Cancel Preloader

জীবনচরিত সাধক কবি হাফিজ (রহ.) ৪র্থ পর্ব

মহাকবি হাফিজ (রহ.) ছিলেন মানবতা ও প্রেমের কবি। তিনি প্রেমের মাধ্যমেই এ বিশ্বকে জয় করতে চেয়েছেন। এজন্য তাঁর গজল আমাদের আত্মাকে প্রেমের আলোতে উদ্ভাসিত করে। “প্রেমের ধর্ম হচ্ছে প্রেমিক (আশেক)-প্রেমাস্পদ (মাশুক) পরস্পর পরস্পরকে আত্মস্থ (আত্মনিমগ্ন) করতে আকুল হবে। পরস্পরের মধ্যে আত্মবিলোপে কৃতার্থ হবে। এ প্রেম জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার প্রেম।”১ তিনি স্রষ্টাকে বিশ্ব থেকে আলাদা করে দেখেননি। তাইতো তিনি মনে করেন যেখানেই প্রেম, সেখানেই প্রেমিক রয়েছে।

বাংলা সাহিত্যের অনেক কবি, সাহিত্যিক মহাকবি হাফিজ (রহ.)-এর কবিতা বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মুসলিম সাহিত্যিকরা হলেন- ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্, কাজী আকরাম হোসেন, আজিজুল হাকিম, মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ, কবি আবদুল হাফিজ, আবদুস সাত্তার, অধ্যাপক মুহাম্মদ মনসুর উদ্দীন, কাজী নজরুল ইসলাম এবং অমুসলিম সাহিত্যিকেরা হলেন-অজয় কুমার ভট্টাচার্য, গিরিশ চন্দ্র, নরেন্দ্রদেব, কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিত লাল মজুমদার। তবে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মহাকবি হাফিজ (রহ.)-এর কবিতার অনুবাদ না করলেও তাঁর চিন্তাধারায় যে মহাকবি হাফিজের প্রভূত প্রভাব রয়েছে, তা এই প্রবন্ধে আলোচনায় স্পষ্ট হয়েছে।২

কবিরা বিশেষ কোনো জাত বা গোত্রের নন। তারা কোনো বিশেষ অঞ্চল বা জনগোষ্ঠীর নন। বরং কবিরা হয়ে থাকেন সমগ্র জনতার সমগ্র বিশ্বের এবং বিশ্ব মানবতার। সব থেকে বড়ো কথা হলো- দুঃখ, হর্ষ, প্রেম কিংবা আনন্দের চরিত্র প্রকাশ যুগ ও এলাকা ভেদে আলাদা হয় না। প্রেমের আকুতি এবং দুঃখের আর্তির প্রকাশ সবদেশে সবকালে একই সুরে অনুরণিত ও গুঞ্জরিত। এই ঐক্য এবং ঐক্যতান যুগে যুগে কবিদের মাঝে প্রত্যক্ষ করা যায় সর্বতোভাবে।৩

সুফি ও সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলাম মহাকবি হাফিজ (রহ.)-এর দ্বারা কতটুকু প্রভাবি^ত হয়েছিলেন এই বিষয়টি আমি এই পর্বে আলোকপাত করছি। কবি কাজী নজরুল ইসলাম একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সুরকার, গীতিকার, প্রাবন্ধিক, গল্পকার, নাট্যকার, চিত্রকর, বংশীবাদক, অভিনেতা, উপন্যাসিক, সাহিত্য সমালোচক, বায়োনভলিস্ট, ঐতিহাসিক, শিশু সাহিত্যিক, বাগ্মী, সংগঠন স্রষ্টা, যাত্রা প্রযোজক, মসিযোদ্ধা প্রভূতিসহ সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় ছিল তার সদম্ভ পদচারণা।৪
আরবি ও ফারসির অনুরক্ত পাঠক হিসাবে দেখা যায় কবি নজরুল সেই বাল্যকাল থেকেই মক্তবের মৌলভি কাজী ফজলে আলীর কাছে আরবি-ফারসির প্রাথমিক পাঠ এবং পরবর্তীতে আপন উদ্যোগে নজরুল এই দুই ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। ফলে দেখা যায় নজরুল আরবি ১৬টি ছন্দের প্রত্যেকটি দিয়ে কবিতা রচনার সক্ষমতা এবং ফারসি কবিতার যুতসই বাংলা অনুবাদের শক্তিমত্তা প্রদর্শন করেন।৫
জ্ঞান ও প্রেম-এই দুইয়ের শক্তি পৃথিবীর অন্য যে কোনো কিছুর চেয়ে বেশি। তাই বাংলাদেশ থেকে সুদূর পারস্য বারবার নজরুলকে টেনে নিয়েছে নিজের কাছে। প্রেম-সৌন্দর্য ও আধ্যাত্মিকতার সবচেয়ে মহিমান্বিত কণ্ঠস্বর কবি হাফিজ শিরাজি (রহ.)। যিনি ইরানিদের কাছে বুলবুল, অদৃশ্যের কণ্ঠস্বর আর পৃথিবীর মানুষের কাছে অনন্ত প্রেম হিসেবে পরিচিত। তাঁর প্রতি নিরবচ্ছিন্ন আকর্ষণ অনুভব করেছেন জ্ঞানপিপাসু ও সাহিত্যপ্রেমী কবি নজরুল ইসলাম। সম্পূর্ণ অংশ না হলেও প্রায় পরিপূর্ণ রূপেই সাধক কবি হাফিজ (রহ.)-কে নিজের মধ্যে ধারণ করতেন নজরুল। এজন্যই দুই কবির জীবনদর্শনে ব্যাপক মিল পাওয়া যায়। তাই প্রকৃতিও যেন ইচ্ছা করেই এই দুই কবির জীবনের সঙ্গে জীবন মিলিয়ে দিয়েছে। কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে, দুজনকেই শৈশবে হারাতে হয়েছে পিতাকে। বাঁচার জন্য করতে হয়েছে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই। জীবিকার জন্য করতে হয়েছে রুটির দোকানে কাজ। নিজের চেষ্টায় হতে হয়েছে বিশ্বখ্যাত, বিশ্ববিস্তৃত। আবার দুজনকেই সইতে হয়েছে পুত্রশোক। সেই সঙ্গে জীবন শেষে সমাধিও হয়েছে নিজের ইচ্ছার স্থানে। নজরুলের জীবনে হাফিজ এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, যেদিন নজরুল মহাকবি হাফিজ (রহ.)-এর ‘দিওয়ানে হাফিজ’ অনুবাদ করতে শুরু করেন, সেদিনই তাঁর পুত্র বুলবুল জন্মগ্রহণ করেন। আর যেদিন অনুবাদ করা শেষ হয়, সেদিনই বুলবুল পৃথিবী ছেড়ে চলে যান।৬
মহাকবি হাফিজ (রহ.)-এর সঙ্গে নজরুলের কালগত ব্যবধান কয়েক শতাব্দীর। দুস্তর সময়ের পরিক্রমায় ফারসি ভাষা প্রচলনের সুবাদে হাফিজ তাঁর সমকালেই বাংলায় ব্যাপক পরিচিত ছিলেন ফারসি সাহিত্যের অমর কবি হিসেবে। হাফিজকে বাংলায় পরিণত ঐশ্বর্য সম্পদে রূপান্তর করেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এ প্রসঙ্গে নজরুলের মুখেই শোনা যাক বাকি কথা- “আমি তখন স্কুল পালিয়ে যুদ্ধে গেছি। সে আজ ইংরেজি ১৯১৭ সালের কথা। সেইখানে প্রথম আমার হাফিজের সাথে পরিচয় হয়। আমাদের বাঙালি পল্টনে একজন পাঞ্জাবী মৌলবী সাহেব থাকতেন। একদিন তিনি দীওয়ান-ই-হাফিজ থেকে কতকগুলি কবিতা আবৃত্তি করে শোনান। শুনে আমি এমনই মুগ্ধ হয়ে যাই যে, সেইদিন থেকেই তাঁর কাছে ফারসি ভাষা শিখতে আরম্ভ করি। তাঁরই কাছে ক্রমে ফারসি কবিদের প্রায় সমস্ত বিখ্যাত কাব্যই পড়ে ফেলি। তখন থেকেই আমার হাফিজের ‘দীওয়ান’ অনুবাদের ইচ্ছা হয়। কিন্তু তখনো কবিতা লিখবার মতো যথেষ্ট সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারিনি। এর বৎসর কয়েক পরে হাফিজের ‘দীওয়ান’ অনুবাদ আরম্ভ করি। অবশ্য তাঁর রুবাইয়াৎ নয়-গজল। বিভিন্ন মাসিক পত্রিকায় তা প্রকাশিত হয়েছিলে। ত্রিশ-পঁয়ত্রিশটি গজল অনুবাদের পর আর আমার ধৈর্যে কুলোল না এবং ঐখানেই ওর ইতি হয়ে গেল। তারপর এসসি চক্রবর্তী এণ্ড সন্সের স্বত্বাধিকারী মহাশয়ের জোর তাগিদে এর অনুবাদ শেষ করি। যে দিন অনুবাদ শেষ হলো, সেদিন আমার খোকা বুলবুল চলে গেছে। আমার জীবনের যে ছিল প্রিয়তম, যা ছিল শ্রেয়তম তারই নজরানা দিয়ে শিরাজের বুলবুল কবিকে বাঙলায় আমন্ত্রণ করে আনলাম। . . . . আমার আহবান উপেক্ষিত হয়নি। যে পথ দিয়ে আমার পুত্রের ‘জানাজা’ (শবযান) চলে গেল, সেই পথ দিয়ে আমার বন্ধু, আমার প্রিয়তম ইরানী কবি আমার দ্বারে এলেন। আমার চোখের জলে তাঁর চরণ অভিষিক্ত হলো’…।৭
খুব দুঃসময়ে পুত্রের মৃত্যু শয্যায় বসে কবি ‘রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ’এর অনুবাদ সম্পন্ন করেন। তাই কবি যথার্থই বলেন, যে পথ দিয়ে আমার পুত্রের শবযান চলে গেল, সে পথ দিয়েই এলেন তাঁর প্রিয়তম ইরানি কবি হাফিজ।’
‘রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ’ অনুবাদ কাব্যের উৎসর্গপত্রে কবি লিখেছেন-
“বাবা বুলবুল!
তোমার মৃত্যু-শিয়রে বসে ‘বুলবুল-ই-শিরাজ’
হাফিজের রুবাইয়াতের অনুবাদ আরম্ভ করি। যেদিন
অনুবাদ শেষ করে উঠলাম, সেদিন তুমি আমার
কাননের বুলবুলি উড়ে গেছ। যে দেশে গেছ তুমি,
সে কি বুলবুলিস্তান ইরানের চেয়েও সুন্দর?
জানি না তুমি কোথায়! যে লোকেই থাক, তোমার
শোক-সন্তপ্ত পিতার এই শেষ দান শেষ চুম্বন বলে গ্রহণ করো।
তোমার চার বছরের কচি গলায় যে সুর শিখে গেলে,
তা ইরানের বুলবুলিকেও বিস্ময়ান্বিত করে তুলবে।
শিরাজের বুলবুল কবি হাফিজের কথাতেই
তোমাকে স্মরণ করি,
‘সোনার তাবিজ রূপার সেলেট
মানাত না বুকে রে যার,
পাথর চাপা দিল বিধি
হায়, কবরের শিয়রে তার।”৮
কবি হাফিজ (রহ.)-এর অসংখ্য কবিতা, গান, সাহিত্য নজরুল অনুবাদ করেছেন, যার অন্যতম হলো গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের কাছে লেখা কবিতা, যা হাফিজ কর্তৃক পূর্ণতা পেয়েছিল। গজল সম্রাট হাফিজ শিরাজী (রহ.) চৌদ্দ শতকে সোনারগাঁয়ে অবস্থানরত গিয়াসুদ্দিন আজম শাহের কাছে বিখ্যাত সেই পঙক্তি পাঠিয়েছিলেন, যা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম অনুবাদ করেছেন।
এদেশে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিস্তার ঘটে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজীর হিজরি ৫ম শতকের শেষভাগে বাংলায় পদার্পণের মাধ্যমে। এই মুসলমান শাসক এই অঞ্চলে রাজকার্য পরিচালনার শুরুতেই ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের বিস্তারে গুরুত্বারোপ করেন। বিশেষ করে ফারসি ভাষা বিস্তারের জন্য তিনি রংপুরে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলায় ফারসি ভাষা ও সাহিত্য
বিস্তারের এটিই প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ। এরপর নাসিরউদ্দিন বোগরা খান হিজরি ৭ম শতকে ফারসি ভাষা সম্প্রসারণের ক্ষেত্র প্রসারিত করেন। পরবর্তীতে একই শতকে বাংলার সুলতান গিয়াস উদ্দিন আযম শাহ ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নে সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেন। সুলতান গিয়াস এসময় ফারসি সাহিত্যের অমর প্রতিভা ইরানের মহাকবি হাফিজকে বাংলা ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানান।
ঘটনাটি ছিল- মহাকবি হাফিজ (রহ.)-কে ভালোবেসে বাংলায় আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বাংলার স্বাধীন সুলতান গিয়াস উদ্দীন আজম শাহ্। কবি আসার জন্য উদগ্রীব হয়ে পারস্য সাগরের কিনার পর্যন্ত উপনীত হয়েছিলেন। কিন্তু পারস্য সাগরের উত্তাল তরঙ্গ দেখে কবির অন্তর কেঁপে ওঠে এবং শারীরিক অসুস্থতার কারণে বাংলায় আসতে পারেননি। অপারগতায় সুলতানকে অমরবাণী উপঢৌকন হিসেবে পাঠান নিম্নোক্ত গজলটি-
‘হে সাকী! দেবদারু, ফুল ও টিউলিপের আলোচনা চলছে
পান-পিয়লাসহ তিন প্রেয়সীকে নিয়ে আলোচনা চলছে।
আজকে পাঠাই বাংলায় যে ইরানের এই ইক্ষু শাখা
এতেই হবে ভারতের সব তোতার চক্ষু মিষ্টি মাখা।
কবি এখানে তিন প্রেয়সী বলতে সুলতান গিয়াস উদ্দীন আজম শাহ্-এর খাদেমদেরকে বুঝিয়েছেন। তারা হলেন- সারভো, গুল ও ল‘লে। এদের একত্রে বলা হতো (সালাসেহ গাসসালেহ)। সুলতানের অসুস্থতার সময় এদের বিশেষ সেবা প্রদানের মাধ্যমে তিনি সুস্থ হয়ে উঠেন।
নজরুল কবি হাফিজ (রহ.)-কে বলতেন কবি সম্রাট। সাহিত্যে প্রেমের বিস্তার ঘটিয়ে বিশ্বজুড়ে মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছেন কবি হাফিজ। ‘বিশ্ববাসী হাফিজের আয়নায় দেখতে পায় নিজেদের। আর নজরুলের আয়নায় আমরা দেখতে পাই হাফিজকে।’ হাফিজের কবিতা ছিল প্রেম-সৌন্দর্য-অধ্যাত্মবাদ নিয়ে আর নজরুল প্রেমের সঙ্গে বিদ্রোহের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে অনন্য ধারার সৃষ্টি করেছেন। আরবি, ফারসি ও তুর্কি শব্দের ব্যবহার নজরুলের কবিতাকে করেছে আরও সমৃদ্ধ-প্রাণবন্ত-আকর্ষণীয়। সেই সঙ্গে কবিতায় যোগ করেছে ভিন্ন দর্শন ও বলিষ্ঠ উচ্চারণ।৯
বিশ্বখ্যাত ইরানি কবি হাফিজ সিরাজী (রহ.) ও বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বিশ্বমানবতার কবি। দুজনের কাব্যেই ধ্বনিত হয়েছে মানবপ্রেম ও মানবতার মিলনের একই সুর। ২৬শে সেপ্টেম্বর, সোমবার ২০২২ সালে ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র মিলনায়তনে আয়োজিত ‘নজরুল ও হাফিজ: মিলনের সুর’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির ভাষণে বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী এবং বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. এম শমশের আলী এসব কথা বলেন।
প্রফেসর ড. এম শমশের আলী বলেন, হাফিজ বিশ্বনন্দিত একজন মহান কবি। তার জ্ঞান ও প্রজ্ঞা এতটাই গভীর দর্শন বিশিষ্ট ছিল যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণ জ্ঞানীরা তার কাব্যভাষার অন্তর্নিহিত তাৎপর্যটা ধরতে অপারগ হয়েছেন। আজকের মানবসমাজ সংঘাত, সংঘর্ষ ও স্বার্থপরতার যে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত, তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো ভালোবাসা। সত্যিকার অর্থেই ভালোবাসার চেয়ে ভালো ভাষা পৃথিবীতে আর কিছু নেই। আর এ কথাটি মহাকবি হাফিজ (রহ.) শত শত বছর আগেই তার ‘দিওয়ান’ এ বলে গেছেন। সুতরাং তিনি যে কত বড়ো মানবতাবাদী কবি ছিলেন, সেটি নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
তিনি বলেন, একই সুর ধ্বনিত হয়েছে নজরুল ইসলামের কাব্যেও। আজ যদি নজরুল বেঁচে থাকতেন, তাহলে দেখতে পেতেন যে, আমরা সাধারণ মানুষরা আজ তার কাছ থেকে কি অসাধারণ জিনিস পেতাম। তাই হাফিজ আর নজরুল যে মানবপ্রেম ও মানবতার মিলনের একই সুরে গাঁথা সেটি নিয়েও কোনো সংশয় থাকতে পারে না। আরো বলেন, কাজী নজরুল ইসলামকে যদি আমরা বিশ্বের সামনে সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারতাম, তাহলে বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে আজ তার অবস্থান হতো আরো অনেক ঊর্ধ্বে। তিনি উপস্থিত সকলকে এই বিষয়টি নিয়ে আরো বেশি কাজ করার আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির ভাষণে নজরুল ইন্সটিটিউটের প্রাক্তন নির্বাহী পরিচালক এবং বর্তমান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, নিঃসন্দেহে কবি নজরুল গভীর শ্রদ্ধা করতেন কবি হাফিজকে। সেই শ্রদ্ধাটি এতটাই ছিল যে, নজরুল দিওয়ানে হাফিজের উৎসর্গ পত্রে বলেছেন- সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হলেও আমার অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হয়নি। তিনি বলেন, ‘তিনি সেপথ দিয়ে এলেন যে পথে আমার পুত্রের জানাযার শবযান চলে গেছে। তিনি এলেন, আর তার চরণ সিক্ত হলো আমার চোখের জলে।’ যে কবি হাফিজের চরণ সিক্ত করতে চান তার চোখের জলে, সন্দেহের কোনোই অবকাশ নেই তিনি হাফিজকে কী পরিমাণ শ্রদ্ধা করতেন।
তথ্যসূত্র:

১। আনোয়ারুল করিম, ‘লালনগীতিকায় সূফীবাদের প্রভাব’, বাংলা একাডেমী পত্রিকা, ৪৯ বর্ষ; ৩য়, ৪র্থ সংখ্যা, জুলাই ২০০৫- ডিসেম্বর ২০০৫, পৃ. ২৮৭
২। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ শাহজালাল, রবীন্দ্র চিন্তাধারায় মহাকবি হাফিজের প্রভাব: একটি পর্যালোচনা, দর্শন ও প্রগতি, ৩৫ ও ৩৬ বর্ষ, ১ম ও ২য় সংখ্যা, ২০১৮-২০১৯, পৃ. ৮১
৩। সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২২ সালে ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র মিলনায়তনে আয়োজিত আলোচনা সভায় ‘নজরুল ও হাফিজ: মিলনের সুর’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপক, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান
৪। প্রাগুক্ত
৫। প্রাগুক্ত
৬। নজরুল রচনাবলী, তৃতীয় খন্ড, বাংলা একাডেমী, সম্পাদক: আবদুল কাদির
৭। কাজী নজরুল ইসলাম ‘রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ’; মুখবন্ধ। নজরুল রচনাবলী, নতুন সংস্করণ, দ্বিতীয় খণ্ড। ২৫ মে ১৯৯৩। বাংলা একাডেমি, ঢাকা। পৃ. ১৫
৮। প্রাগুক্ত
৯। নজরুল কাব্যে আরবী ফারসী শব্দ, আব্দুস সাত্তার, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা
সংকলনে: ড. সৈয়দ মেহেদী হাসান, গবেষক ও লেখক

সম্পর্কিত পোস্ট