Cancel Preloader

সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের সুমহান শিক্ষা ও সংস্কার- ইমাম ড. আরসাম কুদরত এ খোদা

ইমাম ড. আরসাম কুদরত এ খোদা
শেষ পর্ব

৩। সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের প্রস্তাবে ইসলাম শিক্ষায় তাসাউফ অন্তর্ভুক্ত করা: রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.) প্রবর্তিত ইসলামের মৌলিক শিক্ষা হচ্ছে- এলমে তাসাউফ, আল্লাহ্কে জানার বিজ্ঞান, যার মাধ্যমে তিনি বর্বর আরব জাতিকে আদর্শ চরিত্রবানে পরিণত করে পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট জাতির মর্যাদায় উন্নীত করেছিলেন। অপরদিকে মুসলিম সমাজে প্রচলিত ধারণা ছিল, এলমে তাসাউফের সাধনা করে সুফি হবার উদ্দেশ্যে মানুষকে সংসারত্যাগী হতে হবে। সেই ভ্রান্ত ধারণার ফলে সমাজ থেকে এলমে তাসাউফের চর্চা বিলুপ্ত হবার উপক্রম হয়েছিল।

সূফী সম্রাট রাজধানীর বুকে ‘বিশ্ব সুফি সম্মেলন’ ও পরবর্তীতে ‘বিশ্ব আশেকে রাসুল (সা.) সম্মেলন’ আয়োজনের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন- সমাজে অবস্থান করেই মানুষ আওলিয়ায়ে কেরামের নির্দেশানুসারে ধর্ম পালন করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারে। হযরত রাসুল (সা.) মানুষকে সমাজ ও পরিবারে বসবাসরত অবস্থাতে সাধনার মাধ্যমে আত্মিক পরিশুদ্ধতা অর্জন করে মু’মিনে পরিণত হবার শিক্ষা দিয়েছেন। সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান এ সত্যকে উপস্থাপন করে এলমে তাসাউফ ইসলামি শিক্ষা বিষয়ে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে প্রস্তাব দেন এবং তাঁর প্রস্তাবের যৌক্তিকতা উপলব্ধি করে ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলাম শিক্ষায় তাসাউফ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে বিএ (অনার্স) এবং এমএ-তে তাসাউফ অন্তর্ভুক্ত করা হয়।


৪। সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের প্রস্তাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে জমি রেজিস্ট্রি করা হয়

জমির মালিক বান্দা নয়, আল্লাহ্:
পবিত্র কুরআনে বহুবার বর্ণিত হয়েছে- “আসমান ও জমিনের মালিক একমাত্র আল্লাহ্।” অথচ বৃটিশ আমল থেকে প্রচলিত জমি রেজিস্ট্রেশনের পদ্ধতি অনুসারে আমাদের দেশে জমির দলিলে উল্লেখ করা হতো- ‘আমি এ জমির মালিক। আমার মালিকানা স্বত্ব অমুকের কাছে বিক্রি করলাম’। সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান বলেন, “নিজেকে জমির মালিক দাবি করা চরম গর্হিত ও শিরক; যেটি করা কোনো মানুষের উচিত নয়।” তাই তিনি এ ভুল প্রথা পরিবর্তন করার জন্য ইসলামি রীতিতে দলিল লিখন পদ্ধতি উপস্থাপন করেছিলেন এভাবে- “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। পরম করুণাময় আল্লাহ্ তায়ালা আসমান ও জমিনের প্রকৃত মালিক। তাঁর বান্দা হিসেবে আমার জমির দখলিস্বত্ব অমুকের নিকট বিক্রি করলাম।” ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে সমগ্র বাংলাদেশে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের প্রস্তাবিত পদ্ধতিতে জমি রেজিস্ট্রেশন প্রচলন করা হয়।

৫। সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের প্রস্তাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে সাহরি ও ইফতারের সময়সূচি নির্ধারণ:
হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, হযরত রাসুল (সা.) ফরমান- “দ্বিন জয়ী থাকবে ততদিন, যতদিন লোক শীঘ্র শীঘ্র ইফতার করবে, কেননা ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা ইফতার করে বিলম্বে।” (আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ শরীফ) অথচ আমাদের দেশে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত সাহরি ও ইফতারের সময়সূচিতে সূর্যাস্তের ১৪ থেকে ১৮ মিনিট পর ইফতারের সময় নির্ধারণ করা হতো। যুগের ইমাম সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী হুজুর কেবলাজান হাদিস অবমাননাকর এ সময়সূচি পরিবর্তনের জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব উত্থাপন করেন, সেই অনুযায়ী ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বিজ্ঞানভিত্তিক সাহরি ও ইফতারের সময়সূচি প্রবর্তিত হয়েছে।

৬। সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের প্রস্তাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে রবিবারের পরিবর্তে শুক্রবারকে সাপ্তাহিক ছুটি ঘোষণা:
বৃটিশ শাসনামলে প্রবর্তিত রবিবার সাপ্তাহিক ছুটির রেওয়াজ স্বাধীনতা পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশেও পালন করা হতো। যার ফলে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানগণ শুক্রবারের জুমার নামাজ ঠিকমত আদায় করতে পারতেন না। সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান কর্তৃক রবিবারের পরিবর্তে শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন ঘোষণা করার আবেদন ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন সরকার গ্রহণ করেন এবং শুক্রবারকে সাপ্তাহিক ছুটির দিন ঘোষণা করা হয়।

৭। সূফী সম্রাট হুজুর প্রমাণ করলেন কুরআনের আয়াত ৬,৬৬৬টি নয়, বরং কুরআনের আয়াত ৬,২৩৬টি:
মানবজাতির সর্বোত্তম জীবন-বিধান আল কুরআন গবেষণার মাধ্যমে যুগের ইমাম সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান প্রমাণ করেছেন এর আয়াত সংখ্যা ৬,৬৬৬ (ছয় হাজার ছয়শ’ ছেষট্টি)টি নয়, বরং ৬,২৩৬ (ছয় হাজার দুইশ’ ছত্রিশ)টি। তাঁর এ অভিমত সরকার কর্তৃক গৃহীত হয় এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক জানুয়ারি, ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত কুরআন শরীফের সূচিতে পূর্ববর্তী ভুল সংশোধন করে সর্বমোট ৬,২৩৬ (ছয় হাজার দুই শ’ ছত্রিশ)টি আয়াত সংখ্যা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

৮। সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের প্রস্তাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে কাবা ঘর ও রওজা শরীফের ছবি সংবলিত জায়নামাজ বর্জনে সচেতনতা সৃষ্টিকরণ:
বিধর্মীরা মুসলমানদের দুটি পবিত্র স্থান মক্কা ও মদীনা শরীফ অবমাননা করার অসৎ উদ্দেশ্যে চক্রান্ত করে কাবা ও হযরত রাসুল (সা.)-এর রওজা শরীফের ছবি সংবলিত জায়নামাজ তৈরি করে। ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ সরল বিশ্বাসে এরূপ জায়নামাজে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করতেন। অথচ এ দুই স্থানের ছবি পায়ের নিচে রেখে নামাজ পড়া চরম বেয়াদবি। সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান এরকম জায়নামাজ ব্যবহার করা বেয়াদবি ঘোষণা করে। এই প্রসঙ্গে সর্বসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ তাঁর সাথে একমত পোষণ করেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ টেলিভিশনে এ ধরনের জায়নামাজে নামাজ আদায় না করার পরামর্শ দেওয়া হয়। সৌদি আরব-সহ বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশের মুসলমানরাও কাবাঘর ও রওজা শরীফ সংবলিত জায়নামাজ বর্জন করেছেন।

৯। সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের প্রস্তাবে বান্দার নামে নয়, বান্দার পক্ষ থেকে আল্লাহর নামে কোরবানি করার রেওয়াজ প্রচলন:
পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “হে রাসুল (সা.)! আপনি বলুন, নিশ্চয় আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ জগতসমূহের প্রতিপালক একমাত্র আল্লাহর জন্য।” (সূরা আল আন‘আম ৬: আয়াত ১৬২) কিন্তু আমাদের দেশে নিজের নামে, পিতার নামে, এমনিভাবে সাত নামে কোরবানি দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান এ ভ্রান্ত ধারণাটি সংশোধন করে বললেন, “কোরবানি বান্দার নামে নয়, বরং বান্দার পক্ষ থেকে আল্লাহর নামে দিতে হয়।” কেননা হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, হযরত রাসুল (সা.) কোরবানি দেওয়ার সময় এভাবে নিয়ত করতেন- “হে আল্লাহ্! আপনি আমার পক্ষ থেকে, আমার পরিবার-পরিজনের পক্ষ থেকে এবং আমার উম্মতের পক্ষ থেকে কোরবানি কবুল করুন।” তাঁর আহ্বানে মুসলমানগণ পবিত্র কুরআন ও হাদিসের শিক্ষানুসারে আল্লাহর নামে কোরবানি দিয়ে নিজেদেরকে র্শিক করা থেকে বিরত রাখার সুযোগ পেয়েছেন।


১০। সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের প্রস্তাবে আশুরা আল্লাহর অভিষেকের দিন হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে গৃহীত:
পূর্বে আমাদের ধারণা ছিল পবিত্র আশুরা শুধুমাত্র শিয়া সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠান। সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান কুরআন ও হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেছেন- পবিত্র আশুরা দিবসে আল্লাহ্ তায়ালা আরশে সমাসীন হয়েছিলেন, যে কারণে তাঁর অভিষেক উদযাপন উপলক্ষ্যে এদিনে জগতে অবারিত রহমত ও বরকত অবতীর্ণ হয়। ফলশ্রুতিতে, এদিন পৃথিবীতে দু’হাজার নবি ও রাসুলের শুভ জন্মসহ বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। উপরন্তু অসংখ্য নবি ও রাসুল আশুরার বরকতে কঠিন কঠিন বিপদ থেকে পরিত্রাণ লাভ করেছেন। সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের উপস্থাপিত আশুরা দিবসের তাৎপর্য উপলব্ধি করে পরবর্তীতে দিনটি সরকারিভাবে বিশেষ গুরুত্বসহকারে পালন করা হচ্ছে।


১১। সূফী সম্রাটের প্রস্তাবে ১২ রবিউল আউয়ালে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) পালনের সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণ:
১২ রবিউল আউয়াল বিশ্বনবি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শুভ জন্মদিন এবং ১ রবিউল আউয়াল তাঁর ওফাত দিবস হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে ১২ রবিউল আউয়াল দিনটি ফাতেহায়ে দোয়াজ-দাহম ও সিরাতুন্নবি (সা.) হিসেবে সরকারিভাবে পালিত হতো। যুগের ইমাম সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অশেষ বরকতময় শুভ জন্মদিন পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.)-এর গুরুত্ব তুলে ধরে এ দিনটিকে সৃষ্টিকুলের শ্রেষ্ঠ ঈদ ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে ১২ রবিউল আউয়াল ফাতেহায়ে দোয়াজ-দাহম ও সিরাতুন্নবি (সা.)-এর পরিবর্তে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.)-এর সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয় এবং দিনটি পালনে বর্তমানে রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়ে থাকে। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশ অত্যন্ত জাঁকজমকভাবে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) পালন করে থাকে।

১২। মিলাদ শরীফ পাঠ করা বিদআত নয়, বরং অবশ্য কর্তব্য:
পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “নিশ্চয় আল্লাহ্ স্বয়ং ও তাঁর ফেরেশতারা নবির উপরে দরূদ পাঠ করেন, হে মু’মিনগণ! তোমরাও তাঁর উপর দরূদ পড় এবং শ্রদ্ধার সাথে সালাম পেশ করো।” (সূরা আল আহযাব ৩৩: আয়াত ৫৬) একমাত্র মিলাদ মাহ্ফিলে হযরত রাসুল (সা.)-এর শানে দরূদ পাঠ করে সশ্রদ্ধ সালাম পেশ করা হয়। অথচ আমাদের দেশে এক শ্রেণির মানুষ মিলাদকে বিদআত ও হারাম বলে আখ্যায়িত করে, ফলে মিলাদের ব্যাপক প্রচলন বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান পবিত্র কুরআন ও হাদিসের আলোকে প্রমাণ করেছেন- মিলাদ পড়া হারাম নয়, বরং ফরজ। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে আশেকে রাসুলগণ মিলাদ মাহ্ফিলের আয়োজন করে হযরত রাসুল (সা.)-এর সন্তুষ্টি ও দিদার লাভে সক্ষম হচ্ছেন। এছাড়াও মিলাদের মাধ্যমে অসংখ্য মানুষ আল্লাহর রহমতে বিপদ-আপদ ও রোগ-ব্যাধি থেকে উদ্ধার পাচ্ছেন।

১৩। ছবি তোলা হারাম নয়, ছবি তোলা ব্যক্তির সত্যতার প্রমাণ:
পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “আর বনি ইসরাঈলের নবি [শামুয়েল (আ.)] তাদের আরো বললেন, তালুতের বাদশাহির নিদর্শন হলো- তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে সেই তাবুত (তথা সিন্দুক) আসবে, যেটিতে থাকবে তোমাদের জন্য চিত্ত প্রশান্তি, আর তাতে থাকবে মুসা (আ.) ও হারুন (আ.)-এর বংশধরদের পরিত্যক্ত কিছু সামগ্রী, যেটি ফেরেশতারা বয়ে আনবে। অবশ্যই এতে রয়েছে তোমাদের জন্য নিশ্চিত নিদর্শন, যদি তোমরা মু’মিন হও।” (সূরা আল বাকারাহ ২: আয়াত ২৪৮)
ওহির বাণী পবিত্র কুরআনে উল্লিখিত এ তাবুত বা সিন্দুক ছিল শামশাদ কাঠের তৈরি একটি স্বর্ণখচিত সিন্দুক; যার মধ্যে সকল নবি ও রাসুলের ছবি মোবারক সংরক্ষিত ছিল। বর্ণিত আছে, হযরত আদম (আ.) প্রার্থনা করেছিলেন, হে আল্লাহ্! আমার বংশধরদের মধ্যে নবি ও রাসুল হয়ে কারা কারা পৃথিবীর বুকে তশরিফ গ্রহণ করবেন, দয়া করে তাঁদের পরিচয় আমাকে জানার সুযোগ করে দিন। ফলে মহিমান্বিত আল্লাহ্ সকল নবি ও রাসুলের ছবি মোবারক হযরত আদম (আ.)-এর নিকট প্রেরণ করেন। অতঃপর হযরত আদম (আ.) থেকে বংশ পরম্পরায় সকল নবি ও রাসুলের কাছে এ সিন্দুক হস্তান্তরিত হয়। সর্বশেষ রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছেও এ সিন্দুক ছিল। বর্তমান বিজ্ঞান ক্যামেরার সাহায্যে ছবি তোলার যে প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছে, এ আবিষ্কারের বহুকাল পূর্বেই সুমহান আল্লাহ্ নবি ও রাসুলগণের ছবি মোবারক সংরক্ষিত করে তাবুত তথা সিন্দুকের মাধ্যমে আদম (আ.)-এর নিকট প্রেরণ করেন।
পাশাপাশি হাদিস শরীফে আরো বর্ণিত হয়েছে, উম্মুল মু’মিনিন হযরত আয়েশা (রা.) বলেন-“হযরত রাসুল (সা.) বিবাহে আসার পূর্বে, ফেরেশতা জিব্রাঈল একটি রেশমি কাপড়ে আমার ছবি নিয়ে হযরত রাসুল (সা.)-এর কাছে আগমন করেন এবং বলেন, এ আপনার স্ত্রী। কোনো কোনো রেওয়ায়েতে আছে-জিব্রাঈল তাঁর হাতের তালুতে এ ছবি নিয়ে এসেছিলেন।” [তাফসীরে মাআরেফুল কুরআন-৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৬০ (ই.ফা.বা. কর্তৃক অনূদিত); সংক্ষিপ্ত তাফসীরে মাআরেফুল কুরআন, পৃষ্ঠা ৯৩২; তিরমিযী শরীফ- ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২২৬; তিরমিযী শরীফ-৬ষ্ঠ খণ্ড (ই.ফা.বা. কর্তৃক অনূদিত), পৃষ্ঠা ৩৭৮ ও ৩৭৯, হাদিস নং ৩৮৮০ এবং বোখারী ও মুসলিমের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৫৭৩]

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পরম করুণাময় আল্লাহ্ স্বয়ং সকল নবি ও রাসুলের ছবি মোবারক পৃথিবীতে প্রেরণ করলেও, আমাদের সমাজে ছবি তোলা হারাম, নাজায়েজ, এরকম কুরআন ও হাদিস-বিরোধী মতবাদ প্রচলিত ছিল। যুগের ইমাম সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান সমাজের এ ভুল ধারণা সংশোধন করে বলেন- “আল্লাহ্ তায়ালা যেহেতু নবি ও রাসুলগণের ছবি হযরত আদম (আ.)-এর কাছে প্রেরণ করেছেন, সুতরাং ছবি তোলা হারাম হতে পারে না।” অতঃপর তিনি বিষয়টি পবিত্র কুরআন ও হাদিসের অকাট্য দলিল দ্বারা প্রমাণ করেন যে, ইসলামে ছবি তোলা জায়েজ। কেননা এ বিষয়ে পরম করুণাময় আল্লাহ্ কোনো নিষেধাজ্ঞা জারি করেননি। যুগের ইমামের এ বক্তব্য মুসলিম জাতিকে একটি গুরুতর বিতর্ক মীমাংসা করতে সাহায্য করে। দেখা যায়, ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ে ছবি সংবলিত ভোটার তালিকা প্রণয়ন করতে গিয়ে প্রচলিত কুসংস্কার যখন বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তখন নির্বাচন কমিশন থেকে এ বিষয়ে কুরআন ও হাদিসের দলিল চাওয়া হয়। অতঃপর ‘সূফী সম্রাটের যুগান্তকারী অবদান: আল্লাহ্ কোন্ পথে?’ নামক কিতাব নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে প্রেরণ করে ছবি সম্পর্কে ইসলামের বক্তব্য জানিয়ে দেওয়া হয়। সুতরাং যুগের ইমাম সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের সুস্পষ্ট এ দিকনির্দেশনায়, বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে ছবি তোলার বৈধতা স্বীকৃতি লাভ করে এবং এ মর্মে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জুলাই নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা জনাব এস.এম. আসাদুজ্জামান স্বাক্ষরিত ঐ প্রজ্ঞাপনের তৃতীয় ধারায় বলা হয়- “ভোটার তালিকার জন্য ছবি তুলতে ধর্মীয়ভাবে কোনো বাধা-নিষেধ নেই।”

১৪। যে দেশে যে মাতৃভাষা, সেই ভাষায় জুমার খুৎবা দেওয়া উচিত:
নানা পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপটে মুসলমানগণের কর্তব্য ও করণীয় বিষয়ক প্রয়োজনীয় সময়োপযোগী উপদেশ প্রদানের উদ্দেশ্যে, শুক্রবারের জোহর ওয়াক্তের চার রাকাত ফরজ নামাজের পরিবর্তে দু’রাকাত নামাজ ও অবশিষ্ট দু’রাকাতের পরিবর্তে খুৎবার বিধান রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে খুৎবা প্রদান আরবি ভাষায় হওয়ায় মুসল্লিগণ খুৎবার বিষয়বস্তু বুঝতে পারেন না এবং সেই অনুযায়ী আমল করে তা থেকে উপকৃত হতে ব্যর্থ হন। যুগের ইমাম সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান সর্বপ্রথম মাতৃভাষায় খুৎবা প্রদানের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। ফলশ্রুতিতে বহু মসজিদে এখন আরবি ভাষার পাশাপাশি বাংলায় খুৎবা দেওয়া চালু হয়েছে।

১৫। সারা বিশ্বে একই দিনে ঈদ উদযাপন করা সম্ভব:
পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “তোমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে আল্লাহর রজ্জুকে শক্ত করে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।” (সূরা আলে ইমরান ৩: আয়াত ১০৩) হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে- “সকল মুসলমান ভাই ভাই।” অথচ মুসলমানগণ এক আল্লাহর বান্দা ও একই রাসুলের উম্মত হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন দেশে ঈদ, রোজা, কোরবানিসহ বিবিধ ইসলামি অনুষ্ঠান ভিন্ন ভিন্ন তারিখে পালন করে থাকে। চন্দ্র গণনার হেরফেরের কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশের আকাশে চাঁদ দেখা যায়নি- এ অজুহাতে, মক্কা শরীফের সাথে বাংলাদেশের সময়ের ব্যবধান মাত্র তিন ঘণ্টা হওয়া সত্ত্বেও মক্কা শরীফে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের এক দিন অথবা দু’ দিন পর তা বাংলাদেশে পালন করা হয়। যেহেতু সমগ্র পৃথিবীর জন্য চাঁদ একটি, মুসলিম জাতির কেন্দ্রবিন্দু মক্কা শরীফে চাঁদ দেখার সাথে সঙ্গতি রেখে সারা বিশ্বে একই দিনে যাবতীয় অনুষ্ঠানাদি উদ্যাপন সম্ভব। যুগের ইমাম সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান এ সমস্যা সমাধানের জন্য ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে চান্দ্রপঞ্জিকা প্রণয়নের একটি মডেল মুসলিম বিশ্বের সরকার প্রধানগণের নিকট উপস্থাপন করেন। প্রস্তাবটি ইসলামি সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি)-এর সেমিনারে আলোচিত হলে সদস্যভুক্ত ৫০টি দেশের প্রতিনিধি এর ভূয়সী প্রশংসা করেন। অতঃপর ওআইসি তার সদস্যভুক্ত দেশসমূহকে সারা বিশ্বে একই দিনে ঈদ করার প্রস্তাবনা দিয়ে চিঠি প্রেরণ করে। বর্তমানে এ প্রস্তাবটি বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ বিবেচনাধীন রয়েছে।

১৬। হযরত মুহাম্মদ (সা.) প্রবর্তিত ইসলাম হলো মোহাম্মদী ইসলাম:
যুগে যুগে নবি-রাসুলগণ এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর পবিত্র বাণীর ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকে স্বজাতির কাছে যুগোপযোগী যে ধর্মীয় বিধান পেশ করেছেন, তা তৎকালীন নবি ও রাসুলের নামানুসারে অর্থাৎ ইব্রাহিমি ইসলাম, মুসায়ি ইসলাম এবং ঈসায়ি ইসলাম নামে পরিচিতি লাভ করে। একইভাবে বিশ্বনবি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রবর্তিত পুর্ণাঙ্গ জীবন-বিধানের নাম হচ্ছে ‘মোহাম্মদী ইসলাম’, যেটির সাথে পূর্ববর্তী ইসলামি বিধানের কিছু মিল রয়েছে। যেহেতু আমরা হযরত রাসুল (সা.)-এর শিক্ষা অনুসরণ করি, সেহেতু আমাদের ধর্মের নাম হওয়া উচিত মোহাম্মদী ইসলাম। এ প্রসঙ্গে যুগের ইমাম সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী হুজুর কেবলাজান বলেন- “ইসলামের স্বর্ণযুগে মুসলমানগণ ‘উম্মতে মোহাম্মদী’ এবং মুসলমানদের জীবন-বিধান ‘মোহামেডান ল’ হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে উমাইয়া শাসনামলে (৬৬১-৭৫০ খ্রি.) চক্রান্তের মাধ্যমে ইসলাম থেকে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নাম মোবারক বাদ দিয়ে ‘কাণ্ডারিবিহীন ইসলামে’ পরিণত করা হয়েছে।” যুগের ইমাম সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী হুজুর কেবলাজান আরো বলেন- “মাজহাবের ইমামগণের নামানুসারে যদি হানাফি, শাফেয়ি, মালেকি ও হাম্বলি মাজহাব হতে পারে, তরিকার ইমামগণের নামানুসারে যদি কাদেরিয়া, চিশতিয়া, নক্শবন্দিয়া ও মোজাদ্দেদিয়া তরিকা হতে পারে, এমনকি হাদিস সংকলকদের নামানুসারে যদি বোখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, তিরমিযী শরীফ, প্রভৃতি কিতাবের নাম হতে পারে, তবে যিনি আপন সর্বস্ব ত্যাগ করে আমাদের জন্য পূর্ণাঙ্গ ইসলামি জীবন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে গেছেন, তাঁর নামানুসারে এ ইসলামের নাম ‘মোহাম্মদী ইসলাম’ না হওয়ার যৌক্তিকতা কোথায়?” যুগের ইমামের এ শিক্ষা অনুসরণ করে অসংখ্য মানুষ মোহাম্মদী ইসলামের শান্তি বাস্তব জীবনে উপলব্ধি করার সৌভাগ্য অর্জন করছেন।

পরিশেষে বলা যায় যে, সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের সুমহান শিক্ষা ও সংস্কার হযরত রাসুল (সা.)-এর চির শান্তির ধর্ম মোহাম্মদী ইসলামের বাস্তব প্রতিফলন। জগৎশ্রেষ্ঠ এই মহামানবের সুমহান শিক্ষা হৃদয়ে ধারণ করে আলোকিত মানুষ হয়ে জগতকে আলোকিত করা সম্ভব। অন্যদিকে তাঁর সংস্কারগুলো বাস্তবায়েনের ফলে জগদ্বাসী সত্যিকার ইসলামের স্বরূপ উপলব্ধি করতে সক্ষম হচ্ছে। মহান আল্লাহ্ আমাদের সকলকে মোহাম্মদী ইসলামের আদর্শে আদর্শবান হওয়ার তৌফিক এনায়েত করুন। আমিন।
[লেখক: পরিচালক, সমন্বয়ক ও সমস্যার ফয়সালাকারী, দেওয়ানবাগ শরীফ; সহকারী অধ্যাপক, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি]

সম্পর্কিত পোস্ট