Cancel Preloader

সম্পাদকীয়


এই বছর ইংরেজি মার্চ মাসের মধ্যে আরবি রজব মাসের ১৬ থেকে ২৯ তারিখ এবং শাবান মাসের ১ থেকে ১৭ তারিখ পড়েছে। আরবি রজব মাসের ২৬ তারিখ (১১ মার্চ, ২০২১ খ্রি. চাঁদ দেখার উপর নির্ভরশীল) দিবাগত রাতে পবিত্র লাইলাতুল মি‘রাজ বা শবে মি‘রাজ এবং আরবি শাবান মাসের ১৪ তারিখ (২৮ মার্চ, ২০২১ খ্রি. চাঁদ দেখার উপর নির্ভরশীল) দিবাগত রাতে পবিত্র শবে বরাত বা বরকতময় রজনি।

মহান রাব্বুল আলামিন তাঁর শ্রেষ্ঠ হাবিব হযরত রাসুল (সা.)-কে ৫২ বছর বয়সে তাঁর একান্ত সান্নিধ্য প্রদানের উদ্দেশ্যে ২৬ রজবের রাতে মি‘রাজের জন্য মসজিদুল হারাম হতে মসজিদুল আকসায় সায়ের বা পরিভ্রমণ করান। সেখানে সকল নবি ও রাসুল রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.)-কে সাদর সম্ভাষণ জানানোর জন্য সারিবদ্ধভাবে দন্ডায়মান ছিলেন। হযরত রাসুল (সা.)-এর শুভাগমনের সাথে সাথে তাঁরা সবাই পরম শ্রদ্ধার সাথে ‘আসসালামু আলাইকা ইয়া আউয়্যালিনা ওয়াল আখিরিনি’ বলে তাঁকে সালাম পেশ করেন। সে সময় প্রত্যেক নবি-রাসুল আনন্দচিত্তে বলছিলেন- ‘মারহাবা ইয়া রাসুলাল্লাহ্! মারহাবা ইয়া হাবিবাল্লাহ্!!’ অতঃপর সাদর সম্ভাষণের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হলে সকল নবি ও রাসুলের উপস্থিতিতে তাঁদের সবাইকে নিয়ে হযরত রাসুল (সা.) ইমাম হয়ে দুই রাকাত সালাতুল ইসরা অর্থাৎ ভ্রমণের নামাজ আদায় করেন। এই নামাজের মাধ্যমেই আল্লাহ্র রাসুল (সা.) সকল নবি-রাসুলের ‘ইমাম’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে ‘ইমামুল মুরসালিন’ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হন। এই প্রসঙ্গে হযরত রাসুল (সা.) ফরমান, ‘‘আমি (নবি) রাসুলগণের ইমাম (নেতা) এটা আমার অহংকার নয়।’’ ( মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৫১৪)


নামাজ শেষে হযরত রাসুল (সা.) সপ্ত আকাশ সায়ের শুরু করেন। তাঁর সাথে ৭ম আকাশ পর্যন্ত কয়েকজন নবি-রাসুলের সাক্ষাৎ হয়। সেসময় তাঁরা প্রত্যেকে পরম আনন্দের সাথে হযরত রাসুল (সা.)-কে আন্তরিক মোবারকবাদ জানান। এভাবে আল্লাহর রাসুল (সা.) সপ্ত আকাশ ভ্রমণ করে সিদরাতুল মুনতাহায় এসে উপনীত হন। এরপর তিনি মহান রাব্বুল আলামিনের সান্নিধ্য লাভের জন্য অগ্রসর হয়ে একাই আরো ৭০ হাজার নুরের পর্দা অতিক্রম করে ‘ক্বাবা কাওসায়েন’-এ উপস্থিত হন। এভাবে হযরত রাসুল (সা.) মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছে যান এবং আল্লাহর সাথে সৃষ্টিজগতের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। আলোচনা শেষে তিনি যে স্থান থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন পুনরায় সেই স্থানেই ফিরে আসেন। এভাবে হযরত রাসুল (সা.)-এর গৌরবদীপ্ত জীবনে পবিত্র মি‘রাজের ঘটনা সংঘটিত হয়। প্রতিবছর বিশ্বের মুসলমানরা গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সাথে লাইলাতুল মি‘রাজ উদযাপন করে থাকেন।


এবার আলোকপাত করা যাক ‘শবে বরাত’ প্রসঙ্গে। মহান রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে সূরা আদ্ দুখানে লাইলাতুম মুবারাকাহ বা শবে বরাতের রজনি সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। মহান আল্লাহ্ বলেন, ‘‘আমার নির্দেশক্রমে বরকতময় রজনি বা শবে বরাতের প্রত্যেক হিকমতপূর্ণ বিষয়ের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।’’ (সূরা আদ্ দুখান ৪৪: আয়াত ৪-৫) শবে বরাতের রাতে লাওহে মাহ্ফুজে সংরক্ষিত কুরআন সপ্তম আকাশ হতে দুনিয়ার আকাশে একত্রে নাজিল করা হয়। এ প্রসঙ্গে হযরত ইকরামা (রা.) বলেন, ‘‘অর্ধ শা‘বান বা শবে বরাতের রজনিতে আল্লাহ্ তায়ালা এ কুরআন সপ্তম আকাশ (লাওহে মাহ্ফুজ) হতে দুনিয়ার নিকটবর্তী আকাশে নাজিল করেন।’’ (তাফসীরে জালালাইন, পৃষ্ঠা ৪১০)
সম্পূর্ণ কুরআন এক সাথে নাজিল হওয়ার কারণে শবে বরাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। এ রাতেই সৃষ্টিজগতের সকল মানুষের ভাগ্যলিপি এক বৎসরের জন্য নির্ধারণ করা হয়। এ বৎসর নতুন করে কারা পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করবে, কারা মৃত্যুবরণ করবে, কাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হবে, আর কারা হবে দুর্ভাগা- এই সবকিছুই শবে বরাতের রাতে নির্ধারিত হয়ে থাকে। এই প্রসঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘‘এক ব্যক্তি মানুষের সাথে চলাফেরা করছে, অথচ তার মৃত্যুর সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে।

অতঃপর হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) আল্লাহর এ বাণী পাঠ করেন- ‘নিশ্চয়ই আমি একে (কুরআন) বরকতময় রাতে নাজিল করেছি, নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক হিকমতপূর্ণ বিষয়ের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।’ অতঃপর বর্ণনাকারী বলেন, ‘পৃথিবীর প্রতিটি বিষয়ের এক বৎসরে সিদ্ধান্ত শবে বরাতের এ রাতেই গ্রহণ করা হয়।’ (তাফসীরে তাবারী, ২৫নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০৯) উল্লেখ্য যে, প্রতি বছর শবে বরাতের রাতটি দেওয়ানবাগ শরীফে যথাযথ মর্যাদায় উদযাপন করা হয়। এ বরকতময় রজনিতে আশেকে রাসুলেরা সারারাত ইবাদত বন্দেগির মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করেন।


এই মার্চ মাসে মুসলিম উম্মাহ পবিত্র শবে মি‘রাজ ও পবিত্র শবে বরাত উদযাপন করবে। এই মার্চ মাসের ২৬ তারিখ বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাত্রিতে পাক হানাদার বাহিনী নিরীহ নিরস্ত্র বাঙ্গালির উপর নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালায়। এই নির্মম ঘটনায় সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান অত্যন্ত ব্যথিত হন। তাই দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য তিনি ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। যুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ১৯ নভেম্বর ঈদুল ফিতরের নামাজের খুৎবায় তিনি মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করেন। মহান আল্লাহর অপার দয়ায় তাঁর পবিত্র মুখ থেকে উৎসারিত এই ভবিষ্যদ্বাণীর ২৭ দিন পর অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে। মহান স্বাধীনতা দিবসে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানসহ সকল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

সম্পর্কিত পোস্ট