Cancel Preloader

সম্পাদকীয় জানুয়ারি ২০২৩

মহান রাব্বুল আলামিনের অপার দয়ায় ২০২২ সাল অতিবাহিত করে নতুন বছর ২০২৩-এ পদার্পণ করেছি। নতুন বছরের শুরু থেকে সারা দেশে শীতের প্রকোপ বেড়ে গেছে। আমাদের দেশে পৌষ ও মাঘ এই দুই মাস শীতকাল। শীতকাল ধনীদের জন্য আনন্দের আগমনী বার্তা নিয়ে আসলেও বস্ত্রহীন অসহায় দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের জন্য অবর্ণনীয় কষ্টদায়ক। কখনো কখনো শীতের প্রকোপে মানুষের মৃত্যুর খবরও পাওয়া যায়। এমতাবস্থায় মানবিক মূল্যবোধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অসহায় শীতার্তদের পাশে সামর্থবানদের এগিয়ে আসতে হবে।


ইসলাম মানবতার ধর্ম। আর্তমানবতার সেবায় ইসলামের ভূমিকা সর্বাগ্রে। হযরত রাসুল (সা.)-এর গৌরবদীপ্ত জীবনে মানবপ্রেমের অসংখ্য ঘটনার সমুজ্জ্বল নিদর্শন পাওয়া যায়। ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে আহার তুলে দেওয়া এবং বস্ত্রহীনদের বস্ত্র দেওয়ার জন্য হযরত রাসুল (সা.) বিশেষ তাগিদ দিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সাহাবি হযরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, “যে মু’মিন কোনো মু’মিনের ক্ষুধা নিবারণ করবে, আল্লাহ্ তায়ালা তাকে কেয়ামতের দিন জান্নাতের ফল খাওয়াবেন। যে মু’মিন কোনো মু’মিনের তৃষ্ণা দূর করবে, আল্লাহ্ তায়ালা তাকে কেয়ামতের দিন মোহরাঙ্কৃত জান্নাতি সুধা থেকে পান করাবেন। যে মু’মিন কোনো মু’মিনকে বস্ত্র দান করবে, আল্লাহ্ তায়ালা তাকে জান্নাতের উন্নতমানের সবুজ কাপড় পরাবেন।” (তিরমিজি শরীফ, হাদিস নং ২৩৮৬) সুতরাং অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানো আমাদের সবার দায়িত্ব। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ ফরমান, “আল্লাহ্ তোমাদেরকে যে সম্পদ দিয়েছেন তোমরা তা থেকে তাদেরকে দান করো।” (সূরা নূর ২৪: আয়াত ৩৩) মহান আল্লাহর এই বাণী মোবারক থেকে স্পষ্ট যে, সম্পদশালীরা আল্লাহর দেওয়ার সম্পদ থেকেই প্রাচুর্যবান হয়ে থাকে। তাই তাদের সেই প্রাচুর্য অসহায় মানুষের কল্যাণে ব্যয় করা অত্যাবশ্যক। এই প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেন, “তাদের (বিত্তশালী) ধন সম্পদ অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।” (সূরা যারিয়াত ৫১: আায়াত ১৯)


আমাদের আশপাশের অসহায়, দুঃখী, অভাবগ্রস্ত মানুষগুলো আমাদের সমাজেরই অংশ। তাদের কষ্ট ও অভাব মোচনে আমাদেরকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আমর (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- হযরত রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, “দয়াশীলদের ওপর করুণাময় আল্লাহ্ দয়া করেন। তোমরা দুনিয়াবাসীকে দয়া করো, তাহলে যিনি আসমানে আছেন, তিনি তোমাদের দয়া করবেন।” (আবু দাউদ শরীফ) এই প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “নিশ্চয় দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারী এবং যারা আল্লাহকে উত্তম করজ (ঋণ) দেয়, তাদের জন্য বহুগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হবে এবং তাদের জন্য আছে সম্মানজনক প্রতিদান।” (সূরা হাদিদ ৫৭: আয়াত ১৮) সুতরাং আর্তমানবতার সেবায় নিজেদেরকে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রাখতে পারলে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এর প্রতিদান পাওয়া যায়। বর্তমানে শীতার্ত মানুষের কষ্ট লাঘব করার জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ প্রশংসাজনক। এছাড়া ব্যক্তিগতভাবেও আমরা এগিয়ে আসতে পারি। কালক্ষেপণ না করে শীতার্ত মানুষের হাতে শীতবস্ত্র ও কম্বল দিতে পারি। কারণ শীতের তীব্রতায় তাদের জীবন হয়ে উঠছে বিপর্যস্ত। বহু মানুষ খোলা আকাশের নিচে রাতযাপন করে, আবার বহু মানুষ ছেঁড়া কাপড় মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকে। মাথা গোঁজার একটুখানি ঠাঁই তাদের নেই। ঘন কুয়াশা ও তীব্র শীতের প্রকোপে নিদারুণ কষ্ট ও দুঃসহ অবস্থায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তের লাখ লাখ দুঃস্থ মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করছে। ঘন কুয়াশায় যানবাহন চলাচল ও পণ্যদ্রব্য সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং ব্যাহত হচ্ছে চাষাবাদ। এছাড়া শীতজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ায় শিশু ও বৃদ্ধদের কষ্ট বেড়েছে বহুগুণ। শীতজনিত রোগ থেকে রক্ষা পেতে প্রয়োজন যথাযথ চিকিৎসা ও ওষধুপত্র। সুতরাং জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে শীতার্ত মানুষের সেবায় সমাজের বিত্তবানদের আত্মনিয়োগ করা অনস্বীকার্য।


হাদিস শরীফে আছে- “যে ব্যক্তি দুনিয়াতে অপরের একটি প্রয়োজন মিটিয়ে দেবে, পরকালে আল্লাহ্ তার ১০০টি প্রয়োজন পূরণ করে দেবেন এবং বান্দার দুঃখ-দুর্দশায় কেউ সহযোগিতার হাত বাড়ালে আল্লাহ্ তার প্রতি করুণার দৃষ্টি দেন।” (মুসলিম শরীফ) মহান আল্লাহ্ ধনী ও গরিব সৃষ্টি করেছেন। প্রত্যেকের পরস্পর কিছু অধিকার আছে, তারা সেই অধিকার রক্ষা করতে ব্যর্থ হলে আল্লাহ্ অসন্তুষ্ট হন। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ এরশাদ করেন, “কীসে তোমাদেরকে (দোজখে) সাকারে নিক্ষেপ করেছে? তারা বলবে, আমরা মুসল্লিদের অন্তর্ভূক্ত ছিলাম না, আমরা অভাবগ্রস্তকে আহার দান করতাম না।” (সূরা মুদ্দাছছির ৭৪: আয়াত ৪২-৪৪) অসহায় মানুষকে সহায়তা করতে হবে। মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুল (সা.) কৃপণতা পছন্দ করেন না। এই প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে একদা হযরত রাসুল (সা.) সাহাবিদের উদ্দেশে বলেন, “তোমরা কৃপণতাকে ভয় করো। কেননা কৃপণতার কারণে তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা ধ্বংস হয়েছে। তাদের লোভ-লালসা তাদেরকে কৃপণতার নির্দেশ দিয়েছে- তখন তারা কৃপণতা করেছে। আর তা তাদেরকে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করতে বলেছে- তখন তারা তা ছিন্ন করেছে। আর তা তাদেরকে লাম্পট্যের দিকে প্ররোচিত করেছে, তখন তারা তাতে লিপ্ত হয়েছে।” (আবু দাউদ শরীফ-ই.ফা.বা. কর্তৃক অনূদিত-দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৫২-৪৫৩)


সুতরাং কৃপণতা পরিহার করে নিঃস্বার্থভাবে বিপদগ্রস্ত মানুষের সাহায্য ও সেবা করাই মানব ধর্ম। মানবতাবোধ, সহমর্মিতা, পরোপকার, সহানুভূতি, এককথায় মানবপ্রেম ও কল্যাণই ইসলামের শিক্ষা। মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের সকলকে মানবতার শিক্ষা হৃদয়ে ধারণের তৌফিক এনায়েত করুন। আমিন।

সম্পর্কিত পোস্ট