Cancel Preloader

মোর্শেদ: আল্লাহ্কে দেখার দর্পণ

মুহাম্মদ জহিরুল আলম

জগতের সবকিছু অপেক্ষা আল্লাহ্কে লাভ করা শ্রেষ্ঠ অর্জন। মু’মিন ব্যক্তির ইবাদতের লক্ষ্যই আল্লাহ্কে দেখা। এজন্য এমনভাবে ইবাদত করতে বলা হয় যেন ইবাদতকারী আল্লাহ্কে দেখছেন। আল্লাহ্কে দেখার প্রসঙ্গটির সাথে দুনিয়ার সম্পৃক্ততা চলে আসে অর্থাৎ তা হায়াতে জিন্দেগিতে। কারণ মৃত্যুর পর হাশরের মাঠে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী সকলেই আল্লাহ্কে দেখবে, তখন এর জন্য কোনো ইবাদতের প্রয়োজন হবে না। জন্মের পূর্বে মানুষ যেমন আল্লাহর কাছে ছিল, মৃত্যুর মাধ্যমে সে আল্লাহর কাছেই ফিরে যাবে। কিন্তু দয়াময় আল্লাহ্ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন ইবাদতের মধ্যদিয়ে তাঁর পরিচয় লাভ করার জন্য।

আর তা হবে পৃথিবীতে আল্লাহর দর্শন বা দিদার লাভ করার মাধ্যমে। যে ব্যাক্তি আল্লাহর দর্শন অস্বীকার করে তার ইবাদতসমূহ নিষ্ফল। মহান আল্লাহ্ বলেন, “যারা তাদের প্রতিপালকের অলৌকিক নিদর্শনাবলি অস্বীকার করে এবং (দুনিয়াতে) তাঁর সাক্ষাৎ বা দিদার অস্বীকার করেছে, তাদের যাবতীয় আমল নিষ্ফল হয়েছে। ফলে কিয়ামত দিবসে আমি তাদের জন্য মিজান তথা কোনো পরিমাপই স্থাপন করব না।” (সূরা আল কাহ্ফ-১৮: আয়াত ১০৫)

মানুষ আধ্যাত্মিক সাধনার পরম উৎকর্ষতার এক পর্যায়ে মহান রাব্বুল আলামিনের সাক্ষাত লাভের সৌভাগ্য অর্জন করতে পারেন। দয়াময় আল্লাহ্ মানুষকে তাঁর খলিফা হিসেবে সৃজন করেছেন। তাই প্রতিনিধিত্বের গুণে মানুষ প্রভুকে দেখতে পাবে- তা স্বাভাবিক। মহান আল্লাহ্ বলেন, “আমি তোমাদের (ক্বালবের সপ্তম স্তর) নাফসির মোকামে বিরাজ করি। তবুও কি তোমরা দেখ না?” (সূরা আয যারিয়াত-৫১: আয়াত ২১) কিন্তু একা একা ইবাদত করে আল্লাহর সন্ধান পাওয়া যায় না।

দয়াময় আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে পথও দেখিয়ে দিয়েছেন। দয়াময় আল্লাহ্ বলেন, “তিনিই রাহমান, তাঁর সম্বন্ধে যিনি অবগত আছেন, তাঁকে জিজ্ঞেস করো।” (সূরা আল ফুরকান ২৫: আয়াত ৫৯) নুরে মোহাম্মদীর ধারক এমন একজন অলী-আল্লাহ্কে মোর্শেদ হিসেবে গ্রহণ করে, তাঁর আত্মিক দয়া ও শিক্ষা নিয়ে, নিজের কু-রিপু দমন করে ক্বালবের সপ্তম স্তরে আল্লাহর অস্তিত্ব জাগ্রত করলে আল্লাহর সাথে যোগাযোগ স্থাপন হয়। আপন মোর্শেদের মাধ্যমেই আল্লাহর দর্শন লাভ হয়। মোর্শেদ বিহনে হাজারও চেষ্টা করে কোনো লাভ হবে না।

‘মোর্শেদ’ আরবি শব্দ, যার অর্থ পথ প্রদর্শক। ফারসিতে ‘পির’ বলে। বাংলা ভাষায় তিনি হলেন আধ্যাত্মিক শিক্ষক। আমাদের সমাজে পির শব্দটি প্রচলিত রয়েছে। যিনি সাধনার মাধ্যমে মহান আল্লাহ্ ও হযরত রাসুল (সা.)-এর পরিচয় ও দিদার লাভ করেছেন , যিনি আল্লাহ্ ও রাসুল (সা.)-এর সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম এবং অপরকে আল্লাহ্ ও রাসুল (সা.)-এর সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারেন তাঁকেই মোর্শেদ বলে। বিশিষ্ট ইসলামি গবেষক ইমাম ড. আরসাম কুদরত এ খোদা (মা. আ.) হুজুর বলেন, “মোর্শেদ এমন একজন মহামানব, যিনি মুরিদকে আল্লাহর সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিতে সক্ষম। যিনি মুরিদকে হযরত রাসুল (সা.)-এর সাথেও যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারেন। যিনি মুরিদের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে দিতে পারেন। যিনি মুরিদের হৃদয়ে ইমানের বীজ বপন করে থাকেন। মোর্শেদ এমন একজন মহামানব, যিনি মুরিদের চরিত্রকে সংশোধন করে দেন। যিনি মুরিদের অন্তরের খবর রাখেন। যিনি মুরিদকে নিজের জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসেন। মোর্শেদ এমন একজন মহামানব, মুরিদ যদি লক্ষ মাইল দূরে থেকে বিপদে পড়ে তাঁকে ‘বাবা’ ‘বাবা’ বলে ডাকে, তখন তিনি তাকে উদ্ধার করেন।”

সকল যুগে আল্লাহ্কে পেতে হলে সমকালীন যুগের মানুষকে, মোর্শেদ তথা নবি-রাসুল ও অলী-আল্লাহর কাছে বায়াত গ্রহণ করতে হয়। এটি আল্লাহ্কে পাওয়ার একমাত্র বিধান। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ বলেন, “হে মু’মিনগণ! তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর, আনুগত্য করো রাসুলের এবং তাঁদের, যাঁরা তোমাদের মধ্যে (আল্লাহর সাথে যোগাযোগ করে) ফয়সালা দিতে পারেন।” (সূরা আন নিসা-৪: আয়াত ৫৯)

নবুয়তের যুগে আল্লাহ্কে পাওয়ার পথপ্রদর্শক ছিলেন নবি-রাসুলগণ। নবুয়তের যুগ শেষ হওয়ার পর মোজাদ্দেদ, যুগের ইমাম ও অলী-আল্লাহ্গণই মানুষকে আল্লাহ্কে পাওয়ার পথ দেখিয়ে আসছেন। মোকাম্মেল মোর্শেদ, এত্তেহাদি তাওয়াজ্জোহ্ দ্বারা মানুষের পশু প্রবৃত্তিকে দমন করে আত্মার ঐশী ভাব জাগ্রত করে তোলেন। মোর্শেদ মুরিদের আত্মার পিতা, মোর্শেদ নিজ হৃদয়ের প্রজ্বলিত নুর থেকে নুরের শিখা মুরিদের ক্বালবে প্রবেশ করিয়ে দেন, ফলে ঐ নুরের জ্যোতিতে মুরিদের অন্ধকার দিল অলোকিত হয়ে যায়। বিশিষ্ট ইসলামি গবেষক ইমাম ড. আরসাম কুদরত এ খোদা (মা. আ.) হুজুর এই প্রসঙ্গে ব্যাখ্যা করে বলেন, “এ পর্যায়ে মুরিদ যখন তার পাপের কথা কল্পনা করে, মোরাকাবায় তার আপন মোর্শেদের কদম মোবারক জড়িয়ে μন্দন করতে করতে আশ্রয় ভিক্ষা চায়, তখনই মুরিদ আপন মোর্শেদের ক্বালবের মাধ্যমে দয়াল রাসুল (সা.) এবং দয়াময় আল্লাহর দর্শন লাভ করেন। তাই একমাত্র মোর্শেদই মুরিদের জন্য আল্লাহ্কে দেখার আয়না স্বরূপ।”

দয়াময় আল্লাহ্ একবিংশ শতাব্দীর শিরোভাগে পথহারা মানবজাতির মুক্তির আলোকবর্তিকা হিসেবে এবং তাঁর পরিচয় জগদ্বাসীর নিকট তুলে ধরার জন্য মহান সংস্কারক সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেব্লাজানকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান সর্বপ্রথম ১৯৯০ সালে বিশ্ববাসীর উদ্দেশে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন- “আমি আল্লাহ্কে দেখেছি।” তিনি দৃঢ় কন্ঠে ঘোষণা দেন, “আমি আল্লাহ্কে এমনভাবে চিনি, যেভাবে সন্তান তার পিতাকে চেনে।” আল্লাহ্ সম্পর্কে মানবজাতির ভ্রান্ত বিশ্বাস দূর করে আল্লাহর পরিচয় ও স্বরূপ প্রকাশ করার লক্ষ্যে তিনি ‘তাফসীরে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী’ নামক ৮ খণ্ড তাফসির শরীফ প্রণয়ন করেন, যেখানে তিনি পবিত্র কুরআন ও হাদিসের আলোকে প্রমাণ করেন, “মহান আল্লাহ্ নিরাকার নন, তাঁর নুরের রূপ আছে।” এ মহামানব আরও বলেন, “সমাজে বদ্ধমূল ধারণা প্রচলিত আছে যে, আমার মহান মালিক নিরাকার, তাঁকে দেখা যায় না, তাঁকে নিয়ে চিন্তা করা যাবে না, বরং তাঁর সৃষ্টিকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে। কেউ আল্লাহ্কে নিয়ে চিন্তা করলে ইমান হারিয়ে কাফের হয়ে যাবে। অথচ মহান আল্লাহ্ যখন তাঁর দিদার দিয়ে আমাকে ধন্য করেন, তখন আমি অবলোকন করি যে, তাঁর আকার আছে, তিনি রূপহীন নিরাকার নন, তিনি স্বরূপে বিদ্যমান। এরপরই সিদ্ধান্ত নেই- মহান আল্লাহর প্রকৃত স্বরূপ আমি মানবজাতির নিকট তুলে ধরব। ‘তাফসীরে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী’ ৮ খণ্ডের মাধ্যমে মহাগ্রন্থ আল কুরআন ও মারফু হাদিস দ্বারা আমি প্রমাণ করে দিয়েছি- ‘মহান আল্লাহ্ নিরাকার নন, তাঁর অপরূপ সুন্দর নুরের রূপ আছে’।” সূফী সম্রাটের মূল শিক্ষাই হলো মানুষ যেন মহান স্রষ্টা ও রাহ্মাতুল্লিল আলামিনের প্রকৃত পরিচয় জানতে পারে।

পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ বলেন, “হে রাসুল (সা.)! নিশ্চয় যারা আপনার হাতে হাত দিয়ে বায়াত গ্রহণ করেছে, তারা আল্লাহর হাতে হাত দিয়ে বায়াত গ্রহণ করেছে। আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর।” (সূরা ফাতহ্ ৪৮: আয়াত ১০) অর্থাৎহযরত রাসুল (সা.)-এর হাতে হাত দিয়ে বায়াতের অর্থ হচ্ছে তাঁর প্রতি পূর্ণ আনুগত্যের শপথ করা।

সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেব্লাজান বলেন, “মোর্শেদের নিকট বায়াত গ্রহণ করার পর মোর্শেদ আপন হৃদয়ে অবস্থিত আল্লাহর নুর মুরিদের ক্বালবে প্রবেশ করিয়ে দেন। আর সেখান থেকেই ইমানের জন্ম হয়। এজন্য বীজ বিহনে যেমন ফসলের জন্ম হয় না; তদ্রুপ আল্লাহর নুর ক্বালবে ধারণ না করা পর্যন্ত ইমানদার বা মু’মিন হওয়া যায় না।” তিনি আরো বলেন, “আল্লাহ্ প্রাপ্তির পথে সাধককে মোর্শেদের কাছে বায়াত হওয়ার পর তাঁর নির্দেশিত পথে ‘ফানা’ তথা আল্লাহ্তে বিলীন হওয়ার জন্য তিনটি স্তর অতিক্রম করতে হয়- ১। ফানা ফিশ শায়েখ, ২। ফানা ফির রাসুল ও ৩। ফানা ফিল্লাহ। প্রত্যেকটি ফানার তিনটি হাল বা অবস্থা রয়েছে। যথা- ১। সাধারণ ফানা, ২। আদর্শ ফানা ও ৩। মোকাম্মেল ফানা।” (তাফসীরে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১২৬০-১২৬৪ )

সুফী সম্রাট দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেব্লাজান প্রমাণ করেছেন আমাদের মহান আল্লাহ্ অস্তিত্বহীন নিরাকার নন, তাঁর অপরূপ সুন্দর নুরের আকার রয়েছে। পূর্ণিমার চাঁদে বাবা দেওয়ানবাগীর জীবন্ত প্রতিচ্ছবি তারই পুরষ্কার। ২০০৮ সালের ১০

অক্টোবর শাওয়াল মাসের পূর্ণিমার চাঁদে মহান আল্লাহ্ নিজেকে প্রকাশ করেন। তখন থেকেই প্রতি শাওয়াল মাসের পূর্ণিমার

চাঁদে একজন মহামানবের জ্যোর্তিময় চেহারা মোবারক দেখা যাচ্ছে। সমগ্র বিশ্বের অগণিত মানুষ পূর্ণিমার চাঁদে যে

মহামানবের চেহারা মোবারক দেখছেন, তিনি যুগের ইমাম, নুরে মোহাম্মদীর ধারক সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ

মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (মা .আ.) হুজুর কেব্লাজানের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। দয়াময় আল্লাহ্ যখন যে মহামানবরে হৃদয়ে

অবস্থান করেন, তখন তাঁর রূপেই নিজেকে প্রকাশ করে থাকেন। পূর্ণিমার চাঁদে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগীর জীবন্ত প্রতিচ্ছবি

দেখিয়ে মহান আল্লাহ্ প্রমাণ করে দিলেন, যদি আমাকে পেতে চাও, তবে এই চেহারার অধিকারী মহামানবের কাছে যাও।

তাঁর মাঝেই আমি বিরাজমান। তিনিই মোহাম্মদী ইসলামের মহান মোর্শেদ।

আল্লাহ্কে পাওয়ার পথ প্রেমের। আর এই প্রেম শিক্ষা দিয়ে থাকেন অলী-আল্লাহ্গণ। যিনি আল্লাহ্কে পেয়েছেন, তিনি সমগ্র

সৃষ্টিকে পেয়েছেন; যে আল্লাহ্কে পায়নি, সে সর্বহারা। মোর্শেদ শিক্ষা দেন কী কারণে মানুষ আল্লাহ্ হতে দূরে সরে থাকে।

মোর্শেদের সিঁড়ি বেয়েই আল্লাহর কাছে পৌঁছতে হয়। মোর্শেদের সানিড়বধ্যে গিয়ে মোরাকাবার মাধ্যমে আল্লাহর দিদার লাভ

করা সম্ভব; কারণ কেবলমাত্র আল্লাহর কাছে পৌছেছেন এমন মহামানবই এ পথে সাহায্য করতে পারেন। মোর্শেদকে

ভালোবাসার মাধ্যমে মুরিদের মাঝে হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রেম সৃষ্টি হয়, রাসুলের প্রেমই আল্লাহর প্রেম সৃষ্টি করে। তাই

আল্লাহ্কে পাওয়ার সূচনা মোর্শেদের মাধ্যমেই। সর্বপ্রথম মোর্শেদকে ভালোবেসে, নিজ ক্বালবে মোর্শেদকে স্থায়ী করতে হবে,

অতপর দয়াল দরদি মোর্শেদের ক্বালবই হবে মুরিদের জন্য আল্লাহ্কে দেখার আয়না।

[লেখক: প্রাবন্ধিক পিএইচডি গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]

তথ্যসূত্র:

১। আল কুরআন

২। আল হাদিস

৩। তাফসীরে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী ১ম খণ্ড, সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (মা. আ.)

হুজুর কেব্লাজান, পৃষ্ঠা ১২৬০-১২৬৪

৪। মোর্শেদের দরবারে মুরীদের করণীয়, ইমাম ড. আরসাম কুদরত খোদা (মা. আ.), দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃষ্ঠা ১৩৬

সম্পর্কিত পোস্ট