Cancel Preloader

মহামানবগণের জীবনী থেকে


কোরবানির মূল শিক্ষা
কোরবানি সুন্নতে ইব্রাহিম। হযরত ইব্রাহিম (আ.) স্বীয় পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ.)-কে মহান আল্লাহর নামে কোরবানি করে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ‘খলিলুল্লাহ্’ উপাধি লাভ করেছেন। তাই আল্লাহ্ তায়ালা মুসলমানদের জন্যে কোরবানির মতো একটি ফজিলতপূর্ণ বিধান পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। এতে বান্দার পক্ষ থেকে আল্লাহর নামে কোরবানি করাই ইসলামের নির্দেশ। কোরবানির উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষ আল্লাহর প্রেম অর্জনের মাধ্যমে ধর্মনিষ্ঠা ও তাকওয়া অর্জন করবে। তাই পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “আল্লাহর নিকট কখনই পৌঁছায় না এটির (কোরবানিকৃত পশুর) গোশত এবং রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া (খোদাভীতি)।” (সূরা আল হাজ্জ ২২: আয়াত ৩৭)


আরবি ‘কুরবুন’ শব্দ থেকে ‘কোরবানি’ শব্দের উৎপত্তি- যার আভিধানিক অর্থ হলো, নৈকট্য লাভ করা। প্রসঙ্গত আত্মসমর্পণের এক অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে কোরবানির ঐতিহাসিক পটভূমির কথা স্মরণ করলে দেখা যায়, হযরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক পুত্রের স্নেহ, মায়া-মমতা পরিত্যাগ করে হযরত ইসমাঈল (আ.)-কে কোরবানি করার জন্যে নির্জন মরু প্রান্তরে নিয়ে যান। মহান আল্লাহর উপর পূর্ণ আত্মসমর্পণকারী হযরত ইসমাঈল (আ.) পিতার মুখে প্রভুর নির্দেশ শোনামাত্র কোরবানি হতে রাজি হয়ে যান। তারপর পিতাকে মিনতি করে জীবনের শেষ আবদার রেখে বললেন, পিতা! আপনি দয়া করে আমার তিনটি শর্ত মেনে নিন। স্নেহময় পিতা তখন বললেন, বাবা! তোমার শর্তগুলো কী বলো। পুত্র বললেন, আব্বাজান! কোরবানি করার পূর্বে আমার হাত-পা মজবুত করে বেঁধে নেবেন। কারণ গলাকাটা অবস্থায় নিজের অজ্ঞাতসারে হাত-পা ছুঁড়লে তা আপনার শরীর মোবারকে গিয়ে লাগতে পারে, কিংবা রক্তের ছিটা গিয়ে লাগতে পারে। আপনি আল্লাহর বন্ধু, আপনার সাথে আমার বেয়াদবি হয়ে যাবে।


দ্বিতীয়ত– আপনি আপনার পবিত্র চোখে কাপড় দিয়ে ভালো করে বেঁধে নেবেন। কেননা আমার অন্তিম অবস্থা দেখে স্নেহপরবশ হয়ে আল্লাহর নির্দেশ পালন করতে আপনাকে যেন দ্বিধাগ্রস্ত হতে না হয়।


তৃতীয়ত– আমি আপনাদের একমাত্র সন্তান, মায়ের চোখের মণি। যে মা আমাকে বুকে করে নির্জন মরু প্রান্তরে নির্বাসিত জীবন যাপন করেছেন, শত দুঃখ কষ্ট সহ্য করেও আমার লালন-পালন করেছেন, তিনি আমাকে অত্যন্ত ভালোবাসেন। আপনার কাছে আমার অনুরোধ, আমাকে কোরবানি করার পর আমার রক্তমাখা জামা দুঃখিনী মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেবেন। যখন আমার কথা মনে পড়বে, তখন মা দুঃখিনী এ জামা বুকে জড়িয়ে তাঁর অন্তরের জ্বালা কিছুটা জুড়াতে পারবেন।


এ তিন শর্তে রাজি হয়ে পিতা যখন ছেলের গলায় ছুরি চালাচ্ছিলেন, তখন তিনি উচ্চারণ করছিলেন- আল্লাহু আকবার- আল্লাহ্ মহান। কিন্তু ছুরি তো চলে না, অর্থাৎ গলা কাটে না। তবু তিনি ‘আল্লাহু আকবার’ বলে পুনরায় ছুরি চালালেন। তখন হযরত জিব্রাঈল (আ.) বেহেশতি দুম্বা নিয়ে আসতে আসতে বলছিলেন, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার”- আল্লাহ্ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই- আল্লাহ্ মহান। ছুরির নিচে শুয়ে হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর মুখে উচ্চারিত হচ্ছিল- “ওয়ালিল্লাহীল হামদ”- সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্যে। এমন সময় কোরবানি হয়ে গেল। চোখ খুলে হযরত ইব্রাহিম (আ.) দেখলেন, দুম্বা কোরবানি হয়েছে, আর ছেলে পাশেই দাঁড়ানো। আর তাঁরা উভয়ে আত্মসমর্পণের এ অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আল্লাহর বন্ধু খেতাবে ভূষিত হলেন, আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে সক্ষম হলেন।


হযরত ইব্রাহিম (আ.) স্বীয়পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ.)-কে আল্লাহর নামে উৎসর্গ করে আল্লাহর কুরবিয়ত বা নৈকট্য হাসিল করে ‘খলিলুল্লাহ্’ উপাধি লাভ করেছিলেন। তাঁদের সে মহান ত্যাগের স্মৃতি বহন করে আজও মুসলিম জাতির মধ্যে ‘সুন্নতে ইব্রাহিম’ হিসেবে কোরবানির রেওয়াজ চালু রয়েছে। অন্যদিকে পুত্র ইসমাঈল (আ.) আল্লাহর পক্ষ থেকে ‘জাবিহুল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহর নামে জবেহকৃত উপাধি লাভ করেছিলেন।


মূলত নিজের জীবাত্মার পশু প্রবৃত্তিকে আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করে, নিজের স্বেচ্ছাচারিতাকে পরিত্যাগ করত আল্লাহর ইচ্ছার উপর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে স্রষ্টার নৈকট্য হাসিল করাই প্রকৃত কোরবানি। হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর মতো আপন সন্তানের ন্যায় প্রিয়বস্তু আল্লাহর রাস্তায় জবেহ্ বা উৎসর্গ করার মানসিক দৃঢ়তা অর্জন করা কোরবানির শিক্ষা। আমরা হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর কাছ থেকে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণের শিক্ষা পেয়েছি। এ শিক্ষা মহামানবগণের শিক্ষা। এ শিক্ষা বাস্তবায়নের প্রশিক্ষণ লাভের জন্যে আল্লাহর বন্ধুগণের সান্নিধ্য লাভ করা প্রয়োজন। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই আমাদের কোরবানির একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।


মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী, যুগের ইমাম সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) বলেন, “কোরবানি করা হয় রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। মানুষ যে কর্মের দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভে সক্ষম হয়, সেটি তার জন্য কোরবানি। কোরবানি মূলত এসেছে নিজের নফসকে কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার জন্য। আমাদের খেয়াল করতে হবে, এ কোরবানির মাধ্যমে আমরা যেন আমাদের পশু প্রবৃত্তিকে কোরবানি করতে পারি।”
আল্লাহ্ তায়ালার মনোনীত মহামানবগণের সান্নিধ্যে গিয়ে তাঁদের পবিত্র হৃদয় থেকে ফায়েজ হাসিলের মাধ্যমে আত্মার পশু-প্রবৃত্তি দমন করত হৃদয়ে আল্লাহর সুপ্ত নুর জাগ্রত করে বাস্তব জীবনে আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করাই ইসলামের শিক্ষা। কোরবানির এই সঠিক শিক্ষা জীবনে বাস্তবায়িত করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার এটাই চিরন্তন পদ্ধতি।
সংকলনে: সৈয়দ গোলাম মোর্শেদ

সম্পর্কিত পোস্ট