Cancel Preloader

হযরত রাসুল (সা.)-এর হিজরতের কারণ ও প্রেক্ষাপট

কামরুজ্জামান বাবু
মানুষ জীবনের বিবর্তনে প্রায়শ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ছুটে যায়। কখনো ইচ্ছায়, কখনো অনিচ্ছায়। কখনো এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায়, কখনো এক শহর থেকে অন্য শহরে, আবার কখনো এক দেশ থেকে অন্য দেশে। মূলত এ সবকিছুই হয়ে থাকে প্রয়োজনের তাগিদে। মানুষের এই ছুটে চলার প্রক্রিয়া ক্রমশ বিদ্যমান। এক দেশ হতে অন্য দেশে স্থানান্তরের প্রক্রিয়াকে দেশত্যাগ (আরবিতে-হিজরত) বলে। তেমনি একটি ঘটনার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর জীবনে। সর্বশ্রেষ্ঠ এই মহামানব মোহাম্মদী ইসলামের সত্য ও সুমহান বাণী স্বজাতি ও অন্যান্য জাতির নিকট প্রচার করতে গিয়ে অজ্ঞদের রোষানলে পরে নির্মম অত্যাচারের সম্মুখীন হয়েছিলেন। ক্রমে অত্যাচারের মাত্রা চরম আকার ধারণ করলে মহান প্রভুর নিকট হতে প্রত্যাদেশপ্রাপ্ত হয়ে নিজ মাতৃভূমি মক্কা নগরী ত্যাগ করে ইয়াসরিবে (বর্তমান মদীনা) অবস্থান নেন। ইতিহাসে এই ঘটনাকে হিজরত নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর হিজরত
হিজরত আরবি শব্দ। যার অর্থ হচ্ছে ত্যাগ করা, প্রস্থান বা গমন করা, পরিত্যাগ করা, সম্পর্ক শেষ করা, দেশত্যাগ করা, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলে যাওয়া বা স্থানান্তর। তবে ইতিহাসে হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর মক্কা থেকে মদীনায় গমন করাকে বুঝায়।
হিজরতের প্রেক্ষাপট
হযরত মোহাম্মদ (সা.) ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে ৪০ বছর বয়সে মহান আল্লাহ্র পক্ষ থেকে নবুয়তপ্রাপ্ত হন। তখন থেকে তিনি মহান আল্লাহ্র নিকট হতে ঐশী বাণী বা প্রত্যাদেশ লাভ করতে থাকেন যাকে, আরবিতে ওহি বলা হয়। অতীতে মহান আল্লাহ্ কোনো কোনো নবিকে নির্দিষ্ট জাতি কিংবা বংশের মানুষদের জন্য প্রেরণ করলেও সর্বশেষ নবি ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল হযরত মোহাম্মদ (সা.)-কে সমগ্র সৃষ্টিজগতের জন্য প্রেরণ করেছিলেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, “আমি তো আপনাকে বিশ্বজগতসমূহের প্রতি কেবল রহমতস্বরূপই প্রেরণ করেছি।” (সূরা আল আম্বিয়া ২১: আয়াত ১০৭) হযরত মোহাম্মদ (সা.) ছিলেন সকল মানুষের প্রতি রহমতস্বরূপ। যার কারণে সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষের নিকট আল্লাহ্র একত্ববাদের বাণী প্রচার করতে হয়েছিল, যা মোটেও সহজ কোনো কাজ ছিল না। তাঁর প্রচারিত মতবাদে পৌত্তলিকতা বা মূর্তিপূজার কোনো স্থান ছিল না। ফলে তাঁর প্রচারিত মতবাদ মেনে নেওয়ার মতো পরিস্থিতি ঐসময় খুব কম মানুষেরই ছিল। তাই তিনি ৬১০-৬১৩ খ্রিষ্টাব্দের প্রারম্ভ পর্যন্ত প্রায় তিন (৩) বছর গোপনে নিকটাত্মীয়দের নিকট ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ হযরত রাসুল (সা.)-এর রিসালাতের দাওয়াত গ্রহণ করেছিল, আবার অনেকেই প্রত্যাখ্যানও করেছিল।
মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত
৬১৩ খ্রিষ্টাব্দে আল্লাহ্র নিকট থেকে প্রকাশ্যে ইসলামের বাণী প্রচারের প্রত্যাদেশ আসে। আল কুরআনে বর্ণিত হয়- “হে চাদর আবৃত রাসুল! উঠুন, সতর্ক করুন; আর আপনার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করুন; এবং স্বীয় পরিধেয় বস্ত্র পবিত্র রাখুন;, এবং অপবিত্রা থেকে দূরে থাকুন। আর অধিক প্রতিদানের আশায় কাউকে কিছু দান করবেন না, আর স্বীয় রবের তুষ্টির জন্য সবর করুন।” (সূরা আল মুদ্দাছছির ৭৪: আয়াত ১-৭) এরপর থেকে তিনি প্রকাশ্যে সকলকে সাফা পর্বতের পাদদেশে সমবেত করে ইসলামের বাণী প্রচার করে শান্তি ও সত্যের পথে আহŸান করেন। এরপর থেকে প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার করতে থাকেন। ইতোমধ্যে হযরত খাদিজা (রা.), হযরত আলী (রা.), হযরত আবু বকর (রা.)-সহ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ ইসলামের দাওয়াত গ্রহণ করেছিলেন। তারা হযরত রাসুল (সা.)-এর সাথে ইসলাম প্রচারের কাজে অংশগ্রহণ করতেন। ক্রমে মানুষ ইসলামের দাওয়াত গ্রহণ করে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে লাগল। যার ফলে আরবের ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের নিকট হযরত মোহাম্মদ (সা.) চক্ষুশূলে পরিণত হয়ে গেলেন। তারা বিভিন্নভাবে হযরত মোহাম্মদ (সা.)-কে ধর্ম প্রচার থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে এবং ব্যর্থ হন। তারা হযরত রাসুল (সা.)-এর অনুসারীদের উপর জুলুম করতে লাগল ফলে দুই বার আবিসিনিয়ায় হিজরত করতে বাধ্য করল। দয়াল রাসুল (সা.) ইসলাম প্রচারের জন্য তায়েফে যান, কিন্তু তায়েফবাসী হযরত রাসুল (সা.)-কে গ্রহণ না করে প্রস্তরাঘাত করে। এক সময় মক্কার কাফেররা হযরত রাসুল (সা.)-এর পরিবারের পাশাপাশি মুসলমানদেরও বয়কট করে। তারা হযরত রাসুল (সা.)-কে বিতাড়িত করতে বিভিন্ন ধরনের অপচেষ্টা করেও ব্যর্থ হতে লাগল।
অবশেষে হযরত রাসুল (সা.)-কে হত্যার পরিকল্পনা করে আবু জাহেলের নেতৃত্বে একটি ভয়ংকর দল গঠন করা হয়। আবু জাহেলের লোকজন হত্যার জন্য ঔদ্ধত্য হলে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এই সংবাদ রাসুল (সা.)-কে জানানো হয়- “আর স্মরণ করিয়ে দিন, যখন কাফেররা আপনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিল আপনাকে বন্দি করার জন্য, অথবা আপনাকে হত্যা করার জন্য, অথবা আপনাকে দেশান্তরিত করার জন্য, আর তারা তো তাদের ষড়যন্ত্র করছিল এবং আল্লাহ্ও তাঁর কৌশল করছিলেন, বস্তুত আল্লাহ হলেন শ্রেষ্ঠ কৌশলী। (সূরা আল আনফাল ৮: আয়াত ৩০)
ইয়াসরিবের মুসলমানদের অনুরোধে এবং আল্লাহ্র নির্দেশে হযরত রাসুল (সা.) নবুয়তের ১৩তম বর্ষে হযরত আলী (রা.)-কে নিজ বিছানায় শুইয়ে হযরত আবু বকর (রা.)-কে সাথে নিয়ে রাতের আঁধারে মক্কা ছেড়ে ইয়াসরিবে হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হন। এ প্রসঙ্গে তাফসীরে মাজহারী’র ৮ম খণ্ডের ৩৫৭ পৃষ্ঠায় হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, “আল্লাহ্র রাসুল (সা.) যখন হিজরতের উদ্দেশ্যে মক্কা থেকে বের হয়ে গারে ছুরের দিকে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি মক্কার দিকে তাকিয়ে বললেন- আল্লাহ্র শহরগুলোর মধ্যে তুমিই আমার নিকট সর্বাধিক প্রিয় শহর। যদি মুশরিকরা আমাকে বের না করত, আমি তোমা হতে বের হতাম না।”
হত্যাকারীরা হিজরতের সংবাদ জানতে পেরে হযরত রাসুল (সা.) পিছু নিলে তিনি ছুর পর্বতের গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করে সেখানে ৩ দিন অবস্থান করেন। সেখান থেকে কুবায় কিছুদিন অবস্থান করে ইসলামের দাওয়াত প্রচার করেন ও একটি মসজিদ নির্মাণ করে মদীনায় পৌঁছান। সেখানে আওস ও খাযরাজ গোত্র হযরত রাসুল (সা.)-কে স্বাগত জানায় এবং হযরত রাসুল (সা.)-এর সম্মানে ইয়াসরিবের নাম পরিবর্তন করে ‘মদিনাতুন্নবি’ রাখেন যার অর্থ ‘নবির শহর’। পরবর্তীতে শুধু মদীনা নামটিই সংরক্ষণ করা হয়। ক্রমান্বয়ে হযরত আলী (রা.)-সহ অন্যান্য সঙ্গীরা মদীনায় হিজরত করেন। যারা হযরত রাসুল (সা.)-এর সাথে হিজরত করেছিলেন তারা মুহাজির (হিজরতকারী) এবং যারা আশ্রয় দিয়েছিলেন তারা আনসার (সাহায্যকারী) উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন।
হযরত রাসুল (সা.)-এর হিজরতের ঘটনাকে কিছু ঐতিহাসিক ‘পলায়ন’ বা ‘প্রাণভয়ে পলায়ন’ বলে আখ্যা দিয়ে থাকেন। এ সম্পর্কে পাশ্চাত্যের ঐতিহাসিক কার্ল ব্রোকেলম্যান বলেন, “মহানবি (সা.)-এর এই হিজরত পলায়ন ছিল না, তা ছিল স্থানান্তর, যা তাঁর জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করেছিল।” প্রকৃতপক্ষে হযরত রাসুল (সা.)-এর এই হিজরত ছিল জীবনের বিবর্তনের জন্য।
মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের কারণ
১. আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ লাভ: মহান আল্লাহ্র পক্ষ থেকে মদীনায় হিজরতের প্রত্যাদেশ লাভ।
২. মক্কাবাসীর অমানুষিক নির্যাতন: মক্কার কাফের কর্তৃক বিভিন্নভাবে হযরত রাসুল (সা.)-কে অত্যাচার।
৩. পরিবেশগত কারণ: মদীনার মানুষ ছিল শান্তিপ্রিয়। অপরদিকে মক্কার মানুষ ভৌগলিক কারণে ছিল বদমেজাজি।
৪. আকাবার শপথ: আকাবায় ৬২১ ও ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে ইয়াসরিবের অন্যতম আওস ও খাযরাজ গোত্রের প্রথমবার ১২ জন ও দ্বিতীয়বার ৭৫ জনের ইসলাম গ্রহণ এবং তাদের শান্তিতে থাকার শপথ।
৫. আত্মীয়তার সম্পর্ক: মহানবি (সা.)-এর পিতা এবং পূর্বপুরুষ হাশিমের মদীনায় বিবাহ।
৬. মধ্যস্থতার কারণ: হযরত রাসুল (সা.)-এর মাধ্যমে আওস ও খাযরাজ গোত্রের মধ্যকার বুয়াস যুদ্ধের মধ্যস্থতা।
৭. মদীনার ধর্মীয় অবস্থা: মদীনায় বিদ্যমান পৌত্তলিকতা ও জড়বাদ মদীনাবাসীর অপছন্দতা ও শান্তির ধর্মের কামনা।
৮. হযরত মুসাব (রা.)-এর অনুকূল মতামত: হিজরতের পূর্বে মদীনায় প্রেরণকৃত সাহাবি মুসাব কর্তৃক ইতিবাচক মনোভাব।
৯. নবিকে হত্যার পরিকল্পনা: কুরাইশ কর্তৃক হযরত রাসুল (সা.)-কে হত্যার পরিকল্পনা।
হযরত মোহাম্মদ (সা.) স্বেচ্ছায় মক্কা ছেড়ে মদীনায় স্থানান্তরিত হননি। যখন তিনি মোহাম্মদী ইসলামের দাওয়াত প্রচার করতে গিয়ে চরম প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হন তখন আল্লাহ্র নির্দেশপ্রাপ্ত হয়ে ইয়াসরিবে (মদীনা) নগরিতে হিজরত করেছিলেন, যা ইতিহাসের অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা।
[লেখক: প্রাক্তন শিক্ষার্থী, পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।]

সম্পর্কিত পোস্ট