Cancel Preloader

জীবনচরিত – সাধক কবি হাফিজ (রহ.) ২য় পর্ব

সাধক কবি হাফিজ শিরাজী (রহ.) সাহিত্যজগতের এক পরম বিস্ময়। তাঁর কাব্য শুধু পারস্যে নয়, তথা সমগ্র বিশে^র মানবমনে এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছে। পাশ্চাত্যের কিছু মহান ব্যক্তির ওপরেও কবি হাফিজ (রহ.)-এর প্রভাব লক্ষণীয়। জার্মানির জাতীয় কবি গেটে মহাকালের মহাকবি হাফিজ পাঠে মুগ্ধ হয়ে তাঁর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বলেন- “Hafiz! Lets share all joy and woe, as true twin brothers, one from two.” অর্থাৎ দেশকালের ব্যবধান ঘুচিয়ে গেটে তাকে নিজের জোড়ভাই বলে সম্ভাষণ জানিয়েছেন। হাফিজ শিরাজী (রহ.)-এর সাহিত্যকর্ম ওরিয়েন্টালিস্ট জোসেফ ভন হ্যামার কর্তৃক ১৮১২ সালে জার্মান ভাষায় প্রথম অনূদিত হয়। গেটে কিছুটা বৃদ্ধ বয়সে অর্থাৎ ৬৫ বছর বয়সে কবি হাফিজের অনূদিত লেখা পড়ে অভিভূত ও মোহবিষ্ট হয়ে পড়েন। হাফিজ শিরাজী (রহ.)-এর দিওয়ান (Divan) তাঁকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে, আর সেই আলোকে তিনি লিখে ফেলেন ১২ খণ্ডের অনন্য সাহিত্যকর্ম West Eastern Divan (the parliament of East and West)। শুধু তাই নয়, হাফিজ (রহ.)-এর অসাধারণত্ব প্রকাশে তিনি বলেন- Hafiz has no peer. অর্থাৎ হাফিজের কোনো তুলনা হয় না।


আমেরিকার প্রখ্যাত অতীন্দ্রিয়বাদী দার্শনিক রালফ ওয়াল্ডো এমারসন হাফিজ শিরাজী (রহ.)-এর সাহিত্যসৃষ্টি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন: ‘‘হাফিজ কাউকে ভয় পায় না। তিনি এতদূর দেখেন, যেন সবকিছ ভেদ করে দেখেন।’’ তিনি হাফিজকে “Hafiz is a poet of poets.” অর্থাৎ ‘কবিদের কবি’ হিসাবে উল্লেখ করেছেন। ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে ‘অ্যাটলান্টিক’ মাসিক সাহিত্যপত্রে প্রকাশিত এমারসনের ‘পার্সিয়ান পোয়েট্রি’ (পারস্যের কবিতা) প্রকাশিত হওয়ার পর হাফিজ সম্পর্কে সম্পূর্ণ এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়।
জার্মানির প্রখ্যাত দার্শনিক নিৎসে এবং শার্লক হোমসের মতো জনপ্রিয় চরিত্রের স্রষ্টা আর্থার কোনান ডয়েলের মতো বৈচিত্র্যময় ব্যক্তিত্বের কাছেও কবি হাফিজ শিরাজী (রহ.) ছিলেন শ্রদ্ধার পাত্র। এমনকি রানি ভিক্টোরিয়া সময়ে সময়ে হাফিজ (রহ.)-এর গ্রন্থাবলি থেকে পরামর্শ গ্রহণ করতেন বলে শোনা যায়- যেমনটি মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিন ধরেই রীতি রয়েছে। ‘ফাল-এ-হাফিজের’ একটি পুরানো প্রথা, যেখানে একজন পাঠক হাফিজ (রহ.)-এর কাছে কোনো সমস্যার সমাধানের উপদেশ প্রার্থনা করে- তাঁর পুস্তককে একটি দৈববাণীর সমান মান্য করে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে সেটি খোলে।


বাংলার দুই বিখ্যাত কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম কবি হাফিজ (রহ.)-এর দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। হাফিজ শিরাজী (রহ.)-এর অধ্যাত্মচিন্তা রবীন্দ্রনাথকে সবিশেষ আকৃষ্ট করেছিল। রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও হাফিজের বিশেষ গুণাগ্রাহী ছিলেন। অন্যদিকে নজরুলের কবিতায় হাফিজের চিন্তার বিশেষ প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। ফারসি ভাষায় দক্ষ নজরুলের বহু কবিতা ও গানে হাফিজের ব্যবহৃত শব্দগুচ্ছ হুবহু অনুসৃত হয়েছে।
নরেন্দ্রনাথ দত্ত (যিনি স্বামী বিবেকানন্দ নামে পরিচিত) হাফিজ (রহ.)-এর কথা প্রথম জেনেছিলেন পিতা বিশ^নাথ দত্তের কাছ থেকে। বিশ^নাথ দত্ত ফারসি ও আরবি ভাষায় যথেষ্ট দক্ষ ছিলেন। হাফিজের দেওয়ান-ই-হাফিজ থেকে বিশ^নাথ দত্তকে মাঝে মাঝেই আবৃত্তি করতে শোনা যেত। হাফিজ, যিনি কিনা মাটিতে একটি বৃত্ত এঁকে সেই বৃত্তের মধ্যে চল্লিশ দিন কাটিয়ে দিয়েছিলেন। স্বভাবতই যুবক নরেন্দ্রনাথের ঈশ্বরসন্ধানী মনের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। পরবর্তী নয় বছর ধরে, তাঁর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত হাফিজ তাঁর সমগ্র সৃষ্টিকর্মের প্রায় অর্ধেকের বেশি রচনা করেছেন এবং তাঁর ছাত্রদের সেগুলি শেখান। স্বামী বিবেকানন্দের যুবক হৃদয়ে হাফিজ (রহ.)-এর কাব্যের উদার চিন্তা, ঈশ্বরমুখিতা এবং সর্বোপরি তার প্রেমময় আবেশ যে এক অপূর্ব প্রভাব ফেলেছিল তা বলাই বাহুল্য।


ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী হাফিজ (রহ.)-এর সমাধি পরিদর্শন করেছিলেন। এর অল্প কয়দিন আগে তার পায়ে সার্জারি হওয়ার কারণে তিনি ব্যথা অনুভব করছিলেন। গাইডরা তার মন ভালো করতে হাফিজ (রহ.)-এর কবিতা সম্পর্কিত একটি স্থানীয় প্রবাদ শোনান-কেউ মনে কোনো গোপন ইচ্ছা নিয়ে হাফিজ (রহ.)-এর কবিতার বইয়ের যে কোনো পৃষ্ঠা খুললে যে কবিতা দেখা যাবে তাতে সে ইচ্ছা সম্পর্কিত ইঙ্গিত পাওয়া যাবে এবং হলোও তাই, এতে তিনি এত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন যে অনেকক্ষণ একা তার কবরের পাশে বসে নীরবে অশ্রæপাত করেন।


হাফিজ শিরাজী (রহ.)-এর প্রতি গেটের অসাধারণ শ্রদ্ধার কারণে হাফিজ জার্মান জনগণেরও ভালোবাসার ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। তাই তো এ দুই ব্যক্তিত্বকে শ্রদ্ধা প্রদর্শনে গেটের জন্মস্থান ওয়েমার সিটিতে একটি মনুমেন্ট (সৌধ বা মিনার) তৈরি করা হয়েছে। ২০০০ সালে ইরান ও জার্মানি সরকার প্রধান যৌথভাবে এ মনুমেন্টের উদ্বোধন করেন।
কবি হাফিজ (রহ.)-এর তাঁর জীবদ্দশাতেই ইসলামি বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছিলেন, তখন থেকে ব্যাপক বিস্তৃত এ অঞ্চলের কবি, গীতিকার, সাহিত্যিকদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ওঠেন। তার গান, কবিতা, গজল ধর্মীয় অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে যে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে গীতও পঠিত হয়ে থাকে। তিনি লেখনীর সাহায্যে প্রায় সব জাতি, গোষ্ঠী, সভ্যতা ও সংস্কৃতির মানুষের কাছে পৌঁছে গেছেন। তাঁকে নিয়ে, তাঁর সাহিত্যকর্ম ও দর্শন নিয়ে এখনো বিশ্ব সাহিত্যবোদ্ধারা গবেষণা করে চলেছেন। (চলবে)


তথ্যসূত্র:
১। সুমন ভট্টাচার্য, হাফিজ এবং বিবেকানন্দ, উদ্বোধন, কলিকাতা
২। কবিদের কবি হাফিজ, সালাহ্উদ্দিন নাগরী, দৈনিক যুগান্তর
সংকলনে: ড. সৈয়দ মেহেদী হাসান

সম্পর্কিত পোস্ট