Cancel Preloader

মোর্শেদ অবলম্বন অপরিহার্য

মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী, সূফী সম্রাট হযরত
সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান

[সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজান রচিত ‘শান্তি কোন পথে?’ থেকে প্রবন্ধটি সংকলন করা হয়েছে।-সম্পাদক]

আরবি মোর্শেদ শব্দটি ‘রুশদুন’ ধাতু হতে উৎপন্ন হয়েছে, যার অর্থ হচ্ছে পথ। মোর্শেদ শব্দের অর্থ পথপদর্শক। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ বলেন, “ওয়া মাইয়্যুদ্বলিল ফালান তাজিদা লাহূ ওয়ালিইয়্যাম মুরশিদা।” অর্থাৎ- আল্লাহ্ যাকে গোমরাহ করেন, আপনি কখনো তার জন্য কোনো (মোর্শেদ বা) পথপ্রদর্শনকারী অভিভাবক পাবেন না। (সূরা আল কাহ্ফ ১৮: আয়াত ১৭)
নবুয়তের যুগে মানবজাতিকে আদর্শ চরিত্রবানরূপে গড়ে তুলে আল্লাহ্কে পাওয়ার পথপ্রদর্শক ছিলেন নবি ও রাসুলগণ। এমনিভাবে নবুয়তের যুগ শেষ হয়ে যাওয়ার পর মোজাদ্দেদ, যুগের ইমাম ও অলী-আল্লাহ্গণই মোর্শেদরূপে মানুষকে আল্লাহ্কে পাওয়ার পথ দেখিয়ে আসছেন। প্রকৃতপক্ষে প্রত্যেক যুগেই মোর্শেদে কামেলের মাধ্যমে মানুষ খোদাপ্রাপ্তির সন্ধান পেয়ে থাকে। বিষয়টি মহান আল্লাহ্ তাঁর পাক জবানেই বলে দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হচ্ছে- “ওয়া মিম্মান খালাক্বনা উম্মাতুই ইয়াহদূনা বিলহাক্বক্বি ওয়া বিহী ইয়া‘দিলুন।” অর্থাৎ-আর আমি যাদের সৃষ্টি করেছি, তাদের মধ্যে এমন একদল আছে, যারা সত্য পথ দেখায় এবং সেই অনুযায়ী ন্যায়বিচার করে। (সূরা আল আ‘রাফ ৭: আয়াত ১৮১)


অনুরূপভাবে মহিমান্বিত আল্লাহ্ ওহির বাণী আল কুরআনের অন্য আয়াতে এরশাদ করেন- “ইয়া আইয়্যুহাল্লাযীনা আমানূ আত্বী‘উল্লাহা ওয়া আত্বী‘উর রাসূলা ওয়া উলিল আমরি মিনকুম।” অর্থাৎ- হে মু’মিনগণ! তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর, আনুগত্য করো রাসুলের এবং তাঁদের, যাঁরা তোমাদের মধ্যে (আল্লাহর সাথে যোগাযোগ করে) ফয়সালা দিতে পারেন। (সূরা আন নিসা ৪: আয়াত ৫৯)

প্রকৃতপক্ষে নবুয়ত পরবর্তী বেলায়েতের যুগে যুগের ইমাম, মোজাদ্দেদ ও আওলিয়ায়ে কেরামের আত্মায় নুরে হিদায়েত বিদ্যমান থাকায়, তারা হন এত্তেহাদি তাওয়াজ্জোহ শক্তির অধিকারী। ফলে এ সকল মহামানব তাওয়াজ্জোহ এত্তেহাদির দ্বারা মানুষের হায়ওয়ানি তথা পশু প্রবৃত্তির স্বভাবকে দমন করে, আত্মার ঐশী ভাব প্রস্ফুটিত করে দিয়ে মানুষকে সুপথগামী করে তোলেন।
মোর্শেদের ক্বালবের মধ্যে যে ঐশী নুর প্রজ্বলিত অবস্থায় রয়েছে, তা রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.)-এর পবিত্র ক্বালবের ধারা হয়ে এসেছে। এ ঐশ্বরিক নুরই হযরত রাসুল (সা.)-এর সিরাজুম মুনিরের নুর। এ প্রসঙ্গে আমিরুল মু’মিনিন, শেরে খোদা হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “আলেমগণ (আল্লাহ্তত্ত্বের জ্ঞানে জ্ঞানী) পৃথিবীর প্রদীপ এবং আম্বিয়ায়ে কেরামের প্রতিনিধি, কিংবা আলেমগণ আমার উত্তরাধিকারী এবং আম্বিয়ায়ে কেরামেরও উত্তরাধিকারী।” (তাফসীরে মাজহারী ১০ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৭)


এজন্য মোকাম্মেল মোর্শেদ নিজের হৃদয়ে প্রজ্বলিত নুর থেকে নুরের শিখা মুরিদের ক্বালবে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে, তার আত্মার কুরিপুসমূহ দমন করে থাকেন। ফলে উক্ত নুরের জ্যোতিতে মুরিদের অন্ধকার দিল আলোকিত হয়ে যায়। এজন্য আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “যখন ক্বালবে আল্লাহর নুর প্রবেশ করে, তখন ক্বালব খুলে যায় এবং সেটি প্রশস্ত হয়ে যায়।” (তাফসীরে দুররে মানছুর ২৩নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ২১৯)

কোনো ব্যক্তি উপযুক্ত শিক্ষক বা মোর্শেদ ছাড়া একাকী সাধনা করে ক্বালবের এ মহামূলবান নিয়ামত লাভ করতে পারে না। ফলশ্রুতিতে আল্লাহর পরিচয় লাভ করাও তার পক্ষে সম্ভব হয় না। এজন্যই মোর্শেদ অবলম্বন করা অপরিহার্য। শিক্ষক ছাড়া যেমন জাহেরি বিদ্যা সুষ্ঠুভাবে শিক্ষা লাভ করা যায় না, তদ্রুপ পির বা মোর্শেদ ব্যতীত একাকী সাধনা করে মারেফাত বা আল্লাহর সন্ধান লাভ করা সম্ভব নয়। বস্তত মোর্শেদের সাহায্য ব্যতীত প্রকৃত মুসলমান হওয়াই সম্ভব নয়।


পির বা মোর্শেদ সম্পর্কে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণার কারণ
ওহির বাণী আল কুরআনে মোর্শেদকে হিদায়েত লাভের মানদণ্ডরূপে উপস্থাপন করা হয়েছে। অথচ আমাদের সমাজে পির বা মোর্শেদ সম্পর্কে কিছু ভ্রান্ত ধারণা লক্ষ্য করা যায়। ভ্রান্ত ধারণার মূল কারণ হলো- যাদের ধর্মগুরু তথা আলেম হিসেবে মনে করা হয়, তাদের বেশিরভাগই প্রকৃত ইমান ও ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ। তারা বলে- শুধু কুরাআন ও হাদিস আমল করলেই চলে, পির তথা মোর্শেদ গ্রহণের দরকার পড়ে না। অথচ এ সকল আলেম একটিবারও চিন্তা করে দেখে না, ইহুদিদের নিকট তাওরাত কিতাব এবং খ্রিষ্টানদের নিকট ইন্জিল কিতাব থাকার পরেও, তারা সঠিক পথে চলতে ব্যর্থ হয়েছে।


এ প্রসঙ্গে হযরত জিয়াদ ইবনে লবীদ (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, একদা আল্লাহর রাসুল (সা.) একটি বিষয় আলোচনা করছিলেন। অতঃপর তিনি বললেন- “এটি এলেম বিলুপ্ত হওয়ার সময় সংঘটিত হবে। তখন আমি বললাম- হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! এলেম কী করে বিলুপ্ত হবে? অথচ আমরা নিজেরা কুরআন শিক্ষা করছি এবং আমাদের সন্তানদেরও শিক্ষা দিচ্ছি। অতঃপর সন্তানগণ তাদের সন্তানদেরকে শিক্ষা দিতে থাকবে, এভাবে (বংশ পরম্পরায়) কিয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে। তখন আল্লাহর রাসুল (সা.) বললেন- জিয়াদ! তোমার মা তোমাকে হারিয়ে ফেলুক! এতদিন তো আমি তোমাকে মদীনার একজন জ্ঞানী লোক বলেই মনে করতাম। (তুমি কি লক্ষ্য করোনি?) এই ইহুদি ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায় কি তাওরাত ও ইন্জিল কিতাব পড়ছে না? অথচ তারা এ কিতাব অনুযায়ী কিছুই আমল করছে না।” (মুসনাদে আহমদ, সুনানে ইবনে মাজাহ, তিরমিযী ও দায়েমী শরীফের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৩৮)


সুতরাং কুরআন ও হাদিস আমল করলেই চলবে, পির তথা মোর্শেদ গ্রহণ নিষ্প্রয়োজন- এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। এমনিভাবে আমাদের সমাজে কেউ কেউ আবার এ ধারণাও পোষণ করেন, পিতামাতার জীবদ্দশায় পির ধরা জায়েজ নেই। এ ধারণাও সম্পূর্ণ ভুল। মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আল্লামিন বলেন- “আর যদি তোমার পিতামাতা তোমার উপর জোর প্রয়োগ করে যে, তুমি আমার সাথে এমন কিছু শরিক সাব্যস্ত করো, যে সম্বন্ধে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তবে তুমি তাদের কথা মানবে না। তবে দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে বসবাস করবে। আর যে ব্যক্তি আমার অভিমুখী হয়েছে, তাঁর পথ অনুসরণ করবে।” (সূরা লুকমান ৩১: আয়াত ১৫)


প্রকৃতপক্ষে ইমান মানুষের পরম সম্পদ। নবুয়তের যুগে সাহাবায়ে কেরাম ইমান রক্ষার্থে কেবল পিতামাতাকেই নয়, নিজেদের জীবনের মায়া ত্যাগ করেছেন এবং আল্লাহ্ ও রাসুলের প্রেমে নিজেদের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করেছেন।
বেইমান হয়ে মৃত্যুবরণ করার চেয়ে বড়ো আজাব আর কী হতে পারে? পির বা মোর্শেদের নিকট যাওয়ার উদ্দেশ্য হলো- ক্বালবে ইমানের বীজ ধারণ করা এবং সাধনার মাধ্যমে পূর্ণ ইমানের অধিকারী হওয়া। অর্থাৎ নিজের মধ্যে আল্লাহর পরিচয় লাভ করে, তাঁর কাছে পূর্ণ আত্মসমর্পণের মাধ্যমে প্রকৃত মুসলমান হওয়া। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ বলেন- “ফালা তামূতুন্না ইল্লা ওয়া আনতুম মুসলিমূন।” অর্থাৎ- তোমরা মুসলমান তথা আল্লাহ্তে আত্মসমর্পণকারী না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। (সূরা আল বাকারাহ ২: আয়াত ১৩২)


প্রকৃতপক্ষে নবি ও রাসুলগণের যুগ শেষ হওয়ার পর বেলায়েতের যুগে যে ব্যক্তি মোর্শেদ, অর্থাৎ অলী-আল্লাহর সাহচর্যে গিয়ে সাধনার মাধ্যমে ইমানের নুর নিজের ক্বালবে প্রজ্বলিত করতে সক্ষম হয়েছেন, তিনিই প্রকৃত ইমানদার। অশেষ দয়াময় আল্লাহ্ বলেন- “মরুবাসীরা বলে- আমরা ইমান এনেছি। আপনি বলে দিন- তোমরা ইমান তো আনোনি, বরং বলো- আমরা মুসলমান হয়েছি মাত্র। আর ইমান তো এখনো তোমাদের ক্বালবে প্রবেশ করেনি। কাজেই যদি তোমরা আল্লাহ্ ও রাসুলের আনুগত্য করো, তবে তিনি তোমাদের কর্মসমূহ থেকে একটুও কম করবেন না। নিশ্চয় আল্লাহ্ পরম ক্ষমাশীল ও অসীম দয়াময়।” (সূরা আল-হুজুরাত ৪৯: আয়াত ১৪) সেই সাথে মহান আল্লাহ্ ওহির বাণী আল কুরআনের অন্য আয়াতে এরশাদ করেন- “আল্লাহ্ ইসলামের জন্য যার ক্বালবের সুদুরের মোকাম খুলে দিয়েছেন এবং যে তার প্রতিপালক প্রদত্ত নুরেতে রয়েছে, সে কি তার সমান, যে এরূপ নয়?” (সূরা আঝ ঝুমার ৩৯: আয়াত ২২)


এ প্রসঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এ আয়াত তেলাওয়াত করেন- “আফামান শারাহাল্লাহু সাদরাহূ লিল ইসলামি ফাহুওয়া ‘আলা নূরিম মির রাব্বিহী” ফাক্বুলনা ইয়া রাসূলাল্লাহি (সা.) কাইফা ইনশিরাহু সাদরিহী? ক্বালা: ইযা দাখালান নূরুল ক্বালবা ইনশারাহা ওয়ানফাসাহা।” অর্থাৎ- আল্লাহ্ ইসলামের জন্য যার ক্বালবের সুদুরের মোকাম খুলে দিয়েছেন এবং যে তার প্রতিপালক প্রদত্ত নুরেতে রয়েছে, সে কি তার সমান, যে এরূপ নয়? আমরা বললাম- হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! কীভাবে ক্বালবের সুদুরের মোকাম খুলে যায়? জবাবে আল্লাহর রাসুল (সা.) বললেন- যখন ক্বালবে নুর প্রবেশ করে, তখন ক্বালব খুলে যায় এবং সেটি প্রশস্ত হয়ে যায়।” (তাফসীরে দুররে মানছুর ২৩নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ২১৯)


এজন্য ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুসলমানের চরিত্র অর্জনের জন্য হযরত রাসুল (সা.)-এর কাছে শরিয়ত ও মারেফাত শিক্ষা করতে হয়েছে- এটি করতে পিতামাতার অনুমতি নেওয়া আবশ্যক ছিল না। এ যুগেও যদি কেউ চরিত্রে মুসলমান হতে চায়, তাকে নায়েবে রাসুল তথা অলী-আল্লাহ্কে মোর্শেদরূপে গ্রহণ করে, তাঁর কাছে শরিয়ত ও মারেফাতের শুদ্ধ আমল শিখে নিতে হয়। এ বিষয়ে প্রকৃত ইসলামের উপর কায়েম আছেন এমন পিতামাতা নিষেধের পরিবর্তে উৎসাহিত করবেন। আর প্রকৃত ইসলামের উপর কায়েম নেই, এমন পিতামাতার হুকুম না মানলেও কোনো দোষ হবে না। সুতরাং পির বা মোর্শেদ সম্পর্কে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা ভিত্তিহীন এবং পবিত্র কুরআন ও হাদিস বিরোধী।
[লেখক: দেওয়ানবাগ শরীফের প্রতিষ্ঠাতা]

সম্পর্কিত পোস্ট