতর স্তরের জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হন।
কিতাব রচনা
হযরত মুহিউদ্দিন ইবনুল আরাবি (রহ.) ৩৫০টির অধিক কিতাব রচনা করেছেন বলে জানা যায়। যেগুলোর মধ্যে প্রধান হলো ফুফুস আল-হিকাম (দ্য রিংটোন অব উইজডম), যা ইহুদি, খ্রিষ্টান ও ইসলাম ধর্মের নবি-রাসুলদের জ্ঞানের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য নিয়ে লিখিত। এতে ২৭টি অধ্যায় আছে, যার প্রতিটি একজন নবি বা রাসুলের আধ্যাত্মিক জ্ঞানের মর্মবাণী নিয়ে রচিত। কয়েক শতক ধরে এটি হিসেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে পড়ানো হতো এবং অসংখ্য ভাষায় এর ওপর শতাধিক ভাষ্য গ্রন্থ রচিত হয়েছে।
৫৯৪ হিজরিতে ৩৩ বছর বয়সে হযরত মুহিউদ্দিন ইবনুল আরাবি (রহ.) আধ্যাত্মিকভাবে মিরাজ লাভ করেন। যেখানে তাঁর আত্মার আলো উর্ধাকাশে ভ্রমণ করে। এটি হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর মতো দৈহিক কোনো মিরাজ নয়, বরং এটি ছিল তার স্বপ্নে বা ক্বালবে আত্মিক পরিভ্রমণ। হযরত ইবনাল আরাবি (রহ.) এই মরমি অভিজ্ঞতা সম্পর্কে যে গ্রন্থ রচনা করেন তার নাম ‘কিতাব আল-ইশরা’। এছাড়া আছে ফুতুহাত আল-মাক্কিইয়া (দ্য মাক্কান ইলুমিনেশন), যা মরমি দৃষ্টিকোণ থেকে তিনটি সেমিটিক ধর্মের আধ্যাত্মিক জ্ঞান নিয়ে রচিত। এটি সুফিবাদের সর্ববৃহৎ বিশ্বকোষ। এতে মোট ৫৬০টি অধ্যায় আছে, যা ৬টি খন্ডে বিভক্ত। যথা- (১) আল মা’রিফা (আধ্যাত্মিক জ্ঞান), (২) আল-মালুমাত (আধ্যাত্মিক আচরণ), (৩) আল-আহওয়াল (আধ্যাত্মিক অবস্থা), (৪) আল-মানযিল (আধ্যাত্মিক ঠিকানা), (৫) আল-মুনাযালাত (আধ্যাত্মিক সাক্ষাৎ) এবং (৬) আল-মাকামাত (আধ্যাত্মিক গন্তব্যস্থল)। এ বিশ্বকোষ তিনি সম্পূর্ণভাবে ঐশি প্রেরণায় রচনা করেছিলেন বলে দাবি করেন।
হযরত ইবনুল আরাবি (রহ.) বড়ো পির হযরত আবদুল কাদির জিলানি (রহ.)-এর কয়েকজন খ্যাতনামা শিষ্যের সঙ্গে সাক্ষাতের পর রচনা করেন ‘তানাজ্জ্বলাত আল-মাওসিলিয়া’, ‘কিতাব আল-জালাল ওয়াল জামাল’ এবং ‘কুনহ মা লা বুদ্দালিল মুরিদমিনহু’।


এছাড়া তিনি কাব্যগ্রন্থ ও কবিতাসমগ্র রচনা করেন। ‘দিওয়ান’ এবং ‘তারজুমান আল-আশওয়াখ’ হলো আরবি ভাষায় লিখিত তার দুটি বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। ইবনুল আরাবি (রহ.)-এর রচনা পবিত্র কুরআনকে কেন্দ্র করে রচিত এবং সর্বজনীন। তাঁর মতে, প্রত্যেক মানুষের একটি স্বতন্ত্র পথ আছে, যে পথ ধরে সে মহান প্রভুকে অন্বেষণ করে। আর পরিণামে সকল পথ একত্রিত হয়ে এক ঈশ্বরের কাছে পৌঁছেছে। যেমন- ‘ফুসুস আল-হিকাম’ গ্রন্থে ইবনুল আরাবি (রহ.) বলেন: “যদি কোনো বিশ্বাসী ‘জলের রং হলো পাত্রেরই রং’ একথার মর্ম বুঝত, তাহলে সে সকল ধর্মের বৈধতা স্বীকার করত এবং ঈশ্বরকে সব আকারে এবং সব বিশ্বাসের বিষয় হিসেবে চিনতে পারত।” তার দর্শন কেবল ইসলামি জগত নয়, পাশ্চাত্যের দর্শনেও প্রভাব ফেলেছে। তার প্রজ্ঞা আজকের আধুনিক যুগের মানুষকে প্রকৃত মানুষ হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করে।
হযরত মুহিউদ্দিন ইবনুল আরাবি (রহ.) আরো কয়েকটি মূল্যবান কিতাব রচনা করেন। যথা- রুহ আল কুদস (হোলি স্পিরিট ইন দ্য কাউন্সেলিং অব দ্য সোল), আন্দালুসিয়ায় থাকাকালীন নিজের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে লিখেছেন এই বইটি। বইটি তৎকালীন সুফিদের জীবনী নির্ভর।
মাসাহিদ আল আশরার (কন্টেমপ্লেশন অব দ্য হোলি): নিজের জীবনের মোট ৬টি দৈবঘটনা এবং আদেশ নিয়ে লিখেছেন এই বইটি। মিশকাত আল আনওয়ার (হাদিস সংকলন): ১০১টি গুরুত্বপূর্ণ হাদিসের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ। তারজুমান আল আশওয়াক (দ্য ইন্টারপ্রেটার অব ডিজায়ারস): স্বপ্নের ব্যাখ্যা এবং ভাগ্য বিষয়ক আলোচনা। আইয়াম আল শা’ন (দ্য বুক অব গড’স টাইম): সময়ের উৎপত্তি এবং প্রবাহ নিয়ে দার্শনিক আলোচনা। উনকা মুঘরিব: সুফিবাদের সংজ্ঞা এবং বিস্তারিত।
‘ওয়াহ্দাতুল ওযুদ’
হযরত মহিউদ্দিন ইবনাল আরাবি (রহ.) সুফিতত্ত¡ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ‘ওয়াহদাতুল ওযুদ’ বা ‘ওযুদিয়া’ মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেছেন বলে ধারণা করা হয়। এই মতবাদ সর্বেশ্বরবাদ এবং ইসলামের একত্ববাদের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত। ইসলাম একত্ববাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এই এক ঈশ্বরবাদকে সর্বেশ্বরবাদের সাথে সমন্বয় করে ইবনুল আরাবি (রহ.) দেখান যে, জগতের সবকিছুই এক ঈশ্বরের বহিঃপ্রকাশ ছাড়া অন্য কিছু নয়। একমাত্র ঈশ্বরের সত্তাই বিদ্যমান। বাকী সব তার সত্তারই অংশ। মহান আল্লাহ্ সৃষ্টির প্রথমে একাই ছিলেন। আল্লাহর এই সত্তা হচ্ছে বাতেনি বা গুপ্ত সত্তা। তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করলেন নিজেকে প্রকাশ করার। তাই তিনি নিজেকে প্রকাশ করার নিমিত্তে জগত সৃষ্টি করলেন। হাদিসে কুদসিতে বলা হয়েছে- “আল্লাহ্ ছিলেন গুপ্ত ধনাগার। অতঃপর তিনি নিজেকে প্রকাশ করতে চাইলেন। তাই তিনি সৃষ্টিজগত সৃজন করলেন।”
এই দর্শনে হযরত ইবনুল আরাবি (রহ.) দেখান যে, মহান আল্লাহ্ সবকিছুকেই নিজের মধ্যে ধারণ করছেন। জগতের সবকিছুর অস্তিত্ব আল্লাহর অস্তিত্বের ওপর নির্ভরশীল। তাঁর মতে:
“ওগো, তুমিই পয়দা করেছ সবকিছুকে
তুমি ঐক্যবদ্ধ করো তাদেরকে যাদেরকে সৃষ্টি করেছ তুমি।
যা কিছু সৃষ্টি করেছ তুমি
তার অস্তিত্ব তোমারই মাঝে
অনন্তকাল ধরে,
কেননা তুমি সংকীর্ণ ও সর্বব্যাপী দুই-ই।”
হযরত মুহিউদ্দিন ইবনুল আরাবি (রহ.) মনে করেন যে, মহান আল্লাহর গুণাবলি তাঁর সৃষ্টির মাঝে বিশেষ করে মানুষের মাঝেই বিকশিত হয় এবং এর দর্শণ মানুষ সৃষ্টি জগতের ওপর কর্তৃত্ব করে। মহান আল্লাহ্ মানুষের জন্যই ফেরেশতাদের কটাক্ষ করেছিলেন। কারণ তারা মানুষের মূল্য জানতো না। মহান আল্লাহ্ আদি এবং অন্ত উভয়ই। আমরা তার কাছ থেকেই এসেছি, তাই তিনি আদি। আবার তার কাছেই ফিরে যাবো, তাই তিনি অন্ত। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন।” অর্থাৎ নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহ্ থেকে এসেছি এবং তাঁর কাছেই প্রত্যাগমনকারী। ইবনুল আরাবির মতে, আল্লাহর সৃষ্টির মাঝেই প্রভু বিরাজ করেন। তাই আল্লাহর সৃষ্টিকে সর্বদা সুনজরে দেখা উচিত। তিনি তাই বলেন: “কেউ যদি আল্লাহর সৃষ্টিকে অকারণে ধ্বংস করতে চায়, তবে সে নিজেকেই ধ্বংস করবে।”
সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ৭৬ বছর বয়সে তিনি ২২শে রবিউস সানি ৬৩৮ হিজরি মোতাবেক ১২৪০ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র:
1| https://www.bibortonpoth.com/9855
2| https://wordswithoutborders.org/contributors/view/muhyiddin-ibn-arabi/
3| http://www.muslimphilosophy.com/ip/rep/H022
4। তায্কেরাতুল আওলিয়া চতুর্থ খন্ড, মাওলানা নূরুর রহমান, এমদাদিয়া পুস্তকালয় (প্রাঃ) লিঃ, ঢাকা

সংকলনে- ড. সৈয়দ মেহেদী হাসান

সম্পর্কিত পোস্ট