Cancel Preloader

সৃষ্টিকুলের শ্রেষ্ঠ ঈদ: দয়াল রাসুল (সা.)-এর জন্ম ঈদ – মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী, সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান

[সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজান রচিত ‘বিশ্বনবীর স্বরূপ উদ্ঘাটনে সূফী সম্রাট: রাসূল (সঃ) সত্যিই কি গরীব ছিলেন?’ কিতাব থেকে লেখাটি সংকলন করা হয়েছে।-সম্পাদক]
মহান স্রষ্টা ও প্রতিপালক আল্লাহ্ তায়ালা সৃষ্টির সূচনার পূর্বে এক ও অদ্বিতীয় সত্তা অবস্থায় বিরাজমান ছিলেন। তখন তাঁর মাঝে স্বীয় পরিচয় প্রকাশের অভিলাষ জাগরিত হওয়ার পর সৃষ্টিজগৎ সৃজন করলেন। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ্ তায়ালা নিজেই এরশাদ করেন- “আমি ছিলাম গুপ্ত ধনাগার, নিজেকে প্রকাশ করতে ভালোবাসলাম তাই সৃষ্টিজগৎ সৃজন করলাম।” (সিররুল আসরার, পৃষ্ঠা ১০)


আপন রূপ, গুণ ও মাধুর্য প্রকাশের লক্ষ্যে আল্লাহ্ তায়ালা সর্বপ্রথম তাঁর সমস্ত গুণাবলির ধারক রূপে ‘নুরে মোহাম্মদী’ সৃষ্টি করেছেন। আর ‘নুরে মোহাম্মদী’ হতে সমস্ত সৃষ্টিরাজি সৃজিত হয়েছে। এজন্যই হাদিস শরীফে হযরত রাসুল (সা.) ফরমান- “আউয়ালু মা খালাকাল্লাহু নূরী, আনা মিন নূরিল্লাহি ওয়া কুল্লা শাইয়্যিম মিন নূরী।” অর্থÑ “আল্লাহ্ তায়ালা সর্বপ্রথম আমার ‘নুর’ কে সৃজন করেছেন। আমি আল্লাহ্র নুর হতে আর সমস্ত সৃষ্টিরাজি আমার নুর হতে”। অন্য এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে- “আউয়ালু মা খালাকাল্লাহু নূরী ওয়া মিন নূরী খালাকা কুল্লা শাইয়্যিন।” অর্থাৎ আল্লাহ্ তায়ালা সর্বপ্রথম আমার নুরকে সৃষ্টি করেছেন এবং আমার নুর থেকে সকল বস্তু সৃষ্ট।
এ প্রসঙ্গে হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ্ তাআলা ফরমান- “খালাক্বতু মুহাম্মাদান মিন্ নূরি ওয়াজহী।” অর্থ- আমি আমার চেহারা মোবারকের নুর দ্বারা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে সৃষ্টি করেছি। (সিররুল আস্রার, পৃষ্ঠা ৩)


হযরত রাসুল (সা.)-এর মাধ্যমে আপন জাত-সত্তার পরিচয় প্রকাশ করবেন বলেই আল্লাহ্ তায়ালা স্বীয় গুণের পরিচায়করূপে তাঁকে সৃষ্টি করেছেন। হাদিসে কুদসিতে এরশাদ হয়েছে- “লাওলাকা লামা খালাকতুল আফলাক।” অর্থ- (হে হাবিব) আমি আপনাকে সৃষ্টি না করলে কোনো কিছুই সৃষ্টি করতাম না। (সিররুল আস্রার, পৃষ্ঠা ৭০) হযরত রাসুল (সা.)-ই হলেন আল্লাহ্র ওয়াহেদানিয়াত ও শান-মর্যাদা প্রচারের মধ্যমণি। মহান আল্লাহ্ তাঁকে পবিত্র কুরআনে ‘মুহাম্মদ’ অর্থাৎ পরম প্রশংসিত হিসেবে আখ্যায়িত করে মানব মণ্ডলীকে জানিয়ে দিয়েছেন- “লাক্বাদ কানা লাকুম ফী রাসূলিল্লাহি উসওয়াতুন হাসানাহ।” অর্থ- তোমাদের জন্য রাসুলুল্লাহ্ (সা.)-এর মধ্যে রয়েছে সুন্দরতম আদর্শ। (সূরা আহযাব ৩৩: আয়াত ২১) আল্লাহ্ তায়ালা হযরত রাসুল (সা.)-কে মানবমণ্ডলীর সাক্ষীদাতা, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে পৃথিবীতে প্রেরণ করবেন বলেই সৃষ্টির আদিতে হযরত আদম (আ.) হতে শুরু করে পৃথিবীতে আগত সমস্ত নবি-রাসুলকে একত্রিত করে তাঁকে স্বীকার ও সাহায্য করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “স্মরণ করুন, যখন আল্লাহ্ অঙ্গীকার নিয়েছিলেন নবিদের কাছ থেকে যে, আমি তোমাদের যা কিছু দিয়েছি কিতাব ও হিকমত এবং তোমাদের নিকট যা কিছু আছে তার সত্যায়নকারীরূপে যখন একজন রাসুল [হযরত মোহাম্মদ (সা.)] আসবেন, তখন অবশ্যই তোমরা তাঁর প্রতি ইমান আনবে এবং তাঁকে সাহায্য করবে। তারপর তিনি (আল্লাহ্) বললেন, তোমরা কি স্বীকার করলে এবং এ বিষয়ে আমার অঙ্গীকার কবুল করলে? তারা (নবি-রাসুলগণ) বলল, আমরা স্বীকার করলাম। তিনি বললেন, তাহলে তোমরা সাক্ষী থাকো এবং আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষী রইলাম।” (সূরা আলে ইমরান ৩: আয়াত ৮১)


হযরত রাসুল (সা.) সমস্ত নবিদের সর্দার ও সমস্ত সৃষ্টির সেরা বলেই তাঁকে ইমামুল মুরসালিন বা পয়গম্বরগণের ইমাম বলা হয়েছে এবং পৃথিবীতে তাঁর আগমনের সুসংবাদ পূর্ববর্তী নবি-রাসুলগণের মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। তাঁর সম্পর্কে প্রথম আসমানি কিতাব, তাওরাত-এ বর্ণিত হয়েছে, “তোমাদের প্রভু ঈশ্বর তোমাদের ভ্রাতৃদের মধ্য হতে আমার (মুসা) মতই একজন পয়গম্বর উত্থিত করবেন, তাঁর কথা তোমরা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করবে।”


ইনজিল (বাইবেল)-এ বর্ণিত হয়েছে, “যদি তোমরা আমাকে ভালোবাস, তবে আমার উপদেশ মতো কার্য করো; আমি স্বর্গীয় পিতার কাছে প্রার্থনা করব, যাতে তিনি তোমাদেরকে আর একজন শান্তিদাতা প্রেরণ করেন, যিনি চিরদিন তোমাদের সঙ্গে থাকতে পারবেন।” আরো বর্ণিত হয়েছে, “যাই হোক, আমার উচিৎ যে, তোমাদের মঙ্গলের জন্য আমি চলে যাই, কারণ আমি না গেলে সেই শান্তিদাতা আসবেন না; কিন্তু আমি যদি যাই তবে তাঁকে পাঠিয়ে দিবো।”


‘ভবিষ্য পুরাণ’-এ বর্ণিত হয়েছে, “ঠিক সেই সময় ‘মুহাম্মদ’ নামক এক ব্যক্তি যাঁর বাস ‘মরুস্থলে’ (আরব দেশে) আপন সাঙ্গপাঙ্গসহ আবিভর্‚ত হবেন। হে আরবের প্রভু! হে জগদ্গুরু; তোমার প্রতি আমার স্তুতিবাদ। তুমি জগতের সমুদয় কলুষ নাশ করার উপায় জানো, তোমাকে নমস্কার। হে পবিত্র পুরুষ! আমি তোমার দাস। আমাকে তোমার চরণতলে স্থান দাও।”


‘উপনিষদ’-এ আছে, “আল্লাহ্ সকল গুণের অধিকারী। তিনি পূর্ণ ও সর্বজ্ঞানী। মুহাম্মদ আল্লাহ্র রাসুল। আল্লাহ্ আলোকময়, অমিয়, এক, চিরপরিপূর্ণ এবং স্বয়ম্ভূ।”
হযরত রাসুল (সা.)-এর মাহাত্ম্য ও সম্মানে সমগ্র সৃষ্টি জগৎ তাঁর প্রশংসায় উদ্বেলিত হয়ে উঠে। তাঁকে প্রকৃত পরিচয়ে পরিপূর্ণ বৈশিষ্ট্যে বক্ষে লালনের জন্য বিশ্ব প্রকৃতি যুগ-যুগ ধরে অধীর আগ্রহে প্রহর গুণছিল।


হযরত রাসুল (সা.)-কে তাঁর আপনরূপে কোলে পাওয়ার জন্য যুগ-যুগান্তরের প্রতীক্ষায় পুঞ্জীভূত বেদনা ও ক্লান্তিতে সমগ্র বিশ্ব প্রকৃতি উতলা হয়ে উঠে। পৃথিবী জুড়ে মানুষের নৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় যাবতীয় বিষয়ে নেমে আসে চরম অধঃপতন। মানুষকে পাপ-কালিমা থেকে উদ্ধার করার মতো মহীরুহের অভাবে তখন মানুষ জীবাত্মার বশীভূত হয়ে মানবীয় গুণাবলি হারিয়ে আনাচার, অবিচার , ব্যভিচার ছাড়াও অগ্নিপুজা, মূর্তিপূজার ন্যায় বিভিন্ন খোদাদ্রোহী কার্যে লিপ্ত ছিল। পাপ-পঙ্কিলতার অন্ধকার থেকে পরিত্রাণ পেয়ে আলোর দিশা পাওয়ার জন্য পৃথিবীর আকাশ-বাতাস, জল-স্থল, পাহাড়-পর্বত সমস্তই ঐকান্তিকভাবে ‘নুরে মোহাম্মদী’র আগমনের প্রত্যাশায় ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল।
পৃথিবীর এমনি ঘনঘোর তমসাচ্ছন্ন দিনে মানব জাতিকে সত্য ও শান্তির পথে তুলে আনার জন্যে মহান আল্লাহ্ তাঁর সর্বোত্তম সৃষ্টি হযরত রাসুল (সা.)-কে হিজরিপূর্ব ৫৩ সালের ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার সুবেহ সাদেকের সময় এ পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। যাঁকে প্রেরণের মাধ্যমে রাব্বুল ইজ্জত আপন মহিমাকে প্রকাশিত করতে চেয়েছিলেন, সেই রাহ্মাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.)-এর জন্মদিন আল্লাহ্র কাছে সবচেয়ে আনন্দের দিন ছিল। তাই হযরত রাসুল (সা.)-কে পৃথিবীতে প্রেরণের আনন্দের আতিশয্যে মহান আল্লাহ্ তায়ালা স্বীয় ফেরেশতাদের নিয়ে তাঁর প্রতি দরুদ পাঠ করছিলেন এবং মানুষকেও তাঁর প্রতি দরুদ পাঠ করে শ্রদ্ধার সাথে সালাম জানাতে নির্দেশ করেছেন। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “ইন্নাল্লাহা ওয়া মালাইকাতাহু ইউছাল্লুনা আলান নাবিয়্যি ইয়া আইয়্যু হাল্লাজিনা আমানু ছাল্লু আলাইহি ওয়া সাল্লিমু তাসলিমা।” অর্থ- নিশ্চয় আল্লাহ্ নিজে ও তাঁর ফেরেশতারা নবির উপর দরুদ পাঠ করেন। হে বিশ্বাসীরা! তোমরাও তাঁর উপর দরুদ পাঠ করো ও শ্রদ্ধার সাথে সালাম পেশ করো। (সূরা আহযাব ৩৩: আয়াত ৫৬)
সুফি সাধকদের মতে, যে দিন হযরত রাসুল পাক (সা.) ধরাধামে আগমন করেছিলেন, সেদিন আল্লাহ্ নিজে, তাঁর ফেরেশতারা, সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরাম, সমস্ত আউলিয়ায়ে কেরাম রুহানিতে হযরত রাসুল (সা.)-এর শুভ জন্মের আনন্দ প্রকাশ করেন এবং তাঁকে অভিবাদন জানিয়ে বলেছেন, “আস্সালাতু ওয়াস্সালামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ্; আস্সালাতু ওয়াস্সালামু আলাইকা ইয়া হাবিবাল্লাহ্; মারহাবা ইয়া রাসুলাল্লাহ্; মারহাবা ইয়া হাবিবাল্লাহ্।”


হযরত রাসুল (সা.)-এর শুভ জন্মের বর্ণনা দিতে গিয়ে ‘মাওয়াহিবু লাদ্দুন্নিয়া’ কিতাবে বলা হয়েছে, হযরত আমিনা (আ.) বলেন, “প্রশংসিত সন্তান ভ‚মিষ্ঠ হওয়ার সময় আমি তাঁকে সেজদারত অবস্থায় দেখেছিলাম। উভয় হাতের তর্জনী অঙ্গুলি দোয়া ক্রন্দনকারীর ন্যায় আকাশের দিকে প্রসারিত ছিল।” মা আমিনা আরো বলেছেন, “সন্তান ভ‚মিষ্ঠ হওয়ার পর কারা যেন তাঁর সন্তানটিকে নিয়ে গিয়ে সমস্ত সৃষ্টিজগৎ পরিভ্রমণ করান। তিনি তাঁদের কথাবার্তা শুনেছিলেন। তিনি ঊর্ধ্বলোকের সম্মানিত ব্যক্তিগণের কথাবার্তার এক অংশে শুনেছিলেন যে, মুহাম্মদকে সকল নবির গুণাবলিতে বিভ‚ষিত করো এবং সকল আম্বিয়াদের চরিত্র সাগরে ডুবিয়ে দাও।”


হযরত রাসুল (সা.)-এর শুভ জন্মলগ্ন বহু অলৌকিক ঘটনায় পরিপূর্ণ। যেমন- (১) নওশেরাওয়া বাদশাহ্র সিংহাসন নড়ে উঠা; (২) মাওয়া দরিয়া শুকিয়ে যাওয়া; (৩) সাম হওয়া হ্রদ পানিতে ভরে যাওয়া; (৪) পারস্যের অগ্নিকুণ্ড হঠাৎ নিভে যাওয়া; (৫) ক্বাবা ঘরের ‘হুবুল’ নামক বৃহৎ মূর্তিটির উপুর হয়ে পড়ে যাওয়া ইত্যাদি।


‘নুরে মোহাম্মদী’ নামক কিতাবে আছে, “ঐ রাতে কোরায়েশদের একটি মূর্তির মুখ দিয়ে কথা বের হয়েছিল। সে বলেছিল, একটি পবিত্র সন্তান প্রকাশ হওয়ায় চাদর পরিধান করেছি। এর জ্যোতিতে পৃথিবীর পূর্ব-পশ্চিমের সমস্ত এলাকা আলোকিত হয়ে গিয়েছে। তাঁরই উদ্দেশে সকল মূর্তি উপুড় হয়ে পড়েছে। আর তাঁর ভয়ে প্রকম্পিত হয়ে বিশ্বের সমস্ত রাজা-বাদশাহ্দের প্রাণ কেঁপে উঠেছে।”


প্রিয় পাঠক! এখন চিন্তা করে দেখার বিষয় যে, কেন আল্লাহ্ তায়ালার কাছে হযরত রাসুল (সা.)-এর শুভ জন্মদিনটি এত দীর্ঘ কাক্সিক্ষত ছিল? আর কেনই বা তিনি তাঁর শুভ জন্মদিনে এত বেশি আনন্দিত হয়ে জগতে অফুরন্ত রহমত-বরকত নাজিল করেছিলেন? প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্র সাথে হযরত রাসুল (সা.)-এর নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান, তা এর থেকে আঁচ করা যায়।


আল্লাহ্ তায়ালা হযরত রাসুল (সা.)-এর নুর হতে সমগ্র সৃষ্টিরাজি সৃজন করে তাঁকে একেবারে আপন করে নিজের সাথে জড়িয়ে রেখেছেন। এজন্যই আল্লাহ্ তায়ালা নিজের সম্বন্ধে এরশাদ করেন, “রাব্বুল আলামিন”-“মহাবিশ্বের প্রভু”; আর হযরত রাসুল (সা.) সম্বন্ধে এরশাদ করেন, “রাহ্মাতুল্লিল আলামিন”-“মহাবিশ্বের রহমত”। অর্থাৎ- আল্লাহ্ তায়ালা যতটুকু জগতের প্রভু, হযরত রাসুল (সা.)-ও ততটুকু জগতের জন্য রহমত। আবার আল্লাহ্ তায়ালা নিজের সম্বন্ধে এরশাদ করেন- “আল্লাহু নূরুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদি।” অর্থ- আল্লাহ্ নভোমণ্ডল ও ভ‚মণ্ডলের নুর বা জ্যোতি। (সূরা আন নূর ২৪: আয়াত ৩৫) পক্ষান্তরে হযরত রাসুল (সা.) সম্বন্ধে এরশাদ করেন- “সিরাজামমুনিরা।” অর্থÑ “প্রজ্বলিত বাতি”। অর্থাৎ- আল্লাহ্ হলেন আলো বা জ্যোতি; আর হযরত রাসুল (সা.) হলেন প্রদীপ। অধিকন্তু মহান আল্লাহ্ যে, হযরত রাসুল (সা.)-এর মাঝে বিরাজমান সে কথা বুঝাতে গিয়ে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “(হে হাবিব!) আপনি বলে দিন, যদি তোমরা আল্লাহ্কে ভালোবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ করো, তবে আল্লাহ্ও তোমাদের ভালোবাসবেন, তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করবেন।” (সূরা আলে ইমরান ৩: আয়াত ৩১) হযরত রাসুল (সা.)-এর কাছে আত্মসমর্পণ করলেই যে, আল্লাহ্তে আত্মসমর্পণ করা হয়, এ প্রসঙ্গে এরশাদ হয়েছে-“নিশ্চয় যারা আপনার কাছে আনুগত্যের শপথ করে, তারা তো আল্লাহ্র কাছে আনুগত্যের শপথ করে। আল্লাহ্র হাত তাদের হাতের উপর রয়েছে।” (সূরা ফাতাহ্ ৪৮: আয়াত ১০) এমনিভাবে আল্লাহ্ তায়ালা বারবার সতর্ক করেছেন, যেন কেউ হযরত রাসুল (সা.)-কে আল্লাহ্ হতে বিচ্ছিন্ন মনে না করে। তারপরও যদি কেউ তা করে তবে এর ভয়াবহ পরিণতির কথা উল্লেখ করে এরশাদ হয়েছে- “যারা আল্লাহ্ ও রাসুলগণের সাথে কুফুরি করে এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলগণের মধ্যে পার্থক্য করে এবং বলে আমরা কতককে বিশ্বাস করি আর কতককে অবিশ্বাস করি এবং তারা মধ্যবর্তী কোন পথ অবলম্বন করতে চায়, প্রকৃতপক্ষে তারাই কাফের এবং কাফেরদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি।” (সূরা নিসা ৪: আয়াত ১৫০ ও ১৫১) আর যারা আল্লাহ্ ও রাসুল (সা.)-এর মধ্যে পার্থক্য করে না, তাদের পুরস্কারের প্রসঙ্গে এরশাদ হয়েছে- “যারা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলগণের প্রতি বিশ্বাস আনে এবং তাঁদের একের সাথে অপরের পার্থক্য করে না; তাদেরকে তিনি পুরস্কৃত করবেন।” (সূরা নিসা ৪: আয়াত ১৫২)। এমনিভাবে মহান আল্লাহ্ বারবার বুঝাতে চেয়েছেন যে, হযরত রাসুল (সা.) হলেন সৃষ্টির মূল। সৃষ্টিকুলের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই যেহেতু হযরত রাসুল (সা.)-এর আবির্ভাব, সেহেতু তাঁর শুভ জন্মের দিন তথা পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.)-এর দিনটি আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের জন্যও সবচেয়ে আনন্দময় দিন। তাই তিনি সবাইকে আনন্দ প্রকাশের নির্দেশ দিয়ে এরশাদ করেন- “[হে রাসুল (সা.)] আপনি বলুন, এটি আল্লাহ্র অনুগ্রহে ও রহমতে; সুতরাং এতে [মোহাম্মদ (সা.)-এর আগমনে] তারা আনন্দিত হউক, তারা যা কিছু জমা করে তার চেয়ে তিনি [মোহাম্মদ (সা.)] অনেক উত্তম।” (সূরা ইউনুছ ১০: আয়াত ৫৮) কিন্তু পরিতাপের বিষয় আমরা হযরত রাসুল (সা.)-এর শুভ জন্মদিন তথা পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) উদ্যাপন করি না। অথচ হেদায়েতের আলোকবর্তিকা নিয়ে যত নবি-রাসুল এ পৃথিবীতে এসেছেন, হযরত রাসুল (সা.) হলেন তাঁদের সবার নেতা। তাঁর সুপারিশ ব্যতীত কারো মুক্তি হবে না। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “সেদিন (শেষ বিচারের দিন) আমি প্রত্যেক সম্প্রদায় হতে তাদেরই একজন (নবি) সাক্ষী হিসেবে উত্থিত করবো এবং আপনাকে [রাসুল (সা.)] আমি তাদের সত্যায়নকারী হিসেবে আনয়ন করব।” (সূরা নাহল ১৬: আয়াত ৮৯)


সামাজিকভাবে দেখা যায়, খ্রিষ্টানরা তাদের নবি হযরত ঈসা (আ.)-এর জন্মদিন মহাধুমধামের সাথে পালন করে থাকে। অনুরূপভাবে অন্য সকল ধর্মাবলম্বীরাও নিজ নিজ ধর্মের প্রবর্তকদের জন্মদিন সর্বাধিক গুরুত্ব সহকারে পালন করে। কিন্তু আমাদের নবি হযরত রাসুল (সা.) সমস্ত নবি-রাসুলের ইমাম বা নেতা হওয়া সত্তে¡ও আমরা তাঁর শুভ জন্মদিন পালন করি না। অথচ পৃথিবীর সমস্ত নবি-রাসুল ও ধর্মপ্রচারকই হযরত রাসুল (সা.)-এর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে তাঁর আশীর্বাদ কামনা করেছেন। যেমন, ঈসা (আ.) বলেন, “হে বনি ইস্রাইল! আমি তোমাদের কাছে আল্লাহ্র রাসুল। আমার পূর্ববর্তী তাওরাতের আমি প্রত্যয়নকারী এবং আমি এমন একজন রাসুলের সুসংবাদদাতা, যিনি আমার পরে আগমন করবেন, তার নাম- আহমদ।” এমনকি ঈসা (আ.) হযরত রাসুল (সা.)-এর উম্মত হওয়ার আকাক্সক্ষাও করেছিলেন।


কিন্তু পরিতাপের বিষয় আমরা সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুলের উম্মত হওয়া সত্তে¡ও তাঁকে চিনতে পারলাম না। আমাদের মাঝে কেউ কেউ মনে করেন, হযরত রাসুল (সা.) দুনিয়া থেকে পর্দা করার পর মাটির সাথে মিশে গেছেন। আমাদের জন্য তাঁর আর কিছু করার নাই। অথচ পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেন- “ইয়া আইয়্যুহান নাবিয়্যু ইন্না আরসালনাকা শাহিদাও ওয়া মুবাশশিরাও ওয়া নাজিরা।” অর্থÑ “হে রাসুল! আমি আপনাকে সাক্ষীদাতা, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি।” (সূরা আহযাব ৩৩: আয়াত ৪৫) যেহেতু তিনি সমগ্র মাখলুকাতের সাক্ষীদাতা, সেহেতু তিনি সর্বকালেই ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। অন্যথায় তিনি না দেখে সাক্ষী দিবেন কীভাবে?


আসলে আমরা হযরত রাসুল (সা.)-এর মহব্বত হারিয়ে ফেলেছি। অথচ হযরত রাসুল (সা.)-এর ভালোবাসার প্রতি গুরুত্বারোপ করে হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে- “যে ব্যক্তি নিজের পিতা-মাতা, সন্তানসন্ততি ও অন্যসকল মানুষ অপেক্ষা আমাকে বেশি ভালো না বাসবে, সে মুমেন হতে পারবে না।” (বোখারী শরীফ-১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭ এবং মুসলিম শরীফ-১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৯) আমরা প্রকৃত ইমানদার হতে পারিনি বলেই হযরত রাসুল (সা.)-এর পূর্ণাঙ্গ মহব্বত আমাদের মাঝে নেই। আমরা হাজার হাজার টাকা ব্যয় করে নিজের ছেলে-মেয়ের জন্মদিন ধুমধামের সাথে পালন করি। অথচ হযরত রাসুল (সা.)-এর জন্মদিন পালনের প্রয়োজনীয়তা আমরা অনুভব করি না।


রাহ্মাতুল্লিল আলামিনের জন্মদিনের ফজিলত এত বেশি যে, তাঁর জীবদ্দশাতেও সাহাবিগণের বাড়িতে ধুমধামের সাথে মিলাদ অনুষ্ঠিত হতো। এই মর্মে তাফসীরে জালালাইনের অন্যতম লেখক হযরত আল্লামা ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী (রহ.) প্রণীত সাবীলুল হুদা ফি মাওলিদিল মুস্তফা কিতাবে হাদিস উল্লেখ করা হয়েছে- “বিখ্যাত সাহাবি হযরত আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন- একদা আমি হযরত রাসুল (সা.)-এর সাথে হযরত আবু আমের আনসারি (রা.)-এর বাড়িতে গিয়ে দেখতে পেলাম, হযরত আবু আমের (রা.) তার ছেলে-মেয়ে ও আত্মীয়স্বজনকে একত্রিত করে, হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর শুভ জন্মদিনের বিবরণ শোনাচ্ছেন। অতঃপর তিনি বলছিলেন- আজ সেই পবিত্র জন্মদিন। তাঁর এ কাজ দেখে হযরত রাসুল (সা.) অত্যন্ত আনন্দবোধ করলেন এবং বললেন- ‘হে আমের! নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তায়ালা তোমার জন্য তাঁর রহমতের দরজাসমূহ খুলে দিয়েছেন এবং ফেরেশতারা তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছেন। (যারা তোমার ন্যায় এমন কাজ করবে, তারাও তোমার মতো ফজিলত পাবে)।”


অন্য এক বর্ণনায় জানা যায়- “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, একদা তিনি তাঁর ঘরে লোকদেরকে একত্রিত করে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জন্মদিনের বর্ণনা করছিলেন, যা শুনে উপস্থিত সবাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে রাসুল (সা.)-এর প্রশংসা করছিলেন (দরুদ ও সালাম পেশ করছিলেন)। এমন সময় হযরত রাসুল (সা.) সেখানে উপস্থিত হলেন এবং খুশি হয়ে তাদের উদ্দেশে বললেন- ‘তোমাদেরকে শাফায়াত করা আমার জন্য ওয়াজিব হয়ে গেছে’। (দুররুল মুনাজ্জাম)


আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) তার বিখ্যাত ফতহুল বারী কিতাবে বর্ণনা করেন- “হযরত সুহাইলি (রা.) কর্তৃক হযরত আব্বাস (রা.) থেকে এক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। আব্বাস (রা.) বলেন- যখন আবু লাহাব মারা গেলো, এর বছর খানেক পর আমি তাকে স্বপ্নে দেখি, সে অত্যন্ত কষ্টকর অবস্থার মধ্যে আছে। অতঃপর আবু লাহাব তার অবস্থা সম্পর্কে জানায়, ‘তোমাদের ছেড়ে আসার পর থেকে আমি শান্তির মুখ দেখিনি, তবে সপ্তাহের প্রতি সোমবার আমার আজাব লাঘব করা হয়। হযরত আব্বাস (রা.) বলেন- সোমবার আবু লাহাবের এ আজাব লাঘবের কারণ হলো- নিশ্চয় হযরত রাসুল (সা.)-এর জন্মদিন ছিল সোমবার। তাঁর শুভ জন্মের সুসংবাদ নিয়ে আসায় দাসী সুওয়াইবাকে সে খুশি হয়ে মুক্তি দিয়েছিল।” (ফতহুল বারী ৯ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১১৮)


একজন কাফের হয়েও হযরত রাসুল (সা.)-এর জন্মের সংবাদে খুশি হওয়ায় যদি আবু লাহাব উপকৃত হতে পারে, তাহলে হযরত রাসুল (সা.)-এর উম্মত হয়ে তাঁর শুভ জন্মদিন আনন্দের সাথে উদ্যাপন করে আমরা নিঃসন্দেহে আরো অধিক উপকৃত হবো। আমরা যদি এ যুগে তাঁর শুভ জন্মদিন মহাধুমধামের সাথে পালন করি, তাহলে দয়াল রাসুল (সা.) আমাদের উপর খুশি হবেন। আমাদের মুক্তির রাস্তা খুলে যাবে। পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) সম্বন্ধে ইমাম আল্লামা শেহাবুদ্দীন আহম্মদ বিন হাযার আল্-হায়তামী আল্-শাফী (রহ.) প্রণীত “আন্-নেয়ামাতুল কুবরা আলাল আলম ফি মওলুদে সাইয়্যেদিল আনাম” নামক কিতাবের ৭ পৃষ্ঠায় বর্ণিত হয়েছে:
১। ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) বলেন, “যে ব্যক্তি হুজুর (সা.)-এর মিলাদ শরীফে অর্থ ব্যয় করবে, সে আমার সাথে বেহেশতে থাকবে।”
২। হযরত ওমর (রা.) বলেন, “যে ব্যক্তি হুজুর (সা.)-এর মিলাদ শরীফকে ইজ্জত ও সম্মান দেবে সে যেন ইসলামকে পুনর্জীবিত করল।”
৩। হযরত ওসমান (রা.) বলেন, “প্রিয় নবি (সা.)-এর মিলাদ শরীফ উদ্যাপন করতে গিয়ে যে অর্থ ব্যয় করবে, সে যেন বদর ও হুনাইনের মতো মহান যুদ্ধে অংশগ্রহণ করল।”
৪। হযরত আলী মুরতাজা (রা.) বলেন, “ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) উদ্যাপনকারী ইমানের সাথে মৃত্যুবরণ করবে।”
অথচ ধর্মীয় বিষয়ে আমরা এত বেশি উদাসীন যে, যিনি আমাদের রাসুল, যাঁর শাফায়াত ব্যতীত কারো মুক্তি হবে না, যাঁর উপর দরুদ না পড়লে কারো প্রার্থনা আল্লাহ্র দরবারে মঞ্জুর হয় না, ঐ রাসুল (সা.)-এর পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণের এ পুণ্যময় দিনটি আমরা পালন করি না। আমরা হযরত রাসুল (সা.)-এর নির্দেশানুযায়ী রমজানের রোজা শেষে ঈদুল ফিতর এবং হজের পরদিন ঈদুল আযহা বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালন করে থাকি। অথচ যিনি আমাদের এ দুই ঈদ এনে দিলেন, তাঁর শুভ জন্মদিন যে এ দুই ঈদের চেয়েও বেশি আনন্দের তা আমরা বুঝি না।


প্রকৃতপক্ষে সৃষ্টিকুলের শ্রেষ্ঠ ঈদ: দয়াল রাসুল (সা.)-এর জন্ম ঈদ। এ দিনটি আমাদের জন্য সবচেয়ে বড়ো উৎসবের দিন হিসেবে পালন করা উচিৎ। পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) উদ্যাপনের মাধ্যমে অগণিত মানুষ আশেকে রাসুলে পরিণত হচ্ছেন। আশেকে রাসুলদের গভীর প্রেম ও উৎসাহ দেখে দয়াল রাসুল (সা.)-ও দয়া করে তাদের দিদার দিচ্ছেন। ফলে আশেকে রাসুলগণ যেমনিভাবে ইমানের বলে বলীয়ান হয়ে মহান আল্লাহ্ ও হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রতি নিবেদিত হচ্ছেন, তেমনিভাবে আল্লাহ্র অবারিত রহমত ও বরকত লাভ করে তাদের জীবন শান্তিময় ও সমৃদ্ধশালী হচ্ছে। আল্লাহ্ তায়ালা আমাদের সবাইকে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় হাবিবের শুভ জন্মদিনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করে যথাযোগ্য মর্যাদায় তা পালনের মাধ্যমে এর পূর্ণ ফায়েজ, বরকত ও রহমত লাভের তাওফিক দান করুন। আমিন।


[লেখক: প্রতিষ্ঠাতা, দেওয়ানবাগ শরীফ]

সম্পর্কিত পোস্ট