Cancel Preloader

মোরাকাবার আধ্যাত্মিক ও তাত্তিক বিশ্লেষণ ইমাম প্রফেসর ড. কুদরত এ খোদা

১ম পর্ব
প্রথম নবি হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে সর্বশেষ নবি হযরত মোহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত যত নবি-রাসুল জগতের বুকে শুভাগমন করেছিলেন, তাঁরা প্রত্যেকেই মোরাকাবার মাধ্যমে মহান আল্লাহর সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। নবুয়তের যুগের পর বেলায়েতের যুগে আল্লাহর অলীগণ একই পদ্ধতিতে মহান আল্লাহর সাথে যোগাযোগ করেন। মহান আল্লাহর নৈকট্য, দিদার এবং তাঁর সাথে যোগাযোগ মোরাকাবার মাধ্যমে সম্ভব। আল্লাহর সাথে যোগাযোগের পাঁচটি মাধ্যম রয়েছে। যথা- স্বপ্ন, মোরাকাবা, ফায়েজ, কাশফ ও এলহাম। এর মধ্যে মোরাকাবা যোগাযোগের অন্যতম পদ্ধতি।

মোরাকাবার সংজ্ঞা
মোরাকাবা আরবি শব্দ। এটি বাবে (মুফা‘আলাহ)-এর মাসদার। অভিধানে মোরাকাবা শব্দের অর্থ হচ্ছে নজরে রাখা, পর্যবেক্ষণ করা, (আল্লাহ্কে) ভয় করা, ধ্যান করা ইত্যাদি। আরবি মোরাকাবা শব্দের প্রতিশব্দ হচ্ছে তাফাক্কুর। আরবি ‘তাফাক্কুর’ শব্দের বাংলা অর্থ হচ্ছে চিন্তা করা, গভীরভাবে চিন্তা করা, ধ্যান করা। মোরাকাবাকে ইংরেজিতে Meditation বলে। সুফি সাধক ও আউলিয়ায়ে কেরামের নিকট মোরাকাবা শব্দটি অধিক প্রচলিত, বহুল ব্যবহৃত শব্দ। মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে বলেন“(তারাই তত্তজ্ঞানী) যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহর জিকির করে এবং আসমান জমিন সৃষ্টির বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে (মোরাকাবা করে)।” (সূরা আলে ইমরান ৩ : আয়াত ১৯১) হযরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে- তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন“ঐ ব্যক্তির জন্য ধ্বংস, যে এ আয়াত তেলাওয়াত করে অথচ এটা নিয়ে গভীর চিন্তা তথা ধ্যান করে না।” (তাফসীরে মাজহারী, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৯৮ এবং তাফসীরে দুররে মানছুর, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪০৯)
মোরাকাবা বা গভীরভাবে ধ্যান করা সম্পর্কে হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু হতে বর্ণিত হয়েছে- তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন “লা ‘ইবাদাতা কাত্তাফাক্কুর।” অর্থাৎ গভীরভাবে চিন্তা করার বা মোরাকাবার সমতুল্য কোনো ইবাদত নেই। (তাফসীরে মাজহারী, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২০০) হযরত ঈসা (আ.) হতে বর্ণনা করা হয়েছে- তিনি বলেছেন “সেই ব্যক্তি সৌভাগ্যবান, যার কথার মধ্যে থাকে আল্লাহর স্মরণ, সময় কাটে গভীর ধ্যানে এবং দৃষ্টিতে থাকে মহাসত্যের অনুসন্ধিৎসা।” গভীর ধ্যান তথা মোরাকাবা সম্পর্কে হযরত লোকমান হেকিম (আ.) বলেন “নির্জনতা যত দীর্ঘ হয় গবেষণা তত গভীরে পৌঁছে যায়, আর গভীর ও দীর্ঘ গবেষণা বেহেশতের বহু দরজার সন্ধান দেয়।” (তাফসীরে ইবনে কাছীর, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৪১) হযরত ফুযাইল (রা.) বর্ণনা করেন যে, হযরত হাসান বসরি (রহ.) বলেছেন “চিন্তা-গবেষণা তথা মোরাকাবা এমন দর্পণ, যা তোমার সামনে ভালো-মন্দ উপস্থিত করে দেয়।” হযরত সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা (রহ.) বলেন “চিন্তা গবেষণা তথা মোরাকাবা এমন একটি রশ্মি, যা তোমার অন্তরে আলোকচ্ছটা নিক্ষেপ করে।” তিনি প্রায়ই বলতেন “যখন কারো চিন্তা ও গবেষণা তথা ধ্যান করা অভ্যাস হয়ে যায়, তখন প্রত্যেকটি বিষয়ে সে শিক্ষণীয় বিষয় পায়।” তাফাক্কুর বা গভীর ধ্যান সম্পর্কে শায়খ আবু সুলায়মান দারানি (রহ.) বলেন, “বাড়ি হতে বের হবার পর পথে যত বস্তু আমার দৃষ্টিতে পড়ে তার প্রত্যেকটির মধ্যে আল্লাহর অস্তিত্বের সাক্ষী পাই। প্রত্যেকটির মধ্যে থাকে আমার জন্য একটা না একটা শিক্ষণীয় বিষয়।” হযরত ওহাব ইবনে যাম্মাহ (রহ.) বলেন, “আল্লাহর ধ্যান যত বেশি হয়, বোধশক্তি তত প্রখর হয় এবং বোধশক্তি যত প্রখর হয়, জ্ঞানের পরিধি তত বৃদ্ধি পায়। আর জ্ঞান যত বৃদ্ধি পায়, সৎকর্ম তত বেশি সম্পাদিত হয়।” হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয (রহ.) বলেন আল্লাহর স্মরণে আলোচনা করা উত্তম কাজ। আল্লাহর সৃষ্ট বস্তুসমূহের ব্যাপারে চিন্তা- গবেষণা করা সর্বোত্তম ইবাদত।” (তাফসীরে ইবনে কাছীর ১ম খণ্ড)
হযরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.) তাঁর ‘গুনিয়াতুত ত্বালেবীন’ কিতাবে উল্লেখ করেছেন“মোরাকাবা দ্বারা মুজাহাদার পরিপূর্ণতা সাধিত হয়। ফিরিশতা জিব্রাইল হুযুরে পাক (দ.)-এর নিকট জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন যে, ইহসান কি? হুজুরে পাক (দ.) জবাবে বলিলেন, ‘তুমি এমনভাবে ইবাদত কর, যেন আল্লাহ্ তায়ালাকে দেখিতেছ। আর যদি তোমার অবস্থা তেমনটা না হয়, তবে মনে করিবে যে, আল্লাহ্ অবশ্যই তোমাকে দেখিতেছেন।’ মোরাকাবা ইহাই, বান্দা ইয়াক্বীন রাখিবে যে, আল্লাহ্ তায়ালা তাহার সবকিছুরই খবর রাখেন। সদা-সর্বদা বান্দার মনে এই কথাটা জাগরুক থাকার নামই মোরাকাবা। বান্দার জন্য যত রকম ভালাই এবং কল্যাণকর বস্তু রহিয়াছে, সকল কিছুর মূলই হইল এই মোরাকাবা। সালেকের গন্তব্যস্থলে পৌঁছার জন্য মোরাকাবাই হইল প্রধান অবলম্বন।” (গুনিয়াতুত ত্বালেবীন, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৫৬ ও ২৫৭, এ.এন.এম. ইমদাদুল্লাহ অনূদিত)
মোরাকাবা সম্পর্কে আমার মহান মোর্শেদ সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান বলেন, “আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য মোরাকাবা হলো সহজ ও সর্বোত্তম পদ্ধতি। গভীর সাধনা ও মোরাকাবা করে যিনি নিজের ভিতরে আল্লাহ্কে খুঁজে পেয়েছেন, তিনিই প্রকৃত মু’মিন। সেজন্য নিয়মিত মোরাকাবা করতে হবে এবং মোরাকাবার মাধ্যমে নিজের মাঝে মহান আল্লাহ্ ও হযরত রাসুল (সা.)-কে খুঁজে পেতে হবে। ইবাদতের মধ্যে মোরাকাবা হলো উত্তম ইবাদত। মোরাকাবার মাধ্যমে রিপু দমন করা যায়। আত্মার উন্নতির জন্য অধিক মোরাকাবা করতে হয়। ধ্যান বা মোরাকাবা দ্বারা ষড়রিপু দমন করা সম্ভব। মোরাকাবার মাধ্যমে মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়। হযরত মোহাম্মদ (সা.) জাবালে নুরের হেরা গুহায় সুদীর্ঘ ১৫ বছর মোরাকাবার মাধ্যমে মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের সাথে যোগাযোগ করেন। তাই আমাদেরকেও অধিক মোরাকাবা করতে হবে।” তিনি আরো বলেন আল্লাহর প্রেরিত মহামানবগণ মোরাকাবার মাধ্যমে আল্লাহ্ সম্পর্কে জেনেছেন এবং আল্লাহ্কে পেয়েছেন। আধ্যাত্মিক জগত সম্বন্ধে জানতে হলে মোরাকাবার বিকল্প নেই। সাধক-মহাসাধকগণ যাঁরাই আল্লাহ্কে পেয়েছেন, তাঁরা নিজের ভেতরেই আল্লাহ্কে খুঁজে পেয়েছেন। তাঁরা মোরাকাবার মাধ্যমে ক্বালবের ৭০ হাজার পর্দা ভেদ করে আল্লাহর সাথে যোগাযোগ করেছেন।”
মহান আল্লাহর বাণী মোবারক, হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর বাণী মোবারক, নবি-রাসুল ও আউলিয়ায়ে কেরামের বাণী মোবারক এবং আমার মহান মোর্শেদের বাণী মোবারকের মাধ্যমে মোরাকাবা সম্পর্কে জানতে পারলাম। যে ধ্যানের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি লাভ করা যায়, মহান আল্লাহ্ ও হযরত রাসুল (সা.)-এর পরিচয় জানা যায় এবং তাঁদের নির্দেশমতো চলা যায় এবং সমগ্র সৃষ্টিতত্ত¡ সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়, তাকেই প্রকৃত অর্থে মোরাকাবা বলে। মানুষের হৃদয়ে আল্লাহ্ বিরাজমান, যুগে যুগে যত মহামানব আল্লাহ্কে পেয়েছেন, তাঁরাই হৃদয় মাঝে অনুসন্ধান করে প্রভুর পরিচয় লাভ করেছেন। মোরাকাবার মাধ্যমে মানুষ আত্মশুদ্ধি লাভ করতে পারে। সেজন্য সাধককে মোরাকাবার মাধ্যমে অন্তরচক্ষু খুলতে হয়। প্রতিটি ধর্মেই মোরাকাবার শিক্ষা ও গুরুত্ব রয়েছে। যে যুগে যে মহামানব পৃথিবীতে এসেছিলেন তাঁর সান্নিধ্যে গিয়ে, তাঁর হৃদয় থেকে ইমানের নুর হৃদয়ে ধারণ করে, সেই যুগের মানুষ আত্মার পরিশুদ্ধতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। সাধনার মাধ্যমে তাঁর হৃদয় আলোকিত হয়েছিল। তাদের সকলকেই সেই যুগের মহামানবের ধ্যান করে আল্লাহ্কে পেতে হয়েছিল। কারণ মহামানবের ভিতরে আল্লাহ্ বিকশিত অবস্থায় থাকেন। কেননা, নবুয়তের যুগে নবি-রাসুল এবং বেলায়েতের যুগে আউলিয়ায়ে কেরামের চেহারার ধ্যান বা মোরাকাবা করে ক্বালবকে আলোকিত করা যায়।
প্রকৃতপক্ষে মোরাকাবা করলে মু’মিন বান্দার ক্বালবে ফায়েজ বর্ষিত হয়। সেই ফায়েজ হাসিলের মাধ্যমে বান্দার আত্মশুদ্ধি অর্জিত হয়। মোরাকাবায় ফায়েজ লাভের মাধ্যমে ক্বালবের পাপের অন্ধকার দূর হয়ে হৃদয় আলোকিত হয়। ফলে মু’মিন হৃদয়ের দর্পণে মোরাকাবায় আল্লাহ্ ও হযরত রাসুল (সা.)-এর দিদার পায় এবং তাঁদের নির্দেশ মতো সঠিক পথে চলতে সক্ষম হয়। মোরাকাবার জ্ঞানের মাধ্যমে স্রষ্টার নৈকট্য যেমন লাভ হয়, তেমনি সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কেও অবগত হওয়া যায়।
মোরাকাবার গুরুত্ব ও ফজিলত
মহান আল্লাহর প্রেরিত মহামানবগণ মানুষকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য জগতে আগমন করেছেন। নবুয়তের যুগে নবি-রাসুলগণ এবং বেলায়েতের যুগে আল্লাহর অলীগণ মানুষকে মোরাকাবা শিক্ষা দিয়েছেন। মোরাকাবা এমন এক ধ্যান, যার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক জ্ঞান বৃদ্ধি পায়। চিন্তাভাবনা, ধ্যান-সাধনার মাধ্যমে এলমে মারেফাতের জ্ঞান বৃদ্ধির পাশাপাশি মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য হাসিল হয়।
নফল ইবাদতের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মোরাকাবা বা ধ্যান করা। মোরাকাবা একটি সর্বোত্তম ইবাদত ও আমল। এ প্রসঙ্গে আমিরুল মু’মিনিন হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন“গভীরভাবে চিন্তা করা বা মোরাকাবার সমতুল্য কোনো ইবাদত নেই।” (তাফসীরে মাজহারী ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২০০) মোরাকাবার ফজিলত সম্পর্কে হযরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন“তাফাক্কুরু সা‘আতিন ফি ইখতিলাফিল্লাইলি ওয়ান্নাহারি খাইরুম মিন ‘ইবাদাতি ছামানীনা সানাহ।” অর্থাৎ“রাত ও দিনের পরিবর্তনকারী আল্লাহ্কে নিয়ে এক ঘণ্টা মোরাকাবা করা আশি বছরের ইবাদতের চেয়েও উত্তম।” (তাফসীরে দুররে মানছুর ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪১০) হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে- তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন “ফিকরাতু সা‘আতিন খাইরুম মিন ‘ইবাদাতি সিত্তীনা।” অর্থাৎ“এক ঘণ্টা মোরাকাবা করা ষাট বছরের ইবাদতের চেয়েও উত্তম।” (তাফসীরে দুররে মানছুর, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪১০)
মোরাকাবার ফজিলত ও গুরুত্ব হযরত রাসুল (সা.) সাহাবিগণকে বাস্তবে শিক্ষা দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন“তাফাক্কুরু সা‘আতিন মিন ‘ইবাদাতি আলফি ‘আম।” অর্থাৎ“এক ঘণ্টা মোরাকাবা করা এক হাজার বছরের ইবাদতের চেয়েও উত্তম।” (আদর্শ পুস্তক বিতান, হক লাইব্রেরী, বাইতুল মোকাররম থেকে পরিবেশনায়, সিররুল আসরার, পৃষ্ঠা ২৪) এমনিভাবে আরো হাদিসে রয়েছে। আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন“এক ঘণ্টা ধ্যান করা সত্তর বছরের ইবাদতের চেয়েও উত্তম।” (আদর্শ পুস্তক বিপনী বিতান, হক লাইব্রেরী, বাইতুল মোকাররম থেকে পরিবেশনায়, সিররুল আসরার, পৃষ্ঠা ২৪) অনুরূপভাবে মোরাকাবার ফজিলত প্রসঙ্গে অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে- আল্লাহররাসুল (সা.) এরশাদ করেন“এক ঘণ্টা মোরাকাবা করা ষাট বছরের ইবাদতের চেয়েও উত্তম।” (আল কওলুল জামিল ও ফয়সালায়ে হাফতে মাসআলা, পৃষ্ঠা ৩৪)
হযরত উসমান ইবনে আবু দাহরাশ (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন“আমার নিকট এ হাদিস পৌঁছেছে যে, আল্লাহর রাসুল (সা.) সাথিদের নিকট উপস্থিত হলেন, তখন তারা নীরব ছিল, কোনো কথা বলছিল না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের কী হলো, তোমরা কথা বলছ না যে? তারা জবাব দিল, আমরা মহান আল্লাহর সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করছিলাম। তিনি বললেন, হ্যাঁ তাই করো। আল্লাহর সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করো, তবে আল্লাহ্কে কে সৃষ্টি করেছে এ সম্পর্কে চিন্তা করো না। নিশ্চয় পশ্চিম দিকে একটি শুভ্র ভ‚মি রয়েছে, সমস্ত ময়দানটি আলোকিত, অথবা তিনি বলেছেন, ময়দানের আলোতে সে জগৎ আলোকিত। ঐ জগৎ অতিক্রম করতে সূর্যের ৪০ দিন সময় লাগে। সেখানে আল্লাহর এমন মাখলুক রয়েছে, যারা মুহূর্তের জন্য আল্লাহর নাফরমানি করে না। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করল, তাদের শয়তান কোথায়? তিনি জবাব দিলেন, শয়তানকে সৃষ্টি করা হয়েছে কি না, সেটিও তারা জানে না। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করল, তারা কি আদম সন্তান? তিনি জবাব দিলেন, আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে কি না, তাও তারা জানে না।” (তাফসীরে ইবনে কাছীর, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৪৩)
মোরাকাবার মাধ্যমে বান্দার অন্তরে তাকওয়া বা খোদাভীতি তৈরি হয়। ফলে বান্দা মুত্তাকি হওয়ার পাশাপাশি ক্বালবে আল্লাহরজিকির জারির মাধ্যমে আল্লাহর প্রেমিক হতে পারে। ফলে বান্দার ইবাদত বন্দেগিতে একাগ্রতা ও গভীর মনোযোগ অর্জিত হয়। এ প্রসঙ্গে হযরত শামউন ইবনে লাভী (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন“মহান আল্লাহ্কে ভয় করার পদ্ধতি হচ্ছে চারটি। ১। গোপনে ও প্রকাশ্যে আল্লাহর মোরাকাবা করা, ২। কল্যাণজনক কাজ করা, ৩। কিয়ামতের ব্যাপারে চিন্তা ও গবেষণা করা এবং ৪। আল্লাহর সমীপে মোনাজাত করা।” [কালিমাতুর রাসুলিল আ‘জম (সা.), পৃষ্ঠা ৯৪)
মোরাকাবার ফজিলত সম্পর্কে আমিরুল মু’মিনিন, শেরে খোদা হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু হতে বর্ণিত হয়েছে“এক ব্যক্তি তাঁকে প্রশ্ন করলেন, ঐ আয়াতগুলো সম্পর্কে, যে আয়াতগুলো তার নিকট অস্পষ্ট মনে হচ্ছিল, মহান আল্লাহর বাণী ‘এরূপ লোকেরাই বেহেশতে প্রবেশ করবে সেখানে তাদের দেওয়া হবে অফুরন্ত রিজিক।’ হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু জবাবে বললেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহ্ ফরমান“আমার সম্মান প্রদর্শন হয়েছে অথবা আমার বন্ধুত্ব অবধারিত হয়েছে তাঁদের জন্য, যাঁরা আমার মোরাকাবা করেছে, আমার শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি মহব্বত রেখেছে, কেয়ামত দিবসে তাঁদের চেহারা নুরানি হয়ে যাবে, তাঁরা নুরের মিম্বরে অবস্থান করবে। তাঁদের দেহে থাকবে সবুজ পোশাক। আরজ করা হলো, ইয়া রাসুলাল্লাহ (সা.) তাঁরা কারা? আল্লাহর রাসুল (সা.) বললেন, তাঁরা নবিও নন, শহিদও নন, বরং তাঁরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের উপর ভালোবাসা স্থাপন করেছে (তাঁরা আল্লাহর অলীবন্ধুগণ)। মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন স্বীয় রহমতে আমাদেরকে তাঁদের দলভুক্ত করে দেন।” (মুসনাদে ইমাম আলী ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২২৩ ও ২২৪ এবং তাফসীরে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৪)
মোরাকাবার মাধ্যমে আত্মার ষড়রিপুসমূহ দমন হয়। সুফিসাধকগণ তথা আল্লাহর অলীগণের সহবত লাভ করার ফলে যেমন তাদের দিলে ফায়েজ বর্ষিত হয়, তার পবিত্র চেহারা ধ্যান কিংবা স্মরণ করলেও দিলে অনুরূপ ফায়েজ বর্ষিত হতে থাকে। আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন“মহান আল্লাহ্ বলেছেন, নিশ্চয় আমার বান্দাদের মধ্যে অলী-আল্লাহ্ হলেন তাঁরা, আমাকে স্মরণ করলে যাঁদের কথা স্মরণ হয়। তেমনি যাঁদেরকে স্মরণ করলে আমার কথা স্মরণ হয়।” (তাফসীরে মাজহারী, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৪৮) একটি উপমার মাধ্যমে বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা যায় যে, ক্লাসে শিক্ষক যখন উপস্থিত থাকেন, তখন ছাত্র শিক্ষকের দিকে মনোযোগী হলে জ্ঞানার্জন করে পূর্ণতা পায়, তেমনি মোরাকাবার সময় মুরিদ মোর্শেদের চেহারা মোবারক ধ্যানের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি অন্তরকে আলোকিত করতে সক্ষম হয় এবং আত্মশুদ্ধি হাসিল হয়। এজন্যই সাধকগণ আপন মোর্শেদের চেহারা মোবারক ধ্যানের মাধ্যমে তাঁর সামনে হাজির থাকার সমান উপকারিতা লাভ করে থাকেন। সুতরাং মোরাকাবায় ‘তাসাব্বুরে শায়েখ’ মোর্শেদের ধ্যান করা অনুসারীদের জন্য অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর একটি হাদিস উল্লেখ করা যেতে পারে। হাদিসখানা হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন-“একদা আমি রাতের শেষ প্রহরে বাতির আলোতে বসে আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর কাপড় মোবারক সেলাই করছিলাম। এ সময় হঠাৎ প্রদীপটি নিভে গেল এবং সুঁচটি আমার হাত থেকে পড়ে গেলে আমি সেটি হারিয়ে ফেললাম। অতঃপর আল্লাহর রাসুল (সা.) ঘরে প্রবেশ করলেন। এ সময় তাঁর চেহারা মোবারকের নুরের জ্যোতিতে অন্ধকার ঘর আলোকময় হয়ে গেল এবং আমি ঐ আলোতেই আমার হারানো সুঁচটি খুঁজে পেলাম। অতঃপর আমি এ কথা রাসুল (সা.)-কে জানালাম, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আপনার চেহারা মোবারক কতইনা আলোকিত! তখন তিনি বললেন, কিয়ামতের দিন বড়োই পরিতাপ! বড়োই পরিতাপ! তাদের জন্য, যারা আমার চেহারার প্রতি মহব্বতের নজরে তাকাল না (অর্থাৎ ধ্যান করল না)। [দুররুল মুনাজ্জাম এবং শিহাবউদ্দীন আহমদ ইবনে হাজার আল হায়তামী (রহ.)-এর আন-নি‘মাতুল কোবরা ‘আলাল ‘আলম কিতাব, পৃষ্ঠা ৪১ ও ৪২]
হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর চেহারা মোবারক ধ্যান করতে ভালোবাসতেন। হযরত রাসুল (সা.)-এর খাঁটি উত্তরসূরি আউলিয়ায়ে কেরামের চেহারা মোবারক ধ্যান করা অতি উত্তম কাজ। কেননা তাঁদের নির্দেশমতো আমল করলে মানুষের গুনাহর ময়লা দূর হয়ে আত্মা পবিত্র হয়ে যায়। এমন ব্যক্তি আল্লাহর কাছেও অধিক প্রিয়। যেমন, কোনো ঘর যদি অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকে, সেখানে একটি বাতি জ্বালালেই অন্ধকার দূর হয়ে যায়।
আল্লাহর অলীগণের পরিচয় প্রসঙ্গে হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন। তিনি বলেন“আরজ করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আল্লাহর অলী কারা? তিনি বললেন, যাঁদেরকে দেখলে আল্লাহর কথা স্মরণ হয় (আল্লাহর প্রেমের ফায়েজ পাওয়া যায়)।” (তাফসীরে দুররে মানছুর, ১১নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৭০) এমনিভাবে ইমাম বগভী (রহ.) উল্লেখ করেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে“একদা হযরত রাসুল (সা.)-কে প্রশ্ন করা হলো, অলী-আল্লাহ্ তথা আল্লাহর বন্ধুগণ কারা? জবাবে তিনি বললেন যাঁদের (চেহারা) দেখলে আল্লাহর কথা স্মরণ হয়।” (তাফসীরে মাজহারী, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৪৮)
মোরাকাবা বা ধ্যানের মাধ্যমে মু’মিন মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারে। আল্লাহর দিদার লাভের উত্তম মাধ্যম বা পদ্ধতি হচ্ছে মোরাকাবা বা ধ্যান করা। মোরাকাবার ফলে মু’মিন মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনকে আপন করে ফানাফিল্লাহর স্তরে পৌঁছতে সক্ষম হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহ্ বলেন-“আমার বান্দা নফল ইবাদত দ্বারা আমার এত বেশি নিকটবর্তী হয়ে যায় যে, আমি তাকে ভালো বাসতে বাসতে তার কান হয়ে যাই, যে কান দ্বারা সে শোনে, চোখ হয়ে যাই, যে চোখ দিয়ে সে দেখে, হাত হয়ে যাই, যা দিয়ে সে ধরে, পা হয়ে যাই, যা দিয়ে সে হাঁটে। এরূপ ব্যক্তি যখন কোনো বিষয়ে প্রার্থনা করে, তখনই তা দান করে থাকি এবং যখন কোনো বিষয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করে তখনই আশ্রয় দিয়ে থাকি।” (বোখারী শরীফ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৬৩; তাফসীরে মাজহারী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৮; মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ১৯৭)
সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মোহাম্মদ (সা.) শিক্ষক হিসেবে সাহাবিগণকে মোরাকাবা করার পদ্ধতি তালিম দিয়েছেন। অতঃপর সাহাবিগণ হযরত রাসুল (সা.)-এর কাছ থেকে মোরাকাবার মাধ্যমে অন্তরচক্ষু জাগ্রত করে আল্লাহ্ তায়ালার দিদার পাওয়ার শিক্ষা লাভ করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু বলেছেন “আমি এমন প্রভুর ইবাদত করি না, যাঁকে আমি দেখি না।” অনুরূপভাবে হযরত উমর (রা.) আল্লাহর দিদার লাভ প্রসঙ্গে বলেন“আমার প্রভুর নুর দ্বারা আমার ক্বালব আমার প্রতিপালকের দিদার লাভ করেছে।” (সিররুল আসরার পৃষ্ঠা ৪৩, আদর্শ পুস্তক বিপনী বিতান, হক লাইব্রেরী)
মোরাকাবার ফজিলত প্রসঙ্গে হযরত হাসান বসরী (রহ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন“একটু সময় চিন্তা-গবেষণা করা সারা রাত ইবাদত করা হতে উত্তম।” (তাফসীরে ইবনে কাছীর, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৪০) অনুরূপভাবে আমিরুল মু’মিনিন, শেরে খোদা হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন“মহান আল্লাহর নেয়ামতসমূহের চিন্তা-ভাবনা করা (আল্লাহ্কে নিয়ে ধ্যান করা) উত্তম ইবাদত।” (খামসাতু আলাফি হিকমাতিন মিন হিকামি আলী, পৃষ্ঠা ১৮৬) পাশাপাশি হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু আরো বলেন “আসমান ও জমিনের সৃষ্টিরাজি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার মাধ্যমে (মহান আল্লাহর ধ্যান করা) মুখলেস তথা একনিষ্ঠ বান্দাদের উত্তম ইবাদত।” (খামসাতু আলাফি হিকমাতিন মিন হিকামি আলী, পৃষ্ঠা ১৮৬) এমনিভাবে আমের ইবনে আবদে কাইস হতে হাসান বসরী (রহ.) বর্ণনা করেন যে, আমের ইবনে আবদে কাইস (রহ.) বলেছেন, আমি একজন নয়, দুইজন নয়, তিনজন নয়, বরং বহু সাহাবির নিকট শুনেছি, তাঁরা বলেছেন “নিশ্চয়ই ইমানের উজ্জ্বলতা অথবা ইমানের নুর বা জ্যোতি হলো (আল্লাহ্কে পাওয়ার জন্য) ধ্যান বা গবেষণা করা।” (তাফসীরে ইবনে কাছীর, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৪১) অনুরূপভাবে হযরত বাশার ইবনে হারিছ হাফী (রহ.) বলেন “মানুষ যদি আল্লাহর মহত্ত সম্পর্কে চিন্তা করত, তাহলে তারা পাপ করত না।” (তাফসীরে ইবনে কাছীর, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৪১)
মোরাকাবার গুরুত্ব প্রসঙ্গে হযরত যুননুন মিসরী (রহ.) বলেন, “যে ব্যক্তি মনের সন্দেহ ও কাজে চিন্তা ও ধারণাকে দূর করিয়া কেবলমাত্র আল্লাহর ওয়াস্তে মোরাকাবা করিতে থাকে, আল্লাহ্ তায়ালা তাহার বাহ্যিক কার্যকলাপকে লোকচক্ষে সম্মানিত করিয়া তোলেন। আর যে ব্যক্তির মনে আল্লাহর ভয় স্থান পাইয়াছে, সে ব্যক্তি কেবল আল্লাহ্ তায়ালার দিকে অগ্রসর হইতে থাকে। যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তায়ালার দিকে অগ্রসর হয়, সে মুক্তি লাভ করে।” (তাযকেরাতুল আওলিয়া, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১২৪)
মোরাকাবার গুরুত্ব প্রসঙ্গে হযরত হারেস মোহাসেবী (রহ.) বলেন, “যে ব্যক্তি মোরাকাবা ও এখলাস দ্বারা নিজের এতেক্বাদ ও ধারণা দুরস্ত করিয়া লয়, আল্লাহ্ তায়ালা মুজাহাদা এবং সুন্নতের পাবন্দী রূপ-অলঙ্কারে তাহাকে সুসজ্জিত করেন।” (তাযকেরাতুল আওলিয়া, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৬) হযরত জুনাইদ বাগদাদী (রহ.)-কে লোকেরা জিজ্ঞেস করল, মোরাকাবা এবং হায়ার মধ্যে প্রভেদ কী? তিনি উত্তরে বললেন, “গায়েবি বস্তু পাওয়ার প্রতীক্ষণ করাকে মোরাকাবা আর উপস্থিতের প্রতি লজ্জাবোধ করাকে হায়া বলে।” (তাযকেরাতুল আওলিয়া, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৭৮) হযরত শিবলী (রহ.) বলেন, “আমি একদিন হযরত আবুল হাসান নুরী বাগদাদী (রহ.)-এর খানকায় যাইয়া দেখিতে পাইলাম, তিনি মোরাকাবায় এমনভাবে নিমগ্ন রহিয়াছেন যে, তাঁহার শরীরের একটি পশম পর্যন্ত নড়ে না। পরে আমি বললাম, আপনি এমন সুদৃঢ় মোরাকাবা কোথা হইতে শিখিয়াছেন? তিনি বলিলেন, বিড়ালি হইতে। যখন সে ইঁদুরের গর্তের কাছে ইঁদুরের প্রতীক্ষায় বসিয়া থাকে। বিড়ালি তখন আমার চেয়ে বহু গুণে অধিক শান্ত, স্থির এবং নিশ্চল হইয়া থাকে।” (তাযকেরাতুল আওলিয়া, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২০৪ ও ২০৫) লোকেরা একবার হযরত ইবনে আতা (রহ.)-কে জিজ্ঞাসা করল, “এবাদতসমূহের মধ্যে কোনো এবাদত সর্বোত্তম? তিনি বলিলেন, সর্বক্ষণ আল্লাহ্ পাকের ধ্যানে (মোরাকাবায়) নিমগ্ন থাকা।” (তাযকেরাতুল আওলিয়া, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২২৫) হযরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.) মোরাকাবার গুরুত্ব প্রসঙ্গে বলেন, “মোরাকাবা ইহাই বান্দা ইয়াকিন রাখিবে যে, আল্লাহ্ তায়ালা তাহার সব কিছুরই খবর রাখেন। সদা-সর্বদা বান্দার মনে এই কথাটা জাগরূক রাখার নামই মোরাকাবা।” (গুনিয়াতুত্ব তালেবীন, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৫৭)
হযরত খাজা বাহাউদ্দিন নকশবন্দ (রহ.) মোরাকাবার গুরুত্ব প্রসঙ্গে বলেন, তিনটি কারণের ভিত্তিতে আরেফগণ আল্লাহ্ তায়ালার পথ প্রাপ্ত হইয়া থাকেন, ১। মোরাকাবা, ২। মোশাহাদা ও ৩। মোহাসাবাহ। মোরাকাবার সংজ্ঞা“খালেকের (সৃষ্টিকর্তার) প্রতি সর্বদা নজর এমনভাবে নিবদ্ধ করিয়া রাখিবে যে, কোনো মাখলুক দৃষ্টিগোচরই হইবে না।” (তাযকেরাতুল আওলিয়া, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৯) মোরাকাবার গুরুত্ব প্রসঙ্গে সুলতানুল হিন্দ হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.), তাঁর কিছু মুরিদ সন্তানকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, “আমি আল্লাহ্কে ডাক দিলে সাথে সাথে জবাব পাই, তোমরা পাও না? মোরাকাবার শিক্ষাটি লাভ করলে তোমরাও পাবে।” (মোর্শেদের দরবারে মুরীদের করণীয়, পৃষ্ঠা ১৯২) ইমাম সৈয়দ আবুল ফজল সুলতান আহমদ (রহ.) বলেন, “আমিত্ব ভুলে আল্লাহর নৈকট্য লাভের সহজ উপায় হলো মোরাকাবা।” তিনি আরো বলেন, নফল ইবাদতের মধ্যে আল্লাহর নৈকট্য লাভের সহজ ও শ্রেষ্ঠ ইবাদত মোরাকাবার চেয়ে অন্য কোনো ইবাদত নেই। স্রষ্টা ও সৃষ্টিতত্তের ভেদ ও রহস্য সম্বন্ধে জানতে হলে তা একমাত্র মোরাকাবা দ্বারাই সম্ভব।
মোরাকাবার গুরুত্ব প্রসঙ্গে আমার মহান মোর্শেদ সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) বলেন “ইবাদতের মধ্যে মোরাকাবা হলো উত্তম ইবাদত। আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য মোরাকাবা হলো সহজ ও সর্বোত্তম পদ্ধতি। আত্মার উন্নতির জন্য অধিক মোরাকাবা করতে হয়। ধ্যান বা মোরাকাবা দ্বারা ষড়রিপু দমন করা সম্ভব।” তিনি আরো বলেন, “আল্লাহর প্রেরিত মহামানবগণ মোরাকাবার মাধ্যমে আল্লাহ্ সম্পর্কে জেনেছেন এবং আল্লাহ্কে পেয়েছেন। আধ্যাত্মিক জগত সম্পর্কে জানতে হলে মোরাকাবার বিকল্প নেই। যাঁরাই আল্লাহ্কে পেয়েছেন, তাঁরা নিজেদের ভিতরেই আল্লাহ্কে খুঁজে পেয়েছেন। মোরাকাবার মাধ্যমে ক্বালবের ৭০ হাজার পর্দা ভেদ করে আল্লাহর সাথে যোগাযোগ করেছেন।”
পৃথিবীতে যত অলী-আল্লাহর কাশফ ও এলহাম ছিল, আছে এবং হবে তা একমাত্র মোর্শেদে কামেলের রুহানি শক্তির সাহায্যে হুজুরি দিলে মোরাকাবা দ্বারাই সম্ভব। সাধারণ মানুষের পক্ষে চর্ম চোখে আল্লাহ্কে দেখা সম্ভব নয়, কিন্তু অন্তরচক্ষু দ্বারা আল্লাহ্কে অনেকে দেখেছেন এবং দেখবেন। এই অন্তরচক্ষু শুধুমাত্র মোরাকাবা দ্বারাই খোলা সম্ভব। আল্লাহর রহমত, ফায়েজ, বরকত, কীভাবে ওয়ারিদ হয় এবং গাছপালা, তরু-লতা অর্থাৎ আসমান-জমিনের মধ্যে যা কিছু আছে সব কিছু আল্লাহর জিকির করে তা মোরাকাবার মাধ্যমে শুনতে ও বুঝতে পারা যায়। মোরাকাবা হলো আত্মশুদ্ধির প্রধান উপায়।
মূলত নফল ইবাদতের মধ্যে মোরাকাবা সর্বোত্তম ইবাদত। মোরাকাবার মাধ্যমে মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা সহজ হয়। এক ঘণ্টা মোরাকাবা ষাট বছরের নফল ইবাদতের চেয়েও উত্তম। মোরাকাবার ফলে আত্মশুদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি মহান আল্লাহ্কে লাভ করে যুগে যুগে অসংখ্য মানুষ বেলায়েতের যুগে আল্লাহর অলীতে পরিণত হয়েছেন। তাই আসুন, আমরা আমাদের মহান মোর্শেদ সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.)-এর সুমহান শিক্ষা অনুযায়ী মোরাকাবা করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করি। মহান আল্লাহ্ তাঁর প্রিয় বন্ধুর উসিলায় আমাদেরকে তাঁর নৈকট্য লাভ করার তাওফিক দান করুন। আমিন। (চলবে)
[লেখক: মোহাম্মদী ইসলামের নেতৃত্ব প্রদানকারী ইমাম; পরিচালক, সমন্বয়ক ও সমস্যার ফয়সালাকারী, দেওয়ানবাগ শরীফ; প্রফেসর, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি]

সম্পর্কিত পোস্ট